চুরি সংক্রান্ত দু-চারটি কথা— যা আমি জেনেছি

শঙ্কর সান্যাল

 



সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

দুর্নীতি জলের মতো, ওপর থেকে নিচে নামে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বলছে গোল্ডরাশ— সোনার খনির সুড়ঙ্গে তারা ঢুকে পড়েছে। সুড়ঙ্গের শেষ কোথায়? কী আছে শেষে? আদৌ কি পিরামিডের চূড়ায় পৌঁছনো সিঁড়িটায় পা রাখা যাবে? নাকি সেখানে কোনও দিল্লিনিবাসী মহাশক্তিমান যক্ষ পাহারা দিচ্ছেন?

 

ধরাধামে প্রথম চুরিটা করেছিলেন প্রমিথিউস। গ্রিক উপকথার বীর নায়ক। স্রেফ একমুঠো ধুলোকে ওয়েপন বানিয়ে দেবতাদের চোখে থ্রো করে দিলেন আর স্বর্গ থেকে আগুন নিয়ে পৃথিবীতে ধাঁ। দেবতারা যখন বুঝতে পারলেন, তখন আর কিচ্ছু করার নেই। প্রথম চুরিটা নিয়ে একটা তর্ক ছিল। তর্কটা বিশ্বজোড়া। বক্তব্য হল, যশোদা মায়ের রান্নাঘর থেকে বালখিল্য কেষ্টঠাকুরই প্রথম ননী-মাখন চুরি করেছিলেন। সাম্প্রতিক এক মার্কিন গবেষণা এ ব্যাপারে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। প্রমিথিউস আগে আগুন না চুরি করলে যশোদা ননী-মাখন বানালেন কী করে? অব্যর্থ প্রশ্ন, অকাট্য যুক্তি। কেষ্টঠাকুর তো ননী-মাখন খেয়ে মুখ ধুয়ে ক্লিন। কেঁদেকেটে বলে দিলেন, “ম্যায় নাহি মাখন খাই”। ব্যস, এপিসোড খতম। কিন্তু সেটা করলেন না প্রমিথিউস। ইওরোপীয়রা বানিয়ার জাত। প্রমিথিউস প্রথমে বেচলেন আগুনের কনসেপ্ট, তারপরে আগুন। দেশে দেশে লোকলস্কর, সৈন্য্যসামন্ত নিয়ে আগুন বেচতে শুরু করলেন। তখন ছিল প্রমিথিউস অ্যান্ড কোম্পানি। রান্নার আগুন চুলোয় যাক— দাঙ্গার আগুন, যুদ্ধের আগুন, অশান্তির আগুনে প্রফিট অনেক বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আগুনট্রেডে বিস্তর প্রফিট করার পরে কনসেপ্টে মৌলিক চেঞ্জ ফেললেন। প্রমিথিউস অ্যান্ড কোম্পানি হয়ে গেল প্রমিথিউস গ্লোবাল ইনকর্পোরেশন। এখন আর সৈন্যসামন্ত লাগে না। “সব ঠাঁই মোর ঘর আছে/আমি সেই ঘর লব খুঁজিয়া”। পাহাড়, বনজঙ্গল, নদী, মাটির ওপরের এবং নিচের যাবতীয় সম্পদ, এমনকী মানুষ এবং মানুষের ভাবনা (ডেটাবেস), সব, সব চুরি হচ্ছে। অকাতরে, নির্বিচারে, আইন করে বিক্রি হচ্ছে চোরাই মাল। ক্রমশই বড় হচ্ছে, আরও বড় হচ্ছে পুঁজিরাক্ষসের হাঁমুখ।

চুরি দুই প্রকারের— ভাবের ঘরে আর বস্তুগত। সংস্কৃত ভাষা লালিত্যে এবং ধ্বনিমাধুর্যে টেক্কা দিয়েছে সব্বাইকে। কুম্ভীলকবৃত্তি মানে ভাবের ঘরে আর চৌর্যবৃত্তি মানে বস্তুগত চুরি। বাংলাভাষা আবার চোরদের প্রতি একটু বেশি সহানুভূতিশীল। আদর করে নাম দিয়েছে ”নিশিকুটুম্ব”। দুনিয়ার ভিতর কুম্ভীলক হিসাবে রবি ঠাকুরের জুড়ি নেই। সেকালে কপিরাইটের বালাই ছিল না কালিদাস থেকে বৈষ্ণব পদকর্তাদের। ছিল না লালন ফকির, হাসন রাজা, গগন হরকরাদেরও। অকাতরে তাঁদের ঝুলিতে হাত ঢুকিয়েছেন রবি ঠাকুর। বাদ দেননি পশ্চিমিদেরও। প্লেটো থেকে ইমানুয়েল কান্ট, আঁরি ব্রেকশ থেকে সিগমন্ড ফ্রয়েড, কাউকে ছাড়েননি। ঠাকুরজীবীরা এবার রে রে করে তেড়ে আসতেই পারেন। বলতেই পারেন, কুম্ভীলকবৃত্তি নয়, রবি ঠাকুর যা করেছেন, সেটা আত্তীকরণ। যাই হোক না কেন, ভাবের ঘর চুরি করুন আর আত্তীকরণ করুন, তার প্রকাশ কিন্তু অসামান্য শিল্পোত্তীর্ণ। এমন করে পাঁজরের এত কাছে কেউই বোধকরি ডাক দিয়ে যায়নি। এখানেই তিনি অনন্য, তিনি রবীন্দ্রনাথ। তবে রবি ঠাকুরের চুরি নিয়ে একটা গভীর অবসেশন ছিল। না হলে শ্যামা লেখেন! চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে। সেই চুরির দায়ে কারান্তরালে মৃত্যুর দিন গুনছেন ভিনদেশি বণিক বজ্রসেন। এই এপিসোডেই এন্ট্রি নিল শ্যামা। তন্বী, শিখরিদশনা, পীনস্তনী সুন্দরী। কড়োরপতি প্রেমিক বজ্রসেনকে তাঁর চাই-ই। তার জন্য প্রাক্তন প্রেমিক “ফেকলু” উত্তীয়কে মুরগি করতেও সে পিছপা হল না। উত্তীয়ও প্রেমের বাড় খেয়ে জহ্লাদের শাণিত অস্ত্রের নিচে মাথা দিয়ে ঘ্যাচাং ফুঃ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে অজস্র ভাবনাকে বিন্যস্ত করেছেন। একটা চুরি। তার কিনারা করতে রাষ্ট্রীয় অকর্মণ্যতা— “চোর চাই যে করেই হোক/হোক না সে যে কোনও লোক”। চুরির সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছেন কাঞ্চন— কড়োরপতি বণিক বজ্রসেন এবং কামিনী— শ্যামা। আর এই গোটা দ্বন্দ্বের মোদ্দা সিনথেসিস হল ফেকলু উত্তীয়র মুরগি হয়ে যাওয়া। হ্যাঁ সেলুকাস, ইহাই সত্য!

এই তো সেদিন মেট্রো সিনেমার সামনে এক ফিচেল বালক ক-য়ের ঘরের নামতা পড়ছিল চিৎকার করে। জনগণও শুনছিল মন দিয়ে— ক এক্কে কুন্তল, ক দুগুণে কাঞ্চন, তিন কয়ে কামিনী, চার কয়ে কালীঘাট, পাঁচ কয়ে কারাগার। এই অবধি বলা ইস্তক এক সিভিক ভলান্টিয়ার প্রমিথিউসের আউটলেট থেকে খানিক কাঁচা আগুন গিলে এসে ফিচেল বালকটির পশ্চাদ্দেশ ডান্ডিয়ে লাল করে দিল। সেই থেকে বালকটি বিবাগী হয়ে ডিএ-র ধর্নামঞ্চ আর চাকরিপ্রার্থীদের ধর্নামঞ্চে বাদামভাজা ফিরি করছে। কেননা এ রাজ্যের কয়েক লক্ষ ইস্কুলছুটের মধ্যে সেও একজন।

মিশরের ফারাওরা পিরামিড বানিয়েছিল বিস্তর মাথা খাটিয়ে। শঙ্কুসদৃশ এক আশ্চর্য স্থাপত্য। সুউচ্চ চূড়া অভ্রংলেহি। সেই থেকেই চলে আসছে পিরামিড শেপ। বেশ নিরাপদ। চুরির ক্ষেত্রেও। চূড়ায় বসে থাকলে ধরাছোঁয়া না-মুমকিন। টারশিয়ারি যুগে প্রবল ভূকম্পে মাটির নিচে চাপা পড়েছিল গাছ। সেটাই এখন ফসিল কার্বন— কয়লা। নদীর স্রোতে, বাতাসের বেগে পাথর চূর্ণ হয়ে বলি হয়ে গিয়েছে। কোনও এককালে অগ্নিস্রাবী গুহামুখ থেকে থেরিয়ে এসেছিল লাভাস্রোত। কালক্রমে শীতল হয়ে পরিণত হয়েছে ব্যাসল্টে। এই সবই এখন পিরামিডের আওতায়। একটু ভুল হয়ে গেল, পিরামিড শেপের আওতায়। অবলা গরু কাতারে কাতারে এক বাংলা সীমান্ত পেরিয়ে আর এক বাংলায় চলে যায়। মানে নিয়ে যাওয়া হয় কসাইয়ের কাতানতলে। এই যাত্রা থুড়ি পাচারও পিরামিড শেপের আওতায়। কয়লা চুরি, বালি চুরি, পাথর চুরি আগে ছিল না, এমনটা বলা যাবে না। আগে ছিল বিক্ষিপ্ত, অসংগঠঠিত। আগে মানে একযুগ আগেও। এখন সংগঠিত, কর্পোরেট ধাঁচে। কয়লা, বালি, পাথর চুরি, এমনকী গরুর সিংয়ের গুঁতোও বাঙালির মোটা চামড়া ভেদ করতে পারেনি। কোনও গাত্রদাহই ছিল না, নেইও। বাঙালির ভাবনা ছিল “এমনি করেই যায় যদি দিন, যাক না”। জাতীয় সম্পদ, পরিবেশ ইত্যাকার ভারি ভাবনায় ভাবিত হতে বাঙালি নারাজ। ঋত্বিক ঘটক বাঙালিকে বলেছিলেন, ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো। কিন্তু বাঙালি ভাবেনি। মাস গেলে পাঁচশো টাকা ভিক্ষা, সস্তা সাইকেল এবং দু টাকা কিলো পোকাধরা চালে “পরান যায় জুড়িয়া রে”। সেই বাঙালিই ভাবতে শুরু করেছে। কখন? না, যখন সে টের পাচ্ছে তার স্বপ্নটাও চুরি হয়ে যাচ্ছে। “ভাবনাতে মোর লাগিয়ে দিলে ঝড়ের হাওয়া”।

বাঙালি বানিয়ার জাত নয়। ইংরেজ আমবাঙালির মজ্জায় কেরানিয়ানা ঢুকিয়ে ছেড়েছে। ধন নয়, মান নয়, করেছিনু আশা/একটা চাকরি আর একটুকু বাসা। এটাই স্বপ্ন। সেই চাকরিটাই চুরি হয়ে গেল, মানে উধাও। সরকারি, বেসরকরি, কোত্থাও কিচ্ছু নেই। ৭২ লক্ষ বাঙালি যুবক-যুবতী অভিবাসী শ্রমিক। হিসাবটা বেসরকারি, সরকারি হিসাবে ৪৫ লক্ষ। চেন্নাই থেকে চণ্ডীগড়, চাষের কাজ, নির্মাণ শিল্প থেকে ম্যানহোল সাফাই পর্যন্ত, সর্বত্রই বাঙালি। কেননা রাজ্যে চাকরি নেই। কথাটা বলা ভুল হল কি? চাকরি  আছে, গোপন কুঠুরিতে চাকরির দোকান। সেখানে লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হয় চাকরি— বাঙালি যুবক-যুবতীর ঈশা-বাস্য-দিবা-নিশা। রীতিমতো রেটকার্ড আছে। নির্বাচনে বুথ দখল করলে হয়তোবা মেলে কিছু ডিসকাউন্ট। বাপের জমি, মায়ের গয়না বেচে চাকরি কেনা যায়। পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলেও চাকরি নেই। বছরের পর বছর অন্তহীন প্রতীক্ষা। পরীক্ষায় শূন্য পেলে, ফেল করলেই চাকরি। গান্ধিছবির জাদুতে শূন্য হয়ে যায় সাতান্ন। আর ন্যায্য চাকরি চেয়ে হাজার হাজার ক্লিষ্ট মুখ ঝড়-বৃষ্টি-শীতের রাতেও রাস্তায়। মুখ্যমন্ত্রী কাঁদছেন। বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা লাশকাটা ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বলে নয়, প্রতিদিন আদালতের ছুরিকাঁচিতে তার  ময়নাতদন্ত হচ্ছে বলে নয়, ফেলারু চাকরিক্রেতাদের চাকরি যাচ্ছে বলে। গত এক দশকে বাংলায় যত পড়ুয়া মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের অ্যাডমিট ও মার্কশিটে  যাঁদের সাক্ষর রয়েছে, এখন তাঁরা প্রত্যেকেই জেলের ভাত খাচ্ছেন। “অলীক কুনাট্য রঙ্গে/মজে মন রাঢ় বঙ্গে”।

একটা সুপরিকল্পিত, জমাট, ঠাসবুনোট চিত্রনাট্য। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। যা আলফ্রেড হিচকককেও লজ্জা দিতে পারে। রাজ্যজুড়ে ছড়ানো এজেন্টবাহিনি। শিক্ষক শিক্ষণ কলেজগুলিতে স্বপ্নের হাতছানি। পরীক্ষায় বসলেই হবে, পাশ-ফেলে কিছু যায় আসে না। স্বপ্ন ভাসে বাতাসে। টাকা দিলেই হস্তগত অধরা মাধুরী। টাকার হিসাব নেই। টাকা কি নিচের তলাতেই? অসম্ভব। দুর্নীতি জলের মতো, ওপর থেকে নিচে নামে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বলছে গোল্ডরাশ— সোনার খনির সুড়ঙ্গে তারা ঢুকে পড়েছে। সুড়ঙ্গের শেষ কোথায়? কী আছে শেষে? আদৌ কি পিরামিডের চূড়ায় পৌঁছনো সিঁড়িটায় পা রাখা যাবে? নাকি সেখানে কোনও দিল্লিনিবাসী মহাশক্তিমান যক্ষ পাহারা দিচ্ছেন? শিক্ষাঙ্গণে দুর্নীতি খোঁজার নির্দেশ ছিল কলকাতা হাইকোর্টের। এখন ইস্কুল ছাড়িয়ে পিরামিডের সুড়ঙ্গ ঢুকে পড়েছে পুরসভাতেও। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পুরসভার সংখ্যা। প্রতিদিনই এমন সব নাম উঠে আসছে, যে সব নাম অশ্রুতপূর্ব। মন্ত্রী, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দুটি ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গেল নগদ ৫০ কোটি টাকা আর পাঁচ কিলো সোনার গয়না। আমবাঙালি এত নগদ একসঙ্গে দেখেনি। হতচকিত হয়ে গেল। তারপরে শুধুই টাকার হিসাব। লক্ষে নয়, কোটিতে। শান্তনু, কুন্তল, অয়ন, তাপসরা পিরামিডের নিচের তলার বাসিন্দা। তাদের হাতেও এত কোটি, তাহলে পিরামিডের চূড়ায় কত? সেই হিসাবটা কি কোনওদিনই পাওয়া যাবে? বলা মুশকিল, কেননা হিসাবটা নিহিত আছে রাজনীতির জটিল অঙ্কে— তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠানামার অথবা কালনেমির পিঠে ভাগের অঙ্কে।

মুন্নি বদনাম হুই, ডার্লিং তেরে লিয়ে— যাঁরা যাঁরা জেলের ভাত খাচ্ছেন বা আগামীদিনে খাবেন, তাঁদের উদ্দেশ করে এটাই এখন তৃণমূলের জাতীয় সঙ্গীত। পার্থ সবান্ধবী আর মানিক ভট্টাচার্য সপরিবার জেলে। সেই যে কেষ্ট মণ্ডল, চড়াম চড়াম ঢাক বাজিয়ে গুড়-বাতাসা খাওয়াতে উন্নয়ন হয়ে রাস্তায় দাঁড়াতেন, তাঁরও মগজে কি অক্সিজেন কিছু কম পড়িয়াছে?— “ফিসচুলা ফেটে গিয়েছে স্যার।” মানি লন্ডারিং— সহজ কথায় কালো টাকা সাদা করা। গাড়ির চালক, বাড়ির পাচক, ঘাটের রজক, কার না অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়নি? মেয়ের চাকরি, সেটাও বেআইনি। বীরভূমে প্রচলিত প্রবাদ, কেষ্ট মণ্ডলের জমির সীমানা দেখতে হয় দূরবীন দিয়ে। গণ্ডাখানেক চালকল। বোলপুরে নিচুপট্টির বাজারে মাগুরমাছ বেচতে বেচতে কেষ্ট মণ্ডল কি কোনওদিন ভেবেছিলেন মেয়ের তিন কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট থাকবে! মানিক ভট্টাচার্য, বিধায়ক তৃণমূলের, শিক্ষাকর্তা, পদ ছাড়তে হয় হাইকোর্টের নির্দেশে, এখন সপরিবার জেলে। চাকরি চুরির টাকা কোথায় রাখবেন ঠিক করতে না পেরে বিশ্বভ্রমণ করে ফেলেছেন সপরিবার। শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, হুগলির বাইরে কি কদিন আগেও কেউ তাঁর নাম জানত? কুন্তল ঘোষ, তাপস মণ্ডল, অয়ন শীল— কতই না ছুপা রুস্তম বিরাজ করছেন এই বঙ্গে! এ তো গেল কেষ্টবিষ্টুদের গল্প। কিন্তু এর বাইরেও, আচমকা একটি স্করপিও এসে দাঁড়ায় পাড়ার চায়ের দোকানে। গাড়ি থেকে যিনি অবতীর্ণ হলেন, তিনি সাদা কুর্তা-পাজামা শোভিত। পদযুগল আবৃত নাইকির সাদা স্নিকারে। আঁখিপটে রে ব্যান। কুকুরবাঁধা শেকলের মতো সোনার হার গলায়, হাতে হাতকড়ার মতো। অবতীর্ণ হয়েই ঘোয়ণা করলেন, কাতারে যাচ্ছি বিশ্বকাপ দেখতে। ইনি কাউন্সিলার। একদা এঁর পিতৃদেব ভাঙা সাইকেল চালিয়ে মুদির দোকানে যেতেন খাতা  লিখতে। ইনি ক্লাস নাইনে স্কুলছুটদের তালিকায় নাম লেখান। চাকরি তো দূরের কথা, হকারিও করেননি কোনওদিন। রাজনীতি করেছেন— তৃণমূল। এত টাকার উৎস কী? কেডা জানতি চাবে, পরানের ভয় নাই?

আনি মানি জানি না। বাতাস বড্ড ভারি নামের প্রাবল্যে। কত নাম উড়ছে— বনি-কৌশানি, আরও কত পদ্মিনী, শঙ্খিনী, চিত্রিনীদের নাম। কাঞ্চন থাকলেই কামিনীর এন্ট্রি। জমজমাট এপিসোড। চাকরি চুরির ট্রলি গড়গড়িয়ে ঢুকে গিয়েছে টলিউডের অন্দরে। কালো কালো গান্ধিছবি ঢুকে গিয়ে নিমেষে বেরিয়ে আসছে সাদা হয়ে—অজস্র, অপার, অগণন। কোনও চুক্তি নেই, চিত্রনাট্য নেই, টাকার পাহাড় পৌঁছে গেল অভিনেতার কাছে। একটা ঘটনা সামনে এসেছে, কিন্তু এটা কি একমাত্র ঘটনা? সন্দেহ প্রবলতর। আমাদের দেখতে হবে না তো নামাবলী শরীরে জড়িয়ে গোয়েন্দারা আদালতে যাচ্ছেন! নিলাদ্রি দাসকে যখন দেখি, বড় অসহায় লাগে। এই ব্যক্তিটি নাইসা নামে একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট। শিক্ষা দফতর ওই সংস্থাকেই বরাত দিয়েছিল চাকরির পরীক্ষার্থীদের ওএমআর শিট প্রস্তুতের। নিলাদ্রি গ্রেফতার হয়েছেন। অভিযোগ, টাকা নিয়ে বদলে দিয়েছেন ওএমআর শিটে প্রাপ্ত নম্বর। কী ভেবেছিলেন, কাকপক্ষীও টের পাবে না? এটাই অবশ্য অপরাধীদের কমন সাইকোলজি।

এবার একদম শেষে, “বড় বিস্ময় লাগে”, হতবাক হয়ে যাই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, তিনি আবার পুলিশমন্ত্রীও, কিচ্ছু জানতে পারলেন না? গত একযুগ ধরে একটি নির্ভেজাল সংগঠিত অপরাধচক্র শয়ে শয়ে কোটি টাকার চাকরি-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। নগদে, ব্যাঙ্কে, সোনায়, সম্পত্তিতে, সিনেমা শিল্পে, নির্মাণ শিল্পে সেই টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে। সত্যিই কি কিছু জানতেন না? চাকরিপ্রার্থীরা যদি মামলা না করতেন, আদালত যদি তদন্তের নির্দেশ না দিত, তাহলে আমবাঙালির অগোচরেই থেকে যেত এই রোমহর্ষক ক্রাইম থ্রিলার। বাঙালি জানতেও পারত না তাদের কয়েক প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে কোন কোন মহারথী টুকি করে দিয়েছেন। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী একজন নির্ভেজাল সরলমতি মহিলা, ভাজা মাছটি উল্টিয়ে খেতে জানেন না, তাহলে তো অযোগ্যতা এবং অকর্মণ্যতার জন্য তাঁর একমুহূর্তও মুখ্যমন্ত্রী থাকার অধিকার নেই। আর যদি এমনটা হয় যে, সব জেনেও নিবিড় প্রশ্রয়ে তিনি আঁখিপল্লব মুদিত রেখেছিলেন, তাহলে আবার রবি ঠাকুরের শরণাপন্ন হতে হয়— “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে”।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. রবি ঠাকুর বেঁচে থাকলে আজ বোধহয় লিখতেন, “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে / তব ঘৃণা তারে যেন তৃণমূলো কহে”।

Leave a Reply to Hirak Sengupta Cancel reply