
মান্তু ঘোষ
ভারতীদি চলে যাওয়াতে টেবিল টেনিসের একটা বড় ক্ষতি হল। টেবিল টেনিসের উনি খালি কোচই ছিলেন না, অভিভাবকের মতো ছিলেন। উনি যাদের শেখাতেন, তাদের কাছে বাবা-মার মতো ছিলেন। গুরুর তো এরকমই হওয়া উচিত— বাবা-মার মতো। উনি আমাদের সবার কাছে এরকমই ছিলেন। আমার ক্ষেত্রে পারিবারিক ডিসিশনও উনি নিতেন। ভারতীদি যলে যাওয়াতে একটা অভিভাবকহীন ফিলিং হচ্ছে
আমি যে পাড়ায় থাকি, শিলিগুড়ির দেশবন্ধুপাড়ায়, সেখানে আমরা জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনেরা সবাই একসঙ্গেই বড় হয়েছি। আমার বাবা ফুটবল খেলতেন। আর আমার সব জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো দাদা-দিদিরা সবাই বাইয়ের, মানে ভারতীদির কাছেই খেলত। আমার নিজের যে দিদি, সেই দিদিকেও বাবা ভর্তি করে দিয়েছিলেন ভারতী ঘোষের কাছে। আমার দিদিই আমাকে ক্লাবে নিয়ে যায়। আমার তখন ৯ কি ১০ বছর বয়স হবে। আমার বাড়ির ঠিক দুটো কি তিনটে বাড়ির পরেই দেশবন্ধু স্পোর্টিং ক্লাব। আমি তখন থেকে সেখানেই বাইয়ের কাছে ভর্তি হই। আমাদের পাড়ায় তখন এমন কোনও বাড়ি ছিল না যে-বাড়ির কেউ টেবিল টেনিস খেলেনি। সব বাড়িরই একজন-দুজন করে টেবিল টেনিস খেলেছে, এবং তারা সবাই বাইয়ের, মানে ভারতীদির ছাত্র বা ছাত্রী। ব্যাপারটা ছিল এইরকম। আমার বাড়ির বাঁদিকের দুটো বাড়ি পরেই ছিল গণেশ কুণ্ডুর বাড়ি। গণেশদা তখনকার নামকরা খেলোয়াড়। উনিও ভারতী ঘোষের কাছে খেলতেন। আমার টেবিল টেনিসে আসার পেছনে এটাও একটা কারণ ছিল— আমরা তখন দেখছি গণেশদাকে খেলতে, বাইরে যাচ্ছে, জাপানে গেল। এই ব্যাপারগুলো চোখের সামনে দেখেই একটা ইচ্ছে, টেবিল টেনিসের প্রতি আগ্রহ গড়ে ওঠে। আমার দিদি মিতুন মজুমদার, ও-ই আমাকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করায়। প্রথমদিকে আমি অতটা সিরিয়াস ছিলাম না। সিরিয়াসলি খেলতাম না, দুষ্টুমি করতাম, যথারীতি পানিশমেন্টও পেতাম। কিন্তু, আমার মনে আছে, সালটা এইট্টি ফোর-টোর হবে, সেই সময় শিলিগুড়িতে একটা র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্ট হয়েছিল, ডিস্ট্রিক্ট র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্ট। সেই টুর্নামেন্টে যে দিদিটা টপ সিড ছিলেন, আমি ছিলাম সাব-জুনিয়রে, কোনও বাছাই খেলোয়াড়ও ছিলাম না, কিন্তু আমি তাঁকে হারিয়ে দিই। এবার তাঁকে হারানোর পরেই পেপারে নাম-টাম ওঠে, সবাই খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করে। আমার জীবনের সেটা একটা টার্নিং পয়েন্ট। তারপর থেকে বাইও— বাই মানে ভারতীদি, ভারতী ঘোষ, ভারতীদিকে আমরা সবাই বাই-ই বলি— আমাকে বোঝানো শুরু করেন— দেখো, পেপারে তোমার নাম বেরিয়েছে, তুমি অনেক ভাল খেলতে পারো। তখন থেকেই আস্তে আস্তে আমি খেলাটাকে সিরিয়াসলি নেওয়া শুরু করলাম।
ভারতীদির কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে শিলিগুড়ি এবং উত্তরবঙ্গের টেবিল টেনিস কালচারের প্রসঙ্গ আসবেই। শিলিগুড়িতে টেবিল টেনিসের কালচার গড়ে ওঠার একটা বড় কারণ ছিল গণেশ কুণ্ডু। পেপারে প্রায়দিনই গণেশ কুণ্ডুর ছবি থাকত। তারপরে শ্যামল দাস, সঞ্জয় দে। এঁরাও খুব নামকরা খেলোয়ার ছিলেন। এঁদেরকে দেখে অনেকেই টেবিল টেনিসে এসেছিল। আমার যে বাড়ি— জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকতাম আমরা— আগেই বললাম, আমার জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনেরা সবাই টেবিল টেনিস খেলত। এবার সেখান থেকে আমিও যে আসব না ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যের, মানে হতেই পারে না আর কী। ওইসময়ের এটাই দস্তুর ছিল। যদিও দু-একজন ছাড়া কেউ ন্যাশনাল লেভেলে খেলতে পারেনি সেই সময়টায়, কিন্তু একটা ক্রেজ ছিল। এবং সেই ক্রেজটা কিন্তু এখনও ভীষণরকম আছে। কারণ টেবিল টেনিস যা দিয়েছে শুধু শিলিগুড়ি বা নর্থবেঙ্গলকে— এইটুকু একটা ছোট শহর থেকে তিনজন অর্জুন অ্যাওয়ার্ডি— শুভজিৎ সাহা, সৌম্যদীপ ঘোষ, মান্তু ঘোষ। এর মধ্যে আরও একটা জিনিস ঢুকবে। আমি প্রথম জুনিয়র থাকতে থাকতে সিনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এইরকম ঘটনা নর্থবেঙ্গল কেন, বাংলাতেই প্রথম। এটা যথারীতি একটা বড় আলোড়ন ফেলেছিল সামগ্রিকভাবে বাংলার টেবিল টেনিসের ক্ষেত্রেই। কারণ এই ঘটনা নিয়ে তখন পেপারে-টেপারে খবর-ছবিতে ছয়লাপ। এবার আমি যখন ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, যখন র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টগুলো খেলছি, পেপারে নাম বেরোচ্ছে, টিভিতে দেখাচ্ছে— আমি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে পর্যন্ত কেউ এখান থেকে ভাবতে পারত না সিনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়। এবার আমি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে সবাই ভাবতে শুরু করে যে না, আমিও চ্যাম্পিয়ন হতে পারি। ক্রেজ আরও বাড়ে। ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়। এবং আস্তে আস্তে ব্যাপারটা এমন জায়গায় যে তখন সবাই ভাবতে শুরু করে সাবজুনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হতে হবে, জুনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হতে হবে, ইউথ তখন ছিল না, ওই ইভেন্টটা পরে শুরু হয়েছে, সিনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। তো সেটাই হচ্ছে বড় ব্যাপার, যে তখন সবাই আস্তে আস্তে ভাবতে শুরু করে ন্যাশনাল লেভেলে। ন্যাশনাল লেভেলে তার আগে কেউ ভাবত না— সবাই ডিস্ট্রিক্ট কি স্টেট লেভেল অব্দিই ভাবতে পারত। সেটা হওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে ২০০৪ সালে আমরা নর্থবেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করি। সেটা হওয়ার পরে ৬০ জনেরও বেশি প্লেয়ার সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরি পেয়েছে। এটা যদি আজকে দুটো সংস্থা এক থাকত তাহলে কিন্তু হত না। এই ষাটজন আমি নর্থবেঙ্গল থেকে বলছি, ষাটজন কিন্তু ওই দিক থেকেও রয়েছে। এতগুলো ছেলেমেয়ের স্কোপ বেড়ে গেছে, আম্পায়ারদের স্কোপ বেড়ে গেছে, কোচেদের স্কোপ বেড়ে গেছে। ডবল-ডবল করে সবাই সুযোগ পাচ্ছে, বাইরে যেতে পারছে। আজকালকার দিনে একটা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরি— এতে তো শুধু যে চাকরি পাচ্ছে তারই উপকার হচ্ছে না, তার গোটা পরিবারটা উপকৃত হচ্ছে। এইভাবে কতগুলো পরিবার তাদের জীবিকা অর্জন করতে পারছে এখান থেকে। তাই সেই যে ক্রেজটা ছিল, আজকের দিনে সেটা তো কমেইনি, বরং আরও বেড়েছে। যারা পারফর্মার আছে, যারা পারফরমেন্স দিয়েছে, সবই কিন্তু ন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে। সুতরাং উত্তরবঙ্গে টেবিল টেনিসের এই ক্রেজ কমা অত সহজ নয়। এখানে যে খেলাটা হয়, তার লেভেলটাই হচ্ছে ন্যাশনাল বা ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে। সুতরাং, ক্রেজটা ছিল, আছে এবং থাকবে।
এবং এই কালচারের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন ভারতী ঘোষ। দেশবন্ধু ক্লাবের ছোট্ট একটা ঘরে কোচিং করাতেন বাই। উনি নিজেও খেলোয়াড় ছিলেন, চাকরি করতেন রেলে, স্পোর্টস কোটাতেই চাকরি পেয়েছিলেন। রিক্রুটমেন্টের পর খেলতে খেলতেই উনি কোচিং-এ চলে আসেন। তখনকার দিনে সায়গল ইনস্টিটিউটে উনি কোচিং শুরু করেন। পরে আসেন দেশবন্ধু ক্লাবে। সায়গল ইনস্টিটিউটে আমরা ছিলাম না। আমরা দেশবন্ধু ক্লাবে খেলতাম। এবার, এগুলো অনেকেই জানে না, উনি যে চাকরি করতেন তার অনেকটা টাকা দিয়েই উনি ওঁর কাছে যারা খেলত তাদের, শুধু তাদেরই নয়, তাদের পরিবারকেও অনেক হেল্প করতেন। দু-তিনজন এমনও আছে, যাদের উনি সংসারও চালাতেন। খেলার জন্য তাদের ব্যাট কিনে দেওয়া, রাবার কিনে দেওয়া, খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা, এগুলো তো ছিলই। এই খরচগুলো কিন্তু উনি চালাতেন। এরকম অনেকেই আছে ওঁর থেকে যারা উপকৃত হয়েছে। উনি এরকম অনেক দুঃস্থ ছেলেমেয়েকে নিজের পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন। আর টেবিল টেনিসের কথা বলতে, আমি যে বললাম, যে ক্রেজটা ছিল টেবিল টেনিসে, তার একটা অন্যতম অংশ ছিলেন ভারতী ঘোষ। উনি যখন কোচিং শুরু করলেন, ওঁর হাত থেকে ন্যাশনাল লেভেলের খেলোয়াড় বেরোল, প্রথম বেরোলেন গণেশ কুণ্ডু, তারপরে আমি যখন ফার্স্ট ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হলাম, আমি তো ওঁর কাছেই খেলতাম, তারপর যেন একটা জোয়ার চলে এল। অনেক ছেলেমেয়ে ভর্তি হল, আমার সঙ্গে খেলত যেমন তখন সুব্রত রায়, ও-ও তখন ন্যাশনাল লেভেলে খেলছে, এরকম ৮-১০ জন খেলোয়াড় কিন্তু একসঙ্গে বেরিয়ে আসে। ঠিক সেরকমই অন্য বিভিন্ন ক্লাব থেকেও কিন্তু খেলোয়াড় বেরিয়ে আসছিল। মানে শিলিগুড়িটা একটা টেবিল টেনিসের শহর হয়ে গেল নতুন করে।
ভারতীদির কোচিঙের কথা বলতে গেলে বলতে হয়— ফুটওয়ার্কের ওপর উনি ভীষণভাবে জোর দিতেন। ওইজন্য ভারতীদির কাছে যারাই খেলেছে সবারই ফুটওয়ার্ক খুব ভাল হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্যাকহ্যান্ডের ওপরেও উনি জোর দিতেন। ভারতীদির কাছে যারা খেলত ফুটওয়ার্কের মতো ব্যাকহ্যান্ডও তাদের খুব স্ট্রং ছিল। সবচেয়ে ভাল যেটা ছিল ওঁর, উনি সবসময় বলতেন টেবিলে গিয়ে কখনও লড়াই ছাড়লে চলবে না। যতই তুমি ডাউন থাকো ম্যাচে, লড়াইটা কিন্তু তোমায় ছেড়ে এলে চলবে না। এই স্পিরিটটা উনি সবসময় দিয়ে যেতেন। ছোট থেকেই এটা উনি মাথায় গেঁথে দিতেন— হারার আগে হেরো না।
ভারতীদির কোচিঙের আর একটা কথা উল্লেখ করতে হবে। স্পেশালি-এবলডদের বাই খুব ভালবাসতেন। আমি যখন ছোট ছিলাম, খেলতাম, তখনও দেখেছি বাই ওদের খুব যত্ন নিতেন। তখনও ওরা খেলত, এখনও খেলে। বাই খুবই স্নেহ করতেন ওদের, পয়সাকড়ি দিয়েও হেল্প করতেন। অনেক প্লেয়ার এরকম দেখেছি যারা হয়তো শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বাইরে যেতে পারছে না খেলতে, বাই বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে, লোক দিয়ে তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। শুধু খেলাই নয়, এরকমও দেখেছি পাড়াতে এমনিও কোনও দুঃস্থ মানুষ অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, ওষুধের ব্যবস্থা— এসবও বাই করতেন। উনি এরকমই ছিলেন। বাই চলে যাওয়ায় ওই ছেলেমেয়েগুলিও এখন অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়ল।
সব মিলিয়ে, ভারতীদি চলে যাওয়াতে টেবিল টেনিসের একটা বড় ক্ষতি হল। টেবিল টেনিসের উনি খালি কোচই ছিলেন না, অভিভাবকের মতো ছিলেন। উনি যাদের শেখাতেন, তাদের কাছে বাবা-মার মতো ছিলেন। গুরুর তো এরকমই হওয়া উচিত— বাবা-মার মতো। উনি আমাদের সবার কাছে এরকমই ছিলেন। আমার ক্ষেত্রে পারিবারিক ডিসিশনও উনি নিতেন। তখন আর কী কেমন ছিল ব্যাপারগুলো, আমি বলুন, সুব্রত বলুন, আমরা যাচ্ছি সকাল-বিকেল ক্লাবে— বাবা-মায়েরা ওইটুকুই জানতেন। কী হচ্ছে, কী খেলছি, কোন টুর্নামেন্ট খেলব, কোথায় যাব— এই সব ডিসিশনগুলোই ছিল কোচের হাতে। যে-কোনও ডিসিশনই নিতেন ওঁরা। স্কুলে কটা থেকে কটা যাব, কখন পড়তে যাব, কখন প্র্যাকটিসে আসব— সবকিছুই গাইড করতেন ওঁরা। ভারতীদি চলে যাওয়াতে একটা অভিভাবকহীন ফিলিং হচ্ছে। বাড়িতে বাবা-মা বা বয়স্ক কেউ চলে গেলে যেটা হয়, একটা গাছের ছায়া চলে যাওয়ার মতো, একদমই সেরকম মনে হচ্ছে।
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত