বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: উপন্যাসে মহাকাব্যের ব্যবহার

বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: উপন্যাসে মহাকাব্যের ব্যবহার | দেবকুমার সোম

দেবকুমার সোম

 



কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

পূর্বপ্রসঙ্গ: লৌকিক ও মৌখিক সাহিত্য…

Studying other geners is analogous to studying dead languages; studying the novel, on the other hand, is like studying languages that are not only alive, but still young.[1]

সাহিত্যের বিচারে আমরা উপন্যাসকে সর্বাগ্রে রাখতে চাই তার অন্যতম কারণ ওপরে উদ্ধৃত মিখাইল বাখতিনের মন্তব্য। কিন্তু উপন্যাস সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে নবীন বলেই আলোচ্য, এমন সরল সমীকরণে আমাদের অন্তত সায় নেই। মুখ্যত উপন্যাস আমাদের কাছে তার বিপুলতার কারণে; তার মধ্যেকার বিভিন্ন দ্বন্দ্ব এবং তার থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টার কারণে; মানবসভ্যতার সবগুলি দিক, মানুষ আর তার সঙ্গে প্রকৃতির দ্বন্দ্বময় অন্বয় এবং আরও বহুবিধ কারণে সাহিত্যের সবচেয়ে জটিল এবং মহান সৃষ্টি। বিশেষত আজকের দিনে সুস্থ বিনোদনের ভুবন যখন ক্রমসঙ্কুচিত, যখন কাব্যসাহিত্যে রস আর অলঙ্কার প্রয়োগ করে সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা টিকিয়ে রাখা বাতুলতা, তখন উপন্যাসের প্রয়োজন আরও প্রখর। এখন দরকার সরাসরি আপসহীনতা কিংবা অন্তর্ঘাত সৃষ্টি। ফলে আজকের বাংলা উপন্যাস আমাদের কাছে হয়ে ওঠে কাঙ্খিত সেই ম্যাজিকদণ্ড। আমাদের আয়ুধ। কিংবা বিস্ফোরক। মহাকাব্যের কাহিনি থেকে উৎসারিত নভেলে রয়েছে সেই অন্তর্ঘাত সৃষ্টির সম্ভাবনা। রয়েছে রাজনৈতিক অবিমৃষ্যকারিতার বিপরীত প্রবাহে দাঁড়িয়ে সমকালীনকে ছোঁয়া। শাসককে প্রশ্ন করা। আজকের ভারত বা বাংলাদেশে ধর্মের নামাবালি গায়ে চাপিয়ে রাষ্ট্রনেতারা তাঁদের শোষণ কায়েম রেখেছেন। এখন রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা মানে দেশদ্রোহিতা। শাসকেরা সুকৌশলে দেশপ্রেম আর রাষ্ট্রপ্রেমকে একাকার করে দিয়েছেন। মহাকাব্যের চরিত্ররা হয়ে গেছে ঐতিহাসিক চরিত্র। রামমন্দির তৈরি এখন রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। রাষ্ট্রবাদিতার হিংস্রতায় করায়ত্ত মহাকাব্য। এই তো সময় মহাকাব্যের চরিত্রকে নতুন আঙ্গিকে, সমকালের রাষ্ট্রভাবনার বিপ্রতীপে প্রতিষ্ঠিত করা। মহাকাব্যিক উপন্যাসের মধ্যে প্রশ্ন করার যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তাকে কীভাবে এড়িয়ে যাবেন আজকের ঔপন্যাসিক? তাই হয়তো বাংলার বর্তমান বিকল্প ধারার অথরেরা মহাকাব্যের উপাখ্যান থেকে সূত্র সংগ্রহ করে নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শে এক নতুন পথের দিশারী। মিহির সেনগুপ্তের ‘বিদুর’, শাহ‌্‌যাদ ফিরদাইসের ‘ব্যাস’ কিংবা দেবকুমার সোমের ‘অথঃ মারীচ কথা’ মহাকাব্যের উপদান নিয়ে রচিত নতুন কালের কিছু উপন্যাস।

আমাদের মহাকাব্যগুলো যেন সমুদ্রের মতো অপার। অগাধ। আমরা এই সমুদ্রে যেমন অবগাহন করতে পারি, স্নান করতে পারি। ঠিক তেমনই এই সমুদ্রের মর্মস্থলের রহস্যগুলিকেও নিজেদের সমকালীন বিচার ধারায় বিশ্লেষণ করতে পারি। ফলে দেখা যায় ভারতীয় সাহিত্যে যুগে–যুগে বিভিন্ন বাঁক বা মোড় ঘোরানো সৃষ্টির আকর হিসাবে থেকে গেছে রামায়ণ কিংবা মহাভারতের কাহিনি। বিশেষত আমাদের বাংলা সাহিত্যে।

কিন্তু মহাকাব্যের পরিধি সীমিত। তার কাহিনির উৎপত্তি, গঠন এবং সমাপ্তি সুনির্দিষ্ট। বাখতিনের ভাষ্যে ‘Epic is absolute past’। মহাকাব্য সম্পর্কে আলোচনায় তিনি আমাদের যে কথা মনে করাতে চেয়েছেন তা হল:

It is closed as a circle, inside it everything is finished, already over. There is no place in the epic world for any openendness, indecision, indeterminacy. There are no loopholes in it through which we glimpse the further, it suffices unto itself, neither supposing any continuation nor requiring it.[2]

এমন কথা বলে বাখতিন মহাকাব্যের গঠন ও তার মধ্যে অবস্থিত ভবিষ্যৎ-সম্ভাব্যতাকে কেবল নস্যাৎ করলেন না, তিনি এ প্রসঙ্গে ওই একই প্রবন্ধে আরও জানালেন:

By its nature the epic world of the absolute past is inaccessible to personal experience and does not permit an individual, personal point of view or evaluation.[3]

আমাদের মনে হয় যেহেতু বাখতিনের মাতৃভাষায় এবং পরবর্তীকালে তাঁর অধীত বিদেশি ভাষা জর্মন-এর নিজস্ব সাহিত্যে মহাকাব্যের প্রভাব ভারত, গ্রিস কিংবা ইতালির মতো এমন গভীরে প্রোথিত নয়, এমন দেশজ সমাজ গঠনের প্রধানতম স্তম্ভ নয় (ধর্মের ভাবাবেগ বাদ দিলেও), তাই তিনি মহাকাব্যের ভেতরে রয়ে যাওয়া সময়ের অমরতাকে অনুভব করতে পারেননি। যদিও নভেল ও মহাকাব্যের আলোচনার প্রেক্ষিতে তাঁর উল্লেখিত এই প্রবন্ধে তিনি দেখাতে চেয়েছেন মহাকাব্য আর উপন্যাস সম্পূর্ণ পৃথক। ফলে গোড়াতেই আমাদের ভারতীয়দের মতো পড়ুয়া মনের কাছে তাঁর এই পর্যবেক্ষণ অসম্পূর্ণ এবং কিছুটা বা অসত্য মনে হবে। তিনি অবশ্য তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি সাজাতে গিয়ে কিছু পরে নীচের এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে মহাকাব্যের প্রকৃত রূপ–রসকে হয়তো খানিকটা স্পর্শ করতে চেয়েছেন।

On the other hand, traditions isolate the world of the epic from personal experience, from any new insights, from any personal initiative in understanding and interpreting, from new points of view and evaluation.[4]

আমাদের মহাকাব্য দুটিকে আমরা আকরগ্রন্থ বলে যে বিবেচনা করি তার কারণ বহুবিধ। রামায়ণ ও মহাভারত আমাদের কাছে বহমান জীবনস্রোতের কথা বলে। ফলে বিভিন্ন সময় আমরা আমাদের সমকালকে স্পষ্টভাবে বুঝতে চেয়ে মহাকাব্যের কাছে হাত পাতি। সেই দরুন মহাকাব্যের কোনও একটি বিশেষ অংশ, বিশেষ পাঠ কোনও এক মহৎ সাহিত্যের জন্মের কারণ হয়ে ওঠে। হয়তো জন্মও দেয়। উদাহরণ কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান‌্‌ শকুন্তলম‌্‌’ নাটক। মূল মহাভারতের কাহিনিকে অটুট রেখে একজন মহৎ স্রষ্টার হাতে মহাকাব্য কীভাবে বিনির্মিত হতে পারে তার সাক্ষাৎ নমুনা এই নাটক।

মূল মহাভারতে আমরা জানতে পারছি ঋষি কন্বমুনির অবর্তমানে রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছেন। শকুন্তলা বিভিন্ন বাহানা দিয়েও রাজাকে নিরস্ত করতে পারছেন না। রাজা মনু নির্দেশিত আট রকমের বিবাহপদ্ধতির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম গান্ধর্ব বিবাহ এমনটা বুঝিয়ে শকুন্তলাকে সঙ্গমে রাজি করালেন। তখন শকুন্তলা শেষ মুহূর্তে দুষ্মন্তকে বললেন:

আমি যাহা প্রার্থনা করিতেছি, এই বিষয়ে আপনাকে অঙ্গীকার করিতে হইবে। আপনার ঔরসে আমার গর্ভে যে পুত্র জন্মিবে, সে আপনি বিদ্যমানে যুবরাজ ও অবিদ্যমানে অধিরাজ হইবে; যদ্যপি আপনি এই বিষয়ে প্রতিশ্রুত হন, তবে আমি আপনার হস্তে আত্মসমর্পণ করিতে পারি।[5]

এর পরের ঘটনা মহাভারতকার যেভাবে আমাদের জানান তা এমন, শকুন্তলা তাঁর পুত্রকে কোলে নিয়ে রাজধানীতে পৌঁছে রাজা দুষ্মন্তের মুখোমুখি হন এবং নিজের পরিচয় দেন। শকুন্তলার পরিচয়ে রাজা রেগে গিয়ে তাঁকে ‘দুষ্টতাপসী’ বলে ভর্ৎসনা করেন। রাজার ব্যবহারে রেগে গিয়ে শকুন্তলা তাঁকে ভরা রাজসভায় ইতর, চোর, মিথ্যেবাদী এমন সব বাছা–বাছা গালিগালাজ করলেন। রাজাও থেমে থাকার পাত্র নন। তিনি শকুন্তলার গর্ভধারিণী মাকে তো বেশ্যা বললেনই, তাঁর পিতা মহর্ষি বিশ্বামিত্রও যে আসলে নীচ স্বভাবের লোক সেটাও বললেন। আর সবশেষে শকুন্তলাকে বললেন ‘পুংশ্চলী’ অর্থাৎ বেশ্যা।

দুজনের ঝগড়া এমন নিম্নস্তরের ছিল যে শেষে বিতর্কটি আকাশবাণীতে নিষ্পত্তি হল।

হে দুষ্মন্ত! তুমি আপনার পুত্রকে প্রতিপালান কর, শকুন্তলাকে অপমান করিও না। হে নরদেব! ঔরস-পুত্র পিতাকে যমালয় হইতে উদ্ধার করে। শকুন্তলা সত্যই কহিতেছেন, তুমিই এই পুত্রের উৎপাদক।[6]

আমাদের অনুমান মহাভারতের আদিপর্ব রচিত হওয়ার অন্তত পাঁচশো বছর পরে কালিদাস তাঁর অমর সৃষ্টি ‘অভিজ্ঞান‌্‌ শকুন্তলম‌্‌’ নাটকটি রচনা করেন। যদি আমরা ধরে নিই এই কালিদাসই উজ্জয়িনীর সম্রাট বিক্রমাদিত্যের নবরত্নসভার অন্যতম সভ্য ছিলেন। কালিদাস তাঁর নাটকে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার মিলনের সময় শকুন্তলার মুখ দিয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি আদায় করালেন না। আমরা দেখতে পাই কবি (এখানে নাটককার) সুকৌশলে তাঁর রচনার নায়ক–নায়িকাকে যৌবনের কামনায় দগ্ধ হয়ে পরস্পরের প্রতি নিবেদিত এমন একটি আধুনিকমনস্কতা আমদানি করলেন। পুত্রের জন্মের পরে কালিদাসের কন্বমুনি স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁর পালিত কন্যাকে একা দুষ্মন্তের কাছে সপুত্র পাঠিয়ে দেন না। বরং গৌতমী ও শাঙ্গর্রবকে দূত হিসাবে নিয়োগ করেন। ভরা রাজসভাকে কালিদাস মহাভারতকারের মতো অশ্লীলতার প্রদর্শনী করে তোলেন না। শকুন্তলার পরিচয় আর আগমণের কারণ জেনে কালিদাসের দুষ্মন্ত বলেন, ‘এই কল্পনা-প্রসূত অসৎ প্রস্তাবটি কী করে তুলছেন আপনারা?’ স্পষ্টতই ক্রুদ্ধ হলেও রাজা এখানে যথেষ্ট মার্জিত তাঁর আচরণে।

শকুন্তলা রাজার এমন ব্যবহারে যথেষ্ট অপমানবোধ করে মাত্র দুটি কথা বলেন।

শকুন্তলা— …এই স্বভাবসরল মানুষটিকে তপোবনে শপথ নিয়ে ওইভাবে প্রতারণা করে এখন এইসব কথা বলে প্রত্যাখ্যান করা আপনার উপযুক্তই বটে।

রাজা— (কান ঢেকে) ছি! ছি! কূলপ্লাবী নদী যেমন নির্মল জলকে আবিল করে এবং তটতরুকে ভূপাতিত করে, আপনিও তেমনি নিজের কুলকে কলঙ্কিত করে আমাকেও অধঃপতিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন।

শকুন্তলা— যাক, যদি সত্যিই পরদার-পরিগ্রহের আশঙ্কায় আপনিই এই আচরণ করে থাকেন তাহলে এই অভিজ্ঞান দেখিয়ে আপনার আশঙ্কা দূর করব।[7]

মহাভারত থেকে কাহিনি সংগ্রহ করে তাকে সমকালীন করে নেওয়া ছিল কালিদাসের দায়। তাঁর প্রধানতম সমস্যা। যে সমস্যার কথা আমাদের শুনিয়েছেন বাখতিন ওপরের উদ্ধৃতিতে। কিন্তু কালিদাস হলেন মহাকবি। তিনি আকাশবাণীর মতো ভঙ্গুর আর সস্তার জিনিস দিয়ে নায়ক-নায়িকার মিলন সম্ভব করার জন্য শকুন্তলা নাটকটি রচনা করতে চাননি। তাই নাটকের শিরোনামেই ‘অভিজ্ঞান’ কথাটি জুড়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ মিলনের সময় রাজা তাঁর হাতের আংটিখানা খুলে শকুন্তলার হাতে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। যা তাঁদের বিবাহের স্মারক বা অভিজ্ঞান। শকুন্তলার ওই একটি সংলাপে নাটকের মোড় গেল ঘুরে। আমরা জানতে পারলাম কেবল সাক্ষী নয়, বিবাহের প্রমাণসহ শকুন্তলা হাজির হয়েছেন রাজা দুষ্মন্তের রাজসভায়।

মূল কাহিনি মহাভারতের। মহাকাব্যের। ফলে তার কাহিনি কিংবা পাত্র–পাত্রী থেকে বিচ্যূতির কোনও অবকাশ কারও নেই। স্বয়ং কালিদাসেরও নয়। সেটা করার অর্থ তাজমহলের রং পাল্টে দেওয়ার মতো বর্বর বালখিল্যতা। কালিদাস তাঁর যুক্তিবাদী মন নিয়ে পুনঃরচনার সময় দুষ্মন্তকে দেওয়া মুনি দুর্বাসার অভিশাপকেও অক্ষুণ্ণ রাখলেন। ফলে সময়কালে শকুন্তলার পক্ষে তাঁদের বিবাহের স্মারকচিহ্ন প্রমাণসরূপ পেশ করা সম্ভব হল না।

নাটকের মোড় ঘুরেও যেন ঘুরল না। মহাকবি মহাকাব্য থেকে চ্যূত না হয়ে কীভাবে মিলনাত্মক নাটক রচনা করবেন? পাঠক ও লেখকের এই যুগপৎ দ্বন্দ্ব আধুনিক উপন্যাসের প্রাণ।

ষষ্ঠ অঙ্কে পৌঁছে আমরা আবিষ্কার করলাম কবির (অর্থাৎ নাটককারের) অভিপ্রায়। দুজন রক্ষী একটা লোককে মারতে মারতে মঞ্চে প্রবেশ করে। মার খেয়ে সেই লোকটা জানাল:

পুরুষ— একদিন একটা রুইমাছ খণ্ড খণ্ড করে কাটলাম। তার পেটের ভিতরটা দেখতেই চোখে পড়ল মহামণিতে জ্বল‌্‌-জ্বলে এই আংটিটা। তারপর এটা বিক্রির জন্য দেখাতেই আপনারা আমাকে ধরলেন। আপনারা মারুন, কাটুন, যাই করুন, কী করে এটা পেলাম এই হল তার গোপন বৃত্তান্ত।[8]

আকাশবাণীর বদলে আংটির ব্যবহার আর তারপর সেটা শকুন্তলার হাত থেকে খসে নদীতে এক রুইমাছের পেটে যাওয়া। তারপর সেটা এক জেলের জালে ধরা পড়া। এমন মেটাফর আধুনিক উপন্যাসের বিষয়। যা আমরা মহাকাব্য থেকে গ্রহণ করতে পারি। রবীন্দ্রনাথ শকুন্তলা নাটক প্রসঙ্গে বলেছেন বেদব্যাস ও কালিদাস দু জন আলাদা মানুষ, ফলে তাঁদের সৃষ্ট শকুন্তলা ভিন্ন-ভিন্ন হবে। আমাদের মনে হয় যেহেতু রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়কালে দাঁড়িয়ে সাহিত্যে রসকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন, সেহেতু তিনি কালিদাসের আধুনিকতাকে আর বিস্তারে ভাবতে চাননি। তাই হয়তো সচেতনভাবে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন আর কালিদাসের সৃজনপার্থক্য তিনি এড়িয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা আমাদের অনুমানকে পোক্ত করার জন্য রবীন্দ্রনাথের ১৮৯৮ সালে ঐতিহাসিক উপন্যাস সম্পর্কে লেখা নিবন্ধের অংশবিশেষ একবার জেনে নিতে পারি:

তাই বলিয়া কি রামচন্দ্রকে পামর এবং রাবণকে সাধুরূপে চিত্রিত করিলে অপরাধ নাই? আপরাধ আছে। কিন্তু তাহা ইতিহাসের বিরুদ্ধে অপরাধ নহে, কাব্যেরই বিরুদ্ধে আপরাধ। সবর্জনবিদিত সত্যকে একেবারে উল্টো করিয়া দাঁড় করাইলে রসভঙ্গ হয়, হঠাৎ পাঠকদের যেন একেবারে মাথায় বাড়ি পড়ে। সেই একটা দমকাতেই কাব্য একেবারে কাত হইয়া ডুবিয়া যায়।[9]

স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের ইঙ্গিত মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাধবধ কাব্য’ যা ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মসালে প্রকাশিত। সে-অর্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৩৭/৩৮ বছর বয়সেও মেঘনাধবধ কাব্য-কে মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেননি। এমনকি পরবর্তীকালেও অনেক পণ্ডিত সমালোচক মিলটনের স্যাটান, এমনকি দান্তে বা ভার্জিলের অনুকরণ হিসাবে এই মহাকাব্যকে দাগিয়ে দিয়েছেন। আমাদের আলোচনার পরিধি কোনও একটি বিশেষ সাহিত্যকীর্তিকে কেন্দ্রে রেখে রচিত নয়। তবে নান্দনিকতার জায়গা থেকে যেমন, তেমন রাজনীতিকরণের জায়গা থেকেও মহাকাব্যের পুনর্লিখন হয়। হতে পারে। আমরা স্মরণ করতে পারি রবীন্দ্রনাথেরই ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ কিংবা ‘গান্ধারীর অভিশাপ’ বা তাঁর ব্যবহৃত মহাকাব্যিক আখ্যানের আরও বহু সৃষ্টি। যা মূল মহাকাব্যের কোথাও তেমন স্পষ্টভাবে চেনা যায় না। চেনা গেলে অন্তত রবীন্দ্রনাথ তার পুনর্লিখনে উৎসাহী হতেন না।

গো–বলয়ের মানুষ যেমন গরুকে মাতৃজ্ঞানে সেবা করে, বাঙালি হিন্দুরা তেমনটা নিশ্চয় নই। আমাদের কাছে নদী হল মা। তাই আমরা হিন্দু কিংবা মুসলমানেরা বলি আমাদের দেশ নদীমাতৃক। তাছাড়া এসব অঞ্চল ছিল চিরকাল ‘পাণ্ডববর্জিত’, ‘বৌদ্ধ পাষণ্ড’দের দেশ। রাজা আদিশূরের ব্রাহ্মণ্যবাদ যদি ঐতিহাসিক নজরদারির কারণে আমরা ছেড়েও দিই, রাজা বল্লালসেনের কৌলীন্যপ্রথার নিগড়ে সমাজকে বেঁধে ফেলার অপচেষ্টা মাত্র সোয়াশো বছরের মধ্যেই কুলীন হিন্দুদেরকে সমাজের মূলস্রোত থেকে যে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল সেইদিকে আজ আমাদের নজর দিতে হয়। প্রধানত কৌলীন্যপ্রথার কারণে বাংলায় হিন্দুধর্মের বিপযর্য় ঘটে এমনটা আজ আর অস্বীকার করা যায় না। আর ১২০৪ সালের আগুপিছু সময়ে সেই সূত্রে ধীরে ধীরে ইসলাম জায়গা করে নিচ্ছিল এই নদী-ভাঁটির দেশে, তাও আজ অস্বীকৃত ইতিহাস নয়। এই ইতিহাস মেনে নিলে আমাদের কাছে রামায়ণ ধর্মগ্রন্থ না হয়ে রামকাহিনি হয়ে ওঠে। আর আমরা রামের চোদ্দ বছর বনবাসপর্বকে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদেরই একটা আদিম রূপ হিসাবে পেয়ে যেতে পারি। আর সেভাবে যদি গোটা রামায়ণ বিনির্মিত হয়, তবে দেখা যায় কিশোর বয়সে ভাড়াটে খুনির ভূমিকায় রামচন্দ্র এবং তাঁর ভাই লক্ষ্মণকে। যাদের হাতে নিকেশ হয় জঙ্গলের আদিবাসী নেত্রী তাড়কা। এমনটা ভেবে নিলে বহু প্রশ্নের উত্তর সমান্তরালে হয়তো আমরা খুঁজে নিতে পারি। তেমনটা হলে আজ এতদিন পরে নিশ্চিত মিলটন, ভার্জিল কিংবা দান্তের অনুকরণের অনুষঙ্গ যেমন ওঠে না। তেমন রবীন্দ্রনাথের ‘কাব্য একেবারে কাত হইয়া ডুবিয়া’ যাওয়ার আশঙ্কাও বিশেষ থাকে না। আর সেটা সম্ভব হয় কেবল উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে।

মহাকাব্যের পুনর্লিখনের মধ্যে দিয়ে চাইলে উপন্যাসে অন্তর্ঘাতও সৃষ্টি করা যায়। সৃষ্টি হয়। দেবকুমার সোম (যিনি এই প্রবন্ধের লেখকও বটে) তাঁর রামায়ণ কাহিনি-ভিত্তিক উপন্যাসের মুখবন্ধে তাই লিখেছেন:

যুদ্ধটা চলছেই। বিভিন্ন মাত্রায়। বিভিন্ন কৌশলে। মহাকাব্যের যুগে দেবতাদের অমৃতলোভ কিংবা এই সময়ের বহুজাতিক সংস্থার মুনাফালোভ জঙ্গল এবং জংলিপ্রাণকে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? রাষ্ট্রশক্তি যতই বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় জী–জান এক করে দিক, জঙ্গলের রুখুশুখু মানুষগুলো অস্ত্র তুলে নেবে হাতে। রামায়ণের সময়ও তুলেছিল। আজকেও তুলেছে। একে অনুন্নয়নের সরলীকরণে ব্যাখ্যা করা ভ্রমাত্মক। কৈশোরে ঋষি বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায় আদিবাসী নেত্রী তাড়কাকে খুন করেছিল দশরথনন্দন রামচন্দ্র। সেই প্রথম ভাড়াটে খুনি হিসাবে মহাকাব্যে তার আবির্ভাব। তাড়কা নিধনের রাতে তার পুত্র মারীচ পালাতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ এবং জটিল জঙ্গলপথ। উত্তর থেকে দক্ষিণে পালিয়েছিল সে। উদ্দেশ্য, আদিবাসী পুরুষ রাবণের কাছে পৌঁছে মাতৃহত্যার প্রতিশোধ। কীভাবে এক সামান্য উদ্বাস্তু পরিবারের জংলি ছেলে উত্তর থেকে দক্ষিণে পৌঁছাল এবং কীভাবে এক মহাযুদ্ধের সূচনা ঘটল তার হাতে, এই আখ্যানে সেই আয়ন বিধৃত।[10]

আশ্চর্যজনকভাবে মাঝের দীর্ঘ সময় বাংলা উপন্যাস নীরব থেকেছে মহাকাব্য থেকে উপদান সংগ্রহে। এর অন্যতম প্রধান কারণ উত্তর ঔপনিবেশিক সময়কালে নিজের অবস্থানকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন যাঁরা, সে-সব প্রাতঃস্মরণীয় ঔপন্যাসিকদের মনোজগৎ ফরাসি সাহিত্য, বিশেষত অ্যালবেয়র কাম্যুর অলিয়েনিয়েশন তত্ত্ব অধিকার করে নিয়েছিল। ১৯৩০ দশকে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সর্বমান্য সূত্র হিসাবে প্রবেশ ঘটেছিল বদলেয়রের ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর, রিলকের ‘ডুইনো এলিজি’-র। খানিকটা তেমন ধারায় বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে এসেছিল কাম্যুর ‘দ্য আউটসাইডার’। এর পাশাপাশি কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বর্ণযুগের সাহিত্যকীর্তিও ছিল তাঁদের কাছে আর্দশ। দস্তয়েভস্কি তো ছিলেনই। সঙ্গে চেকভ, গোর্কি, গোগোলদের প্রভাব বেশ জটিল আর বর্ণময় ছাপ ফেলেছিল সেদিনের বাংলা সাহিত্যে। পরবর্তী দশকে রুশ সাহিত্যের পাশাপাশি কৃত্তিবাসগোষ্ঠী কিংবা হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের সূত্রে ফরাসি সৌরভ আরও নিবিড়তা পেল। হাংরিদের কাছে জাঁ জেনে হয়ে উঠলেন অবতার বিশেষ। ততদিনে আমেরিকার সাহিত্যে বিট আন্দোলন থেকে জাঁক কেরুয়াক বা তার গায়ে–গায়ে হেনরি মিলার উঠে এসেছেন। বাঙালি পাঠকের হাতে অনুবাদের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গেছে জেমস হ্যাডলি চেজ, হ্যারেন্স রবিনস‌্‌-দের থ্রিলারধর্মী উপন্যাস। আর উত্তর-আধুনিক সময়ে পৌঁছে বাঙালি উপন্যাসকার ম্যাজিক রিয়ালিজমকে তাঁর সময়কার পরাবাস্তবতার মধ্যে দিয়ে চিহ্নিত করতে চেয়ে আরও বিচ্ছিন্ন হলেন মহাকাব্যিক আখ্যানমালার নতুন ডাইমেশন থেকে।

উপন্যাস হবে আত্মজৈবনিক এমন একটা গোলমেলে ধারণা কীভাবে যেন সেঁটে গেছে আধুনিক বাংলা উপন্যাসের শরীরে। সেই ভাবনা থেকেই জারিত উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের। কিন্তু অ্যালবেয়র কাম্যু ঔপনিবেশিক ফ্রান্সের লেখক হলেও তাঁর অ্যালিনিয়েশন তত্ত্ব সম্পূর্ণতই পশ্চিম ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ভোগবাদের বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে। তার চেয়েও কঠিন সত্য এই, স্বয়ং কাম্যুও মহাকাব্যের আখ্যান থেকে তাঁর উপন্যাস ‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’ রচনা করেছিলেন। অনুরূপভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লব-পূর্ব উপন্যাসের পটভূমির সঙ্গে খুব সামান্য সংযোগ সুবিধাভোগী, পাইয়ে দেওয়ার ভারতীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির। আর আমেরিকান সাহিত্যের খোলনলচে নিয়ে নির্মিত বাংলা উপন্যাস একরকম সফট‌্‌কোর পর্নের দরজা খুলে দিল। আত্মজৈবনিক উপন্যাসের প্রধান শর্তগুলিকে সম্পূর্ণত মেনে সেদিন আমাদের সাহিত্য রচিত হয়নি। আজও নয়। পাশাপাশি অগ্রাহ্য করা হয়েছে মহাকাব্য বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচনার সম্ভাবনাকে। অথচ, গোটা বিশ শতক শাসন করল জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’।

হ্যাঁ, এ কথা সত্যি মহাকাব্যের সঙ্গে সমকালের সময়ের দূরত্ব এতটাই যে তাকে বিচার করা, বিশ্লেষণ করা কেবল দুরূহ নয়, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তার মধ্যেকার বিভিন্ন উপদান আজও বৌদ্ধিক তর্ক-বিতর্কে সমকালীনতায় উত্তীর্ণ। আজকের অনেক পণ্ডিত মনে করেন মহাভারত আক্ষরিক অর্থে এক ডিসকোর্স। এই মহাকাব্যের মূল কাহিনি কীভাবে আমাদের সামনে তার চরিত্রগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সে এক বিস্ময়কর বুনন।

সৌতি উগ্রশ্রবাঃ নৈমিষারণ্যের মুনিদের মহাভারতের কাহিনি বলছেন। যে কাহিনি তিনি শুনে এসেছেন জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে উপস্থিত থেকে বৈশম্পায়নের মুখে। বৈশম্পায়ন ছিলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের সাক্ষাৎ শিষ্য। রাজা জনমেজয় হলেন কুরু বংশের রাজা। তিনি বৈশাম্পায়নের মুখে শুনতে চান তাঁর পূর্বপুরুষের যুদ্ধের কথা। অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের কাহিনি। যে কাহিনি লিখেছেন স্বয়ং বেদব্যাস। যিনি নিজে আবার এই কাহিনির অন্যতম প্রধান চরিত্র। মূল কাঠামোয় পরবর্তী সময়ে স্থানকালভেদে বহু সংযোজন ঘটে আজকের মহাভারতে রূপ নিয়েছে। তবে কাহিনির সূত্রপাতের নির্যাস এটুকু। কাহিনি শুরুর আগের কাহিনির (অর্থাৎ আদিপর্ব) বুনন যেমন চমকপ্রদ, তেমনই জটিল। মুখে মুখে বলা কাহিনির অন্তর্নিহিত রহস্য তো প্রাঞ্জল হয় না, উল্টে আরও জটিল এক মনস্তাত্ত্বিক আখ্যানের পূর্বাভাস হয়ে দাঁড়ায়। এর বাইরে এসে যদি পাঠক দাঁড়ান, তাহলে কাহিনির শুরুর মুখেই ফের তিনি আর এক বিপর্যয়ের মধ্যে গিয়ে পড়েন। সেটা হল কীভাবে কাহিনির সূত্রপাত ঘটছে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কৌরবদের মধ্যে পুরুষ হিসাবে বেঁচে আছেন মাত্র দুজন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র আর তাঁর এক দাসীর গর্ভে জন্ম নেওয়া পুত্র যুযুৎসু। অন্ধরাজা যুদ্ধে তাঁর হারের কারণ ব্যাখ্যা করছেন তাঁর অনুচর সঞ্জয়ের কাছে। যেখানে একে-একে চুম্বকে উঠে আসে মূল মহাভারতের ঘটে যাওয়া যুদ্ধের কার্যকারণ। অর্থাৎ যুদ্ধশেষে সঞ্জয়ের সামনে ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপকথা শুনলেই মহাভারতের মূল কাহিনি আমাদের জানা হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক ঔপন্যাসিকরা কখনওই তাঁদের হাতের সব তাস খেলার শুরুতেই দেখিয়ে দেন না। কিন্তু মহাভারতকারের স্পর্ধা তিনি গল্পটা বলেন সম্পূর্ণ উলটো রাস্তায়। তারপরও থেকে যায় কাহিনির টানাপোড়েন। পাঠ-উত্তেজনা। শুরু হয় ডিসকোর্স।

কাহিনির বিন্যাস যদি উহ্য রাখা হয়, তাহলে দর্শনগতভাবেও সমগ্র মহাভারত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অবস্থানবিন্দু থেকে সরে যেতে থাকে। আদিতে কাহিনি ছিল বেদব্যাসের। অর্থাৎ বৈদিক দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে এই কাহিনির বিন্যাস। তারপরে সেটা কখন যে পাঠকের অগোচরে মনুর সমাজভাবনা হয়ে ওঠে সেটা ঠাহর হয় না। মহাভারত রচনার শুরুর সময়কালে পরিবার কিংবা বিবাহব্যবস্থা ছিল না। তখন এক নারীর একাধিক পুরুষসঙ্গ ছিল সাধারণ এক প্রথা। সেই প্রথায় ভোজরাজ কন্যা কুন্তীর যৌনসঙ্গম পাঁচ পুরুষের সঙ্গে। কুমারি অবস্থায় সূর্য। বিবাহিত জীবনে প্রথমে রাজা পাণ্ডু। তারপর একে-একে ধর্ম, পবন আর ইন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সহবাস। এই কাহিনি গড়িয়ে-গড়িয়ে যখন অর্জুনের দ্রৌপদীলাভে এসে পৌঁছায়, তখন তাঁর পাঁচ স্বামী স্বভাবতই সামাজিকভাবে নিন্দার্হ হয়ে ওঠে। তাই ভরা রাজসভায় যখন তাঁর বস্ত্রহরণ হয়, সেই সময় পাঁচ স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত জীবন কুরুচিকর এমন কর্দয ইঙ্গিত করেন মহাবীর কর্ণ। অর্থাৎ ততদিনে বেদ থেকে সরে কাহিনি চলে এসেছে মনুর কালে। যেকালে পাঁচজন পুরুষের সঙ্গে যে নারীর যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাঁকে সমাজে বেশ্যা নামে অপবাদ দেওয়ার চল এসে গেছে।

আর এরই ফাঁকে যখন কৃষ্ণ চরিত্রের আগমন ঘটে, তখন কাহিনির অভিমুখ ঘুরে যায় অবতারবাদে। বৈষ্ণব দর্শনের দিকে। বেদে অবতারবাদের কোনও স্থান নেই। অথচ মহাভারতের আঠেরো দিনের ভয়াল যুদ্ধে রচিত হয়ে যায় ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতা’। অর্জুনকে কৃষ্ণ তাঁর মুখবিবরে ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করান। যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু রাজকার্য? যুদ্ধের পরে আরও আঠেরো বছর হস্তিনাপুরের রাজা থাকেন জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র। তবে ভীমের অপমান আর বক্রোক্তির কারণে তিনি রাজ-ঐশ্বর্য ছেড়ে সাধারণ মুনির মতো দিনযাপন করেন। তারপর সন্ন্যাস নিয়ে বিদুর, গান্ধারী আর কুন্তীসহ জঙ্গলে চলে যান বাকি জীবন তপশ্চর্যা করবেন বলে। তার আগে তিনি যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে যান প্রজাপালনের গূঢ়তত্ত্ব। আর সব শেষে বিদুর গভীর জঙ্গলে মিলে যান যুধিষ্ঠির শরীরে।

মহাভারতের এই বাহ্যিক কাঠামো কমবেশি সব ভারতীয়ের জন্মসূত্রে জানা। কিন্তু আমাদের কাছে এ এক পরম বিস্ময়! যুগ-যুগ ধরে কবি-সাহিত্যিকেরা এই আকর গ্রন্থ নিয়ে তাঁদের যুগোপযোগী কাজ করেছেন। তবুও এর প্রয়োজন ফুরায়নি। ফুরায় না। সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যে, বৈষ্ণব সাহিত্যে, অনুবাদ সাহিত্যে বারবার ব্যবহার হয়েছে আমাদের মহাকাব্য। ‘ক্লেদজ কুসুম’, ‘আওয়ার লেডি অফ ফ্লাওয়ার্স’ কিংবা অ্যালিনিয়েশন তত্ত্বও রয়েছে এই দুই মহাকাব্যে। তাকে আবিষ্কারের দায় আর দায়িত্ব সমকালীন ঔপন্যাসিকের। মহাকাব্যের আখ্যান থেকে জন্মও দেওয়া যায় আত্মজৈবনিক উপন্যাসের। এবং তার প্রমাণ কর্ণ কিংবা একলব্য চরিত্রের প্রতি আধুনিক কাহিনিকারদের পক্ষপাত।

মিহির সেনগুপ্তের সাম্প্রতিক উপন্যাসে বিদুরের যে চরিত্র উঠে আসে তা এক জটিল অথচ আধুনিক মানুষের মনস্তত্ত্ব। যুদ্ধ যখন চলছে তখন বিদুর তাতে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি নিজের মতো যুদ্ধের কারণ অনুসন্ধানে ছিলেন কাহিনির কেন্দ্র থেকে স্বনির্বাসিত থেকে। যুদ্ধশেষে তিনি ফিরে আসেন এবং সহায় হন অন্ধরাজা, রানি গান্ধারী আর তাঁর প্রেয়সী কুন্তীর। কুন্তীর সঙ্গে বিদুরের দৈহিক সম্পর্কের কথা আমরা পাই প্রতিভা বসুর ‘মহাভারতের মহারণ্যে’ নামের প্রবন্ধ গ্রন্থে। তাঁর এই পর্যবেক্ষণ দক্ষিণভারত থেকে পাওয়া। যা বুদ্ধদেব বসু কিংবা অন্য মহাকাব্যের পণ্ডিতেরা স্বীকার করেন না। অথচ মিহির সেনগুপ্তের কুন্তী বিদুরের কাছে নিজের যৌন আকাঙ্খার দাবি রেখে যুক্তি দেন, ‘একজন ক্লীবের সঙ্গে বিবাহিতা হয়েছি বলে কি আমার যাবতীয় কামনা, বাসনা, আকাঙ্খা সব বিসর্জন দিতে হবে?’ ধৃতরাষ্ট্র চরিত্রের বিশৃঙ্খলা, চারিত্রিক দোষ স্পষ্ট করেছেন কথাকার তাঁর এই উপন্যাসে। তিনি বলতে চেয়েছেন ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর গর্ভে শত পুত্র আর এক কন্যার জন্ম দেননি। গান্ধারীর গর্ভজাত সন্তান হল দুর্যোধন, দুঃশাসন আর দুঃশলা। এমন বহু স্বকীয়তায় উজ্জ্বল উপন্যাসের নায়ক বিদুর। মহাভারতের মূল আখ্যান থেকে বিচ্যূত না হয়ে আধুনিক মননে তার চরিত্রের ব্যাখ্যা এই অনুপম উপন্যাস।

কাল অপরাহ্ণ।… এমন মলিন অপরাহ্ণে হয়তো কোনো একদিন একটি সামান্য ঘটনা ঘটতে পারে। কখনো সেই আপাতসামান্য ঘটনার শাখাপ্রশাখা হিংস্র রক্তক্ষয়ী আর মর্মান্তিক হয়ে উঠতে পারে। কখনো বা সেই মর্মান্তিক রক্তপাত থেকে জন্ম নিতে পারে, নতুন কোনো মহৎ উজ্জ্বল আর সর্বকাল-জয়ী ঘটনা।[11]

শাহ‌্‌যাদ ফিরদাউসের ইতিমধ্যে বিখ্যাত উপন্যাস ‘ব্যাস’-এর সূচনাবিন্দু আমরা ওপরে উল্লেখ করলাম। মহাভারতকার কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের জন্মকাহিনি আমাদের জ্ঞাত। কিন্তু এই উপন্যাসের সূচনাবিন্দু অর্থাৎ পরাশর ও সত্যবতীর যৌনমিলন এবং সেখান থেকে শুরু হয়ে কুরুপ্রান্তরে ঘটে যাওয়া যুদ্ধকে বেদব্যাস তাঁর দৃষ্টিতেই এখানে বর্ণনা করেছেন। মূল মহাভারত তাঁর লেখা। আবার এই উপাখ্যানের কথকও তিনি। কিন্তু সময়ের উদ্ধবর্তনে উঠে এসে সহস্রাধিক কালপ্রবাহ পার হয়ে এসে এই উপন্যাস হয়ে ওঠে আজকের দর্পণে ভিন্ন এক ডিসকোর্স। যা সমকালীন বাংলা উপন্যাসমালায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এভাবেই আজকের ভিন্নধারার উপন্যাস রচনায় উপাদান হিসাবে বারবার ব্যবহৃত হচ্ছে ভারতীয় মহাকাব্যের উপাখ্যান।

বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহলের হালহকিকত যাঁরা খেয়াল করেন, তাঁদের কাছে মহাকাব্যিক আখ্যানকে সমকালীনভাবে উপস্থাপনার নজির কিছু কম নয়। তবু, বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব নন্দনতত্ত্বকে আরও সন্নিবেশিত করার জন্য, আরও সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করার জন্য মহাকাব্যের কোনও বিকল্প নেই। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে উন্নত সমাজের লেখকদের চাইতে এ-ব্যাপারে আমরা সৌভাগ্যবানই বটে।

 

[ক্রমশ]


[1] Bakhtin, M. M. Epics and Novel Toward a Methodology for the Study of the Novel. The Dialogic Imagination, Four Essays. Trans. Emerson, Cary & Holquist, Michael. Ed. Holquist, Michael. Pinnacle Learning, New Delhi. First Printed in India 2014. ISBN 978-93-83848-05-08. পৃঃ ৩।
[2] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৬।
[3] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৬।
[4] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৭।
[5] বেদব্যাস। মহাভারত, আদিপর্ব্ব। অনুবাদ কালীপ্রসন্ন সিংহ। প্রথম খণ্ড। তুলি–কলম, কলকাতা। সপ্তম পরিমার্জিত সংস্করণ জানুয়ারি ২০০৬। পৃঃ ১২৩।
[6] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১২৭।
[7] কালিদাস। অভিজ্ঞান‌্‌ শকুন্তলম‌্‌। অনুবাদ: জ্যোতিভূষণ চাকী। সংস্কৃত সাহিত্যসম্ভার, দ্বিতীয় খণ্ড। নির্বাহী সম্পাদক: প্রসূন বসু। নবপত্র প্রকাশন। কলকাতা। দ্বিতীয় প্রকাশ: ৯ মে ২০১১। পৃষ্ঠা ১০৬।
[8] পূর্বোক্ত। পৃঃ ১১০।
[9] ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ। ঐতিহাসিক উপন্যাস। আশ্বিন ১৩০৫। রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড। ১২৫তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ। বিশ্বভারতী। কলকাতা। পুনর্মুদ্রণ পৌষ ১৪০২। পৃঃ ৬৮৭।
[10] সোম, দেবকুমার। অথঃ মারীচ কথা। প্রতিভাস। কলকাতা। জানুয়ারি, ২০১৯। ISBN 978-93-88735-17-9।
[11] ফিরদাউস, শাহ‌্‌যাদ। ব্যাস। পাঠক সংঘ। কলকাতা। পৃষ্ঠা ৭।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: পুরাণকথা ও বাংলা উপন্যাসের সম্ভাবনা – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...