লড়ছেন লীলাবতী মাহাতো

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

রুখা সুখা এক জেলা। রাজ্যের বাইশতম এবং অন্যতম এক শুষ্ক, কৃষিজ দিক থেকে প্রায় অনুর্বর এক জেলা। জুন থেকে সেপ্টেম্বরের ভেতর গড়ে ১৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টি, যা সেভাবে কোনও বড়সড় সংরক্ষণের অভাবে ধুয়ে চলে যাচ্ছে অধিকাংশই, কাজে লাগছে না ফসলের, কৃষকের। খরাপ্রবণ ভারতবর্ষের কাছে যে ছবি বড় কষ্টের, অসহায়তার। লীলাবতী মাহাতো সেই গল্পটাকেই বদলে দিয়েছেন।

হাজার পাঁচটা মেয়ের মতো শুরু করা ঝাড়গ্রামের বিনপুর দুনম্বর ব্লকের ধোবাখুরিয়া গ্রামের লীলাবতী ১৬ বছর বয়সে কলেজ শুরুর জীবন ছেড়ে দিয়ে, পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে আসতে বাধ্য হয়। দুটি কন্যাসন্তান জন্মায়। কৃষিশ্রমিকের কাজ করা লীলাবতী স্বামীর সহযোগিতা পেলেও পেলেন না শ্বশুরবাড়ির বাকিদের কাছ থেকে তেমন কিছু আশ্বাস, ভরসা। মেয়েগুলোকে দেখবে কে? টাকা কোথায়? খাবার? আর তখনই স্বনির্ভর গোষ্ঠী বানানোর চিন্তা। গ্রামে তাঁর মতো অন্যান্য মহিলাদের নিয়ে গড়ে তুললেন এমনই বেশ কিছু গোষ্ঠী, পেলেন গোষ্ঠী থেকে ঋণের সুবিধে। এই সময়টাতেই স্বামী টাটানগরে কাজ পেলে কিছুটা সুরাহা বাড়ল। স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকেই ঋণ নিয়ে নিছক সবজি চাষ করতেই তিন বিঘে জমির লিজ নিলেন। চারমাসে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা আয়। পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার ফসল। নিজের জমি না থাকলেও এমন আয় পথ দেখাল, আশা দেখাল গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দাদের ভেতরেও। পুরুষ সদস্যদের থেকেও এল সাহায্য চাওয়ার, পরামর্শ চাওয়ার আহ্বান। লিজ নেওয়া জমিতে চাষের ঘটনাও শুরু হয়ে গেল আকছার। এই সময়েই একশো দিনের কাজে জল সংরক্ষণের মতো প্রয়োজনীয় বিষয়কে ধরতে চাইলেন লীলাবতী।

২০১৪ সালে প্রফেশনাল অ্যাসিস্টেন্স ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন বা প্রদান এনজিও-র সহযোগিতা পেলেন লীলাবতী। জল সংরক্ষণকে কৃষির মধ্যে কাজে লাগিয়ে পরিবেশ বাঁচানোর প্রচেষ্টায় লীলাবতীই যে গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত এবং উপযুক্ত, প্রদান-এর কর্তৃপক্ষের বুঝতে বেশিদিন লাগেনি। কী কী করলেন লীলাবতী? ভারমিকম্পোস্ট ব্যবস্থা এবং অন্যান্য জৈব কৃষির উপর জোর দিলেন, মাটির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর দিকগুলি ভাবলেন, জলের পরিমাণ নির্ণয় করতে সাহায্য নিলেন বিজ্ঞানীদের, এবং সর্বোপরি ভূমির জলের পরিমাণ বাড়ানোর ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু করলেন। কীভাবে বাড়াবেন? পুকুর? কিন্তু পঞ্চায়েত তো বাদ সাধছে। আবার লড়াই। মাসে দুবার করে মিটিং এবং মিটিং-এর পর নিয়ম করে গোপালপুর থেকে সাহু পিউর পঞ্চায়েত অবধি মেয়েদের নিয়ে পদযাত্রা। পরিণতিতে ভয় পেয়ে গেল কর্তৃপক্ষ। কে এই লীলাবতী? সরিয়ে দেওয়ার, মাথা কেটে নেওয়ার হুমকি। আর তখনই বাঘের মতো গর্জে উঠলেন সঙ্গী নারীরা। “মাথা পরের কথা, লীলার শাড়ির আঁচলটুকু একবার ছুঁয়ে দেখুন, তারপর দেখুন আমরা কী করতে পারি।” এতটা জোর আশা করেনি কর্তৃপক্ষ। অবশেষে জয়। আশেপাশের গ্রামের ৫০০ জন মহিলা একত্রিত হয়ে বছর দুয়েকের প্রতিবাদ, সাহস, স্লোগান এবং ধর্নায় পঞ্চায়েতকে বাধ্য করলেন পুকুর খোঁড়ার অর্থ জোগাতে।

বাকিটা ইতিহাস। ৮৫টি গ্রামের মোট ১২৫০টি পরিবারের মেয়েরা, এবং অনেকাংশে পুরুষদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় জল সংরক্ষণের বেশ কিছু উদ্ভাবনী চমক দেখিয়ে চলেছে বিনপুর ব্লক। স্ট্যাগারিং ট্রেঞ্চ, কন্টার বান্ড, ফিল্ট্রেশন পিট, সিপেজ ট্যাঙ্ক— এমনই নানারকম সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রায় হাজারের উপর উদাহরণ তৈরি করলেন লীলাবতীরা। কৃষিতে সেচের সুবিধে কতটা হল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না আর। এছাড়াও জল কম লাগে এমন ফসলের অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা করলেন তাঁরা। সব মিলিয়েই পরিণতি যা ভেবেছিলেন, তার চেয়ে নিঃসন্দেহে বেশিই পেয়েছিলেন লীলাবতী মাহাতো।

লীলাবতী একটা স্কুটার কিনেছেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছেন গ্রামের মেয়েদের নিয়ে। সেখানে সমস্যা এবং আলোর দিক— সবকিছু নিয়েই খোলামেলা কথা বলছেন। ছুটে যাচ্ছেন মাইলের পর মাইল একাই। পাশে তাঁর, তাঁদের পরিশ্রমের বেগুন, টমাটো, তরমুজ, লঙ্কার বিঘের পর বিঘে জমি, জল পেয়ে তরতাজা সেসব সোনার ফসল— কত কত গল্প।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to হীরক সেনগুপ্ত Cancel reply