
প্রবুদ্ধ ঘোষ
আজও ক্রীড়া-ইতিহাসবিদেরা স্প্যাসকির প্রসঙ্গ-মাত্র ফিশারের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ‘ফিশার বনাম স্প্যাসকি’ খেতাবি যুদ্ধ তুলে আনেন। কিন্তু, ববি ফিশারের ছায়ার বাইরে একজন আস্ত বরিস স্প্যাসকি আছেন। ১৯৭২-এর বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের আগে এবং পরে একজন দুর্দান্ত বরিস স্প্যাসকি আছেন। ১৯৭২ বিশ্বখেতাবি লড়াই এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সোভিয়েতের সেই প্রথম ও শেষ পরাজয় বরিস স্প্যাসকির একমাত্র পরিচয়জ্ঞাপক নয় কিংবা তাঁর জীবনের একমাত্র সত্য নয়। স্প্যাসকির দাবাসৌকর্যের সত্য তাঁর একদা-প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অষ্টম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মিখাইল তালের তাঁর প্রতি জানানো বিনম্র শ্রদ্ধা
মিথপ্রতিম সোভিয়েত দাবাসাম্রাজ্যের অন্যতম স্থপতি কিন্তু সোভিয়েত দাবাস্কুলের সবচেয়ে অবাধ্য দুজন ছাত্রের নাম মিখাইল তাল এবং বরিস স্প্যাসকি। সোভিয়েত দাবার ছাঁচে ও ধাঁচায় কিছুতেই আঁটা যায়নি তাঁদের। অথচ ১৯৬০-এর দশকের ক্রীড়া-রাজনীতির সর্বাপেক্ষা আলোচিত নামগুলির মধ্যে তাঁরা অন্যতম সেরা। বরিস স্প্যাসকি সম্প্রতি মারা গেলেন। মিডলগেম বিশারদ এবং নিখুঁত দানবিশ্লেষক স্প্যাসকির স্মরণে এই লেখা।
বরিস স্প্যাসকির প্রথম সাফল্য মাত্র ১৫ বছর বয়সে। লেনিনগ্রাদ চ্যাম্পিয়নশিপ। তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিযোগিতা বিবেচিত হত লেনিনগ্রাদ দাবা প্রতিযোগিতা। স্বনামধন্য দাবাতাত্ত্বিকরা খেলতেন এই প্রতিযোগিতায়। ১৫ বছর বয়সে স্প্যাসকি এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হলেন। মার্ক তাইমানভ চ্যাম্পিয়ন। লেভেনফিশ তৃতীয়। ভিক্টর করশনয় চতুর্থ। ১৬ বছরের স্প্যাসকি বুখারেস্ট দাবায় স্মাইস্লভের মুখোমুখি হলেন। ভ্যাসিলি স্মাইস্লভ। দাবার সুদীর্ঘ সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অন্যতম সেনাপতি। ১৯৪৮ সালে যে বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ে মিখাইল বটভিনিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, তাতে দ্বিতীয় হয়েছিলেন স্মাইস্লভ। বটভিনিকের একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাগ বসিয়ে ১৯৫৭ সালে খেতাব জিতেছিলেন স্মাইস্লভ। ১৯৫৩-৫৯ সালে স্মাইস্লভ ক্রীড়াদক্ষতার তুঙ্গে ছিলেন। একাধিক প্রথমসারির দাবা প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন। বুখারেস্টের প্রতিযোগিতায় কিশোর স্প্যাসকিকে হয়তো অবজ্ঞাই করেছিলেন স্মাইস্লভ। কালো ঘুঁটি নিয়ে কিং-সাইড দিয়ে আক্রমণ শানিয়েছিলেন। কিন্তু ভাবতে পারেননি যে সেই আক্রমণ সামলে প্রত্যাক্রমণের সাহসী নীতি বেছে নেবেন স্প্যাসকি। তারপর একত্রিশ দানের মাথায় নিখুঁত দানগণনায় ঘাতক কৌশলের প্রয়োগ করলেন স্প্যাসকি। মিখাইল বটভিনিকের মতো জহুরির চোখ এই বুখারেস্ট প্রতিযোগিতার পরে ঠিক চিনে নিয়েছিল। তবে, কিছু দাবা-বিশারদের সংশয় তখনও ছিল। স্মাইস্লভকে হারানো নিশ্চয়ই কোনওভাবে হয়ে গেছে, ও আর সম্ভব না! তাঁদের ভুল প্রমাণ করে আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত ক্যান্ডিডেটস দাবায় ওই ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন স্প্যাসকি। উল্লেখ্য এই ক্যান্ডিডেটস দাবা জিতেই ১৯৫৭-র বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের যোগ্যতা অর্জন করেন স্মাইস্লভ। স্প্যাসকি এবার কালো নিয়ে হারালেন স্মাইস্লভকে। প্রতিযোগিতার দীর্ঘতম গেম খেলে ৬৬ দানে পরাজিত করেন স্মাইস্লভকে। ঊনিশ বছরের স্প্যাসকি কুইনের বিরুদ্ধে দ্বৈত রুক এন্ডগেমে সেদিন অসাধারণ ক্রীড়াদক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর স্নায়বিক কাঠিন্য, এন্ডগেমের তত্ত্বজ্ঞান এবং জেতার অদম্য জেদের জন্যই গেমটা জিতেছিলেন তিনি।

54.Qxf3+ Rcg4 55.Kh2 Kxh4 56.Qf6+ Kh5 57.Qf3 Kg5 58.Qe3+ Kf5 59.Qf3+ Ke5 60.d4+ Kxd4 61.Qd1+ Kc3 62.Kh3 Kb4 63.Qc2 Rg3+ 64.Kh4 R7g4+ 65.Kh5 Rc4 66.Qd2+ Rgc3 0-1
ঝড়ঝাপটা আর প্রতিকূলতা একজন প্রকৃত চ্যাম্পিয়নকে গড়ে দেয়। ক্রীড়াজগতের এই প্রবাদবাক্যের অন্যতম সফল উদাহরণ স্প্যাসকি। গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন, জুনিয়র দাবায় বিশ্বখেতাব জয়, ১৯৫৬-র ক্যান্ডিডেটসে দারুণ খেলা এই সবকিছুই আচমকা ফিকে হতে লাগল। ১৯৫৮ সালে রিগায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতায় খেতাবজয়ের একদম কাছে পৌঁছেও শেষ তিনটি ম্যাচে পরপর হেরে গেলেন। মিখাইল তালের বিরুদ্ধে জেতা পজিশন থেকে একটু একটু করে রাশ হারালেন। এন্ডগেমে পৌঁছে হারলেন। ১৯৬০-এর দশকের শুরুতেই বিবাহবিচ্ছেদ। একমাত্র সন্তান জন্মানোর পরেই দু-বছরের বিয়ে ভেঙে গেল। স্প্যাসকি বরাবরই শান্ত। অন্তর্মুখী। মুখভঙ্গিতে আবেগের বহিঃপ্রকাশ কম। উচ্ছ্বাস কিংবা মনোকষ্ট সংযত করতে জানেন। তাই মানসিক ভাঙচুরের ছবি কিছুতেই বাইরে ধরা পড়তে দিলেন না। শরীর খারাপ হতে লাগল ঘন ঘন। এসবের অবধারিত প্রভাব সরাসরি পড়ল খেলায়। তবু, আশ্চর্য সংহত ভঙ্গিতে কখনও প্রকাশ করলেন পরাজয় আর বিচ্ছেদের বেদনা। “আমি আর নাদেজদা বিপরীত রঙের বিশপ ছিলাম। দুজনে তাই দুটো আলাদা ডায়গনাল বেছে নিলাম। বিচ্ছেদ হয়ে গেল।”
১৯৫৮-১৯৬৩ অবধি জীবনের এক যন্ত্রণাময় অধ্যায় সয়ে স্প্যাসকি মস্কোয় চলে গেলেন। দিশেহারা স্প্যাসকিকে জীবনে ফেরাল দাবা। আর, তাঁকে দাবায় ফেরালেন ইগর বোনদারেভস্কি। ভাঙা মনের ধুলো ঝেড়ে অনুশীলনে ফিরলেন স্প্যাসকি। ততদিনে দাবাবিশ্ব অনেকটাই বদলে গেছে। সোভিয়েতের আধিত্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে, কিন্তু দুজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বদলে গেছে। বটভিনিক বিশ্বখেতাবি লড়াই থেকে অবসর নিয়েছেন। টাইগ্রান পেট্রোসিয়ান নতুন বিশ্বখেতাবধারী। বোনদারেভস্কি সেই হতোদ্যম অবস্থা থেকে স্প্যাসকিতে ফের বিশ্বের সেরা দাবাড়ুদের কাতারে আনতে তাঁর খেলায় শান দিলেন। স্প্যাসকির খেলার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল পজিশন অনুযায়ী খেলার কৌশল বদলে নেওয়া এবং কিং-পন ও কুইন-পন ওপেনিংয়ের ওপরে সমান দখল। মিডলগেমের জটিলতা থেকে জেতার পথ খুঁজে নেওয়া এবং এন্ডগেমে নিখুঁত দানগণনায় প্রতিপক্ষের শেষ প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়া— স্প্যাসকি সময়বিশেষে নির্মম, নিষ্ঠুর এবং অপ্রতিরোধ্য। মাঝের কয়েক বছরে তাঁর ইস্পাতকঠিন মানসিকতায় যে চিড় ধরেছিল, সেসব সারিয়ে তুলে স্প্যাসকিকে পুরনো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিলেন বোনদারেভস্কি। স্প্যাসকি কখনও নিজের দাবা-প্রশিক্ষকদের ঋণ স্বীকার করতে ভোলেননি। “ভ্লাদিমির জাক আমাকে অস্ত্র দিয়েছিলেন। আলেক্সান্দার টলুশ সেটাকে ধারালো করেছিলেন। আর, বোনদারেভস্কি সেই অস্ত্রকে ইস্পাতকঠিন করে তুলেছিলেন।” ১৯৬৪-র আমস্টারডাম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে ফের খেতাবের গন্ধ পেতে শুরু করলেন স্প্যাসকি। ব্রনস্টাইন, রেশেভস্কি, গিলগোরিচ, পর্টিশদের পেছনে ফেললেন। ২৩ গেমে ১৭ পয়েন্ট নিয়ে স্মাইস্লভ, বেন্ট লার্সেন এবং মিখাইল তালের সঙ্গে যৌথভাবে প্রথম স্থান অধিকার করলেন। ১৩তম রাউন্ডে পল বেঙ্কোকে যেভাবে হারালেন, তা শিক্ষণীয়। ক্যারো-কান ডিফেন্সের বিরুদ্ধে মাঝছক মুক্ত রাখার নীতিতে খেলেছিলেন স্প্যাসকি। মিডলগেম থেকে এন্ডগেমে রূপান্তরের সময়ে সামান্য অ্যাডভান্টেজ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর সেটাকেই জয়ের অ্যাডভান্টেজে পরিণত করলেন C-ফাইলে একটা অপ্রতিরোধ্য পন তৈরি করে। স্প্যাসকি যে প্রবলভাবে আবার দাবায় ফিরতে শুরু করেছিলেন, তার প্রমাণ রাখলেন ১৯৬৫-র ক্যান্ডিডেটস দাবায়। কেরেস, জেলার, তাল— পরপর এঁদের হারিয়ে ক্যান্ডিডেটস জিতলেন। পল কেরেসের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে এবং তালের বিরুদ্ধে ফাইনালে শুরুতেই চাপে পড়ে গেছিলেন স্প্যাসকি। হেরে গেছিলেন প্রথমদিকের গেমে। ওটাই ছিল কেরেসের শেষ ক্যান্ডিডেটস প্রতিযোগিতা। সর্বশক্তি দিয়ে স্প্যাসকিকে হারাতে চেয়েছিলেন দাবাতাত্ত্বিক তথা কিংবদন্তি কেরেস। কিন্তু প্রত্যাবর্তনে নির্মম হয়ে কেরেসের যাবতীয় প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেন স্প্যাসকি। ফলাফল ৬-৪। ফাইনাল ম্যাচে মিখাইল তালের বিরুদ্ধে ফলাফল ৭-৪। শেষ তিনটি গেমেই জেতেন স্প্যাসকি। ৫-৪ এগিয়ে যাওয়ার গেমে অনবদ্য এন্ডগেম উপহার দেন স্প্যাসকি। সুসংহত পন-কাঠামোর সুবিধে নিয়ে দ্বৈত রুক+নাইট এন্ডগেমে প্রথমে ‘এক্সচেঞ্জ আপ (নিজের নাইট দিয়ে বিপক্ষের রুক জিতে নেওয়া)’ হন। তারপর তালের একটি অপ্রতিরোধ্য পনকে রুখে দিয়ে জেতার দোরগোড়ায় পৌঁছে যান। যদিও স্প্যাসকি মনে করতেন তাঁর দুর্বলতা ওপেনিং তত্ত্বের প্রস্তুতিতে এবং এন্ডগেমে— কিন্তু মিডল গেমের দক্ষতায় তিনি ওপেনিং আর এন্ডগেমের তুলনামূলক দুর্বলতা জয় করতে জানেন। ১৯৬০-এর দশকে ‘কমপ্লিট প্লেয়ার’ অর্থাৎ খেলার প্রত্যেক বিভাগেই দক্ষতা থাকা দাবাড়ু ছিলেন স্প্যাসকি। আর, সেই দক্ষতাতেই ১৯৬৬ সালে এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে পরাজিত করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেরা দাবাড়ু রবার্ট জেমস ফিশারকে। এই ম্যাচেও চমৎকার এন্ডগেম খেলেছিলেন স্প্যাসকি। ফিশারের সুবিদিত এন্ডগেমজ্ঞানকে পর্যুদস্ত করে কঠিন বিশপ বনাম নাইট এন্ডগেম জিতে নিয়েছিলেন। মনে রাখা দরকার, ফিশার তখন বিশ্বদাবায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন এবং নিজের ঘরানা তৈরি করে নিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে পেট্রোসিয়ানের বিরুদ্ধে বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের আগে বরিস স্প্যাসকির সাক্ষাৎকার নিয়েছিল ‘নেদেলি’ সংবাদপত্রের এক সাংবাদিক। ‘পশ্চিমি বিশ্বের সেরা দাবাড়ু কে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে স্প্যাসকি নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ববি ফিশার’!

35.h4 Nc4 36.Ke2 Ne5 37.Ke3 Kf6 38.Kf4 Nf7 39.Ke3 g5 40.h5 Nh6 41.Kd3 Ke6 42.Ba8 Kd6 43.Kc4 g4 44.a4 Ng8 45.a5 Nh6 46.Be4 g3 47.Kb5 Ng8 48.Bb1 Nh6 49.Ka6 Kc6 50.Ba2 1-0
###
পেট্রোসিয়ানের সঙ্গে বিশ্বখেতাবি মঞ্চে স্প্যাসকির সাক্ষাৎ দুবার। ১৯৬৬ আর ১৯৬৯। ১৯৬৬-র বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ে স্প্যাসকিই এগিয়ে ছিলেন, অন্তত দাবাবিশেষজ্ঞরা সেরকমই ভেবেছিলেন। আগের দু-বছরে বিশ্বদাবায় স্প্যাসকির আধিপত্য সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। যে-কোনও পজিশনে মানিয়ে নিয়ে নিজের স্বাভাবিক পজিশনাল+ট্যাকটিকাল গেমের ঔজ্জ্বল্য বের করে আনার ক্ষেত্রে স্প্যাসকি অনন্য। অন্যদিকে পেট্রোসিয়ানের আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধের। প্রথম ছটি গেমে কিছুতেই পেট্রোসিয়ানের দুর্গ ভাঙতে পারলেন না স্প্যাসকি। পঞ্চম গেমে এন্ডগেমে একটি পন বেশি নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন স্প্যাসকি। কিন্তু প্রায় ৩৮ দান ধরে অবিশ্বাস্য প্রতিরোধক্ষমতা দেখান পেট্রোসিয়ান। শেষ পর্যন্ত রুক+বিশপ বনাম রুক+নাইট এন্ডগেম ড্র হয়। দশম রাউন্ডে পেট্রোসিয়ান চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। স্প্যাসকি গেমে ফেরার সুযোগই পাননি। ১৩ ও ১৯তম রাউন্ডে স্প্যাসকি জিতলেন বটে, কিন্তু পেট্রোসিয়ানের অভিজ্ঞতা এবং রক্ষণাত্মক দক্ষতা থেকে কাঙ্ক্ষিত চূড়ান্ত জয় বের করে আনতে পারলেন না। শেষ তিনটি গেমের দুটোতেই হারলেন। হয়তো দীর্ঘ ২২ গেম ধরে স্নায়ুর জোর ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু কয়েক বছর আগের স্প্যাসকির সঙ্গে ১৯৬৫-পরবর্তী স্প্যাসকির মানসিকতার আকাশ-পাতাল তফাৎ। সেইজন্যেই ১৯৬৬-র হারের পরে নতুন উদ্যমে ফিরলেন স্প্যাসকি। স্প্যাসকির নিজের কথায়, “আমি প্রতি-আক্রমণের নীতিতে স্বচ্ছন্দ। আক্রমণ করা সহজ, সেটা করতে পারলে ভালই হয়। কিন্তু আমি মূলত প্রতি-আক্রমণ গড়ে তুলতে ভালবাসি।” ১৯৬৮ সালে জিতলেন দাবার অস্কার। সেই বছরের ক্যান্ডিডেটসে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফাইনালের যাত্রাপথে হারালেন এফিম জেলার, বেন্ট লার্সেন এবং ভিক্টর করশনয়কে। তারপর ১৯৬৯ সালের বিশ্বখেতাবি যুদ্ধে ফের পেট্রোসিয়ানের মুখোমুখি। অনেকেই ভেবেছিলেন স্প্যাসকি শেষ পর্যন্ত স্নায়ুকাঠিন্য রাখতে পারবেন না; তিন বছর আগের মতো এবারেও হয়তো তীরের কাছাকাছি পৌঁছেও তরী ডুবিবে। একমাত্র ভ্যাসিলি স্মাইস্লভ বলেছিলেন, “চেষ্টা এবং জয়ের লক্ষ্যে হেরে গিয়েও বারবার ফিরে ফিরে আসা। ১৯৫৪ সালে আমি বটভিনিকের সঙ্গে পারিনি কিন্তু তিন বছর পরে সেই অপরাজেয় বটভিনিককেই হারিয়েছিলাম। স্প্যাসকিও পারবে জিততে।” পেট্রোসিয়ানের প্রতিরোধ ভাঙার কৌশল আয়ত্ত করেই যুদ্ধে নেমেছিলেন স্প্যাসকি। প্রথম থেকেই উপর্যুপরি আঘাত হানতে লাগলেন পেট্রোসিয়ানের গেমপ্ল্যানে। এগিয়ে গেলেন। আর, উনিশ নম্বর রাউন্ডে বের করে আনলেন নিজের সেরা খেলা। প্রবল আক্রমণের ঝড়। বিধ্বস্ত পেট্রোসিয়ানের পজিশন। তিনিই যে সম্ভাব্য বিশ্বখেতাবজয়ী, তা বুঝিয়ে দিলেন ক্রীড়াবিশ্বকে।

1.e4 c5 2.Nf3 d6 3.d4 cxd4 4.Nxd4 Nf6 5.Nc3 a6 6.Bg5 Nbd7 7.Bc4 Qa5 8.Qd2 h6 9.Bxf6 Nxf6 10.O-O-O e6 11.Rhe1 Be7 12.f4 O-O 13.Bb3 Re8 14.Kb1 Bf8 15.g4 Nxg4 16.Qg2 Nf6 17.Rg1 Bd7 18.f5 Kh8 19.Rdf1 Qd8 20.fxe6 fxe6 21.e5 dxe5 22.Ne4 Nh5 23.Qg6 exd4 24.Ng5 1-0
স্প্যাসকি পরে স্বীকার করেছিলেন যে, ১৯৬৬-র বিশ্বখেতাবি যুদ্ধের আগে আত্মতুষ্টি পেয়ে বসেছিল তাঁকে। তার ওপরে পরপর প্রতিযোগিতার ধকল সামলে ক্লান্ত ছিলেন। সোভিয়েত দাবা সংস্থা থেকে যে বৃত্তি পেতেন, তাতে আরও ভাল মানের প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব ছিল, এই আক্ষেপও করেছিলেন।
১৯৭২-র বিশ্বখেতাবি লড়াইতে ফিশারের কাছে হেরে স্প্যাসকির দ্যুতি কিছুটা ম্লান হল বটে, কিন্তু প্রকৃত চ্যাম্পিয়নদের মতোই প্রবল বিক্রমে ফিরে এলেন ১৯৭৩ সালে। তৎকালীন বিশ্বদাবার সবচেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতা সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব জিতলেন। সে-যুগের প্রবাদবাক্য ছিল, সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপ থেকেই পরবর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হয়। সোভিয়েতের শীর্ষ দাবাড়ুদের গড় রেটিং বিশ্বের অন্যান্য শীর্ষ দাবাড়ুদের গড় রেটিংয়ের চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল। ফলে সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপের ফলাফলের দিকে ক্রীড়াবিশ্ব তাকিয়ে থাকত। স্প্যাসকি বিশ্বখেতাব হারানোর এক বছরের মধ্যে যেভাবে ‘ও কিছুই না’ মনোভাব নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন, তা অবিস্মরণীয়। স্প্যাসকি চ্যাম্পিয়ন। আনাতোলি কারপভ দ্বিতীয়; উল্লেখ্য দু-বছরের মধ্যে তিনিই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ঘোষিত হবেন তথা সোভিয়েতের পোস্টার-বয় হয়ে উঠবেন। পেট্রোসিয়ান তৃতীয়, পোলুগভেস্কি চতুর্থ। কুযমিন, জেলার, গ্রিগোরিয়ান, পল কেরেস, মার্ক তাইমানভ, মিখাইল তাল প্রমুখ পরের স্থানগুলি দখল করেছিলেন। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে সোভিয়েত দাবাসংস্থার সহ-সভাপতি বাটুরিনস্কি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন সোভিয়েতের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রতিযোগিতা এটি— পরবর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন খুঁজে নেওয়ার লড়াই। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ফিশারের হাতে খেতাব বেদখল হওয়ার ‘অসম্মান’ থেকে মুক্তি খুঁজছিল সোভিয়েত দাবা। বরাবরই ‘সেরার সেরা’ দাবাড়ু খুঁজে নিয়েছে সোভিয়েত দাবা, তাই ১৯৭৩-এর সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে পরের খেতাবজয়ীকে তুলে আনতে মরিয়া হয়ে উঠল তারা। স্প্যাসকি ১৭টি গেমের মধ্যে একমাত্র ভ্লাদিমির স্যাভনের কাছে হেরেছিলেন। অপ্রত্যাশিত হার। কিন্তু, দ্রুত সেই পরাজয় সামলে নিয়ে তাইমানভ, স্বেসনিকভ, বেলিয়াভস্কিকে হারালেন। শেষ দুই রাউন্ডে করশনয় এবং পেট্রোসিয়ানের বিরুদ্ধে ড্র। কিন্তু, ১৯৭৪ সালের ক্যান্ডিডেটস জিতলেন কারপভ। ১৯৬৫-৭৩— স্প্যাসকির দাবাজীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও আধিপত্যমূলক অধ্যায় শেষ হল।
###
বটভিনিক-পরবর্তী সোভিয়েত দাবাসাম্রাজ্যের সেনাপতি হওয়ার কথা ছিল বরিস স্প্যাসকির। সোভিয়েত দাবাকে ক্রীড়াদক্ষতার যে পর্যায়ে উন্নত করেছিল, সেখানে বোর্ডে বসে দানপর্যায় ভাবার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক কাঠিন্য এবং দাবাড়ুর ক্রীড়াদর্শন সমান তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্প্যাসকির নিকটতম দাবাশত্রুরা জানতেন যে, স্প্যাসকি শারীরিক ও মানসিকভাবে চূড়ান্ত দক্ষ ছিলেন। পজিশনের কোনও ছাপ তাঁর অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠত না। খারাপ পজিশনই হোক বা জেতার আগের মুহূর্ত, স্প্যাসকির মুখের একটিও পেশি তাঁর মানসিক অবস্থা জানান দিত না। সর্বোপরি, ধীরে ধীরে আক্রমণ গড়ে তুলে প্রতিপক্ষকে পিষে দেওয়া এবং মিডলগেমের জটিলতায় নিপুণ দক্ষতায় শৈল্পিক দানপর্যায়ে জয় ছিনিয়ে আনা— সোভিয়েতসুলভ এই দক্ষতা তাঁর ছিল। তবু, কিছুতেই স্প্যাসকিকে সোভিয়েতের রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাঁচে পুরোপুরি ঢেলে নেওয়া গেল না। স্প্যাসকির প্রিয় লেখকের নাম সলঝেনিৎসিন, যাঁর নামোচ্চারণও তৎকালীন সোভিয়েতে নিষিদ্ধ ছিল। স্প্যাসকি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, একটি গ্রামে দাবা শেখাতে গিয়ে কথাপ্রসঙ্গে তিনি কম বেতনের কথা বলেছিলেন। সোভিয়েতের পুলিশ সেসব নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে রিপোর্ট পাঠায়, স্প্যাসকির ঠাকুর্দা যাজক ছিলেন, সেই উল্লেখও পুনরায় উত্থাপিত হয়। কিন্তু সেই আলোচনাতেই তিনি যে সলঝেনিৎসিনের লেখার কথা বলেছিলেন, তা উহ্য রাখা হয়! সোভিয়েত দাবার সেরা সময়ের দাবাড়ুদের তুলনামূলক আলোচনায় স্প্যাসকি বটভিনিকের থেকে এগিয়ে রেখেছেন মিখাইল তালকে। পেট্রোসিয়ানকে। আর, পল কেরেসকে। পল কেরেসের প্রতি অফুরান শ্রদ্ধা ছিল স্প্যাসকির। তাঁর মতে, কেরেস ছিলেন গালিভার আর বাকিরা লিলিপুট— আর, বটভিনিক ছিলেন সেই লিলিপুটদের নেতা! খুব স্বাভাবিকভাবেই এমন একজন ব্যক্তিত্বকে ‘আদর্শ’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়নি সোভিয়েত। ১৯৭২ সালে ববি ফিশারের কাছে পরাজয় তথা ঠান্ডাযুদ্ধের রাজনৈতিক মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সোভিয়েতের প্রথম পরাজয় স্প্যাসকির সোভিয়েতসুলভ দাবা-ইমেজে চিড় ধরাল। ফিশারের একাধিক শর্ত স্প্যাসকি মেনে নিয়েছিলেন, হয়তো সেইসব শর্ত এড়িয়ে যেতেও পারতেন। কিন্তু, দাবার প্রতি অশেষ ভালবাসা বারবার স্প্যাসকিকে ফিশারের মুখোমুখি বসিয়েছে। রেকর্ড বলছে, ১৯৭২-এর আগে যতবার ফিশার বনাম স্প্যাসকি ম্যাচ হয়েছে, স্প্যাসকিই জিতেছেন। বিশ্বখেতাবি যুদ্ধের দ্বিতীয় রাউন্ডের পরে সোভিয়েত দাবাসংস্থার প্রধান পাভলোভিচের নির্দেশ ছিল, ফিশারের শর্তের বিরুদ্ধে গিয়ে ফিশার আর ফিডের ওপরে পালটা শর্ত চাপিয়ে দিতে হবে স্প্যাসকিকে। বিশ্বখেতাবি যুদ্ধ ভেস্তে গেলে খেতাব সোভিয়েতের কাছেই থাকত। স্প্যাসকি তা করেননি। “আমি চ্যাম্পিয়ন। আমি একবার যখন খেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সেখান থেকে পিছু হটব কেন? যুদ্ধ না দিয়ে রাজা পালাতে পারে না।” ফিশার বনাম স্প্যাসকি দু-দশক পরেও সোভিয়েত বনাম যুক্তরাষ্ট্রের যাবতীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে বেপরোয়া ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। প্রিয় শত্রুর মুখোমুখি হতে কোনও রাজনীতি, কোনও ফিডে, কোনও প্রভাবকে পাত্তা দেননি ফিশার বা স্প্যাসকি। বটভিনিকের পরে দাবাসাম্রাজ্যের সেনাপতি পদে সোভিয়েত বরণ করে নিল আনাতোলি কারপভকে। আর, বরিস স্প্যাসকি অবাধ্য, বেপরোয়া, নিখাদ দাবাপ্রেমী হয়ে রয়ে গেলেন, যাঁর মিডলগেমের নীতি-কৌশল পরবর্তী প্রজন্মের ব্যাকরণ বইতে রয়ে গেল।

আজও ক্রীড়া-ইতিহাসবিদেরা স্প্যাসকির প্রসঙ্গ-মাত্র ফিশারের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ‘ফিশার বনাম স্প্যাসকি’ খেতাবি যুদ্ধ তুলে আনেন। কিন্তু, ববি ফিশারের ছায়ার বাইরে একজন আস্ত বরিস স্প্যাসকি আছেন। ১৯৭২-এর বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের আগে এবং পরে একজন দুর্দান্ত বরিস স্প্যাসকি আছেন। ১৯৭২ বিশ্বখেতাবি লড়াই এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সোভিয়েতের সেই প্রথম ও শেষ পরাজয় বরিস স্প্যাসকির একমাত্র পরিচয়জ্ঞাপক নয় কিংবা তাঁর জীবনের একমাত্র সত্য নয়। স্প্যাসকির দাবাসৌকর্যের সত্য তাঁর একদা-প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অষ্টম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মিখাইল তালের মন্তব্য—
স্প্যাসকি আলেখাইনের মতো আক্রমণে দক্ষ এবং পেট্রোসিয়ানের মতো রক্ষণ সামলানোয়। যখন যেমন পজিশন, তখন তেমনভাবেই মানিয়ে নিতে জানে স্প্যাসকি, আর সেটাই একজন চ্যাম্পিয়নের সর্বোচ্চ গুণ।
একটা গেম শেষে থাক। এই গেমটা বরিস স্প্যাসকির খেলা ‘সেরা’ গেম হয়তো নয়, স্প্যাসকি বা তাঁর প্রতিপক্ষ কারপভ কেউই সে-সময় নিজেদের ফর্মের শীর্ষে নেই। কিন্তু স্প্যাসকি ৭০ বছর বয়সে একটি র্যাপিড প্রতিযোগিতায় গেমটি খেলেছিলেন ৫৫ বছর বয়সী কারপভের বিরুদ্ধে। মিডলগেম থেকে এন্ডগেমে রূপান্তরের মুহূর্তেই খেলার নাড়ি ধরে ফেলেছিলেন স্প্যাসকি। তারপর সমবর্ণের বিশপ এন্ডগেমের তত্ত্ব নিখুঁতভাবে মেনে কিং নিয়ে মাঝছক দখল করেছিলেন। পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হয়েছিলেন কারপভ।
বরিস স্প্যাসকি বনাম আনাতোলি কারপভ
1.e4 c6 2.d4 d5 3.Nc3 dxe4 4.Nxe4 Nd7 5.Nf3 Ngf6 6.Nxf6+ Nxf6 7.h3 Bf5 8.Bd3 Bxd3 9.Qxd3 e6 10.O-O Be7 11.c4 O-O 12.b3 c5 13.Bb2 cxd4 14.Rfd1 Qa5 15.Bxd4 Rfd8 16.Qe2 Qf5 17.Rd3 Qe4 18.Qxe4 Nxe4 19.Rad1 Kf8 20.Kf1 f6 21.Be3 Rxd3 22.Rxd3 Ke8 23.Nd2 Nxd2+ 24.Rxd2 a6 25.Ke2 Rd8 26.Rxd8+ Kxd8 27.c5 Kd7 28.Kd3 Bd8 29.b4 Bc7 30.Kc4 h5 31.a4 Be5 32.b5 axb5+ 33.axb5 Kc7 34.g4 hxg4 35.hxg4 Kd7 36.f4 Bb2 37.f5 e5 38.Kd5 Ba3 39.g5 fxg5 40.Bxg5 Bb2 41.Bh4 1-0