
স্বাতী মৈত্র
…অগোছালো পাঠের সকল দোষেই আমি দুষ্ট। পড়তে চাই বলে না পড়ে কম বই তো ফেলে রাখিনি। বইয়ের তাক থেকে মাঝেমাঝেই মেসন ট্রিলজির তৃতীয় বইটা কেমন যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, এদিকে প্রথম দুটো বইয়ে কী ঘটেছিল আদৌ মনে নেই। সেলে তুলে আনা উমবেরতো ইকোর ‘বদলিনো’। ‘ওয়ান স্ট্র রেভলিউশন’, এ-সময়ের জরুরি পাঠ। আমার লোভের তো শেষ নেই। পুরনো বইয়ের গ্রুপ থেকে ছিনিয়ে আনা আত্মজীবনী ও সমাজতাত্ত্বিক বইয়ের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। আমার সামনে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজের আদি-অন্তহীন কাগজপত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালবেসে পাঠানো খাতা। আমি কি আদৌ বই পড়ি?…
আমার বই পড়বার ইচ্ছা অনেকটা শিশুর সামনে চকলেটের বাক্স রাখবার মতন। কোনটা যে বেছে নেব ভেবে পাই না, যেখানে পারি খাবলা মারি, কিছুটা এদিক কিছুটা ওদিক। মাথা ঘুরে যায়, ঠিকঠিকানা পাই না।
গুছিয়ে পড়বার অভ্যাস আমার নেই। ক্রোনোলজি মানি না, সাবজেক্ট ধরে পড়তে পারি না (যদি না অবশ্যই সেটা পেশাগত ইন্টারেস্টের কারণে হয়, সে আবার অন্যরকম এক পাঠের অভ্যাস)। কৌতূহল জাগলে একদিনেও শেষ করে ফেলতে পারি, ভাল না লাগলে সঙ্গে সঙ্গেই অন্য কোনও ভালবাসার বস্তু খুঁজে নিই। বই আধপড়া রেখে অন্যদিকে চলে যেতে, অন্য কাউকে দিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। বইয়ের তাক খালি করতে হলে নির্দ্বিধায় দানও করে দিয়েছি, পুরনো বইয়ের বিক্রেতা খুশিমনে নিয়ে গিয়ে হয়তো বইমেলাতেই বিক্রি করছেন এইবার। বই নামক বস্তুর প্রতি আমার মোহ ক্ষণস্থায়ী, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ভালবেসে ঘরে জায়গা দেব, অথবা আবার কয়েক বছর পরে ঘুরে এসে পাঠ করব, এ সম্ভাবনা কম।
এ-হেন পাঠকের ‘পড়তে চাই’ বইয়ের তালিকা যে একাধারে এলোমেলো ও দিকভ্রান্ত, তা বলাই বাহুল্য। ধরুন, বইমেলায় এক ঘন্টা হাঁটবার পর চারটে বইয়ের তালিকা তৈরি হল। হলুদ নোটবই হাতে ঘুরে ঘুরে তালিকা তৈরি করলাম— তিনটে লেখাপড়ার বই, একটা গল্পের বই। একটাও না কিনে বটতলা উডকাটের একজিবিশন দেখতে চলে গেলাম।
অগোছালো পাঠের সকল দোষেই আমি দুষ্ট। পড়তে চাই বলে না পড়ে কম বই তো ফেলে রাখিনি। বইয়ের তাক থেকে মাঝেমাঝেই মেসন ট্রিলজির তৃতীয় বইটা কেমন যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, এদিকে প্রথম দুটো বইয়ে কী ঘটেছিল আদৌ মনে নেই। সেলে তুলে আনা উমবেরতো ইকোর ‘বদলিনো’। ‘ওয়ান স্ট্র রেভলিউশন’, এ-সময়ের জরুরি পাঠ। আমার লোভের তো শেষ নেই। পুরনো বইয়ের গ্রুপ থেকে ছিনিয়ে আনা আত্মজীবনী ও সমাজতাত্ত্বিক বইয়ের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। আমার সামনে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজের আদি-অন্তহীন কাগজপত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালবেসে পাঠানো খাতা। আমি কি আদৌ বই পড়ি?
মাঝেমাঝে আর পাঁচটা মানুষের মতন আমিও ভাবি, একদিন বিশ্রাম নিতে নিতে শুধুই বই পড়ব, ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ এবার পড়েই ছাড়ব। ‘লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ডস’ আর ‘স্তালিনগ্রাদ’ পড়ে শেষ করব— সে পড়তে পড়তে যতই ঠান্ডা লাগুক না কেন। বড় হয়ে একদিন ‘ইউলিসিস’ পড়ব। কিন্তু অগোছালো পাঠকের বড় সমস্যা, কখন যে কোন বই ডাকে তার ঠিক নেই। ধরুন, আপনি হিসেব করলেন এইবার বেড়াতে গিয়ে সেথ ডিকিনশনের ‘এক্সোরডিয়া’ আর এনকে জেমিসিনের ‘দা ব্রোকেন কিংডম’ পড়ে শেষ করবেন। ওদিকে লাদাখের আবহাওয়ায় মোহিত হয়ে আপনি পড়ে ফেললেন আব্দুল হামিদ রাধুর ‘টিবেটান ক্যারাভ্যান্স’ ও হাইনরিখ হারারের ‘সেভেন ইয়ারস ইন টিবেট’। ভেবেছিলেন পড়বেন সাইফাই, পড়লেন তিব্বত-কেন্দ্রিক ভ্রমণকাহিনি। তালিকা, প্ল্যান, টার্গেট— এসব করেই বা লাভ কী? আপনার ওসব কপালে নাই। এর মধ্যে আপনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল, অনেক সময় পড়া বইও কেমন করে জানি না-পড়া বই হয়ে যায়— অর্থাৎ, বিন্দুমাত্র মনে থাকে না, মনে হয় যেন নতুন বই পড়ছেন। যে বই আপনি পড়েও ভুলে গেছেন— যেমন, ফেলুদার সবকটা গল্পের প্লট ও চরিত্র— সেটা কি পড়া বই না না-পড়া বই?
উনিশ শতকে নারীশিক্ষার প্রণেতারা চেয়েছিলেন মেয়েরা যেন ‘ভাল’ বই পড়ে, বটতলা ও অন্যান্য হাবিজাবি নাটক-নভেল পাঠের থেকে শতহস্ত দূরে থাকে। আমার মতন চঞ্চলা পাঠিকাকে দেখে কি তাঁরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন? হয়তো বলতেন, এই জন্যই মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে নেই।