
ভাস্কর জানা
২০২৪ সালে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক মাইলফলক স্পর্শ করেছে শহর কলকাতা। বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বিজ্ঞান গবেষণার নিরিখে সারা পৃথিবীর ১০০ শহরের মধ্যে কলকাতার স্থান রয়েছে ৮৪ নম্বরে। ভারতের মধ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে আমাদের শহর। এরই সঙ্গে মহান বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোসের বিখ্যাত কাজ বোস সংখ্যায়ন পা দিয়েছে শতবর্ষে, যার ওপর ভিত্তি করে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানচর্চা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল। বড় অদ্ভুত এই সমাপতন। বিজ্ঞান-মানচিত্রে শহর কলকাতাকে প্রথম সারিতে নিয়ে আসার জন্য প্রাথমিকভাবে যাঁদের নাম স্মরণ করতেই হয় তাঁদের মধ্যে একজন অবশ্যই সত্যেন্দ্রনাথ
নতুন বছরে পৌঁছে গত বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব কষতে বসলে আপামর বাঙালির জন্য হয়তো অপ্রাপ্তির দিকেই পাল্লাটা বেশি ঝুঁকে থাকবে। যদিও বেশ কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে তার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক মাইলফলক স্পর্শ করেছে শহর কলকাতা। বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বিজ্ঞান গবেষণার নিরিখে সারা পৃথিবীর ১০০ শহরের মধ্যে কলকাতার স্থান রয়েছে ৮৪ নম্বরে। ভারতের মধ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে আমাদের শহর। এরই সঙ্গে মহান বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোসের বিখ্যাত কাজ বোস সংখ্যায়ন পা দিয়েছে শতবর্ষে, যার ওপর ভিত্তি করে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানচর্চা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল। বড় অদ্ভুত এই সমাপতন। বিজ্ঞান-মানচিত্রে শহর কলকাতাকে প্রথম সারিতে নিয়ে আসার জন্য প্রাথমিকভাবে যাঁদের নাম স্মরণ করতেই হয় তাঁদের মধ্যে একজন অবশ্যই সত্যেন্দ্রনাথ।
১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার তরুণ অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ আইনস্টাইনকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর লেখা একটি গবেষণাপত্র। তিনি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের তত্ত্বের একটি স্বতন্ত্র গাণিতিক বিশ্লেষণ তৈরি করেছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে। আইনস্টাইনকে লেখা চিঠিতে তাঁর অনুরোধ ছিল গবেষণাপত্রটিকে যোগ্য বলে মনে হলে তিনি যেন সেটিকে জার্মান বৈজ্ঞানিক পত্রিকা শাইটস্রীফট ফ্যুর ফিজিকে প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন। এর আগেও তিনি এই গবেষণাপত্রটি ইংল্যান্ডের একটি পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন কিন্তু সেটি প্রত্যাখ্যাত হয়। খাঁটি জহুরির মতন আইনস্টাইন সোনা চিনতে ভুল করেননি। তিনি প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে সেটিকে প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন। পরবর্তীকালে সত্যেন্দ্রনাথের এই কাজটি বোস সংখ্যায়ন নামে সুপরিচিত হয় যা বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল অনামী এই বাঙালি বিজ্ঞানীকে।
সত্যেন্দ্রনাথের মৌলিক কাজটি কী ছিল জানতে গেলে আমাদের আরও দুই দশক পিছিয়ে যেতে হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ক্লাসিক্যাল বলবিদ্যার কোনও তত্ত্ব দিয়ে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বিকিরণকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির প্যাকেট বা কোয়ান্টা হিসেবে ধরে নিয়ে একটি সমীকরণ লিখেছিলেন যা পরীক্ষালব্ধ ফলের সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু এই সূত্রটির কোনও সঠিক ব্যাখ্যা ছিল না। আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে ফটো-ইলেকট্রিক এফেক্ট ব্যাখ্যা করার সময় প্লাঙ্কের তত্ত্বকে কাজে লাগান। তিনি দেখান আলো আসলে একঝাঁক বিভিন্ন এনার্জির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমষ্টি, পরে এই কণার নাম দেয়া হয় ফোটন। যদিও প্ল্যাঙ্কে সূত্রের সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারেননি আইনস্টাইনও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় সত্যেন্দ্রনাথ এই সুত্রটি ছাত্রদেরকে বোঝাতে পারতেন না। এই সমীকরণের একাংশ আলোর তরঙ্গরূপ এবং আরেকটি অংশ আলোর কণারূপ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হত। সত্যেন্দ্রনাথ আলোকে ফোটন কণার গ্যাস হিসেবে ধরে পুরো সমীকরণটি ব্যাখ্যা করার কাজ করছিলেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন একটি কোয়ান্টাম দশায় অনেকগুলি ফোটন কণা রাখা যেতে পারে, অর্থাৎ তারা স্বতন্ত্র নয় বরং একে অপরের থেকে অভিন্ন। এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি নতুন সংখ্যায়নের জন্ম দেন তিনি, যা দিয়ে প্ল্যাঙ্কের সূত্রকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।
সে-সময় কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের জগতে প্ল্যাঙ্ক, আইনস্টাইন, নিলস বোরের পর চতুর্থ যুগান্তকারী ধারণাটি দিয়েছিলেন সত্যেন বোস।
এতদিন পর্যন্ত ধ্রুপদী কণাদের ম্যাক্সওয়েল বোলজম্যান সংখ্যায়ন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেত। বোস সংখ্যায়ন দিয়ে ফোটনের মতো যে কণারা একই কোয়ান্টাম দশায় একসঙ্গে অনেকে থাকতে পারে তাদের ব্যখ্যা করা যায়। কিন্তু ইলেকট্রনের মতন কণাদের ক্ষেত্রে আবার এই নিয়ম খাটে না। সত্যেন্দ্রনাথের কাজের কিছুদিন পরে পাওলি দেখান যে দুটি ইলেকট্রন কখনও একই কোয়ান্টাম দশায় থাকতে পারে না। পাওলির এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল মেনে চলে যে কণারা তাদের জন্য তৈরি করা হয় ফার্মি ডিরাক সংখ্যায়ন। কোয়ান্টাম জগতে যে কণাগুলো বোস সংখ্যায়ন মেনে চলে তাদের নাম দেওয়া হয় বোসন আর ফার্মি ডিরাক সংখ্যায়ন মেনে চলা কণাদের নাম দেওয়া হয় ফার্মিয়ন।
সত্যেন্দ্রনাথের এই কাজটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আইনস্টাইন। তিনি দেখান শুধুমাত্র ফোটন কণা নয় এই সংখ্যায়ন হালকা পরমাণু গ্যাসের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। আইনস্টাইন আরও বলেন যে-সব পরমাণু বোস সংখ্যায়ন মেনে চলে তাদের তাপমাত্রা প্রচুর কমিয়ে চরম শূন্যের কাছাকাছি করলে তারা একই কোয়ান্টাম দশায় পৌঁছবে। এই পরিস্থিতিতে একই দশায় অনেকগুলি পরমাণু থাকতে পারে এবং তাদেরকে একে অপরের থেকে পৃথক করা যাবে না। এভাবে পদার্থের একটি সম্পূর্ণ নতুন অবস্থা তৈরি হবে যার নাম বোস আইনস্টাইন কনডেনসেট বা BEC। এই তত্ত্ব বেরোনোর প্রায় ৭০ বছর পর কলোরাডো বিশ্ববিদ্যলয়ের বিজ্ঞানীরা রুবিডিয়াম পরমাণুতে BEC তৈরি করেছিলেন। জীবদ্দশায় তা দেখে যেতে পারেননি বোস বা আইনস্টাইন কেউই।
সত্যেন্দ্রনাথের কাজ শুধুমাত্র তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্ল্যাসিকাল বলবিদ্যা, কোয়ান্টাম তত্ত্ব, রসায়ন, স্পেকট্রোস্কপি, আয়নোস্ফিয়ার গবেষণা, মাথ্যামেটিকাল ফিজিক্স-সহ নানা ক্ষেত্রে তাঁর একাধিক গবেষণাপত্র রয়েছে। জীবনের শেষদিকে কাজ করেছিলেন ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি নিয়ে। ছাত্রদের হাতেকলমে বিজ্ঞানশিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড উৎসাহী ছিলেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে নিজের হাতে একটা যন্ত্র তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁর ছাত্ররা এই যন্ত্রটি নিয়ে টেবিলে বসে তাঁকে কাজ করতেও দেখেছেন। সেটির নাম দেওয়া হয়েছিল Scanning Spectro Photometer. সত্যেন্দ্রনাথের ছাত্রী সায়েন্স কলেজের প্রথম মহিলা পিএইচডি পূর্ণিমা সিনহার স্মৃতিচারণায় মাস্টারমশাইয়ের কাজের এই দিকটি উঠে এসেছে।
মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সত্যেন্দ্রনাথ পিএইচডি করার জন্য বিদেশযাত্রার স্কলারশিপ পাননি কারণ তখন শুধু অবিবাহিত ছাত্রদের এই সুযোগ দেওয়া হত। তিনি খুব কম বয়সেই ঊষাবতী ঘোষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সত্যেন্দ্রনাথের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল ইউরোপে গিয়ে পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যা নিয়ে কাজ করার। বোস পরিসংখ্যান বেরোনোর পর আইনস্টাইনের সুপারিশের ভিত্তিতে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদেশে কাজ করার জন্য বিশেষ বৃত্তি দেওয়া হয়। ১৯২৪ সালে প্যারিসে পৌঁছনোর পর তাঁর পরিচয় হয় বিখ্যাত পদার্থবিদ পল ল্যাজভাঁর সঙ্গে। পল তাঁকে তাঁর গুরু নোবেলজয়ী পদার্থবিদ মাদাম কুরির ল্যাবে নিয়ে যান। মাদাম ধরে নিয়েছিলেন তিনি ফরাসি জানেন না তাই মাদাম কুরির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তিনি তৎক্ষণাৎ পাননি। তিনি ডি ব্রগলি-দের ল্যাবে এক্স-রে স্প্রেকট্রোস্কোপি এবং ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে কাজ করেন যা তাঁকে পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বার্লিনে পৌঁছে তিনি অটো হান, লিসা মাইটনার, হাইজেনবার্গ, পিটার ডিবাই, পাওলির মতো প্রথমসারির পদার্থবিদদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হয় ১৯২৫ সালের শেষের দিকে। আইনস্টাইন তাঁর প্রথম পেপারটিকে স্বীকৃতি দিলেও দ্বিতীয় পেপারটির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। সত্যেন্দ্রনাথ চিরকাল আইনস্টাইনকে গুরু হিসেবে মেনেছেন। কিন্তু অনেক বিষয়েই আইনস্টাইন তাঁর চিন্তাধারা সমর্থন করেননি। আইনস্টাইনের এই প্রত্যাখ্যান তাঁর মনে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। ১৯২৬ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন সত্যেন্দ্রনাথ।
শুধুমাত্র গবেষণার জগতেই নিজেকে আটকে রাখেননি সত্যেন্দ্রনাথ। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে জগদীশচন্দ্র, রামেন্দ্রসুন্দর, প্রফুল্লচন্দ্রর মতন পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ধারাটিকে আরও সমৃদ্ধ করার কৃতিত্ব তাঁর। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা যদি তাড়াতাড়ি প্রচার করতে হয় তাহলে মাতৃভাষায় সবচেয়ে সোজা। ফ্রান্স, জার্মানি, জাপানের মতন দেশে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার রমরমা দেখে তাঁর মনে হয়েছিল বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করতে গেলে বিজ্ঞানের পরিভাষা তৈরি করা আশু প্রয়োজন। বাংলায় তাঁর প্রথম বিজ্ঞানপ্রবন্ধ বিজ্ঞানের সঙ্কট ১৯৩১ সালে পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা একমাত্র বিজ্ঞান প্রবন্ধ সঙ্কলন বিশ্বপরিচয় উৎসর্গ করেন সত্যেন্দ্রনাথকে। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকা। ৭৫ বছর পেরিয়ে যাকে নিরলসভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন সংস্থার সদস্যরা।
সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা করতে হলে বিজ্ঞানী পরিচয়ের বাইরেও উঠে আসবে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার নানা দিকগুলি। তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ, সাহিত্য অনুরাগী, সমালোচক, ঐতিহাসিক এবং সঙ্গীতশাস্ত্র বিশারদ। ভালবাসতেন মহাপুরুষদের জীবনী পড়তে এবং লিখতে। প্রিয় কবি ছিলেন টেনিসন এবং রবীন্দ্রনাথ। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে মেঘদূত আবৃত্তি মন কাড়ত শ্রোতাদের। সে-সময় কলকাতার অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিন্দু স্কুলে পড়ার সময় অঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে ভাল ফল করতেন সংস্কৃত, ইতিহাস এবং ভূগোলের মতন কলাবিভাগের নানান বিষয়ে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ না নিলেও সত্যেন্দ্রনাথ প্রচ্ছন্নভাবে সাহায্য করতেন। খুব ছোট বয়সে জনশিক্ষা প্রসারের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। স্বদেশি আন্দোলনের সময় অল্প কিছুদিন এ-জন্য নাইট স্কুলও চালিয়েছিলেন। কর্মজীবনে পৌঁছেও নানাভাবে বিপ্লবীদের সাহায্য করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন তখন অনেক ছাত্রছাত্রী গুপ্ত সমিতিতে যোগদান করেছিলেন, তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনিও। সত্যেন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে প্রথমবার বিদেশে গিয়ে প্যারিসে যে-বাড়িতে ছিলেন সেখানে ছিল ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় ছাত্র সংগঠনের কার্যালয়। তিনি অনুশীলন সমিতির সদস্য অবনীনাথ মুখার্জীকে আত্মগোপন করে বিদেশে পাঠানোর জন্য সাহায্য করেছেন। গুপ্ত সমিতির আর এক সদস্য শৈলেন ঘোষ তাঁর সুপারিশে ঢাকার একটি কলেজে চাকরি পান।
সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর অন্য ধারার পত্রিকা সবুজপত্রর আসরে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, দিলীপকুমার রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখার্জী, বিষ্ণু দে ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। ফ্রেঞ্চ এবং জার্মান ভাষায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের জার্মান থেকে ইংরেজি অনুবাদের প্রথম কৃতিত্ব সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ সাহার। বিশিষ্ট ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ। ছোটবেলা থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিশেষ ভক্ত ছিলেন তিনি। ভালবাসতেন এসরাজ বাজাতে। সত্যেন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে ঢাকায় তাঁর বাড়িতে এসেছেন অমিয় সান্যাল, জ্ঞান গোঁসাই, বাহাদুর খাঁ, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর উপাচার্য থাকাকালীন পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন।
পোশাকআশাক এবং কথাবার্তায় আপাদমস্তক বাঙালি এই মানুষটি মননে ছিলেন এককথায় আন্তর্জাতিক। স্বাধীনতার পর দেশভাগ ও দাঙ্গার স্মৃতি ব্যথিত করত তাঁকে। সে-সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের জন্য তাঁর কলকাতার বাড়িটি ছিল অবারিত দ্বার।
বিজ্ঞান কখনও দেশকালের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককোণে বসে সত্যেন্দ্রনাথ যে তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিলেন তা কাজে লাগিয়েছেন সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা। তাঁর তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এসেছে সাতটি নোবেল পুরস্কার। মোট ছয়বার নোবেল কমিটির কাছে মনোনয়ন যাওয়া সত্ত্বেও নোবেল পাননি তিনি। যদিও এতে তাঁর কাজের কৃতিত্ব কখনওই ছোট হয় না। সম্প্রতি বোস সংখ্যায়নের ১০০ বছর উদযাপন করতে কলকাতার সত্যেন্দ্রনাথ বোস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের এক অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিলেন বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীরা। সত্যেন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বলে গেলেন রাজনৈতিক পরিচয় ও ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে একমাত্র বিজ্ঞানই পারে শান্তির বার্তা দিতে আর সেই লক্ষ্যেই কাজ করেছেন তাঁরা। কোয়ান্টাম কণাদের আচরণে নানা বিসঙ্গতি রাখা সত্ত্বেও তাঁরা সমন্বয়ের (coherence) এক অদ্ভুত নিয়ম মেনে চলে। সেই ছন্দোবদ্ধতা আমাদের কাছে বিস্ময়। সত্যেন্দ্রনাথ সারাজীবন বিজ্ঞান ও মানবতার সেই সমন্বয় সাধনের কাজই করে গিয়েছেন। তাঁর জীবনদর্শনকে অনুধাবন করতে পারাটা আমাদের পরম প্রাপ্তি।
তথ্যসূত্র:
- জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকা
- এসএন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সাইন্সেস অনলাইন আর্কাইভ
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা। লেখককে অভিনন্দন জানাই।
একটি তথ্য যোগ করছি। বিলেতের যে পত্রিকা সত্যেন বসুর ওই যুগান্তকারী নিবন্ধটি প্রত্যাখ্যান করে তার নাম ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিন, তৎকালে সেটি পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে নামকরা পত্রিকা, এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন গবেষণা পত্রিকা যা আজও নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
ঘটনাক্রমে এই মন্তব্যলেখক বর্তমান ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিন লেটার্সের অন্যতম সম্পাদক। সত্যেন বসুর প্রতি এই চূড়ান্ত অবিচারটি সম্পর্কে বর্তমান সম্পাদকমন্ডলী অবহিত এবং আমরা ঘটনাটিকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করি এবং অত্যন্ত সতর্ক থাকি এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়ার ব্যাপারে। এই ইতিহাস আমাদের সেটাই শিখিয়েছে।