লড়াই করেই বাঁচতে চাই

পৃথা তা

 


যারা নারী দিবসের আগে থেকে অত্যন্ত সুকৌশলে "শ্রমজীবী" শব্দটাকে মুছে দিয়ে এটা ফুলেল আব্বুলিশ বিষয় করে দিতে চাইছে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে দেওয়ার মালিক তারা নয়। ভোটে জেতা রাষ্ট্র এই অধিকার শ্রমিকদের না দিলে কেড়ে নিতে হবে। ততদিন সমমজুরি, সমান সম্মান, কর্মঘণ্টা, কাজের পরিবেশ— এই সবকিছুর জন্য লড়াই চলবে। মেয়ে হিসেবেও, শ্রমিক হিসেবেও

 

ঘরের বাইরেটা সহজ হয় না অনেকের জন্যই। তা নারী, পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ যেমন মানুষ-ই হোন না কেন। কাজের ভাগ ও ভিত্তি অনুসারে এই “সহজ না হওয়া”-র তারতম্যটা অদ্ভুত আকার নেয়। অস্বস্তি, আক্রমণ হয়ে দাঁড়ায় কোথাও, কোথাও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা তীব্র যন্ত্রণার কারণ হয়।

সমাজের একটি অংশের মধ্যেকার একটি ভাগ নিয়েই কিছু অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিই আজকে।

 

দুই.

শ্রমজীবী মেয়েরা। তাদের নিয়ে বহুচর্চিত কিছু “মিথ” ঘোরে, কিছু সত্য, কিছু-বা অর্ধসত্য, কিছু মিথ্যা৷ এই ধরনের কিছু ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় নতুন এমন কিছু সমস্যা জানা যায় যা একান্তভাবে পেশাগত ভিত্তিতে জড়িয়ে না থাকলে জানা যায় না।

চা-বাগানের মেয়েদের নিয়ে নানা কাব্য, গান যতই থাকুক এটা কঠিন সত্যি যে চা-বাগানের মেয়েদের মতো কম মজুরিতে শ্রম বিক্রি করতে খুব অংশের শ্রমিকদেরই হয়। ব্যতিক্রম— বিড়ি, জরিশিল্প, তাঁতশিল্প, গৃহসহায়িকা ইত্যাদি।

তাঁদের কাজের জায়গায় বাগানের মাঝে নেই কোনও মহিলা বাথরুম। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকরভাবে কাজ করতে বাধ্য হতে হয় তাঁদের। শ্রমিক মায়েদের পিঠে বাচ্চাদের বেঁধে কাজ করাই বছরের পর বছর ধরে দস্তুর। নেই কোনও ক্রেশের ব্যবস্থা। অস্বাস্থ্যকর অবস্থার শিকার হয়ে রোগে পড়ে শিশুরাও। মারাও যায় এইভাবে ভুগে। কোনও ক্ষেত্রে যদিও-বা একটু কোনও কাজ শুরু হয় তাতে খাজনার থেকে বাজনা বেশি হয়। কাজের প্রচারের বিজ্ঞাপনে টাকা খরচ হয় কাজের থেকে বেশি। তার ঢক্কানিনাদে ঢাকা পড়ে যায় ১ শতাংশ হওয়া আর ৯৯ শতাংশ না-হওয়া।

এদিকে চা-শ্রমিকদের বাচ্চাদের দেখভালের জন্য সরকার বরাদ্দ করল বিরাট অঙ্কের টাকা কিন্তু তা বরাদ্দ হল নির্মাণশ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ অর্থের ভাগ থেকে। ভাল করে ভেবে দেখলে একজন শ্রমিকের খাওয়া-পরা তখনই জুটবে যখন অপর কোনও শ্রমিক তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থাৎ পুঁজির এই অসম বণ্টন খুব সহজেই ধর্মান্ধদের সেই যুক্তিকে শ্রমিকদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারে। “অন্য ক্ষেত্রের শ্রমিকরা বেশি পাচ্ছে বলেই আমরা কিছু পাচ্ছি না”…. ইত্যাদি ইত্যাদি। এই দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও চলছে প্রাণপণ, তা কিছু ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছে। অথচ প্রতিক্ষেত্রের গভীরে ঢুকলে কী দেখা যাবে? চা নিয়ে যখন শুরু হল, চা নিয়েই বলা যাক।

চা-বাগান শ্রমিকের দৈনিক মজুরি সাধারণভাবে ২৫০ টাকা।

পাতা তোলার ক্ষেত্রে সমতলের বাগানের শ্রমিকদের ২২-২৬ কেজি ঠিকা থাকে। এই বাঁধাধরা ঠিকার ওপর তুলতে পারলে কেজি প্রতি ৩-৩.৫০ টাকা মজুরি দেওয়া হয় প্লাকিং ওয়ার্কারদের।

কিছু বিশেষ কাজের ক্ষেত্রে যেমন ওষুধ স্প্রে করা বা ফ্যাক্টরির কাজের ক্ষেত্রে কিছু অতিরিক্ত মজুরি দেওয়া হয় প্রথাগত বাগানগুলিতে। সাধারণভাবে ৬-১০ টাকা অতিরিক্ত মজুরি দেওয়া হয়।

মে মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখ অব্দি সময়কালকে বলা হয় আর্লি পিরিয়ড। সেই সময়ে সাধারণত ৫-৬ দিনে ঠিকা থাকে ২২ থেকে ২৮ কেজি পাতা তোলার। এই সময়ে ৫-৬ দিনের চুক্তিতে কেজি প্রতি ৪০ শতাংশ কম টাকা পেতে পারেন শ্রমিকরা। ৭ দিনের চুক্তি হলে ৩০ শতাংশ কম পেতে পারেন, ৮-৯ দিনের চুক্তির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কম পেতে পারেন। যদিও এই শর্ত ও শতাংশ অনেকক্ষেত্রেই নির্ভর করছে বাগানমালিক ও বাগানের সংগঠনের ওপর।

এই আর্লি পিরিয়ড-এর সময়ে কেমন পাতা হবে জানা যায় না। গড়ে তোলা পাতার ৭০ শতাংশ হিসাবে যায় না।

নভেম্বরের পরে শুরু হয় ব্যাক পিরিয়ড। কেজি প্রতি মজুরি কিছুটা তখন বাড়ে।

বিড়ি-মজুরদের অবস্থা আরও শোচনীয়। হাজার বিড়ি পিছু মজুরি ১৫০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা করতে কালঘাম ছুটে যায় কোনও কোনও জেলায়৷ মুর্শিদাবাদের বড় বড় বিড়ি ইন্ডাস্ট্রির মালিকদের (বলা ভাল মাফিয়া) ওপর নির্ভর করে এই দামের ওঠাপড়া।

 

তিন.

সারা বছর খাতা খুলে সরকারি দপ্তরে ৩০ টাকা করে কিস্তি জমা করেন নির্মাণশ্রমিকরা। কেউ ১৫ বা কেউ ৩০ বছর ধরে। ৬০ বছরের পর মাসে ১০০০ টাকা পেনশন পাবেন বলে। বার্ধক্যভাতা চালু হলে ওই পেনশন আর হয় না। উপরন্তু এতদিনের জমানো অর্থ নষ্ট হয়। তা ফেরত আনার জন্য জুতোর শুকতলা খয়ে গেলেও সমস্যা মেটে না।

অকুপেশনাল ডিজিজ, যেমন নির্মাণ, বালি-পাথর-কয়লা খাদান শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সিলিকোসিস; বিড়িশ্রমিকদের লাং ক্যান্সার; চা-শ্রমিকদের স্কিন ডিজিজ, ইউটিআই; রিকশাচালকদের হার্নিয়া ইত্যাদি মহামারির পর্যায়ে যাচ্ছে। প্রতিক্ষেত্রে আলাদা আইন ও সরকারি চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তা পান না শ্রমিকরা। সিলিকোসিসে মৃত্যুকে সরকারি হাসপাতালে “লাং ডিজিজ”, COPD আখ্যা দিয়ে দায় সারেন চিকিৎসকরা। কারণ সরকারি ফরমান। যাতে সিলিকোসিসে মৃত্যুর সংখ্যা ঠিক কতটা ব্যাপক তা বোঝা না যায়। বোঝা না যায় রাজ্যে/দেশে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন বা তা নিয়ে সরকারের ভাবনাচিন্তা কেমন। আর খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সিলিকোসিসে চিকিৎসা/মৃত্যু বলে তার জন্য বরাদ্দ অর্থ যেন ভুক্তভোগী চাইতে না পারেন।

সুযোগ-সুবিধা বুঝে লিঙ্গসচেতন, স্বাস্থ্যসচেতন, শব্দসচেতন, বর্ণসচেতন মিডিয়া ব্যবসায়ীরা গিগ ইকোনমির অন্তর্ভুক্ত ওয়ার্কারদের মালিকরা যখন পার্টনার বলে ডেকে তাঁদের শ্রমিক হিসাবে মঞ্জুরিকৃত অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায়, বা সিলিকোসিস লাং ডিজিজে রূপান্তরিত হয়ে যায়, তখন চুপ থাকেন।

স্কিম-ওয়ার্কারদের সুযোগসুবিধা তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাঁদের অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন পেশা বদলাতে বা মাইক্রোফিনান্সের চক্করে চক্রাকার চড়া সুদের ফাঁদে পড়তে। কারণ ঘরের পুরুষসদস্য অভিবাসী শ্রমিক। নির্দিষ্ট দিনের চুক্তিতে এককালীন মজুরি পাবেন তিনি। যতদিন না পাচ্ছেন ততদিন তাঁর পরিবার চলবে এইভাবে। মাইক্রোফিনান্স এমন আকার নিচ্ছে যে পরিবারে একা মহিলা থাকার সুযোগ নিয়ে মাসিক কিস্তি আদায় না হলে চরম অত্যাচার নামিয়ে আনছে পরিবারগুলিতে। তার জেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকে। এই কারবারের ব্যাঙ্কগুলির দালালরা অনেকেই শাসক দলের মাতব্বর। ফলে এইসব মৃত্যু (পড়ুন খুন) ‘অজ্ঞাত কারণে’র ফাইলেই ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে চলছে ডিআর লটারির বাড়বাড়ন্ত। যার জন্য সর্বশান্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে বহু পরিবার।

আশা, মিড ডে মিল, অঙ্গনওয়ারী কর্মীদেরকেই একমাত্র মহিলাপ্রধান অর্গানাইজেশন বলতে ইচ্ছুক সরকার। তাতেও তাদের ন্যূনতম বেতন, সামাজিক সুরক্ষা, সামাজিক সম্মান, চিকিৎসা ইত্যাদির অবস্থা চূড়ান্ত খারাপ। এত স্বল্প বেতনে কাজ করা বাজার অর্থনীতি হিসেব করলে সত্যিই অসম্ভব। তবু বিপুল কর্মহীনতার সুযোগ নিয়ে নামমাত্র বেতনে সরকার শ্রম চুরি করছে দিনের পর দিন। এই অব্যবস্থা ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা করাই যে সরকারের মানসিকতা তা স্পষ্ট করে দিয়েছে এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট।

 

চার.

শ্রমিক হিসাবে বেঁচে থাকা এমন অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থায় দুর্বিষহ। মহিলা শ্রমিক হলে তার ওপর চাপে পিতৃতন্ত্র ও মনুবাদের বোঝা। কাজের জায়গার দূরত্ব, বাড়ি ফেরার সময়, গৃহকর্মে বাড়তি সময়দানের অঙ্কের হিসেবের ওপর নির্ভর করে কর্মস্থান কেমন হবে। এমনকি তা অবমাননাকর পরিস্থিতির সঙ্গে অনিচ্ছুক যোগাযোগ রাখতেও বাধ্য করে। মাতৃত্বকালীন ছুটি, টিকা, ও অনান্য স্বাস্থ্যবিধি প্রশ্নের মুখে পড়ে। বাজেট যেভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনকে বেসরকারি/কর্পোরেটের হাতের পুতুল বানিয়ে (একটি ছোট উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ন্যায়সংহিতা) তাদেরকে সেটা দোমড়ানো মোচড়ানোর অধিকার দিচ্ছে, তাতে শ্রমিকদের অবস্থা আরও করুণ হবে। মহিলা শ্রমিকদের করুণতর। একই অবস্থা মনরেগায় কাজ করা শ্রমিকদের। যৌথ সঙ্ঘবদ্ধ লড়াই ছাড়া এই অবস্থা থেকে বেরোনোর রাস্তা নেই। শ্রমিক হিসাবে মেয়েদের ঘামের মূল্য ঘরে-বাইরে সর্বত্র বুঝে নিতে হবে তাঁদেরকেই। এখনও “গৃহশ্রমের মূল্য” বলে যে কোনও বিষয় হয় তা বিস্ময়ের বস্তু করে রাখা হয়েছে সমাজের কাছে অতি চতুরভাবে, ভারী ভারী শব্দের আড়ালে।

যারা নারী দিবসের আগে থেকে অত্যন্ত সুকৌশলে “শ্রমজীবী” শব্দটাকে মুছে দিয়ে এটা ফুলেল আব্বুলিশ বিষয় করে দিতে চাইছে— যেন বাচ্চা মেয়ে খেলনার জন্য বায়না করছে বলে তাকে পুতুল কিনে দেওয়া হচ্ছে— তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে দেওয়ার মালিক তারা নয়। ভোটে জেতা রাষ্ট্র এই অধিকার শ্রমিকদের না দিলে কেড়ে নিতে হবে। ততদিন সমমজুরি, সমান সম্মান, কর্মঘণ্টা, কাজের পরিবেশ— এই সবকিছুর জন্য লড়াই চলবে। মেয়ে হিসেবেও, শ্রমিক হিসেবেও।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...