জল

জল | অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

জল আসছে।

মাঝরাত্তিরে হঠাৎ হাসানের ঘুম ভেঙে গেল। পাশ ফিরে সে দেখল পাশে প্রদ্যুম্ন নেই। প্রদ্যুম্ন আর হাসান একসঙ্গে থাকে। কীভাবে থাকে, কেমন করে থাকে— সেসব প্রসঙ্গ এই গল্পে নিষ্প্রয়োজন। মানুষ, অনেকভাবেই মানুষের পাশে থাকে। একসঙ্গে থাকে, এক-সঙ্গে থাকে। যতই তাতে অন্য কোনও মানুষের চোখ টাটাক না কেন। মানুষেরা এমনই প্রকৃতির হয়। হাসান চকিতে হাত বাড়িয়ে মাথার উপরে নিভিয়ে রাখা লম্ফটাকে ছুঁতে চেষ্টা করল। গায়ের চাদরটা সরিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসতে চেষ্টা করল। কনকনে ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে। দরমার দেওয়াল ফুঁড়ে সেই হাওয়ার দাপট ঘরের একেবারে ভিতরটুকুতে ঢুকে এসে হাসানের হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কার্তিক মাসের শেষ। নদীর জল এখনই যেন জমে গিয়ে বরফের মতো হতে শুরু করেছে। সকাল হলে দেখা যায় ঘাসের উপরে পুরু হয়ে শিশির পড়ে পড়ে জমে রয়েছে। মাটির পথে খালি পা রাখলেই সমস্ত শরীরটাই যেন ছ্যাঁকা লেগে শিরশির করে কেঁপে ওঠে। বাবুরা এই সময় গ্রামের লাগোয়া রিসর্টে বেড়াতে এসে ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়ে ‘টাটকা-নেটিভ’ খেজুর রসের সন্ধান করেন। উলের মোজাতে আর দামী স্নিকার্স জুতোতে তাঁদের পা ঢাকা থাকে। তাঁরা তাঁদের ৬৪ মেগাপিক্সেলের মোবাইল ক্যামেরাতে শিশিরের ছবি তোলেন। হাতে ঠেকান না। হাসান আবারও হাত বাড়ায়… প্রদ্যুম্ন সত্যিই ওর পাশে নেই।

কোথাও বেরিয়েছে। হাসান মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করে। রাত কত এখন? কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী আজ। আকাশে যে একফালি চাঁদ কোনওরকমে টিকে রয়েছে, তার দিকে তাকালে স্বচ্ছন্দেই বলে দেওয়া যায় রাত এখন অনেক। আন্দাজ তিনটে বা সাড়ে তিনটের আশেপাশে তো হবেই। এমন রাত্তিরে প্রদ্যুম্ন কোথায় বেরিয়েছে? তার কি ছোটবাইরে করতে যাওয়ার দরকার হল হঠাৎ? হাসান তবুও জোর করে উঠে বসে। অনেক কষ্টে সে প্রদ্যুম্নকে এতদিনে রাজি করিয়েছে। তিনদিন পরেই তাদের রওনা হতে হবে। এই সময় যদি প্রদ্যুম্ন আবারও বেঁকে বসে হঠাৎ? হাসান মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে। মনের রেষারেষি কি তারও কিছু কম? ভাবনাগুলো পাগলা কুকুরের মতো তার মনের ভিতরটুকুতে, শরীরের ভিতরটুকুতে এধার-ওধার করে বেড়ায়। তবুও হাসান তার মনকে বুঝিয়েছে। এমনটা করা ছাড়া তাদের যে আর কোনও উপায় নেই। হাসান কান পেতে নদীর শব্দ শুনতে চেষ্টা করে। ছলাৎ ছলাৎ জল। হাসান উঠে দাঁড়ায়।

জলের খুব কাছে গিয়ে বসেছিল প্রদ্যুম্ন। একেকটা ঢেউয়ের দোলায় ওর পায়ে, গায়ে জলের ছিটে এসে লাগছিল। চাদরটা মাথার ওপরে মুড়ি দিয়ে, গুটিসুটি মেরে সে বসেছিল। প্রদ্যুম্ন কথা বলে না। আজ অবধি এই গ্রামে কেউ প্রদ্যুম্নকে একটাও কথা বলতে শোনেনি। পনেরো বছর আগে একটা ভেঙে যাওয়া মাছ-ধরা নৌকোতে আধমরা হয়ে ভাসতে ভাসতে সে যখন চরের এই গ্রামটাতে এসে ঠেকেছিল কেউ ভাবতেও পারেনি যে, ও বেঁচে উঠবে। অমন শরীর নিয়ে ও যে কতদিন সেই উত্তাল সমুদ্রে, নদীতে ভাসতে ভাসতে এসেছিল কেউ ঠাহর করতে পারেনি। কেউ কেউ বলেছিল ও বোধহয় শ্রীলঙ্কার মানুষ। কেউ বা বলেছিল অন্ধ্রপ্রদেশ। তামিলনাড়ু, উড়িষ্যার নামও উঠেছিল। আধমরা প্রদ্যুম্ন একটাও কথা বলেনি। নৌকোটাতেও এমন কিছু ছিল না, যা থেকে ওর পরিচয় জানা যেতে পারে। ক্যানিংয়ের এসডিও আপিসে নিয়ে গেলে পরে সেখানকার অফিসারেরাই ওর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রদ্যুম্ন’। কাগজপত্র কিছুই না থাকায় ওর বিষয়ে তাঁরাও বিশেষ কিছু জানতে বা জানাতে পারেননি। বিশাল এই বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত উপকূলভূমির কোন একটি ক্ষুদ্র অংশ থেকে যে সেদিনের সেই অষ্টাদশবর্ষীয় যুবকটি আধভাঙা একটি মাছের নৌকোতে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছিল— সে রহস্য চিরতরে রহস্যই থেকে গেছে। প্রদ্যুম্ন তারপর থেকে এই চরেরই বাসিন্দা। স্থানীয় বাসিন্দাদের জমিতে মুনিষ খেটে দেওয়া, একটু অবস্থাপন্ন যারা, তাদের বাজারদোকান করে দেওয়া, এইসব করেই ওর দিন কাটছিল। এই সময়েই হাসানের নজর পড়ে ওর ওপর। হাসানের জমি ছিল। বাজারে একটা চায়ের দোকানও ছিল। হাসানের মেয়ে-বউ দুজনে দোকানে বসত। হাসান জমি চষত। ধান, সর্ষে, মরসুমি সবজি, যে বছরে যে রকম। লঙ্কা, ধনেপাতা, উচ্ছে, শিম— কোনও একবারে বাঁধাকপিও লাগিয়েছিল। খুব ফলন হয়েছিল সেবার।

হাসান ছুটতে ছুটতে নদীর পাড়ে চলে এসেছে। পাড় বলতে আর কি! তাদের বাড়িও তো নদীর পাড়েই। মাটির বাঁধের ওপর। একেকটা কোটালের সময় জল একেবারে দরজা অবধি উঠে আসে। মাটি ভিজে যায়। উঁচু করে মাটি তুলে তুলে ঘরের চারপাশে একটা চৌকাঠ মতো দিতে চেষ্টা করেছিল ওরা দুজন। বাঁধ টপকে যে জল আসে, তার কাছে আর সেই চৌকাঠ কতটুকু। গ্রামের ভেতরে হাসানের যে বাড়ি ছিল সেই বাড়ি আর নেই। মহাজনকে বেচে দিতে হয়েছে। এখন কেবল নদীর পাশেকার এই এতটুকু একফালি জমি আর দরমার এই ভাঙা ঘরটুকুই ওদের সম্বল। সারারাত ঘরে শুয়ে শুয়ে ওরা নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনে। বর্ষায় ওদের ঘর ভাঙে ফিবছর। কোটালের বড় ভয়ানক রূপ। ফিবর্ষার পরেই ওদের আবার তাই নতুন করে ঘর তুলতে হয়। একফালি জমিতে আর ফসলও তেমন হয় না। মাটি একেবারে নোনা হয়ে গেছে। হাসান চুপিচুপি পিছন থেকে এসে নিঃশব্দে প্রদ্যুম্নের পাশটাতে বসল। দুজনে কেবল ফ্যালফ্যালে একটা দৃষ্টিতে সামনের নদীটার দিকে তাকায়। এই নদীই সব খেয়েছে ওদের জীবনে। গত দশ বছর, তাদের এই চরের আয়তন নাকি ভাঙনের ফলে ২১ শতাংশ কমে গিয়েছে। এতশত অঙ্কের হিসেব ওদের মাথায় ঢোকে না।

জল আসছে।

সেবারে জম্পেশ বাঁধাকপির ফলন হয়েছিল। সেভাবে লাভের মুখ না দেখলেও সুদখোর মহাজনের যাবতীয় সমস্ত পাওনা মিটিয়ে, হাতে তখনও বেশ কিছুটা পয়সা বেঁচেছিল হাসানের।

প্রদ্যুম্নকে হাসলে ভারী সুন্দর দেখায়। ওর এই ব্যবহারের জন্যই হাসানের ওকে পছন্দ হয়েছিল। সকালে হাসানের জমিতে কাজ করত প্রদ্যুম্ন। বিকেলে এসে হাত লাগাত চায়ের দোকানে। টুকিটাকি ফাইফরমাশ— যখন যেটার প্রয়োজন, এইটুকুই। বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছিল বছর না ঘুরতেই। হাসানের মেয়ে প্রদ্যুম্নচাচা বলতে অজ্ঞান ছিল। হাসানের বউয়েরও তাকে ভারী পছন্দ হয়েছিল। সেবারে পুজো হয়েছিল দেরিতে। পুজো মিটতে না মিটতেই রেডিওতে, টিভিতে বলাবলি শুরু হয়েছিল— ঝড় আসছে। বঙ্গোপসাগর ধরে ঝড় আসছে, এবারেও তার অভিমুখ নাকি বাংলার দিকেই। প্রদ্যুম্নের মুখ ভয়ে শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিল। হাসান লক্ষ করেছে, এই পনেরোটা বছর— যে কবারই সাগরে ঝড় এসেছে, প্রদ্যুম্নের মুখে ভয়ের ছাপ পড়েছে। সে ছাপ শুধু ভয়েরই নয়, আতঙ্কের। নিখাদ আতঙ্কের। হাসানের মনে হয়েছে এই ঝড়ের আতঙ্কের সঙ্গেই যেন বা ওর অতীতের কোনও একটা যোগাযোগ আছে। কিন্তু এই বিষয়ে সে বিশেষ কিছুই জেনে উঠতে পারেনি। প্রদ্যুম্ন যে কথাই বলতে পারে না। কেবল ওর মুখের আতঙ্কটুকুই ওর হয়ে কথা বলে। দারুণ ঝড় এসেছিল সেবার।

দু-তিনদিন আগে থেকেই চরের চারপাশে স্পিডবোটে করে পুলিশের লোকেরা টহল দিয়ে গিয়েছিল। মাইকিং করে বলে গিয়েছিল সকলে যেন নতুন ইস্কুলবাড়িটার দোতলায় গিয়ে ওঠে। ঝড় সরে না যাওয়া অবধি কেউ যেন বাড়ি না ফেরে। ঝড়ের আগের দিন লঞ্চে করে জনাদশবারো হলুদ জামা পরা লোক এসে গ্রামের সমস্ত বাড়ি বাড়ি ঘুরে বলে গিয়েছিল ইস্কুলবাড়িতে গিয়ে উঠতে। হাসানেরা কথার অন্যথা করেনি। প্রদ্যুম্ন, হাসান, ওর মেয়েবউরা সবাই ইস্কুলবাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। সারারাত ধরে চলেছিল ঝড়ের দাপট। চরের চারপাশেকার যে বাঁধ, সেই দুর্বল বাঁধকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিয়ে সাগরের নোনাজল ঢুকে এসেছিল চরের একেবারে ভিতর অবধি। একটা জমিও রক্ষা পায়নি। হাসান ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে, একসময় নাকি এই ভাঙা চরই মূল স্থলভূমির অংশ ছিল। কবে যে এই রাক্ষুসে নদী দুপাশ থেকে এসে, সেই জমিরই দুপাশের পাড় ভাঙতে ভাঙতে তাকে চর করে নিয়েছিল, সেও হাসানের ঠাকুর্দা— তার ঠাকুর্দার আমলের কথা। কিন্তু মাটি খুঁড়লে তখনও মিষ্টি জল পাওয়া যেত। নদীর জলও অতটাও নোনা ছিল না। চাষ হত এই চরের জমিতে। কিন্তু গত ক বছর ধরে যে কীসব হয়ে চলেছে। কোটাল হোক, বর্ষা হোক, ঝড় হলে তো আর কথাই নেই— হু হু করে সাগরের জল ঢুকে আসছে জমিতে। চরের প্রায় সমস্ত জমিই এখন চাষের অযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভরসা বলতে নতুন হওয়া রিসর্ট! সেখানে ফাইফরমাশ খাটো। নয়তো নোনাজমিতে নতুন এক ধরনের ধানের বীজ দিয়েছে সরকার। সেই চাষ করো। তাতে লাভ হয় না, উলটে দেনা বাড়ে মহাজনের কাছে। নানারকমের দেনা। দেনার কোনও হিসেব নেই। এই করে করেই প্রথম চায়ের দোকানটা গেল হাসানের। তারপর একে একে সমস্ত জমিটাকেই, ভাগে ভাগে খেপে খেপে বেচে দিতে হল। তারও একবছর পর ইস্কুলে যেতে গিয়ে জলে ডোবা তারে কারেন্ট খেয়ে মেয়েটা মরল যেদিন, মহাজনের কাছে গিয়ে পা জড়িয়ে ধরেছিল হাসান। সেদিন ছিল সুদের কিস্তি দেওয়ার দিন। মহাজন ছাড়েনি। আদ্ধেক টাকা আদায় করে তবে বাকি সুদটুকু সে কেবল সেই মাসের জন্য মকুব করেছিল। প্রদ্যুম্ন পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। ইস্কুলের জন্য এই চরে ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি কোনওদিন। ইলেক্ট্রিসিটি এসেছিল রিসর্ট হওয়ার পরেপরেই। তারই তার ছিঁড়ে পড়েছিল জলের ওপর। আবারও ঝড় এসেছিল সেই বছর।

সবাইকে আবারও সেই হলুদ জামা পরা ছেলেরা ইস্কুলবাড়ির দোতলাতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক রাত্তিরে কেমন করে জানি ঝড় আসার সময় একছুট্টে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল হাসানের বউ। সমুদ্রই তাকে নিয়েছিল। হাসানও আজকাল প্রদ্যুম্নের মতোই কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। দুজনেই এখন সেই নদীর ধারে এসে বসেছে। একেকটা ঢেউয়ের সঙ্গে আলতো করে জলের ছিটে এসে লাগছে ওদের শরীরে। ওরা এই সপ্তাহেই কলকাতা যাবে। এত বড় শহর— সেখানে, দুজন মানুষ কি কুলিগিরিরও দুটো কাজ জুটিয়ে নিতে পারবে না। গ্রামের কতজনই তো এভাবে চলে গেছে। প্রথম গেল সদানন্দ, তারপর চন্দন, একে একে সমীর, বংশী, ইমদাদুল, আসিফ। ওরা এখন কলকাতায় থাকে। কেউ বা বালিগঞ্জে, কেউ বা পার্ক সার্কাসে। বস্তির একেকটা ঘরে গাদাগাদি করে থাকে ওরা, দশজন— পনেরোজন। বংশী নাকি প্লাম্বিংয়ের কাজ শিখেছে। সদানন্দ গ্রিলের মিস্তিরি এখন। ওদের একটা হিল্লে হয়ে গেছে। হাসান বা প্রদ্যুম্নেরও কি সেরকমটা হবে না? তবুও প্রদ্যুম্ন এই চর ছেড়ে যেতে চায় না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে আজকাল সে অন্ধকার নদীটার দিকেই চেয়ে চেয়ে বসে থাকে। কেউ বা যেন আসবে কোনও একদিন। এই নদীপথ বেয়েই। প্রদ্যুম্নের জন্য, হাসানের জন্য। কোনও একসময়। সময় পালটাবেই।

ইস্কুলবাড়ির একতলার বারান্দাতে হনহন করে পায়চারি করছিল হাসান। কাল রাত্তিরে সে কোনওভাবে বুঝিয়েসুঝিয়ে প্রদ্যুম্নকে বাড়ি ফেরাতে পেরেছিল। তারপর ভোর না হতেই আবারও সেই হলুদ জামাপরা ছেলেগুলো লঞ্চে করে এসে নেমেছে। আবারও ঝড় আসছে। আবারও সেই ইস্কুলবাড়ির দোতলাতে গিয়ে থাকতে হবে। গাদাগাদি করে, গবাদি-মানুষের মতো। রাত্তির হলেই কড়াইতে খিচুড়ি চাপবে। হলুদবরণ রং। হাড়শুকনো নয়তো জলজলে একেবারে— তবুও তো খাবার। তাতেই খিদে মিটবে। অনেক মানুষ একসঙ্গে বসে গাদাগাদি করে, ভাগাভাগি করে সেই খাবার খাবে। কারও বা জলের অভাবে পেটখারাপ করবে। আলো জ্বলবে না। ঘন হয়ে আসবে অন্ধকার। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে ওরা শোঁ শোঁ হাওয়ার শব্দ শুনবে। কিন্তু প্রদ্যুম্ন এখনও এল না। হাতের ইশারায় এই আসছি বলে সে চলে গেল। কোথায় যে গেল বুঝিয়ে দিয়েও গেল না। হাসান হনহন করে পায়চারি করে। মনটা কু গাইছে তার।

প্রদ্যুম্ন বিশ্ব-উষ্ণায়ন মানে জানে না। আবহাওয়া-শরণার্থী কাদের বলে জানে না। প্রদ্যুম্ন সেই আধভাঙা নদীবাঁধেরই ওপরে এসে দাঁড়ায়। হাওয়ার তীব্রতা বাড়ছে। জল বাড়ছে। জলের স্রোত বাড়ছে। একটার পরে একটা মিনিট যায়। একটার পরে একটা ঘন্টা। শনশনে হাওয়া আর বৃষ্টিতে সপসপে হয়ে ভিজে গিয়েছে প্রদ্যুম্ন। হাওয়ার তেজ বাড়ছে। অন্ধকারে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রদ্যুম্ন আর বাড়ি ফিরবে না। প্রদ্যুম্নের চোখ বুজে আসে।

এই পনেরোটা বছরে সে অনেক বেঁচেছে, আর তার জীবনের আকাঙ্খা নেই। পূর্বের এক জীবনকে সে এই সমুদ্রেই ভাসিয়ে দিয়ে এসেছিল। নতুন আরেক জীবনকেও সে সমুদ্রে সঁপে দিতে বাধ্য হয়েছে। বাঁধটা ক্রমশই যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাটি ভাঙছে। অনেক দূরে একটা সাদা ফেনার পাহাড় ছুটে আসছে। বিশালাকৃতি একটা ঢেউ। ঝড়ের গতিতে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। বাঁধ ভাঙল। হু হু করে জল ঢুকছে। প্রদ্যুম্নের শরীরটা জলের উপরে গিয়ে পড়েছে। আবারও একটা ঢেউ। ঝকঝকে সকাল।

ক্যানিং বাসস্ট্যান্ডে একটা নতুন রং করা সরকারি বাসের জানলার পাশে বসেছিল হাসান। মালপত্র যেটুকু সে নিয়ে আসতে পেরেছিল পোঁটলা করে সেসব তার পেটের উপরে রাখা রয়েছে। একবাটি মুড়ি আর ঘুগনি দিয়ে সকালের জলখাবার করেছে সে। ঘুগনিটা ভালো ছিল না। বিশ্রী ঢেকুর উঠল একটা। কিন্তু ওর চেয়ে ভালো দোকানে যাওয়ার মতো পয়সা ছিল না তার। কলকাতায় গিয়ে সদানন্দের ওখানে উঠবে বলে ভেবে রেখেছে। কিন্তু হাতে তো সামান্য কিছু হলেও সঞ্চয় রাখতে হবে। সদানন্দের সঙ্গে মাত্র একবারই ফোনে কথা বলতে পেরেছে হাসান। কলকাতাতেও নাকি বিষম ঝড় হয়েছে। কারেন্ট ছিল না অনেকক্ষণ। সদানন্দ বলেছে কোনও মতে চলে তো এসো, তারপর নাহয় ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ‘ব্যবস্থা হয়ে যাবে’, হাসান মনে মনে শব্দগুলোকে নিয়ে ওলটপালট করে। প্রদ্যুম্নকে সে এই কদিনেই প্রায় ভুলে গিয়েছে। প্রদ্যুম্নদের মনে রাখতে নেই। ওতে মনের ভার বাড়ে। হাসানকে যে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। সমুদ্র থেকে দূরে, জল থেকে দূরে, চাষের জমি থেকে দূরে— ঘুপচি দরমার কোনও এক কুঠুরিতে দশজন পনেরোজন এমন নতুন মানুষ, তাদের দলবল-ব্যবসা-কোন্দলের মধ্যে— হাসানকেও যে আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত হাসানদের সবকিছুই শেষ না হয়ে যায়…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4858 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...