সিদ্ধার্থ বসু

দেহ-মনের খেলা

 

১.

যত লিখি
তত লিখতে ইচ্ছে করে না

দু-লাইন এগোতেই
হাত সরে না পরের লাইনে

ফেলে আসা পাড়া-ঘর, সময়, মানুষ

যত হল্লা, হত্যা যত, পুঁজ-রক্ত, যত হেরে যাওয়া
সব চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে অস্তিত্বে আমার

মনে হয়
যা হওয়ার, না-হওয়ার, সবই হয়ে গেছে
মন আর কোথাও যাবে না

যত মন
নত মন
নিবৃত্ত স্থবির

দেহ শুধু— এ-শরীর— ঘুরে মরে, মাথা কুটে মরে।

 

.

প্রেম বলে লোকে
খোঁজে
বোঝে
বোঝায়, কেমন প্রেম
কীসে সত্যি
ভ্রষ্ট কোনখানে
কী দিয়ে আরম্ভ হয়
কখন ফুরোয়, নিভে যায়

স্নেহ প্রেম, যত্ন প্রেম, বাৎসল্য প্রণয়
দেহ প্রেম, দেহ-মন, বিশুদ্ধ হৃদয়

কী প্রেম?
কী নয় প্রেম?

এ হলে হয় না আর
এই হলে হয়

সব ছবি ফুটে ওঠে
সব দাগ ধুয়ে ধুয়ে যায়

 

৩.

শরীর উন্মাদ করে
মন শুধু জ্বেলে রাখে আয়ু

দেহ ধরে দেহভার
হাতে হাত
আশ্রয়ে আশ্রয়

শুধুই ঘুমের মতো
ঘামের, ওমের মতো লাগে

ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে না বিদ্যুৎ কোনও
অথচ অতন্দ্র প্রতি গ্রন্থি-পেশি-স্নায়ু

মনের বয়স মজে
প্রেমসুধারসে

শুশ্রূষায়, নির্ভরে, সংলগ্নতায়

বেহায়া শরীর শুধু
জমি আঁচড়ায়

 

.

দু-চোখ তোমায় যখন দ্যাখে
রক্ত নাচে খর
উজান বেয়ে ছলকে ওঠে
বাহির, অন্দরও

শরীর দিয়ে শরীর ছানি
উষ্ণ, স্বাদু, তরল
জীবনজুড়ে ফেনিয়ে ওঠে
অমৃত আর বিষ
দেহ আমার এমনই সোজা
স্বচ্ছস্রোত, সরল
অন্য দেহ, আরও অপর
সহজ খোয়াইশ

কিন্তু জট-জটিল মনে
অশেষ কাটাকুটি
স্রোতের গায়ে স্রোত খেলে যায়
ঢেউ ভেঙে দেয় ঢেউ
আয়ুব্যাপী প্রণয়সাধন
মেলে না কার ছুটি
আগুনহীন আলোর ধাঁধা
বোঝে না আর কেউ

শরীর বোকা, নগ্ন, ক্ষুধাতুর
ভোলা এ মন ভোলে না মূলসুর

 

৫.

দেহই স্থপতি

কখনও শরীরবোধ জাগায় মনের বিভ্রম
(কারও ভ্রম আজন্ম কাটে না)
কিন্তু সে হৃদয় জড়
যেখানে আসন পায়, বসে থাকে
সরে না, নড়ে না

দেহ শুধু ভ্রমিয়া বেড়ায়
ভ্রম থেকে আরও অন্য ভ্রমে

অপার্থিব অতীন্দ্রিয় অলৌকিক
ইত্যাকার শব্দের ওজন
শরীরেই হয় প্রতিষ্ঠিত

উদগ্র ওষ্ঠের জন্য
অন্য অধরের যে কামনা
প্রস্তুত প্রত্যঙ্গ চেয়ে
আরেক অঙ্গের তীব্র স্পৃহা
কোনওদিন ফোটাতে পারে না কোনও মন

সত্যের অমোঘ টান
বোঝে শুধু দেহ

মন তাতে ভেসে থাকে বানে-খাওয়া ভিটের মতন

 

.

মন রে তুই মিথ্যা শিখেছিস

তোকে দেহ যা অকপট বলে
নিছক কৌতূহলে ভাঙিস-গড়িস

শুনে তোর প্ররোচনা
দেহ ভাবে শিখেছে ছলনা
ভেঙে সেই মিছে সান্ত্বনা
পা দিয়ে তোর জটবিচুটি ফাঁদে
দেহ জন্মভরে কাঁদে

মন রে তুই মিথ্যা শিখেছিস

দেহের কালাম বেবাক খাঁটি
তাকে সাজবি বলে পরিপাটি
তুই যা বুঝিস তা না-বুঝিস

তুই মিথ্যা শিখেছিস

তুই ভাবলি তোর অনেক ক্ষমতা
প্রেম-বিরহ-কামের কথা
রাখবি ঢেকে রঙিন ত্যানায়
মিটবে দেহের খোয়াইশ

তুই মিথ্যা শিখেছিস

দেহ আমার পরম সাধু
নেই মায়া নেই আলেখ জাদু
তাকে তুই ভুল বুঝে ভুলিয়েছিস

মন রে তুই মিথ্যা শিখেছিস

 

.

শরীর বাঁধা আদর আর
আদর বাঁধা শরীর
মন ভাসে সেই সহজ জলে

মন ফোটে আনমনে

এবং মন শরীরব্যেপে থাকে

একটি-দুটি অঙ্গ জাগে
ঝরে

তাতে কি মন মরে?

 

৮.

ঘর বসাতে চাস এখনই?
শরীর দিয়ে ছোঁ

দেহই পারে টানতে কাছে
অঙ্গে তরঙ্গ

গোটা শরীর পাছাড় দেয় পারে

এই আছে, নেই
পলকে নেয়
দমকে ফের ঝরে

ঢেউ জাগে আর
ঢেউ ভাঙে সংসারে

কিন্তু যদি বাঁধতে চাস
দেহের ভিতর বাসা
ফুরিয়ে ফ্যাল গতর তোর
মুড়িয়ে ফ্যাল নটে

জংলি ঘোড়া দিগ্বিদিকে ছোটে

বৃথাই তাকে বাঁধা
তার দু-পায়ে ধরে সাধা

আমার ঘাটে বিছিয়ে তোর ছায়া
নেভা দেহের সহজ স্রোতে
অনন্ত দাঁড় বাওয়া

 

৯.

শরীরের দোষে আমি হারিয়েছি অনেক শরীর
দেহের আগুনে ছাই হয়ে গেছে অনেক হৃদয়
ব্যথার সংশ্লিষ্ট ব্যথা, কথার বিহনে কথা হয়ে
রাখতে চেয়ে দেহভার, যে দেহেই বাঁধতে গেছি নীড়

দেহ দিয়ে দেহ চাওয়া, সে-ই সবচেয়ে স্বাভাবিক
অঙ্গের কারণে অঙ্গ, দিতে পারে প্রকৃত রসিক
কিন্তু ঝরে গেলে কাম, জুড়ে বসে ঘৃণা, কী অস্থির
প্রত্যঙ্গের অনাসক্তি অন্ধ করে, বোবা ও বধির

তোকে যে চিনেছি তার কোথায় শরীর, কোথা মন
উত্তাল তরঙ্গভঙ্গ যেই অঙ্গে করেছ ধারণ
যে মন উদগত হয় এ দেহের দোটানা ছাড়িয়ে
শুকনো পাতার মতো, লঘু পায়ে গিয়েছি মাড়িয়ে

পেরিয়ে অনন্ত পথ, ঘর-বার, খর উচাটন
মন খোঁজে দেহ আর দেহ খোঁজে সে দেহের মন।

 

১০.

শরীর জাগে
শরীর ঝরে যায়

মন ঘোরে ধাঁধায়

কখন দেহ মাতায় তাকে
কখন যে কাঁদায়

বিচার দিয়ে বিচার করে
বিচার দিয়ে বাঁধে
বিচার দিয়েই মজবে সে আস্বাদে

এমন খায়েশ
মিথ্যে করে
মামুলি করে তাকে
শরীর তার
প্রাচীন নামে ডাকে

সত্তা-জোড়া
হাওয়ার আগে ছুট
সজাগ মন
বিচক্ষণ
গুণ টানে ঝুটমুট।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...