বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: লৌকিক এবং মৌখিক সাহিত্য যখন উপন্যাসের উপাদান

বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: লৌকিক এবং মৌখিক সাহিত্য যখন উপন্যাসের উপাদান | দেবকুমার সোম

দেবকুমার সোম



কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

পূর্ব প্রসঙ্গ: সংজ্ঞা অনুসন্ধান

মানুষ তার গুহাজীবন থেকেই গল্প–কাহিনির প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এ হল মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আমাদের পূর্বপুরুষদের একটি অংশ শিকারজীবন ছেড়ে যখন কৃষিজীবনে পৌঁছালেন, তখন তাঁরা তাঁদের ফেলে আসা জীবনকে মৌখিক গল্পের আদলেই বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সে-সব মৌখিক গল্প-কাহিনি ক্রমশ মহাকাব্যের বাইরে পাঁচালি-ব্রতকথা, প্রবাদ-প্রবচনে তার অবস্থান পোক্ত করেছে। সেকালে ধর্ম আর সংস্কৃতির মধ্যে তেমন সূক্ষ্ম তফাত না থাকায় আজ লোকজীবনে ধর্মের আঙ্গিকে সেই গল্প-কাহিনির মূল অনুসন্ধান প্রায়শ হয়ে ওঠে নিষ্ফল অনুমান মাত্র।

আদিম সময় থেকে হোমো সেপিয়েন্স-এর গল্প শোনার অভ্যাসে ছেদ পরেনি। তখন শিকারজীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা গল্পের আকারে যেমন উঠে এসেছিল, তেমনই অলৌকিক কিংবা অতিলৌকিক বিষয়ে যে টান, তাও এসেছিল মৌখিক কাহিনির সূত্রে। মানুষ মূলত পরিযায়ী। এক আকাশের নীচে উদ্ভিদের মতো নাতিপুতি নিয়ে শিকড় গেড়ে বাস করতে পারে না। সেটা তার সভ্যতার আদিম লগ্ন থেকেই সুনিশ্চিত হয়ে গেছে। পরিযায়ী মানুষ এক আকাশের নীচ থেকে অন্য আকাশের নীচে গেছে কখনও রাষ্ট্র নামের অদৃশ্য দানবের অত্যাচারে, কখনও আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাকে ভিটেমাটি ছাড়া করেছে। জাতিদাঙ্গা, অর্থনৈতিক আত্মরক্ষা কিংবা লোভের বশবর্তী হয়েও মানুষ তার জন্মভূমি বরাবরের জন্য ছেড়ে চলে যায়। মানুষ উদ্বাস্তু হয় পেটের জন্য। একটু ভালোভাবে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য। ফলে সভ্যতার আদিম সময় থেকে আজ অবধি মুখচলতি গল্পগুলো বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে। গল্পগুলো এক জায়গা থেকে অন্যত্র দলবদ্ধ মানুষের সঙ্গে বয়ে চলে। কখনও তা বেদুইন তাঁবুজীবনের অস্থায়ী দেশজ উপাদানে, কখনও আবার জিপসি ক্যারাভানে। কিংবা আমাদের দেশের কাকমারা সম্প্রদায়ের মধ্যে দিয়ে স্থানিক বিচ্যূতি ঘটিয়ে হয়ে যায় মানুষের যাবতীয় চলাচলের মুখফেরতা ইতিকথা। আমরা গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড’-এ দেখেছি প্রতি বছর পালা করে মাকোন্দো জনপদে আসা জিপসি নেতা মেলকিয়াদেসকে। বুড়ো একা আসেননি। সঙ্গে করে এনেছেন তাঁর দলবল আর দুনিয়ার অন্যপারের নতুন-নতুন কাহিনি।

কিংবা ডমরুধর? ‘পূজার পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যার পর দালানে, যে স্থানে প্রতিমা হইয়াছে, সেই স্থানে গল্পগাছা’র মধ্যে দিয়ে মুখে-মুখে সে রচনা করে চলেছে মৌখিক কাহিনি। যে কাহিনি মকোন্দো জনপদের খাপছাড়া, পাগলাটে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া-র ঊর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত দুঃসাহসী বৈজ্ঞানিক গবেষণার চেয়ে ন্যূন নয়। বরং এক অদৃশ্য সূতোয় দুই মিলে এই সাধারণ শাশ্বত সূত্রকে নির্দেশ করে যে, মানুষের গল্প সকল দেশে একইরকম। এমন সমীকরণে যদি কোনও পাঠকের সন্দেহ হয় তবে সামান্য এই কথাটা বলতে হয়:

“মন্তব্য। ‘‘পিত্তিরক্ষে’’ বলিয়াছেন যে— ‘‘পাঠকদিগের যদি আমার গল্পের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ হয়, তাহা হইলে তাঁহাদিগকে আমার নিকট পাঠাইয়া দিবেন। সে বাঘছাল আমার ঘরে আছে। আমি তাঁহাদিগকে দেখাইব। তাঁহাদের সন্দেহ দূর হইবে।’’”[1]

মহাভারতে যে কাহিনি আমরা শুনি তা এরকম:

নৈমিষারণ্যে কুলপতি শৌনকের আশ্রমে মহর্ষিরা বারো বছরের জন্য যজ্ঞ করছিলেন। একদিন মহর্ষিরা তাঁদের দৈনন্দিন কাজ সেরে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন সেখানে সৌতি উগ্রঃশ্রবা উপস্থিত হন। এবং কথা প্রসঙ্গে কৃষ্ণদ্বৈপায়নের মহাভারত কাহিনি বিধৃত করেন। উগ্রঃশ্রবা ছিলেন সূত লোমহর্ষণের পুত্র। লোমহর্ষণের মা ছিলেন জাতিতে ব্রাহ্মণ। আর তাঁর পিতা ছিলেন ক্ষত্রিয়। সেই সূত্রে তিনি সূতপুত্র। তাঁর পুত্র উগ্রঃশ্রবা সৌতি। সূতপুত্র ছাড়াও সৌতির অন্য আর একটি অর্থ আমরা পাই। অর্থটি হল কথকঠাকুর। সৌতিদের প্রধান কাজ ছিল রাজা কিংবা মুনি-ঋষিদের বংশগৌরব কীর্তন করা। সৃষ্টি-প্রলয়-মন্বন্তরের বিচিত্র কাহিনি শোনানো। অর্থাৎ প্রাচীন ভারতবর্ষে এক শ্রেণির মানুষের জীবিকা ছিল কথকতা। গল্প বলা। নৈমিষারণ্যের আশ্রমবাসীরা তেমনই এক গল্পবলিয়ে কথকের কাছ থেকে সমগ্র মহাভারত শোনেন।

আমরা জানি পাকিস্তানের পেশোয়ারে কিস‌্‌সাখোয়ানি বাজারের কথা। কথিত সেখানে একসময় হাটের মাঝে সারা মুলুক থেকে বিভিন্ন কিস‌্‌সা এসে জড়ো হত। তারপর সেখান থেকেই কিস‌্‌সাগুলো ভাগবাঁটোয়ারা হয়ে মোড় নিত দূরদূরান্তে, ভিন্ন রূপে, বিচিত্র কল্পনায় পাখা মেলে। এমন কিস‌্‌সার কথা আমাদের শুনিয়েছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানগুলো সকালে বাজারফিরতি মানুষের চায়ের সঙ্গে মৌখিক গল্পগুজবের আসর; সেও তো মৌলিক এবং মৌখিক সাহিত্য। সেখানে কান পাতলে আমরা পাই চরিত্রের অভিনব বর্ণনা। কাহিনির মৌলিকতা। এর মধ্যে পাড়াপড়শির কেচ্ছা কাহিনি থেকে বিশ্ব রাজনীতি কিংবা ক্রিকেটের ব্যাকওয়ার্ড শট লেগ আর স্কোয়ার লেগ ফিল্ডিঙের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যও চলে আসে। অর্থাৎ বলার কথা এই যে, মৌখিক কাহিনিগুলো উপন্যাস রচনায় চরিত্র নির্মাণের আকর হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

বাদশাহ শাহরিয়াকে তাঁর স্ত্রী শেহেরেযাদ এক হাজার এক রাত ধরে আরব্য রজনীর গল্প বলেন। যে কাহিনিগুলির অধিকাংশের উৎপত্তি খলিফাদের সময়কালে। শেহেরেযাদের মুখনিঃসৃত সে-সব কাহিনিতে কল্পনার ডালপালা আর যৌনতার অনুপান মিশে রচিত হয়েছে বিরাট আরব ভূখণ্ডের মানুষের জীবনপ্রবাহ।

চিনদেশে কাগজ আবিষ্কারের বহু আগে থেকে মুখে মুখে ছোট্ট রাজকন্যার কাহিনি ছড়িয়ে ছিল। জনপ্রিয় ছিল আরমানিতে গল্প বলিয়ে পেশাদার লোকেদের। আর সেকালে রাজাবাদশার সভা আলোকিত হত না বিদুষকের উপস্থিতি ছাড়া। যাঁদের মূল কাজ ছিল গল্পের মোড়কে রাজার মনোরঞ্জন।

আমাদের বাংলাদেশের রূপকথার গল্পগুলির কথা আর নাই বা উল্লেখ করা হল। আজকের বাঙালি শিশুদের অধিকাংশই শৈশবে ঠাকুরমা কিংবা ঠাকুরদার স্নেহ–ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। তারা এক অর্থে ঠাকুরমার ঝুলি থেকে বের হওয়া গল্প–কাহিনি না শুনতে পাওয়ায় দুর্ভাগা। দুঃসহ তাদের শৈশব।

ছাপাখানা আসার আগে মুখে মুখে গল্প বলায় বৈচিত্র ছিল খুব। প্রতিবার একই গল্পে একজন কথক যেমন নিজের কল্পনায় বহু রং মেশাতেন, তেমন আবার ভিন্ন ভিন্ন কথকের কল্পনায় গল্পের মূল অংশ পাল্টে গিয়ে আজকের লব‌্‌জে বিনির্মিত হত। ছেলেবেলায় এমনই এক বিনির্মিত গল্পের আগাপাশতলা শোনানো যাক।

এক ছিলেন রাজা। আর তাঁর ছিলেন এক রানি। রাজা ছিলেন নিঃসন্তান। বহু যাগযজ্ঞ করেও যখন রাজার কোনও সন্তান হল না, তখন হঠাৎ কোথা থেকে একদিন একজন সন্ন্যাসী এসে একটা ফল দিয়ে রাজাকে বললেন, সেই ফল যেন রানি শুদ্ধ বসনে, শুদ্ধ চিত্তে খান। তাহলেই তিনি সন্তানবতী হবেন। সন্ন্যাসীর নির্দেশ মেনে রানি সেই ফল খেলেন। তার কিছুদিন পরে রাজার একটি ফুটফুটে ছেলে হল। কিন্তু সেই ছেলের গায়ের রং মিশমিশে কালো। ভোরবেলায় ধাইমা রাজবাড়ি থেকে ফিরে তার বোনঝিকে জানল যে রাজার কুচকুচে কালো একটা বাচ্চা হয়েছে। বোনঝির শ্বশুরঘর সেখান থেকে প্রায় পাঁচ ক্রোশ দূর। ধাইমার বোনঝি সেদিন তার শ্বশুরঘর ফিরে গিয়ে জানাল তার মাসি দেখেছে রাজার একটা কাকের মতো কুচকুচে কালো বাচ্চা হয়েছে। ধাইমার বোনঝির ননদিনী থাকে সেখান থেকে আবার পাঁচ ক্রোশ দূরে। সে তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে রাষ্ট্র করল রানিমা একটা কাক প্রসব করেছেন। এভাবেই জন্ম নিল আর এক রূপকথা। কথাসাহিত্যের আড়ালে যে ‘কথা’টা থাকে সেই ‘কথা’ ‘কথার কথা’ নয়। বরং কথাসাহিত্যের গর্ভমুখ। তাকে আজও মর্যাদার সঙ্গে আমাদের লালন করতে হয় মানুষের জীবনস্রোতের অভিমুখ বুঝে নিতে।

কাগজ–কালি আসার ফলে সভ্যতার এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। আজকে যেমন সব ডকুমেন্ট/রেকর্ড/নথিপত্র ডিজিট্যাল হয়ে যাচ্ছে। কাগজ–কালি আসার পরে ঠিক তেমন সবকিছু লিখিত রূপ নিল। এমনকি রানিমার বাচ্চা হওয়ার গল্পটাও আর বিকৃত করা গেল না। কিন্তু গল্প শোনার, বিশেষত গালগপ্পো শোনার নেশা মানুষের চিরন্তন। অভিজ্ঞজনেরা গোপন কথা বলতে গেলে যেমন সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেন দেওয়ালেরও কান আছে। তেমন দুনিয়ায় কানপাতলা লোকের অভাব নেই। আর কেচ্ছা–কাহিনি নিয়ে সমাজে চিরকালই কানপাতা দায়। এই সমস্যা থেকে আমরা তো কোন ছার, স্বয়ং দেবাদিদেব মহেশ্বরও রেহাই পাননি। আসুন আমরা সেই গল্পটা কথাসরিৎসাগর থেকে একবার ঝালিয়ে নিই।

কৈলাসে একদিন মহাদেব শিব তাঁর স্ত্রীর পতিসেবায় তুষ্ট হয়ে বললেন, দেবি, আমি তোমার সেবায় খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। বলো, তুমি আমার কাছ থেকে কী উপহার চাও।

ভোলানাথ স্বামীর প্রেমে গদগদ হয়ে তখন পার্বতী বললেন, তাহলে প্রভু আপনি আমাকে এমন একটা গল্প শোনান, যে গল্প অশ্রুতপূর্ব। জগতে কেউ কোনওদিন এমন গল্প কখনও শোনেনি। সেই গল্প একেবারে অভিনব।

পার্বতীর এমন সামান্য উপহার চাইবার কথা শুনে মহাদেব সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। পার্বতী গল্প শুরুর আগে ঘরের দোরের সামনে নন্দীকে পাহারায় বসিয়ে খিল দিলেন। তার আগে নন্দীকে স্পষ্ট বলে দিলেন যতক্ষণ না তিনি দরজা খুলছেন, ততক্ষণ যেন কেউ ঘরে না আসে।

বন্ধ ঘরে শিব সবেমাত্র গল্পটা শুরু করতে যাবেন, এমন সময় পুষ্পদন্ত কোথা থেকে এসে হাজির। পুষ্পদন্ত শিবের অন্যতম প্রিয় অনুচর। তার ঠিক সেই সময়ই ভোলেবাবার সঙ্গে জরুরি শলাপরামর্শ আছে। নন্দী মা ঠাকরুণের আদেশের কথা শুনিয়ে পুষ্পদন্তকে জানিয়ে দিল তার পক্ষে এখন বাবাকে ডাকা যাবে না। বাবা ভীষণ ব্যস্ত আছেন। অগত্যা কৌতূহলী পুষ্পদন্ত সুক্ষ্ম শরীরে হরপার্বতীর শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়ল। আর আদ্যোপান্ত শিবের মুখনিঃসৃত গল্পটা শুনে নিল।

এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। পুষ্পদন্ত একে কানপাতলা মানুষ। তার ওপর সে তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসে। ফলে সেদিন রাতে পুষ্পদন্ত জমিয়ে শিবের বলা গল্পটা হুবহু তার স্ত্রী জয়াকে শুনিয়ে দিল। এই পর্যন্ত ঘটনায় বিপদের বিশেষ গন্ধ ছিল না। কিন্তু পেটপাতলা জয়া পরদিন সকালে আনন্দে ডগ‌্‌মগ হয়ে গিন্নিমাকে গিয়ে আগের দিন রাতে পুষ্পদন্তের কাছে শোনা গল্পটা বেশ রসিয়ে-রসিয়ে শুনিয়ে দিল।

ব্যস কৈলাসে শুরু হয়ে গেল গৃহবিবাদ। বেচারা ভোলেশঙ্কর বুঝতেই পারলেন না ষড়যন্ত্রটা কার? তিনি ধ্যানে বসলেন। আর মুহূর্তেই বুঝে গেলেন পুষ্পদন্ত আর জয়ার কীর্তি।

পুষ্পদন্ত আর তার স্ত্রীর এমন অপরাধে পার্বতী রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তাদের অভিশাপ দিলেন তারা মানুষদেহ ধারণ করে মর্ত্যে যাবে আর মর্ত্যের মানুষকে এই গল্প শুনিয়ে তাদের পাপমুক্তি ঘটবে। দোষ করেছিল পুষ্পদন্ত আর তার স্ত্রী জয়া। আর তাদের হয়ে ওকালতি করতে গিয়ে পুষ্পদন্তের বন্ধু মাল্যবানের কপালেও মর্ত্যে মানুষ হয়ে জন্মানোর আভিশাপ জুটল।

গল্প আমরা শুনতে চাই। কিন্তু সবকিছুর মতো গল্পেরও সীমাবদ্ধতা আছে। একটা পরিধির পরে গল্পটা আর গল্প থাকে না। সেটা গালগপ্পো হয়ে যায়। আমাদের পারিবারিক জীবনে এমন কিছু চরিত্র থেকেই যায়, যারা গালগপ্পে ওস্তাদ। কিন্তু সাহিত্যে তো সে জিনিস খাটে না।

এর আগের পর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি বাংলা উপন্যাসের চলতি যে কাঠামো, তার ভিত্তি মূলত বিলেতি। তার ওপর পরবর্তীকালে পোচ পড়েছে ফরাসি, জার্মান আর রাশিয়ান উপন্যাসের। ইউরোপ থেকে ধার করা আমাদের উপন্যাস লেখার বয়স মোটামুটি একশো সত্তর বছর। এই প্রায় পৌনে দুশো বছরের সাহিত্যের ইতিহাস অখণ্ড বঙ্গভূমির সমগ্র সাহিত্যের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। আমরা এই কালপর্বে উপন্যাসের মূল কাঠামো অক্ষত রেখে কখনও গল্প বলেছি (যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত)। গল্পের আদল অক্ষত রেখে চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে কাহিনির বিস্তার ঘটিয়েছি (রবীন্দ্রনাথের গোরা)। কখনও আঞ্চলিক বা স্থানিক অবস্থান মুখ্য হয়ে উঠেছে আমাদের আখ্যানে (তারাশঙ্করের গণদেবতা)। প্রকৃতি আর মানুষের সহাবস্থানের ছবি এঁকেছি কথাসাহিত্যে (বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী)। অন্ত্যজশ্রেণির মানুষের ব্যথা-বেদনাকে বুঝতে চেয়েছি বস্তুবাদী উপাখ্যানে (মানিকের পদ্মানদীর মাঝি)। আবার রাজনৈতিক উপন্যাস রচনায় বহুস্বরকে স্বীকৃতি দিয়েছি (সতীনাথের জাগরী)। এই তালিকায় আমরা যোগ করতে চাই সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লালসালু। যোগ করতে পারি জগদীশ গুপ্তের অসাধু সিদ্ধার্থ। জীবনানন্দের মাল্যবান। কমলকুমারের সুহাসিনীর পমেটম। মালোপাড়ার কাহিনি নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম। এই তালিকা আরও দীর্ঘ হয়। আরও বিস্তার পায় ১৯৫০-এর দশকে এসে। সে–এক বিস্ফোরণ বটে। এই সামান্য সময়ে বাংলা উপন্যাসে এতজন প্রতিভাশালী নায়কের আবির্ভাব ঘটেছে যে বাংলা উপন্যাস আজ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশিষ্টতার দাবি করতেই পারে। এতৎসত্ত্বেও বাংলা উপন্যাসের দেশজ আখ্যানতত্ত্বের কোনও স্বীকৃত ম্যানিফেস্টো আজও লিখে ওঠা গেল না। আমরা স্বকৃত, সর্বমান্য কোনও ন্যারেটোলজি আজও খাড়া করতে পারিনি আমাদের উপন্যাস রচনায়। বরং ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক কিংবা আলোচক আমরা প্রত্যেকেই জাঁক করে আমাদের উপন্যাসের রীতি-প্রকরণগুলিকে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছি পশ্চিম ইউরোপের রোমান্টিক উপন্যাসের আদলে। কিংবা রাশিয়ার বাস্তববাদী উপন্যাসের মান্য উপাদানগুলোর সাযুজ্যে মার্কসবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি বাখতিনের বহুস্বরের আদলে। দেরিদা বা ফুকোর বিনির্মাণ তত্ত্বের সূচকের মাপজোকে। অথবা হিস্পানিয়া বা আফ্রিকার উত্তর-ঔপনিবেশিক সংজ্ঞায়। অর্থাৎ আজ আমাদের স্বীকার করতেই হবে গত প্রায় পৌনে দুশো বছরে আমাদের উপন্যাসের নিজস্ব কাঠামো তৈরিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। যে ঝোঁকটা দেখা গেছে হিস্পানিয়ান সাহিত্যে। যেমনটা আমরা দেখেছি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান বা উত্তর ঔপনিবেশিক আফ্রিকান দেশগুলোর উপন্যাস রচনায়। আর আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিকে এশীয় অঞ্চলে নির্দিষ্ট করতে চাই, তবে দেখতে পাব ম্যান্ডারিন ভাষার উপন্যাসে ইউরোপীয় ঘরানার কোনও চল‌্‌ নেই। সেখানে পশ্চিম ইউরোপ কিংবা আমেরিকার ইয়াঙ্কি সাহিত্যের জল অচল। মার্কিন কথাকার পার্ল এস বাক‌্‌ তাঁর দ্য গুড আর্থ উপন্যাসটিতে পশ্চিম দুনিয়ার পাঠকের সামনে চিনদেশের সমাজজীবনকে তাদের জীবনবোধের জায়গা থেকে নির্মাণ করে একই সঙ্গে পুলিৎজ়ার আর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়ায় এই সমীকরণ স্পষ্ট হয় যে, চিন, ইজিপ্ট কিংবা ভারতের মতো পুরনো সভ্যতার দেশগুলিতে নভেলের নিজেস্ব আঙ্গিক বর্তমান। এবং তা যথেষ্ট চমকপ্রদ। আরব দেশগুলিতে আজও উপন্যাস রচনায় আরব্য রজনীর কাহিনিগুলি কিংবা বিবিধ কিস‌্‌সা যে তামাদি হয়ে যায়নি, তার উদাহরণ খালেদ হুসেইনের কাইট রানার, ওরহান পামুকের মাই নেম ইজ রেড উপন্যাস। অথচ, এখনও বহু বাঙালি ঔপন্যাসিক মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন উপন্যাসের শুরুতেই থাকতে হবে চমক। যেমন বিদেশের বহু বিখ্যাত উপন্যাসে দেখা যায়। তাঁরা অন্তর থেকেই বিশ্বাস করেন এ টেল অফ টু সিটিজ়, দ্য ট্রায়াল, দ্য আউটসাইডার কিংবা ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড-এর সাফল্যের মূলে আছে প্রথম লাইনের চমক। এর বিপরীতে আমরা উদাহরণ দিতে পারি ভুবনজয়ী বহু উপন্যাসের, যাদের শুরুটা সত্যিই খুব ম্যাড়ম্যাড়ে।

মৌখিক সাহিত্য থেকে লিখিত সাহিত্যে পৌঁছাতে গেলে আমাদের একটা দেওয়াল টপকাতে হয়। সেই দেওয়ালটা হল কীভাবে মুখের ভাষা সরাসরি লেখার ভাষা হয়ে উঠবে? কথক যখন কোনও গল্প বলে, তখন সে তার কথা এমনভাবে সাজিয়ে নেয় যে, সেটা একটা বিশিষ্ট বাকবিন্যাস হয়ে ওঠে। তো, তা, এমন মুখচলতি অব্যয়ের যেমন দেদার ব্যবহার হয়, ঠিক তেমন আবার কথক অনেক সময় নির্বাক থেকে, সামান্য চোখের ভাষা বা শরীরী ভাষা ব্যবহার করে পরিস্থিতিকে বাঙ্ময় করে তোলে। তার সঙ্গে থাকে যে পরিবেশে গল্পপাঠ হচ্ছে তার পরিপার্শ্ব। শ্রোতাদের জাতি, বর্ণ, বয়স, পেশা, রুচি ইত্যাদি নানান কিছু। এই প্রসঙ্গে জঁ পল সার্ত্র আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে মুখের কথায় আমরা আমাদের মনোভাব মাত্র তেরো শতাংশ শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিতে পারি। শোনা কথা, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর কোনও লেখা শেষ করে সেটা উচ্চকণ্ঠে পাঠ করতেন, যাতে কানের ব্যবহারে তিনি বুঝতে পারেন তাঁর লেখা কতটা মুখের ভাষার আদল পেল। এই যে পাঁচিল, এ দুর্লঙ্ঘ সত্যি। তাই মৌখিক সাহিত্যকে লিখিত সাহিত্যে আনতে প্রয়োজন সংশোধন। গ্রহণ–বর্জনের সূক্ষ্ম হিসাব। তার সঙ্গে থাকে স্থানিকতার মাপজোক।

আবার মৌখিক সাহিত্য আর লৌকিক সাহিত্যের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম চক‌্‌খড়ির দাগ রয়েছে। তা এমন অস্পষ্ট বহু সময় স্বয়ং রচনাকারের ঠাহর হয় না। লৌকিক সাহিত্য হল পুরাণকথা, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তি এইসব। তুলনায় মৌখিক সাহিত্য বয়সে বেশ কাঁচা শুধু নয়, তার স্থিরতা ক্ষণস্থায়ী। জনমানসে তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ তার জন্ম হয় সাময়িক সময়ের প্রয়োজনে। যেমন দীর্ঘ ট্রেনভ্রমণে কোনও সহযাত্রীর কাছ থেকে শোনা কোনও মৌখিক কাহিনি। সেই কাহিনির রেশ গন্তব্যে পৌঁছে গেলে ফিকে হয়ে যায়। তারপর মিলিয়ে যায়। এমন কাহিনির জন্ম কেবল ট্রেনের সহযাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য। ট্রেন থেকে নেমে গেলে তার প্রয়োজনও ফুরায়। তবে কিছু মৌখিক গল্প বা কাহিনি লোকপরম্পরায় টিঁকে যায়। কীভাবে টিঁকে যায় সে এক আশ্চর্য রসায়ন। তখন সে মৌখিক সাহিত্যের ঘেরাটোপ ভেঙে উন্নীত হয় লৌকিক সাহিত্যে। এভাবে যে কাহিনিগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক হয়ে যায়, তাই হয় পুরাণকথা। লোকশ্রুতি। কিংবদন্তি। এভাবেই মৌখিক সাহিত্য থেকে কোনও স্থানের নাম হয়। কিংবা তৈরি হয় বাগধারা। কথাপ্রসঙ্গে আমরা হাসান আজিজুল হকের লেখকের উপনিবেশ নিবন্ধের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু এখানে একবার স্মরণ করতে পারি।

“লেখকমাত্রেরই নিজের নিজের উপনিবেশ আছে— সেখানকার ভাষা আলাদা, ঘরবাড়ি মানুষজনের চেহারা, চলাফেরা সবই আলাদা। তারাশঙ্করের সাহিত্যের জনপদ, ঘরগেরস্থি, মানুষজন, দালান-কোঠা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে অনেক দূরে। পৃথিবীর সাহিত্যের বড় শিল্পীদের প্রত্যেকের নিজের তৈরি ভুবন আছে— সাহিত্য পাঠকের এটাই বোধহয় প্রথম অভিজ্ঞতা।… লেখকদের যে স্রষ্টা বলা হয় সেটা একমাত্র এইভাবেই বোঝা যায় যে, এই পৃথিবীতে বাস করেও কী-এক অদ্ভুত দায়ে তিনি আরো একটি দুনিয়া বানিয়ে ফেলেন।”[2]

হাসান আজিজুল হকের এই মন্তব্য তাঁর অভিজ্ঞতানির্ভর। যা কোনও সবল সাহিত্যিকের পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আমরা আমাদের প্রাত্যহিক বেঁচে থাকায় এমন বহু মৌখিক গল্পের মুখোমুখি হই, যা আমাদের জীবনবোধকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। কিংবা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় আমাদের সমগ্র অস্তিত্বকে। মৌখিক কাহিনি কীভাবে কোনও এক মহান নভেলের শরীর-অংশ হয়ে ওঠে তার সাক্ষাৎ নমুনা হরিহর রায়ের পূর্বপুরুষ বিষ্ণুরাম রায়ের পুত্র বীরু রায়ের কাহিনি। কথিত জমিদার বীরু রায় দিনের বেলায় তাঁর জমিদারি সামলাতেন। আর রাতের বেলায় ‘নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের উত্তরে যে কাঁচা সড়ক ওদিকে চুয়াডাঙা হইতে আসিয়া নবাবগঞ্জ হইয়া টাকী চলিয়া গিয়াছে, ওই সড়কের ধারে দিগন্তবিস্তৃত বিশাল সোনাডাঙ্গার মাঠের মধ্যে, ঠাকুরঝি পুকুর নামক সেকালকার এক বড় পুকুরের ধারে’ তাঁর ঠ্যাঙাড়ে বাহিনি নিয়ে লুকিয়ে থাকতেন। তখন দেশে ঠ্যাঙাড়েদের রাজত্ব। ঠ্যাঙাড়ে বাহিনির কারণে ঠাকুরঝি পুকুরের খুব দুর্নাম ছিল সেকালে। একদিন সেখানেই এক গরীব ব্রাহ্মণকে সপুত্র খুন করে সব লুটে নিয়েছিলেন জমিদার বীরু রায়। সেই ঘটনার ঠিক এক বছর পরে বাংলার ১২০৮ সালে পুজোর সময় বীরু রায় সপরিবারে তাঁর শ্বশুরবাড়ি হলুদবেড়ে থেকে ফিরছিলেন। সেই সময় এক সন্ধের মুখে তাঁর নৌকা যখন ইছামতীর বড় চরে বেঁধে মাঝিরা জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন কুমির এসে টেনে নিয়ে যায় ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের একমাত্র পুত্রকে। এই কাহিনি মৌখিক। কিন্তু বিভূতিভূষণের কলমের জাদুকরি ভাষায় তা চিরকালের জন্যে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে গেল। অথরের লেখনীতে এই কাহিনির সমাপন ঘটে নিম্নরূপে:

“যেন এক অদৃশ্য বিচারক এ বৎসর ইছামতীর নির্জন চরে তাহার বিচার নিষ্পন্ন করিলেন। মূর্খ বীরু রায় ঠেকিয়া শিখিলেন যে সে অদৃশ্য ধর্মাধিকরণের দণ্ডকে ঠাকুরঝি পুকুরের শ্যামাঘাসের দামে প্রতারিত করিতে পারে না, অন্ধকারেও তাহা আপন পথ চিনিয়া লয়।”[3]

আমাদের গ্রামদেশে যেমন, নগরজীবনেও তেমন পরতে-পরতে রয়েছে বহু মৌখিক কাহিনি। গল্প। গ্রামদেশের মুসলমান জীবনের অন্দরমহলে মুখে-মুখে ছড়িয়ে থাকা কিস‌্‌সাকে উপন্যাসভুক্ত করেছেন পশ্চিমবাংলায় সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আবুল বাশার কিংবা আফসার আমেদ। বর্তমান বাংলাদেশের বহু মান্য কথাকার। এঁরা সকলেই তাঁদের গদ্যভাষা তৈরি করে নিয়েছেন মৌখিক গল্পগুলো থেকে। একইভাবে নাগরিক জীবনের মৌখিক গল্পকে আমাদের সামনে তুলে ধরে অন্ত্যজশ্রেণির ফ্যাতাড়ু চরিত্রগুলি। নবারুণও হাসান আজিজুল বর্ণিত তাঁর নিজস্ব ‘ময়না দ্বীপ’-এ তাঁর পাঠকদের পৌঁছে দিয়েছেন মৌখিক আর লৌকিক গল্পের মিলমিশে।

মুখে–মুখে রটে যাওয়া কোনও ঘটনার আকস্মিকতার মধ্যে দিয়েই হয়তো জন্ম নেয় মৌখিক গল্প। তারপর সে-সব গল্প ডালপালা মেলে চাড়িয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। জনমানসে তার ছাপ হয় পাকা। লিখিত সাহিত্যের চেয়ে মৌখিক সাহিত্যের এই হল চমৎকারিত্ব। মুখচলতি গল্পগুলি শুধু বেঁচে থাকে বললে ভুল হবে, লিখিত সাহিত্যের যখন মরণাপন্ন অবস্থা হয়, তখন তাকে জল দিয়ে বাঁচিয়ে দেয় মৌখিক সাহিত্য। তবে বিষয়টা তেমন একতরফা কি? নিশ্চিত নয়। অনেক সময় লিখিত সাহিত্যের নির্যাস থেকেও তো তৈরি হয় মৌখিক কাহিনি। বিশিষ্ট কথাকারেরা যেমন বহু মৌখিক আখ্যানকে লিখিত আকার দিয়ে বাংলা সাহিত্যে স্থায়িত্ব দিয়েছেন, তেমন আমাদের স্কুলজীবনে প্রিয় মাস্টারমশাইদের কাছে শোনা লিখিত সাহিত্য আমাদের মুখে মুখে ঘুরে মৌখিক হয়ে গেছে। আমরা পরবর্তীকালে সে-সব গল্পের লিখিতরূপের হদিশ করার সাহস করিনি এই ভয়ে যদি পাঠপ্রতিক্রিয়া বিরূপ হয়!

ফলে মৌখিক গল্পকে লিখিত উপন্যাসে এনে তাকে হাত–পা বেঁধে জলে ডোবানোর আয়োজন যেন না হয়। বরং আমাদের বাংলা উপন্যাসে সেই কাহিনি ছড়িয়ে যাক। চলতিফিরতি জীবন্ত মানুষের মতো মৌখিক গল্পও যে জীবন্ত, তা আমরা যেন ভুলে না যাই। আমাদের শানিত বৌদ্ধিক বিচার দিয়ে তা হয়ে উঠুক উপন্যাসের আদল। অর্থাৎ আমাদের বাংলা উপন্যাসেও মৌখিক সাহিত্যের জীয়নকাঠির ছোঁয়া লাগুক। তার মধ্যে প্রাণের স্পর্শ হোক। একই গল্প বিভিন্ন রূপ আর রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে বারবার হয়ে উঠুক আমাদের সাহিত্যকীর্তির অনন্য নির্মিতি। তেমনই এক সাম্প্রতিক বাংলা উপন্যাসকে আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে রেখে বঙ্গীয় উপন্যাসের ভিতরমহলের কিছু সম্পদের হদিশ নেওয়া যাক।

দাস্তানগোই হল বারোশো শতকে উর্দু মৌখিক গল্প বলার এক ধারা। যাকে সহজ ইংরাজিতে বলা যায়, ‘to tell a tale’। গল্পের এই মেজাজ খানিক মিশ্র। ভারতীয় পুরাণকথার কথক ঠাকুরদের বাকভঙ্গির সঙ্গে মিশে গেছে নাইল নদের অববাহিকা অঞ্চলের গল্পগাছা। সেই গল্পগাছা আবার মোটেও স্থানিক নয়। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস‌্‌ নদীর ধারবরাবর সে মুখচলতি গল্প হাঁটতে হাঁটতে পার হয়েছে কারবালার প্রান্তর, বোগদাদ বন্দর কিংবা তেহেরানের বাজার। আর এইভাবে সে সুলতানি আক্রমণের মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়েছে খোদ হিন্দুস্তানে। অভিষেক সরকার প্রণীত দাস্তানগোই এমনই এক উপন্যাস, যেখানে গল্প বলা হয়েছে সেই বারোশো শতকের উর্দু মৌখিক গল্পের আদলে। অথর এই নভেলে একটি জীবনপ্রবাহ খণ্ডে–খণ্ডে সাজিয়ে আমাদের শুনিয়েছেন। তাঁর এই নির্মাণ সম্পূর্ণত দেশীয়। খণ্ডগুলোর নামে কখনও ‘দস্তান-এ-দিল্লি’, কখনও আবার ‘দস্তান-এ-কিতাব’ কিংবা ‘দস্তানে-এ-দস্তান’। এই কাহিনিতে একজন কথক রয়েছেন, যিনি এই খণ্ডিত দস্তানগুলির বুননের মধ্যে দিয়ে আমাদের শুনিয়ে চলেন সমগ্র আখ্যানটি। এইভাবে অভিষেক আমাদের শুনিয়েছেন ১৯৮০ দশকের স্বর্ণমন্দিরে রাষ্ট্রীয় আক্রমণ। দিল্লির শিখ গণহত্যা থেকে কলকাতা ছুঁয়ে একুশ শতকের আলিগড়ের কাহিনি। আর এরই মধ্যে এসেছে বাবরি বিতর্ক। সংখ্যালঘু আর ধর্মীয় ইস্যুতে সিপিএম-এর ভণ্ডামি। এমনতর চেনাজানা আলোচনা আর প্রশ্নবাণ। যেমন এই উপন্যাসের এক মুখ্য চরিত্র নীলেশ ত্রিপাঠির সংলাপের মধ্যে দিয়ে দাস্তান ঢুকে পরে বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে।

“দুনিয়ার বেশিরভাগ লোক ধর্মে বিশ্বাসী, সম্প্রদায়ে বিশ্বাসী, মানুষ পরিচিতি চায় রেহান। একটা আইডেন্টিটি। সেই ইচ্ছাটার ওপর ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিয়েছে সোভিয়েত, আর চিন। পৃথিবীতে খাঁটি প্রোগ্রেসিভ বলে কিছু হয় না, কখনও ছিল না। আমেরিকা বেশ করেছে বলছি না, কিন্তু দ্বিমেরু পৃথিবীটা এর চেয়ে ভালো ছিল মানতে পারলাম না। বক্সিং–রিং থেকে ছিটকে গেল একজন, তুমি আমি তো গ্যালারিতে ছিলাম বস।”[4]

ফলে অথর এখানে দস্তানের মতো মৌখিক সাহিত্যের রীতি-প্রকরণকে নিয়ে এলেন লিখিত সাহিত্যে। উপন্যাসে উঠে এল বহুস্বর। তবে সেই বহুস্বরের নান্দনিকতা জাগরী কিংবা চার অধ্যায় থেকে পৃথক। পৃথক তার গল্পের বুনন। একরৈখিক এক কাহিনিকে এভাবে যখন কথকতায় ভেঙে নেওয়া যায়, তখন কথক নিজেও হয়ে পড়েন কাহিনির অন্যতম চরিত্র। কিংবা প্রধান চরিত্র। যেমন আমারা দেখি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বিরচিত মহাভারতের মূল আখ্যানে রচয়িতা স্বয়ং বেদব্যাসের প্রবল উপস্থিতি।

বাংলা উপন্যাসের বিকল্পধারার লেখকদের কাছে তাই আজ লৌকিক আর মৌখিক দুই গল্পেরই দারুণ প্রয়োজন। তবে গল্পের ছালচামড়া তুলে ফেলে তাকে বীভৎসভাবে পরিবেশনের কোনও কারণ নেই। গল্পের যে স্পিরিট, যে আবেদন, তাকেই অক্ষত রেখে বয়ান নির্মাণ করতে হবে। সেটাই হবে বাংলা উপন্যাসের নন্দনতত্ত্বের এক বিশেষ রূপ। বিশেষ ধর্ম। কারণ আমাদের দেশের মতো পুরনো আর জটিল এক সমাজে গল্পের ভাঁড়ার কিছু কম নয়। এমনকি গালগপ্পেরও।

[ক্রমশ]

[1] ডমরু-চরিত। ত্রৈলোক্যনাথের গ্রন্থাবলী। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা ১৯৯। বসুমতী কর্পোরেশন লিমিটেড। কলকাতা। দ্বিতীয় সংস্করণ হইতে মুদ্রিত।

[2] লেখকের উপনিবেশ। হাসান আজিজুল হক। গল্প সমগ্র। প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা ৯। নয়া উদ্যোগ। কলকাতা। জানুয়ারি, ২০০৪।

[3] পথের পাঁচালী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভূতি রচনাবলী। প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা ১০। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ। কলকাতা। নবম মুদ্রণ। পৌষ ১৪০২।

[4] দাস্তানগোই। অভিষেক সরকার। তৃতীয় পরিসর প্রকাশনা। কলকাতা। ISBN 978-80489-50-1.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4655 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. খুবই আকর্ষনীয় গল্পের ছলে কথা বলা। প্রতিটি পর্ব পাঠের পর অনিবার্যভাবে যে কথাটি নিজের মনে জন্ম নিচ্ছে তা হল, ‘তারপর?’ অপেক্ষা করব।

  2. চমৎকার লেখা।
    তবে পাঠকের প্রস্তুতি প্রয়োজন।
    হীরক সেনগুপ্ত

Leave a Reply to শৈলেন সরকার Cancel reply