
শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার
প্রাণশক্তিকে পুঁজি করে নিজের যা অভাব তাকেই শক্তিতে পরিণত করার বিকল্প পথ তৈরি করেছিল ভিয়েতনামের যোদ্ধারা। প্রতুল একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শৈশব থেকে তাঁর গানে যে অভাবগুলি ছিল, তাকেই তিনি শক্তিতে পরিণত করেছেন। তাঁর গানে যা নেই সেটাই হয়ে উঠেছে তাঁর গানের সম্পদ। এভাবে দেখলে প্রতুলকে আমার সঙ্গীতের এক গেরিলা যোদ্ধাই মনে হয়। তাঁর এই ঢাল-তরোয়ালবিহীন যুদ্ধ যে কতটা শক্তি ধরে সেটা আমরা নয়ের দশকে মাঝামাঝি থেকে দেখতে পেয়েছি
গানে তিনি বলেছিলেন, স্লোগান দিতে গিয়েই আমি ভিড়ে গেলাম গানে। সেই গানে খ্যাপা মোষের ঘাড় ভাঙার স্লোগান দিয়ে লাল নিশানের স্পর্ধিত উচ্চারণের কথা বলেছিলেন তিনি। পরিহাস এটাই, তাঁর শেষযাত্রাকে ঘিরে রেখেছিল সেই খ্যাপা মোষের প্রতিভূরাই। ফলেই তাঁর শেষ মিছিলে কোনও ‘লাল সালাম’ ধ্বনি ওঠেনি, আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গীত হয়নি, তাঁর মরদেহ আচ্ছাদিত হয়নি লাল নিশানে। তাঁর শেষ মিছিলের আবহ জুড়ে বেজে গেল শুধু ‘আমি বাংলায় গান গাই’। আসলে বেশ কয়েক বছর ধরেই দ্রোহী প্রতুলকে একটি পেলব সংস্করণে হাজির করতে তাঁকে কয়েদ করে রাখা হয়েছিল এই গানে। কিন্তু ‘স্লোগান’ থেকে ‘টুইডলডাম’, ‘ভয় পাস নে ছেলে’ থেকে ‘আলু বেচো ছোলা বেচো’ বাদ দিয়ে যে প্রতুলের ‘আমি বাংলায় গান গাই’-ও হত না এটা সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রথমত, যিনি স্লোগান থেকে গানে ভিড়ে যাওয়াটা তো একটা রাজনৈতিক কাজ। এবং এ থেকে যে গানের সৃষ্টি হয় বা যে শিল্পীর জন্ম হয়, সেটাও রাজনৈতিক। প্রতুল একজন রাজনৈতিক শিল্পী। প্রতুলের গানও রাজনীতির গান। সেই রাজনীতি যেমন সুনির্দিষ্ট, তেমনি ওই রাজনীতির কোন ধারার ফসল শিল্পী প্রতুল ও তাঁর গান, সেটাও সুনির্দিষ্ট। তাঁর গান যে পথে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখত তার সঙ্গে সমস্ত লাল নিশান অনুগামীরা একমত হবেন এমনটা নয়। ফলে তাঁর শেষ মিছিলটি তাঁর গানের রাজনীতির পথ থেকে অনেক দূরে বেঁকে গেল। তাঁর গানের সহযোদ্ধারা সামাজিক মাধ্যমে দুঃখ করেছেন, শেষবারের মতো তাঁরা সহযোদ্ধা প্রতুলের মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে পারলেন না। কাছ ঘেঁষতেই দিল না সেখানে পাহারায় থাকা ক্ষমতাধররা।
আসলে প্রতুলকে একটি গানে আটকে রাখা আর প্রতুলের মরদেহের কাছাকাছি তাঁর একদা-সহযোদ্ধাদের আসতে না-দেওয়া একটি অভিন্ন রাজনীতিই। তবে আমরা জানি না, প্রতুল সচেতনভাবেই সেখানে আটক থাকতে চেয়েছিলেন কিনা। কারণ এই ধারণাটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়, যখন দেখা যাবে শুধু প্রতুল নয় অগ্নিগর্ভ সত্তরের অনেক বিপ্লবীই বর্তমান শাসক দলের অভ্যন্তরে বা কাছাকাছি বৃত্তে রয়েছে। এটাও বিস্ময়কর বিষয় নয়। গত শতকের ছয় ও সাতের দশকের আগুনে বিপ্লবী রেজিস দেব্রে যিনি চে গুয়েভারা ও সালভাদোর আলেন্দের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং যাঁর বই এবং বক্তৃতা পড়ে ছয় ও সাতের দশকে ইউরোপের তরুণ সমাজ আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তিনিই আটের দশকে এসে হয়ে গেলেন ফরাসি রাষ্ট্রপতি মিত্তেরোঁর উপদেষ্টা। এখন প্রশ্ন উঠবে আমরা যখন প্রতুলের গান নিয়ে কথা বলব তখন কি আটকে থাকব তাঁর পরিবর্তিত রাজনীতিতেই? ফেলে আসা গানের পথ কি মিথ্যা হয়ে যাবে? এই কথার উত্তর দেওয়ার আগে আরেকটি বিষয়ের দিকেও হয়তো নজর দেওয়া জরুরি। প্রতুলকে একটিমাত্র গানে আটকে রাখার রাজনীতিটি আছে দু-দিক থেকেই। শাসকেরা নিজেদের স্বার্থে তাঁকে নির্বিষ চেহারায় হাজির করতে চায়। সেই উদ্দেশ্য থেকেই ‘বিপ্লবী’ প্রতুলকে তারা ‘বাঙালি’ প্রতুল করতে চায়। এভাবে তারা আড়াল করে দিতে চায় তাঁর দ্রোহের সঙ্গীতকে। মমতা সমস্ত অনুষ্ঠানে প্রতুলকে শুধুমাত্র ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গাইতে বলতেন। এমনকী অসুস্থ প্রতুলকে দেখতে গিয়ে তিনি তাঁর গান শুনছেন বলে যে চিত্রাংশটি সামাজিক মাধ্যমে ভাসন্ত, সেখানেও প্রতুলকে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গাইতেই শোনা যায়। হয়তো মুখ্যমন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে ‘ভয় পাস নে ছেলে’ বা ‘আলু বেচো’ গাওয়া যায় না। যে রাজনীতির বিরুদ্ধতা থেকে এই গানগুলির জন্ম, সেই রাজনীতির আঙিনায় বসে কি সেই গান গাওয়া সম্ভব? ফলে শেষের কটি বছরে বহু রাজ্যের শাসকদলের বহু অন্যায়ের সামনে প্রতুল যেমন নীরব থেকেছেন, তেমনি যে গানগুলি তাঁর পরিচিতি নির্মাণ করেছিল, সেই গানগুলিও অনেকটাই অগীত হয়ে যায়।
যাঁরা প্রতুলের শেষ জীবনটিকে মেনে নিতে পারেননি, তারাও যখন শুধুমাত্র তাঁর শেষ জীবনের ওপর সমস্ত নজর কেন্দ্রীভূত করেন, তখন পরোক্ষে তাঁরাও শাসকের রাজনীতির ছকে বাঁধা পড়ে যান। তাঁরাও তাঁর দ্রোহের গানগুলিকে আলোচনা থেকে দূরে সরিয়ে দেন এবং তাঁদের কাছেও তিনি হয়ে যান শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর পাশের আসনে বসা হাস্যরত প্রতুলে। এভাবেও তাঁর দ্রোহের গানগুলি চলে যায় আলোচনার বাইরে। এখন বোধহয় প্রয়োজন এই খণ্ড প্রতুলকে তাঁর বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এনে সমগ্র প্রতুলে স্থাপিত করার। এ-কাজে হয়তো এমনও হতে পারে যে ব্যক্তিপ্রতুল চলে গেলেন গানের প্রতুলের প্রতিপক্ষে। যাক, সেই দ্বৈরথের কষ্টিপাথরেই ইতিহাস ছেঁকে বের করে নেবে ইতিহাসের প্রতুলকে।
রাজনীতির প্রয়োজনেই প্রতুল গায়ক হয়েছেন এ-কথা নিবন্ধের শুরুতেই বলেছি। কিন্তু গায়ক হওয়ার মতো অনেক উপকরণই তাঁর ছিল না। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে কেউ তাঁকে হারমোনিয়াম ধরতে দিত না, ফলে খালি গলায় গেয়েই তিনি গান গাওয়ার আনন্দ নিতেন। তাঁর এই স্বাভাবিক গায়নকে নিয়েই তিনি রাজনীতির ময়দানের গানে এসেছেন। তিনি যখন গানে এসেছেন তখন গানের জগৎটা প্রযুক্তির ডানায় ভর করে যন্ত্রসঙ্গীতে ভরপুর হয়ে আছে। যে শ্রোতার কাছে তিনি গান শোনাবেন তাদের কাছেও তখন গান মানে শুধু গান নয়। গান এবং বাজনা। বাজনাও তিরিশ বা চল্লিশের দশকের একমাত্রিক সঙ্গীতানুষঙ্গ নয়। রাজনীতির গানেই প্রতুলের পূর্বসূরি সলিল চৌধুরীর হাত ধরে রাজনীতির গানেও যন্ত্রের রংবেরঙের ঝনৎকার চলে এসেছে। গায়ক শ্রোতা দুইই সেই বর্ণাঢ্য সঙ্গীতের নেশায় ডুবে রয়েছে। প্রতুলের যেমন উপকরণ ছিল না, সামর্থ্যও ছিল না বর্ণাঢ্য পরিবেশনার। যে রাজনৈতিক ধারার সঙ্গীতকর্মী হিসেবে প্রতুল গানে এসেছেন, তারা বড়জোর শ্রোতার সামনে তাঁকে হাজির করিয়ে দিতে পারত। এর চেয়ে বেশি কিছু আয়োজনের সামর্থ্য তাদেরও ছিল না। ফলে প্রতুলকে ভাবতে হল গানের এমন একটি ভাষার, পরিবেশনের এমন একটি ভঙ্গির, যা তাঁর সীমাবদ্ধতাগুলিকে ছাপিয়ে একটা শক্তিতে পরিণত হবে। রবীন্দ্রনাথের একটি গানে আছে, কম কিছু মোর আছে হেথা, পুরিয়ে নেব প্রাণ দিয়ে তা। এই কথাটা প্রতুল যে রাজনীতির গান গাইতেন তারও কথা। প্রতুল যখন গানে আসছেন তখন সারা দুনিয়ায় সাড়া জাগানো অসম যুদ্ধে ভিয়েতনামের গেরিলারা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নাস্তানাবুদ করছে। প্রতুলের গানের মধ্যগগনে থাকার সময়ে ভিয়েতনামে গেরিলারা শেষ বিজয় অর্জন করে। সারা পৃথিবী জুড়েই সহায়সম্বলহীন উপকরণহীন জনগণ প্রাণের জোরে লড়াই করার অনুপ্রেরণা পেয়েছে, শক্তি পেয়েছে ভিয়েতনামের গেরিলাদের মরণপণ লড়াই থেকে। এমন অসম যুদ্ধেও প্রবল শক্তিধরদের পরাস্ত করা যায় এই বিশ্বাস তৈরি করেছে ভিয়েতনাম। শুধুই কি প্রাণশক্তি? না। প্রাণশক্তিকে পুঁজি করে নিজের যা অভাব তাকেই শক্তিতে পরিণত করার বিকল্প পথ তৈরি করেছিল ভিয়েতনামের যোদ্ধারা। প্রতুল একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শৈশব থেকে তাঁর গানে যে অভাবগুলি ছিল, তাকেই তিনি শক্তিতে পরিণত করেছেন। তাঁর গানে যা নেই সেটাই হয়ে উঠেছে তাঁর গানের সম্পদ। এভাবে দেখলে প্রতুলকে আমার সঙ্গীতের এক গেরিলা যোদ্ধাই মনে হয়। তাঁর এই ঢাল-তরোয়ালবিহীন যুদ্ধ যে কতটা শক্তি ধরে সেটা আমরা নয়ের দশকে মাঝামাঝি থেকে দেখতে পেয়েছি। সুমন-নচিকেতাদের নতুন গানে যখন বাংলা গানে একটা নতুন পর্ব এল সেই সময়ে প্রতুল আন্দোলন সংগ্রামের মঞ্চ ছাড়াও গান গাইতে শুরু করলেন মূলধারার অনুষ্ঠানগুলিতেও। দেখা গেল সুবিপুল যন্ত্রের সম্ভার নিয়ে যাঁরা মঞ্চ মাতাচ্ছেন, মানুষের মন জয় করে নিচ্ছেন, তাঁদের চেয়ে কোনও অংশে পিছিয়ে থাকছেন না একটি মাত্র মাইক্রোফোনকে সম্বল করে যন্ত্রানুষঙ্গ বিরহিত প্রতুলের মঞ্চ-উপস্থাপনা। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে হলভর্তি শ্রোতারা অপলক বিস্ময়ে শুনছে তাঁর গান। প্রতুলের গানের অনুষ্ঠান মানে অবশ্য শুধু শোনা নয়, দেখাও। প্রতুলের মৃত্যুর পর কবীর সুমন বলেছেন যে তিনি প্রতুলকে সেই অর্থে গায়ক বলেন না যে-অর্থে হেমন্ত, ভীষ্মদেব, রফি বা তিনি নিজে একজন গায়ক। তাঁর কাছে প্রতুল একটি ঘটনা বা ফেনোমেনন। প্রতুল ‘ছোকরা চাঁদ’ বা অন্য যে-কোনও গান গাওয়ার সময় তাঁর চুল থেকে মাথা পর্যন্ত ব্যবহার করে একটি রূপ দিচ্ছেন। গানের একটি রূপ দিচ্ছেন গোটা শরীর দিয়ে। তিনি গানটি পারফর্ম করছেন। প্রতুল একজন পারফর্মার। এই কথাটাই অন্যভাবে বলেছিলেন একজন নাট্যকর্মী যে, প্রতুলের গানের সঙ্গে নাটকের অসম্ভব মিল। তিনি গানের নাটক উপস্থাপন করতেন। গায়ক প্রতুল যেখানে পারফর্মার হন সেটা শুধু নাটকের মিল নয়। তিনি আরও কিছু অভাবকে পূরণ করেন তাঁর একক পরিবেশনায়। সেটা হল তাঁর গানে কণ্ঠস্বরের নানাবিধ ব্যবহার। প্রতুল বলেছেন, গলা মানে তো স্বরযন্ত্র মানে যন্ত্র। আমি আমার স্বরযন্ত্র দিয়ে যন্ত্রের অভাব মেটাই আবার গানও গাই। গলা দিয়ে আমি বাজাই এবং গাই। সাধারণত গানে যেভাবে প্রিল্যুড-ইন্টারল্যুড আসে যন্ত্রে, হামিং আসে সহশিল্পীদের কণ্ঠ থেকে, গাইতে গাইতে সেই কাজটুকুও করেন প্রতুল কণ্ঠস্বর দিয়ে। এবং এর সঙ্গেই যুক্ত হয় তাঁর আশরীর অভিব্যক্তি। কখনও হেসে ওঠেন, কখনও কেঁপে ওঠেন দুঃখবোধে, কখনও চোখ বুজে ডুবে যান গানের গভীরে, কখনও বিস্ফারিত নেত্রে গানকে নিক্ষিপ্ত করেন শ্রোতার চোখে। কখনও হাসেন ভালবাসার নরম হাসি, কখনও বিদ্রূপের ক্রূর হাসি। শরীর কখনও বেঁকে যায়, কখনও আনত, কখনও শূন্যে লাফিয়ে ওঠেন, কখনও স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন মাউক্রোফোনের সামনে। এক-একটা গান একটা শব্দছবি, এক-একটা দৃশ্যায়ন যেন। প্রতুল যন্ত্রানুষঙ্গের বিকল্প তৈরি করেছেন নানাভাবে। কখনও হামিং, আলাপের ঢং, কখনও গানের বাণীতেই জুড়ে দিয়েছেন এমন কিছু শব্দ যা ধ্বনিগতভাবে যন্ত্রানুষঙ্গের বিকল্প হয়ে ওঠে। এভাবেই যে পারফর্মেন্সটি তৈরি করেন প্রতুল, সেটা আদ্যোপান্ত একটি রাজনৈতিক নির্মাণ। ধরা যাক তাঁর ‘ভয় পাস নে ছেলে’ গানটি। রেডিওয় শোনা সাঁওতালি গানের ঘুমপাড়ানি সুর আচমকাই এমন একটি রাজনৈতিক গানে বাসা বেঁধে ফেলে। ফলাফলে যেটি দাঁড়ায় তা হল শ্রেণিশত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান। সুর ও কথার এমন অভাবনীয় রসায়নে বিপ্লবী আহ্বানের ইশতেহার হয়ে যায় গানটি। সুর কথা ও পরিবেশনার রসায়নে বিদ্রূপ ও ব্যঙ্গের যে কষাঘাত তৈরি হয় তাঁর ‘টুইডলডাম টুইডলডি’ গানে সেটা বিস্ময়কর। ছোট্ট একটি গান শেষ হয় যে কড়া কষাঘাত দিয়ে তা এক ঘন্টার জ্বালাময়ী বক্তৃতাতেও অসম্ভব। এটা সম্ভব হয়েছে এ-জন্যেই যে প্রতুল শুধুমাত্র রাজনীতির গান করেননি। তিনি গানের রাজনীতিকেও, পারফর্মেন্সের রাজনীতিকেও গভীরে গিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এখান থেকেই একটি কথা বলা জরুরি হয়ে ওঠে। প্রতুলকে স্বভাবগায়ক, সহজাত গায়ক, স্বতঃস্ফূর্ত গায়নের রূপকার বললেও ভুল হবে। তিনি স্বভাবগায়ক হয়তো ছিলেন, সহজাত গায়নের একটি অদ্ভুত প্রতিভাও অবশ্যই ছিল, কিন্তু তাঁর পারফর্মেন্সকে শুধুমাত্র হৃদয়জাত বললে ভুল হবে। একটা মেধাবী মস্তিষ্কের ভাবনাও তাঁর গানে, পরিবেশনে সুস্পষ্ট।
এই সমস্ত আলোচনার শেষে একটি বিষয়ে কিছুটা ভাবনাচিন্তা না করলে শিল্পী ও মানুষ প্রতুলের সমগ্রের আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে। কেন প্রতুল লাল পতাকার মিছিলের বিরুদ্ধতার পথ ছেড়ে ত্রিবর্ণ পতাকার শাসকীয় মিত্রতায় নিজেকে পৌঁছে দিলেন? কেন রেজিস দেব্রে আগুনে বিপ্লবীর ইশতেহার রচনা করে শেষ পর্যন্ত মিত্তেরোঁর উপদেষ্টায় পরিণত হন? কেন ভীরুতার মুখে লাথি মেরে লাল ঝাণ্ডা ওঠানোর কবি ইন্দিরা মমতার ঘনিষ্ঠতায় থেকে ভরসা খোঁজেন? একে শুধুমাত্র ব্যক্তিমানুষের পথবদল ভাবলে ভুল হবে। এর একটি রাজনৈতিক মাত্রা অবশ্যই আছে যেখান থেকে মিছিলের পথ ক্ষমতার রাজপ্রাসাদে গিয়ে পথ হারায়। একজন রাজনৈতিক গায়কের সমগ্র জীবনের আলোচনায় এই রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।