শ্রমের বাজারে লিঙ্গবৈষম্য অর্থনৈতিক উন্নয়নকে থামিয়ে দিচ্ছে

দেবাশিস মিথিয়া

 


‘জেন্ডার গ্যাপ ২০২৪’ অনুযায়ী, লিঙ্গবৈষম্যের বিচারে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের জায়গা হয়েছে ১২৯ নম্বরে। ২০২৩ সালে যা ছিল ১২৭। ‘শিক্ষার সুযোগ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন'-এর প্রশ্নে ভারতীয় মহিলারা তুলনায় পুরুষের থেকে অনেকটা পিছিয়ে। অথচ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং নেপালের মতো ছোট ছোট প্রতিবেশী দেশও লিঙ্গসমতার নিরিখে ভারতের চেয়ে ভাল জায়গায় রয়েছে। ভারতীয় মহিলাদের সমাজের সামনের সারিতে তুলে আনতে সাবিত্রী বাই ফুলে, চন্দ্রমুখী বসু এবং কাদম্বিনী গাঙ্গুলিরা লড়াই করেছিলেন, নতুন পথের দিশা দেখিয়েছিলেন। তাঁদের আন্দোলনের প্রায় ১৫০ বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হল ভারতীয় অর্থনীতিতে লিঙ্গসমতা আসেনি

 

বর্তমান যুগ সোশাল মিডিয়া বা সমাজমাধ্যমের। জীবনের সব তথ্য সবার কাছে দ্রুত পৌঁছে দিতে না পারলে কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। পুরুষ থেকে মহিলা, আট থেকে আশি সবাই এখন মজে আছেন সোশাল মিডিয়ায়। দিনের একটা ভাল সময় কাটাচ্ছেন কোনও-না-কোনও সমাজমাধ্যমে। অতি দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছেন বিশ্বের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। এখন সব তথ্যই প্রায় মানুষের হাতের মুঠোয়। মানুষের ব্যবহৃত সামাজিক মাধ্যমগুলির ধরনও ভিন্ন। ‘লিঙ্কডইন’ এরকমই একটি ব্যতিক্রমী সমাজমাধ্যম। ‘প্রফেশনাল’ লোকেরাই মূলত এই প্ল্যাটফর্মটিকে ব্যবহার করেন। তাঁরাই এখানে তথ্য সরবরাহ করেন আবার এখান থেকে তথ্য নিয়ে তা পেশাগত জগতে কাজে লাগান। সদস্যদের প্রোফাইলে চোখ বোলালে পাওয়া যাবে একজন কর্মীর কর্মজীবনের সব তথ্য। অন্যভাবে বললে, সমাজমাধ্যম থেকে সংগৃহীত প্রফেশনালদের তথ্যসম্ভারই ‘লিঙ্কডইন ডেটা’। এই তথ্যকে নেটওয়ার্কিং, নিয়োগ এবং সর্বোপরি কাজের বাজারের প্রকৃতি বুঝতে ব্যবহার করা হয়।

লিঙ্কডইন ডেটা বলছে, কাজের দুনিয়ায় শীর্ষ বা সি-স্যুট লেভেলে মহিলাদের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কম। এই ছবি বিশ্বের সর্বত্র। যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ব্রাজিল এবং ভারতের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলিও এই সমস্যায় জর্জরিত। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে নেত্রী হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩১.৭ শতাংশ মহিলাকে। যা ২০২৩ সালের তুলনার চেয়ে ০.৪ শতাংশ কম। ইদানিং একটা বিষয় স্পষ্ট, মহিলাদের কাজের বাজারে পুনরায় মন্দা এসেছে। খুব ধীরে হলেও ২o১৬ সাল থেকে প্রতি বছর ১ শতাংশ করে মহিলারা উচ্চপদে আসীন হচ্ছিলেন। কোভিড মহামারির পর দেখা গেল কাজের ক্ষেত্রে মহিলাদের নেতৃত্ব দেওয়ার হার ক্রমশ কমছে। বিষয়টি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ করে তুলছে। লিঙ্কডইনে নথিভুক্ত মহিলা কর্মীর অনুপাত ৪৭.৭ শতাংশ। যা মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। তবে চিন্তার কথা হল— প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে বা সি-স্যুট লেভেলে পৌঁছানোর দৌড়ে মহিলারা ক্রমাগতই পিছিয়ে পড়ছেন। এই ‘ড্রপ টু দ্য টপ’ প্রতিটি শিল্পের ক্ষেত্রেই ঘটছে। যার অর্থ হল সর্বোচ্চ পদে নতুন করে মহিলাদের নিয়োগ প্রায় নেই।

কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্বাস্থ্যের সুযোগ ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন— এই চারটি বিষয়ের পরিসংখ্যানে ভর করে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ-২০২৪’-এর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে বিশ্ববাজারের অর্থনৈতিক অস্থিরতা কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে কাজের বাজারে প্রবেশকালে বা এন্ট্রি লেভেলে মহিলাদের অনুপাত প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি হলেও সর্বোচ্চ পদে তা অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে। আবার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিতের মতো ক্ষেত্র হলে শীর্ষনেতৃত্বে মহিলাদের অংশগ্রহণ আরও কম। যা মোট মহিলা কর্মীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। লিঙ্কডইন এবং দ্য কোয়ান্টাম হাব (নয়াদিল্লি-ভিত্তিক পাবলিক পলিসি কনসাল্টিং ফার্ম) যৌথভাবে ‘উইমেন ইন লিডারশিপ ইন কর্পোরেট ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারতীয় কর্পোরেটে নারী নেতৃত্ব’ নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, লিঙ্কডইনের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্বের সামগ্রিক বৃদ্ধি ঘটেছে। যা ২০১৬ সালের ২৩.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ২৬.৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পুনরায় ০.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। নেতৃত্বের ভূমিকাতে নারী— তার হার ২০১৬ সালের ১৬.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ১৮.৭ শতাংশে পৌঁছেছিল। ২০২৪ সালে সামান্য কিছুটা কমে ১৮.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু এই সামান্য নামাওঠা সরিয়ে রাখলে, কর্মস্থলে নেতৃত্বদানকারী মহিলাদের সংখ্যা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।

‘জেন্ডার গ্যাপ ২০২৪’ অনুযায়ী, লিঙ্গবৈষম্যের বিচারে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের জায়গা হয়েছে ১২৯ নম্বরে। ২০২৩ সালে যা ছিল ১২৭। অর্থাৎ আরও ২ ধাপ নেমেছে। ‘শিক্ষার সুযোগ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’-এর প্রশ্নে ভারতীয় মহিলারা তুলনায় পুরুষের থেকে অনেকটা পিছিয়ে। সেই কারণেই জেন্ডার গ্যাপের বিশ্বতালিকায় ভারত নিচের দিকে জায়গা পেয়েছে। অথচ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং নেপালের মতো ছোট ছোট প্রতিবেশী দেশও লিঙ্গসমতার নিরিখে ভারতের চেয়ে ভাল জায়গায় রয়েছে। ভারতীয় মহিলাদের, সমাজের সামনের সারিতে তুলে আনতে সাবিত্রী বাই ফুলে, চন্দ্রমুখী বসু এবং কাদম্বিনী গাঙ্গুলিরা লড়াই করেছিলেন, নতুন পথের দিশা দেখিয়েছিলেন। তাঁদের আন্দোলনের প্রায় ১৫০ বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হল ভারতীয় অর্থনীতিতে লিঙ্গসমতা আসেনি। ২০২৩-২৪ সালের পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের শ্রমশক্তিতে পুরুষদের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৭৮.৮ শতাংশের কাছাকাছি, সেখানে মহিলারা মাত্র ৪১.৭ শতাংশ। লিঙ্গবৈষম্য অনেকখানি।

এই লিঙ্গবৈষম্য অর্থনীতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের “জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট” রিপোর্টে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল— অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নীতিনির্ধারণের জন্য, লিঙ্গবৈষম্য দূর করা জরুরি। এটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা অংশ। লিঙ্গসমতা উৎপাদনশীলতাকে বহুগুণ বাড়ায়। মেয়েদের দক্ষতা এবং বুদ্ধিকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারলে সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মহিলারা যদি জমি এবং সারের মতো উৎপাদনশীল উপাদান নিয়ন্ত্রণে পুরুষের সমান অধিকার পায়, তাহলে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কৃষি উৎপাদন ২.৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। গবেষণায় প্রমাণিত, নির্দিষ্ট কিছু পেশায় কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অসুবিধাগুলি দূর করতে পারলে উৎপাদন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে ব্রাজিল, চিন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশে পারিবারিক আয়ের সিংহভাগ যদি মহিলারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাহলে শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উপর ব্যয়ের পরিমাণ বাড়বে। যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারকে ত্বরান্বিত করবে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি প্রতিবেদনে পাওয়া যাচ্ছে, উদ্যোক্তা হিসেবে মহিলাদের সংখ্যা বাড়লে ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের জিডিপি ০.৭ ট্রিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে। উদ্যোক্তা হিসেবে মহিলারা শুধুমাত্র অন্যান্য মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করবে তাই নয় তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য অনুপ্রাণিতও করবে। এর ফলে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটবে। রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রেও নারীর ক্ষমতায়ন সরকারি নীতির অভিমুখ বদলে দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থায় মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের আইন চালু হওয়ার পরে পানীয় জল ও নিকাশি ব্যবস্থার মতো পরিষেবা সহজে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে। কারণ এই ব্যবস্থাগুলি পর্যাপ্ত না হলে তার দায়ভার মেয়েদেরকেই বইতে হয়।

ভারতে শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের হার বিগত দুই দশকে আশ্চর্যজনকভাবে কমেছে, ২০০৫ সালে এই হার ছিল ৩২ শতাংশ, ২০২১ সালে তা ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২২ সালে ‘অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া ডিসক্রিমিনেশন’ রিপোর্টে ভারতে লিঙ্গভিত্তিক মজুরি এবং বেতনের ব্যবধানকে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে শুধু নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয় মজুরি এবং বেতনের ক্ষেত্রে নিচ থেকে উপরতলা পর্যন্ত মহিলারা বৈষম্যের স্বীকার।

বেজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন, কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অফ উইমেন এবং অ্যাজেন্ডা ২০৩০-এর মতো মঞ্চগুলি লিঙ্গসমতা ও মহিলাদের প্রতি ন্যায়বিচারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই সংস্থাগুলি মেয়েদের জীবনে সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নীতিগত দুর্বলতা, অসংগঠিত ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোগ ও গ্রামীণ উন্নয়নে মহিলাদের জন্য লাভজনক কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। ফলে, সমকাজে সমবেতন আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং বেসরকারি স্তরে মহিলাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। কর্পোরেট, প্রো-কর্পোরেট নীতি এবং শ্রম আইনের পরিবর্তনগুলি মহিলাদের জীবিকাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

সমুদ্র থেকে মহাকাশ, বিজ্ঞান থেকে সাহিত্য, সঙ্গীত, খেলাধুলো, রাজনীতি ও অর্থনীতি সর্বত্রই মেয়েরা ছাপ ফেলেছেন। তবু কাজের বাজারে প্রতিনিয়ত তাঁদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। যোগ্যতার নতুন নতুন প্রমাণ দিতে হচ্ছে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে মহিলাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্যের স্বীকৃতির দিন হিসেবে পালন করা হয়। এটা না করে দিনটিকে বিশ্বজুড়ে লিঙ্গসমতা ফেরানোর দিন হিসেবে পালন করা হোক। আর নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টায় দূর হোক লিঙ্গবৈষম্য। শুধু কোনও একটি বিশেষ দিন নয়, বছরের প্রতিটি দিনই প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েদের সঠিক সম্মান প্রদর্শন করা হলেই বোধহয় সার্থক হবে নারী দিবসের ধারণা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5094 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...