দেশের ইতিহাসের প্রচলিত পাঠকে ছুড়ে ফেলে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো এক বই

শুভ্র মৈত্র

 

…এসব কথা দিব্যি রেখে দেওয়া যায় চাদরের তলায়, একটা মেক-বিলিফ জগতে ডুবে থাকা যায়, করা যায় শখের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা। এসবই হতে পারত যদি না হাতে একটা ‘সনাতন’ এসে পড়ে। মারাঠি শরনকুমার লিম্বালে এর আগেই ‘বেজন্মা’ লিখে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন পাঠককে। আর এবার দেশের ইতিহাসের প্রচলিত পাঠকে ছুড়ে ফেলে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে বসেছেন। আর কে না জানে পেঁয়াজ চোখে জ্বালা ধরায়। লিম্বালে জ্বালিয়েছেন এক আলো যা একইসঙ্গে অদৃশ্য আর বিকশিত ইন্ডিয়ার আড়ালে পড়ে থাকা অন্ধকার ভারতকে দেখার জন্য অনির্বাণ শিখা।…

 

খবরটা স্থান পাওয়ার কথা ছিল ভেতরের পাতায়, পেয়েছেও তাই। দলের জেলা সম্পাদক হলেন দেবলীনা হেমব্রম। একে নারী, তায় আদিবাসী। বঙ্গজ কম্যুনিস্ট পার্টির ইতিহাসে ব্যতিক্রমী, সন্দেহ নেই। যে দলের ক্ষমতাচ্যুতির বয়স হতে চলল প্রায় রামের বনবাসের সমান, যার আশু ক্ষমতালাভের কোনও ইঙ্গিতও নেই, সংবাদমাধ্যম যদি তার খবরকে ভেতরের পাতায় জায়গা দেয়, তাহলে তা কতটা দোষের তা নিয়ে চর্চা চলুক। কিন্তু দুই হাজার এগারোর আগেও যে দলের সর্বোচ্চ পদে বামুন-কায়েত ছাড়া কাউকে দেখা যেত না, সেই সত্যিটা কারও মনে চলে আসতে পারে।

ঘোষিত কোনও অ্যাজেন্ডা ছিল না, শ্রেণিসংগ্রামের পাঠে কোনওদিন এ-রাজ্যে জাতপাতের কথা শোনা যায়নি শাসকের গলায়। ‘আমাদের বাংলায় ওসব নেই’-এর মতো এক আরোপিত মোহে কাটাতেই ভালবাসে মধ্যবিত্ত বাঙালি।

অথচ কী সুতীব্র বাস্তবতা বাঙালির বর্ণচেতনা! কারও নাম জানাই সম্পূর্ণ হয় না, তার উপাধি না জেনে। কোন জাত? সংরক্ষণের প্রশ্নে আরও উচ্চকিত হয় সেই চেতনা। উচ্চবর্ণের আধিপত্য এ-রাজ্যের দক্ষিণপন্থী দলগুলির মধ্যে একচেটিয়া ছিলই, আজও তার কিছুমাত্র ব্যত্যয় ঘটেনি। কংগ্রেস বা আজকের তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে তাকালেই তার আভাস মেলে। কিন্তু তথাকথিত বামপন্থী দলগুলির দিকে তাকালেও কোনও ভিন্ন চরিত্র পাওয়া যায়নি, সেটা খুব নির্মম সত্যি।

এসব কথা দিব্যি রেখে দেওয়া যায় চাদরের তলায়, একটা মেক-বিলিফ জগতে ডুবে থাকা যায়, করা যায় শখের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা। এসবই হতে পারত যদি না হাতে একটা ‘সনাতন’ এসে পড়ে। মারাঠি শরনকুমার লিম্বালে এর আগেই ‘বেজন্মা’ লিখে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন পাঠককে। আর এবার দেশের ইতিহাসের প্রচলিত পাঠকে ছুড়ে ফেলে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে বসেছেন। আর কে না জানে পেঁয়াজ চোখে জ্বালা ধরায়। লিম্বালে জ্বালিয়েছেন এক আলো যা একইসঙ্গে অদৃশ্য আর বিকশিত ইন্ডিয়ার আড়ালে পড়ে থাকা অন্ধকার ভারতকে দেখার জন্য অনির্বাণ শিখা।

যারা রোজকার পুরীষ পরিষ্কার না করলে, মরা পশু না সরালে, রাত জেগে পাহারা না দিলে সমাজ একদিনও চলতে পারে না, সেই সমাজ তাদের অস্পৃশ্য করে রাখে। এবং মাহাররা মেনেও নেয় তা, কারণ দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কার যা শিখিয়েছিল পূর্বজন্মের কর্মের ফলেই তাদের এই জীবন। মাহারদের ওপর নির্মম অত্যাচারের কাহিনি পড়তে কষ্ট হয়। তার জন্য লেখক কোনও পেলব বিবরণের ধার ধারেননি। ধাক্কাটাই দিতে চেয়েছেন। কিন্তু এই অত্যাচারের থেকেও যেটা অসহনীয় তা হল উচ্চবর্ণের হাতে এই অত্যাচার মাহারদের নীরবে মেনে নেওয়া। যাদের ছায়া অস্পৃশ্য, নির্বিবাদে যারা মেনে নেয় গলায় ঝোলানো পাত্র আর পেছনে বেঁধে রাখা ঝাঁটা-র প্রাত্যহিক জীবন, যাতে থুথু বাইরে না পড়ে আর পায়ের ছাপের কলুষ মুছে দেওয়া যায়— তাদেরকে নির্মম প্রহার করেই তো গ্রামের চোখে নায়ক হওয়া যায়। মৃত্যুতেও তাদের মুক্তির প্রশ্ন নেই, মৃতদেহ সৎকার করার জন্যও জমি দেওয়া হয় না তাদের।

না, কোনও বিদ্রোহের ছবি আঁকতে চায়নি ‘সনাতন’, ইচ্ছাপূরণের কোনও রূপকথাও নেই এখানে, বরং লিম্বালে শুধু উদাসীন ভঙ্গিতে এঁকে চলেছে এক ইতিহাস, যা আমাদের পাঠ্যে নেই। ব্রিটিশ উপনিবেশের যে একমাত্র অত্যাচারী এবং শোষকের চেহারা আমরা দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, মাহারদের কাছে তারাই এসেছিল মেসিহা হয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেনাবাহিনিতে নিয়োগ করছে অস্পৃশ্যদের, এ যেন এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন। বা, মৃত গরুর মাংসে যেদিন মাহার পল্লীতে আসে উৎসবের আলো, সেদিনই সেই গরুকে ইচ্ছে করে মেরে ফেলার দায়ে তাদের ওপর অত্যাচার নেমে আসে— তখন রক্ষাকর্তা হয় মুসলিমরা, জাতপাতের শিকলে দমবন্ধ মাহার যুবকেরা খ্রিস্টান বা মুসলিম হওয়ার মধ্যে নিজেদের মুক্তি খোঁজে।

কিন্তু লেখক জানেন, ধর্মান্তর শুধু ধর্ম পাল্টায়, উপাস্য দেবতার নাম পরিবর্তন করে, কিন্তু পরিচয় পাল্টাতে পারে না। তাই ভীমনাক বা সিদনাক ভিনধর্মে গিয়েও খ্রিস্টান বা মুসলিমদের কাছে ব্রাত্য হয়ে থাকে, ফিরে আসতে পারে না নিজের ধর্মেও।

আসলে ধর্মই যে যাবতীয় কষ্টের মূলে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে আমরাও বুঝতে পারি, ধর্ম যদি কেড়ে নেয় মানুষের সত্তা, ক্ষমতা কাড়ে তার অধিকার। সেই কারণেই গল্প রচিত হয় পূর্বজন্মের, ঈশ্বরের অভিশাপের। অভিশপ্তদের বিরুদ্ধে প্রকল্পের রূপায়ণে আগ্রাসী ভূমিকা নেয় ক্ষমতা।

ঊনবিংশ শতকের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসে এসেছে সমকালের সিপাহি বিদ্রোহ, মঙ্গল পান্ডে বা ঝাঁসির রানিকে নিয়ে মিথের পেছনে বাস্তবতা। এসেছে জ্যোতিবা ফুলে বা ভীমরাও আম্বেদকরও। মাহারদের এই অত্যাচারে বেঁচে থাকার কথা বলতে গিয়ে লেখক সামগ্রিক দলিত জীবনের ছবিটাই আঁকতে চেয়েছেন। যার কোথাও আছে দলিত রমণীদের ইচ্ছেমতো ধর্ষণের অধিকার, কোথাও তাদের বুক ঢেকে রাখায় নিষেধাজ্ঞা বা অরণ্য থেকে গোটা সম্প্রদায়কে উৎখাত করার চিহ্ন। কোনও চটজলদি সমাধান দেওয়ার দায় ছিল না লেখকের, বরং, যতদিন দলিতদের গল্প দলিতরা নিজেরাই না লিখছে, ততদিন তাদের উঁচুজাতের জয়গান গেয়ে যাওয়াটাই ভবিতব্য।

উপন্যাস হিসেবে প্রায় ডকুমেন্টারি হতে চাওয়া ‘সনাতন’ কতটা সার্থক তা বিচার করবেন সাহিত্য সমালোচকরা, কিন্তু লেখক যে ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছিলেন, বিঘ্ন ঘটাতে চেয়েছিলেন এই আপাত শান্তি-কল্যাণ-উন্নয়নের মডেলে— তাতে তিনি সার্থক, সন্দেহ নেই।

আর হ্যাঁ, ভিনরাজ্যের গল্প পড়ার সুখ পাওয়ার জন্য এই উপন্যাসে মুখ না গোঁজাই বাঞ্ছনীয়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...