আলিউজ্জামান ও রঘু জাগুলীয়ার কবিতা: আমার আগ্রহের কারণ

অভিষেক ঝা

 

…আলিউজ্জামান ও রঘু দুজনে ভিন্ন প্রেক্ষিতের ভূ-রাজনৈতিক পরিসরের মানুষ। তাঁদের লেখায় ছাগলের রেফারেন্সের সঙ্গে জবাইয়ের আন্তঃযোগসূত্র আমাকে ভাবতে বাধ্য করে। ছাগল জবাইয়ের সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্ব জুড়ে দেওয়ার উল্লেখ প্রচুর করেছেন অসমের মিঞা কবিরা, বিশেষ করে ছেলিম এম হুছেইন। কিন্তু ছেলিমের প্রেক্ষিত বাংলার এই দুজন কবির থেকে আলাদা। যোগসূত্রটি কী ভাবতে গিয়ে আমি বাধ্য হই আলিউজ্জামান, রঘু এবং ছেলিমের পরিচয়ের দিকে তাকাতে। একই সঙ্গে মনে পড়ে বাংলা ভাষার গল্পকার সাদিক হোসেনের লেখা কবিতার বই ‘কাটা কবিতাগুচ্ছ ও হরিমলপুর’-এর কবিতাগুলির কথা।…

 

বইমেলার উইশলিস্ট মূলত একজন পাঠকের সঙ্গে একজন লেখকের এতদিনের সম্পর্কের লগবুক। কখনও কখনও এই তালিকায় ব্যক্তিগত সূত্রে পরিচিত নতুন লেখকের বই ঢুকে পড়ে। ফলত পাঠক হিসেবে আমার কাছে এখনও অজানা এমন লেখকের খুব ভাল লেখা এই তালিকায় কখনওই থাকে না। এই বইমেলাতেও আমি আমার পাঠাভ্যাসের রুচি অনুযায়ী বইদের তালিকা তৈরি করছি। যাঁদের কোনও-না-কোনও বই এই বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি তাঁদের ভিতর আমার পছন্দের লেখকতালিকায় লুৎফর রহমান, শৌভ চট্টোপাধ্যায়, মণিশংকর বিশ্বাস, কৌশিক বাজারী, কবি রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, ভিক্টর ভৌমিক, পবিত্র সাঁফুই, অলোকপর্ণারা রয়েছেন তাঁদের আগের লেখাপত্র ভাল লাগার সূত্রেই। লোকসংস্কৃতি নিয়ে সুব্রত ঘোষের আগের বই ‘ক্ষ্যাপা খুঁজে মরে’ এত ভাল লেগেছিল যে সুব্রতবাবুর নেওয়া বিভিন্ন লোকশিল্পীর সাক্ষাৎকার সঙ্কলনটির অপেক্ষায় রয়েছি। শুভ আঢ্য, নীলাঞ্জন দরিপা, তৃষা চক্রবর্তী, সুমন সাধুর কবিতা ভাল লাগে, তাই তাঁদের বই নিয়েও আগ্রহ রয়েছে। সেঁজুতি দত্তের দু-একটি গল্প পড়ার সুযোগ হয়েছে বলেই তাঁর প্রথম গল্প সঙ্কলন ‘ক্যাসান্ড্রার প্রলাপ’ অবশ্যই কিনব। বইমেলায় প্রকাশিত না হলেও বইমেলার ঠিক আগেই হাতে এসেছে সব্যসাচী সান্যালের কবিতার বইয়ের পিডিএফ ‘ক্ষ অক্ষর’। এই বইটিও বইমেলার উইশলিস্টের বই হিসেবেই ধরব। তবে এঁরা যেহেতু প্রত্যেকেই লেখক, কবি এবং চিন্তক হিসেবে নিজেদের লেখার ধারাটিকে পাঠক হিসাবে আমার কাছে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন, তাই এঁদের কাউকে নিয়েই আমি এই লেখায় বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। আমার উইশলিস্টে থাকা বইগুলির মধ্যে দুইজনের প্রথম বই প্রকাশিত হবে এই বইমেলায়। তাঁদেরকে কেন পড়তে ভাল লাগে আমার, তা জানাতেই এই লেখা।

মাত্র একটি বই কেনার অপশনও যদি থাকে, তবুও আমি যে-কোনওভাবে দুটি কবিতার বই অবশ্যই কিনব এই বইমেলায়। আলিউজ্জামানের ‘বহুগামী বারুদের ঘোড়া’ এবং রঘু জাগুলীয়ার ‘রঙ-বেরঙের কাজ’। বইগুলির প্রকাশক ‘মুক্তাঞ্চল’। দুজনেরই এটি প্রথম বই। আলিউজ্জামানের কবিতা প্রথম পড়েছিলাম অপরজন ওয়েবজিনে সম্ভবত দু-হাজার একুশ-বাইশ নাগাদ, কুড়িও হতে পারে। তারপর দু-হাজার তেইশের সেপ্টেম্বরে আলিউজ্জামান বেশ কিছু কবিতা আমায় মেসেঞ্জারে পাঠান। কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে প্রথমেই একটা ব্যাপার বেজায় ভাল লেগে যায় আমার। আলিউজ্জামানের কোনও সারল্য নেই— এটাই কারও কবিতা ভাল লাগাবার পক্ষে যথেষ্ট কারণ। এক সহজ ভাষায় কবিতা লিখে চলেন তিনি। খুব সহজে নিজের অস্তিত্বকে “এক চোখ নেভা আলাদা ছাগল” হিসাবে জানান দিয়েই পরের লাইন হয়ে যায় “নিবিষ্ট দাঁতের হিম্মতে টানছি নিরাকার ঘাস”। সেই হিম্মতই কবিতার শেষ অংশে গিয়ে অস্তিত্বকে কোরবানি-যোগ্য করে তোলে এবং ছোরার নিচে থলথলে গলা নিয়ে সেই অস্তিত্ব কত সহজে উচ্চারণ করে বসে, “তুমি তো জানো মালিক, আমার জন্মানো শুধু সৃষ্টির তাড়নায়”। আলিউজ্জামানের কবিতার ভাষা সদর্থকভাবে বাঙালির ভাষা। তাই দ্বিধাহীনভাবে তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি সমস্ত কিছুর সংশ্লেষ ঘটাতে পারে তাঁর কবিতা। একই কবিতায় ‘ভিন্টেজ বৈশাখ’-এর পাশে ‘অনলসম মীন অরণ্য’ এবং ‘লাম আলিফ হামজা ইয়াসহ দ্বীনের মোহর’ চলে আসে। “মোনাজাত কালে” চলে আসে “দৈবক্রমে ভুলে থাকা কোহেন কোহেন ওয়েদার”। এবং এগুলি কবিতাগুলি আনছে কীসের প্রেক্ষিতে? কখনও মৃত্যুর অধিক মৃত্যু পাওয়ার ইচ্ছায় ‘সদ্য ধারে কিনে আনা সোনামুগডাল’-এর পরিসরের প্রেক্ষিতে, কখনও আবার জলমুগ্ধ অ্যাকুরিয়াম থেকে লাফিয়ে ওঠা আসন্ন জন্মমাসের প্রেক্ষিতে। আলিউজ্জামান যে-কোনও শব্দকেই কবিতায় অনায়াসে আঁটিয়ে দিতে পারেন। তাঁর অবচেতনে কোনও দ্বিধা কাজ করে না। একই কবিতা সিরিজে ‘উর্ণজাল’, ‘বালিকার মর্মে দুলে ওঠা’, ‘অবনত নদী’র পাশাপাশি ‘টুটাফাটা কিউব’, ‘পাপা ডাকা বয়’, ‘উপাসনাহীন কিবলামুখী’ শব্দবন্ধ পাশাপাশি কোনও জড়তা ছাড়া ব্যবহার করেন তিনি। ফলে বাঙালিয়ানার এক অনাবিল পরিসর তৈরি হয় যেখানে নিজের বাড়ির উঠোনের কাছের জলা থেকে মহাসিন্ধুর কাঠ খুঁজে পাওয়ার ক্ষমতা রাখে আলিউজ্জামানের কবিতা। যে-কবি প্রথম বই প্রকাশিত হওয়ার আগেই বহুস্তরীয় বাঙালি চর্চাটি নিরলসভাবে আয়ত্ত করার কাজে নিমগ্ন তাঁর প্রথম বই প্রকাশ হতে দেখা খুবই আনন্দের।

রঘু জাগুলীয়ার কবিতা পড়তে শুরু করি দু-হাজার কুড়ি সাল নাগাদ। তবুও প্রয়াসের ওয়েবজিন, দুনিয়াদারি ওয়েবজিন, আপনপাঠ ওয়েবজিন এইসব জায়গাতেই আমি রঘুকে পড়েছি। রঘুর কবিতার ভাষা এই পাঁচ বছরে যেভাবে পাল্টেছে তা চমকে দেওয়ার মতো। নন্দনতত্ত্বের রাজনীতি খুব গভীর না হলে কেউ উচ্চারণ করতে পারেন না, “আমি এর থেকেও নিচে নেমে কবিতা লিখবো। শুধু আমার পরিসরকে বলার জন্য…”। পার্থিব পত্রিকায় প্রকাশিত তার ‘পরিচয় নিয়ে’ শিরোনামে লেখা একগুচ্ছ কবিতার ভিতর দিয়ে রঘুর ‘নিচে নামা’র স্বর সুস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। প্রথম কবিতায় মেঘের দুটো আঙুলের ফাঁক দিয়ে যে আলো এসে পড়ে তাতে না শেষ হওয়া মাঠের দিকে তাকাতে বলা হচ্ছে। দ্বিতীয় কবিতায় এসে লুঙ্গির গিঁটে কাঁচি ঘুমিয়ে থাকে। তারপরেই খালি গায়ে ছাগলব্যাপারীদের চলে যাওয়ার একটা উল্লেখ আসে যেখানে ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে এসে মিশে ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে বলি হওয়া ছাগলদের কাটা মুণ্ডু।

আলিউজ্জামান ও রঘু দুজনে ভিন্ন প্রেক্ষিতের ভূ-রাজনৈতিক পরিসরের মানুষ। তাঁদের লেখায় ছাগলের রেফারেন্সের সঙ্গে জবাইয়ের আন্তঃযোগসূত্র আমাকে ভাবতে বাধ্য করে। ছাগল জবাইয়ের সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্ব জুড়ে দেওয়ার উল্লেখ প্রচুর করেছেন অসমের মিঞা কবিরা, বিশেষ করে ছেলিম এম হুছেইন। কিন্তু ছেলিমের প্রেক্ষিত বাংলার এই দুজন কবির থেকে আলাদা। যোগসূত্রটি কী ভাবতে গিয়ে আমি বাধ্য হই আলিউজ্জামান, রঘু এবং ছেলিমের পরিচয়ের দিকে তাকাতে। একই সঙ্গে মনে পড়ে বাংলা ভাষার গল্পকার সাদিক হোসেনের লেখা কবিতার বই ‘কাটা কবিতাগুচ্ছ ও হরিমলপুর’-এর কবিতাগুলির কথা। রঘুর কবিতার দিকে আরও একটু মন দিয়ে তাকাই এবং দেখি উল্লেখিত কবিতাটির পরের কবিতাতেই স্টেটমেন্ট দেওয়ার ভঙ্গিতে জানানো হচ্ছে, “হেঁতালবন হোক আর/ হংসচরিত গাঁ;/শূদ্রপাখিদের রৌদ্রে গলা শুকায়/বাবুলোকে বলে ওদের মুখ থেকে/পিত্তের গন্ধ বের হয়”। সমালোচনা শাস্ত্রে আমার পুঁথিগত ট্রেনিং আমাকে পথ দেখাতে পারে না। একে আমি কনফেশনাল বলব, নাকি টেস্টিমনিই? নাকি দুটোর একটা দিয়েও এই সহজ সত্যিটাকে ধরা যাবে না। তাহলে কি রঘু শরণকুমার লিম্বালে বর্ণিত সেই দশম ও একাদশ রস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যাকে আলোচনার সুবিধার্থে ‘দলিত সত্তাজাত রস’ বলে চিহ্নিত করতে পারি? শূদ্রপাখি বলতে গেলেন কেন রঘু হঠাৎ? ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’তে বিনয় মজুমদার এক নতুন ধরনের পাখি দেখতে পেতেন ঙ বা ঞ দিয়ে কোনও শব্দ শুরু করতে পারলে। রঘু কি সেই ঙ বা ঞ পাখির রূপক বাদ দিয়ে একদম সরাসরি শূদ্রপাখির উল্লেখ করলেন যা বিনয়ের ফোনেটিক্যাল অস্বস্তি ছাড়িয়ে সামাজিক অস্বস্তি হয়ে উঠছে পাঠকের কাছে? এটাই কি তাহলে ‘নিচে নামার’ কবিতার পরিসর? অসম্ভব অস্বস্তি নিয়ে তাকাতে দেখি ক্রোধকে কত নগণ্য হিসেবে দেখছে রঘুর কবিতা: “সামান্য দেশলাই কাঠি, অর্ধদগ্ধ হয়ে এখন/পেচ্ছাপখানায় শুয়ে আছে”। ‘নিচে নামা’র কবিতাদের নিয়ে আমার আগ্রহ বড় প্রবল কারণ ‘পরিচয় নিয়ে’ সিরিজের শেষে গিয়ে রঘু কুসুমপুরের মাঠ থেকে দু-বেলা যে আলো আসে তার সঙ্গে ফিরতে চাইছেন। দু-বেলার আলো যা দিনকে মহিমান্বিত করে না, আবার দিনকে গুরুত্বহীনও ভাবে না। প্রাত্যহিকতাকে যে-কবি দু-বেলার আলো হিসেবে দেখতে পারেন তাঁর দলিত পরিচয়টি নিয়ে গভীরে যাওয়ার পর, তাঁর প্রথম কবিতার বই নিয়ে আমার প্রবল আগ্রহ রয়েছে। ‘মুক্তাঞ্চল’কে ধন্যবাদ এত শক্তিশালী স্বরের অধিকারী দুইজন কবিকে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. আলিউজ্জামান এখনও পড়া হয়নি। তবে রঘু এক আবিষ্কার!

আপনার মতামত...