আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কেমন আছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা?

ডালিয়া দত্ত

 


অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা কতটা বঞ্চিত তার প্রমাণ মিলবে তাঁদের জীবনে উঁকি মারলে। নারী দিবসের প্রাক্কালে তাঁদের প্রতিদিনের লড়াইকে সবার সামনে তুলে ধরতে পারলে হয়তো তাঁদের কিছুটা সম্মান দেওয়া যেতে পারে। দেখা যাক অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা কীভাবে জীবিকার জন্য লড়াই চালান

 

বিশ্বজুড়ে কাজের বাজারে মন্দা। একটা কাজের জন্য মানুষ হা-পিত্যেশ করছে। প্রতিদিন সংগঠিত ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হচ্ছে, কমছে সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ। ফলে মানুষকে ভরসা করতে হচ্ছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর, আর এই ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে শ্রমিকসংখ্যা বাড়ছে। এই শ্রমিকদের একটা বড় অংশ মহিলা। অথচ শ্রমিক হিসাবে তাঁদের কোনও স্বীকৃতিই নেই। সারা দেশ জুড়ে প্রতিনিয়ত চলছে নানা পরিবর্তন, কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলাদের অবস্থা অপরিবর্তিত। যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল এদের স্বার্থরক্ষা করার, তারাই আজ নিজেদের স্বার্থে এদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর, কাজের শর্তের ওপর এই আক্রমণ তাদের অধিকার হরণ করছে।

অর্থনৈতিক সঙ্কট সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে শ্রমজীবী মানুষকে। বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত। তাঁদের সংখ্যা মোট শ্রমশক্তির ৯৩ শতাংশ। অসংগঠিত ক্ষেত্র বলতে বুঝি নির্মাণ শ্রমিক (বাড়ি, বিভিন্ন স্থাপত্য, সড়ক, সেতু নির্মাণে যুক্ত), মাল বহনকারী, দোকান কর্মচারী, বিভিন্ন স্তরের ভেন্ডার, বেসরকারি হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের। এছাড়াও বিড়ি, পোশাক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, অটোমোবাইলের মতো উৎপাদনকেও অসংগঠিত ক্ষেত্র হিসেবে ধরা হয়। এই সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মহিলাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।

অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই বিরাট অংশের মানুষ, যাঁরা নিজের এবং পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে প্রতিদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তাঁদের অবস্থা দুর্বিষহ। বিশেষ করে মহিলাদের। এঁরা চরম শোষণের শিকার অথচ সরকার এঁদের ব্যাপারে একেবারেই চুপ। দেশের নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। বড় বড় রাজনৈতিক দলের বিপুল নির্বাচনী ব্যয়ের জোগান দেয় বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা। ফলে সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক দলগুলো শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে খেটেখাওয়া মানুষকে বঞ্চিত করে। সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হন অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা।

অসংগঠিত ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য চোখে পড়ার মতন। শ্রমজীবী মহিলারা কোথাও পুরুষের সমান, আবার কোথাও পুরুষের থেকে বেশি কাজ করেও মজুরি পান পুরুষের চেয়ে কম। কাজ পাওয়ার প্রশ্নেও বৈষম্য। সমকাজে সমমজুরির প্রশ্নে বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে মহিলাদেরকে চরম বঞ্চনার শিকার হতে হয়। এ জন্য যে তাঁর পুরুষ সহকর্মী সবসময় দায়ী এমনটা নয়। কিন্তু তাঁকে যে ব্যবস্থায় কাজ করতে হয়, সেই ব্যবস্থাই তার জন্য দায়ী।

অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা কতটা বঞ্চিত তার প্রমাণ মিলবে তাঁদের জীবনে উঁকি মারলে। নারী দিবসের প্রাক্কালে তাঁদের প্রতিদিনের লড়াইকে সবার সামনে তুলে ধরতে পারলে হয়তো তাঁদের কিছুটা সম্মান দেওয়া যেতে পারে। দেখা যাক অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা কীভাবে জীবিকার জন্য লড়াই চালান।

ঘটনা ১: ১৮ বছরের শামিমা বেগম। মুর্শিদাবাদের বিড়িশ্রমিক। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মা হন। অভাবের তাড়নায় বাবা-মা লেখাপড়া শেষ না করিয়ে বিয়ে দিয়ে দেন। কন্যাশ্রীও তাঁকে স্কুলে আটকে রাখতে পারেনি। অল্প বয়সে মা হওয়ায় স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। তবুও অভাবের জ্বালায় বিড়ি বাঁধা শুরু করেন। ১০০০ বিড়ি বেঁধে পান ২০২ টাকা। ওই ১০০০ বিড়ি বেঁধে একজন পুরুষ তুলনায় অনেক বেশি টাকা পান। অল্পবয়সি মহিলা তাই কাজের জায়গায় নানা কুপ্রস্তাব, কু-ইঙ্গিত তার নিত্যসঙ্গী। এত কিছুর মধ্যেও রোজগার বাড়াতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলেন। তারপরও বাড়ির ভিতরে চলে অত্যাচার। শামিমার দুই কন্যা। বর্তমানে গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা নিলেও বাড়ির চাপ পরিবারের জন্য তাঁকে পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে হবে।

ঘটনা ২: তারামণি সর্দার, ২৬ বছরের এক নির্মাণকর্মী। বাড়ি তৈরির সময় জল, বালি, সিমেন্ট, ইট, পাথর, সেন্টারিং মেটেরিয়াল, কংক্রিটের মিশ্রণ ইত্যাদি তাঁকে মাথায় করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হয়। এসব করতে গিয়ে সারাদিনে কয়েক কিলোমিটার হাঁটেন। আসলে তিনি জোগাড়ের কাজ করেন। বাড়িতে ছয় বছরের মেয়েটা অন্যের সাহায্য নিয়ে ভাইকে দেখে। সংসারে তারামণি-ই একমাত্র রোজগেরে। কিন্তু প্রতিদিন তাঁর কাজ জোটে না। ঠিকাদারের খুশির ওপর নির্ভর করে তাঁর কাজ পাওয়া। এদিকে কাজ না করলে না খেয়ে মরতে হবে। তাঁর আলাদা কোনও রোজগারও নেই। কাজের শেষে বাড়ি ফিরে রান্না ও ঘরের কাজ। প্রায়দিনই তাঁর স্বামী প্রচুর মদ খেয়ে তাঁর উপর অমানুষিক অত্যাচার করে। তারামণি জানেনা এ যুদ্ধের শেষ কোথায়।

ঘটনা ৩: বছর তিরিশের তাপসী মণ্ডল। মিড ডে মিলের রাঁধুনি। বাড়িতে অসুস্থ স্বামী। তাঁর চিকিৎসার জন্য তাঁকে অন্যত্র রান্নার কাজ নিতে হয়েছিল। স্কুলে তাঁরা তিনজন মিড ডে মিলের রান্না করেন। সারামাস খাটার পর হাতে পান মাত্র ২০০০ টাকা। আগে পেতেন ১৫০০ টাকা। তাঁদের দাবি নিয়ে জোর আন্দোলনের পর এই ৫০০ টাকা বেড়েছে। কিন্তু স্কুলে ১০ মাসের মাহিনা পান। ছুটির জন্য দু-মাস কোনও অর্থ পান না। দুর্গাপুজোয় বাড়তি টাকা সরকারি অনুদান নেই। মূল্যবৃদ্ধির কারণে সংসার চালানো কঠিন। স্কুলে বাচ্ছাদের খাবারের শেষে নিজের খাবারটা বাড়ি নিয়ে গেলে জোটে চোর অপবাদ। মনটা খারাপ হয়ে যায়। অথচ স্কুলে শুধু রান্না করলেই চলে না। বাচ্চারা পটি করে ফেললেও পরিষ্কার করতে হয়। অনেক আগে এসে স্কুল খুলতে হয়, ঝাঁট দিতে হয়। কাজটা চলে যাওয়ার ভয়ে প্রধানশিক্ষক যা বলেন তাই মেনে নিতে হয়। তাপসী ভাল পরিবারের মেয়ে। ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যুর পর বাবার মানসিক অসুস্থতা, তাঁর কাজ করতে না পারা একদিন তাঁদের অভাবের মধ্যে ঠেলে দিল। তাপসী বুঝতেই পারেননি। সেই অভিশাপ যেন আজও তিনি বয়ে চলেছেন।

ঘটনা ৪: ৩৫ বছর বয়সি টুম্পা হালদার, উবের চালান। বাড়ি হাওড়া জেলার জগাছাতে। বাধ্য হয়েই এই পেশাতে আসা। ঝোঁকের বশে কম বয়সে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন তিনি। বাপ-মা মেনে নিলেও শ্বশুরবাড়ির লোক মানেনি। টুম্পা জোর করে শ্বশুরবাড়ির চিলেকোঠার ঘরে তাঁর নতুন সংসার পাতলেন। কিন্তু প্রথমদিনই তাঁর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। যখন মাতাল স্বামী ঘরে ফিরল। শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। দিনের পর দিন অভুক্ত থাকা, শেষে গাড়ি চালানো শেখা। পেটের জ্বালায় গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নেওয়া। কিন্তু সেখানেও নানা কুকথা, বাজে চাউনি। স্ট্যান্ডে অন্যান্য পুরুষ ড্রাইভারদের তিনি যেন এন্টারটেইনমেন্টের রসদ। পাড়ায় কান পাতলেই শুনতে পান তাঁর চরিত্রের কী কী খারাপ দিক। এমনকি ড্রাইভিং-এ তাঁর হাত ভাল হওয়া সত্ত্বেও যাত্রীরা অনেক সময়ই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। টুম্পা প্রতিদিন যা রোজগার করেন তাতে গাড়ির ইএমআই দিয়ে যেটুকু থাকে ওঁর সংসার চলে যায়। তবে রোজগার বাড়াতে গাড়ি চালানোর সময় বাড়াতে পারতেন। সেখানে বাধ সেধেছে টুম্পার লিঙ্গ। টুম্পা খুব সুন্দর করে তাঁর অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন— রাতে মহিলা ড্রাইভার, মাতাল প্যাসেঞ্জার অপদার্থ পুলিশ। লজ্জা বাঁচিয়ে ফিরতে পারাই দুঃসহ। কিছু ঘটে গেলে পুলিশ-প্রশাসন আমার চরিত্র নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে। আমার অভাব নিয়ে নয়। ফলে রাতে গাড়ি চালানোর কথা ভাবিইনি। তবে একটা জেদ নিয়ে টুম্পা স্টিয়ারিং-এ বসেন। তিনি মনে করেন এটা তাঁর জীবনের স্টিয়ারিং। গন্তব্যে তাঁকে পৌঁছতেই হবে। এটা তাঁর বেঁচে থাকার লড়াই, এই লড়াইয়ে তাঁকে জিততেই হবে।

ঘটনা ৫:  জবা চক্রবর্তী। ৩৫ ছুঁই ছুঁই বয়স। স্বামীপরিত্যক্তা এই মহিলা সেলাই করে সংসার চালান। স্বনির্ভর গোষ্ঠী বানিয়ে তাঁরা স্কুলের ছাত্রীদের পোশাক বানান। তাঁদের গ্রামে ২০০টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী আছে। এক-একটি মহিলা দল বা স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে ১০ জন করে মহিলা সেলাইয়ের কাজে যুক্ত। সরকার যা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করেছে, তা পেলে বেশি বেশি কাজ করে মোটামুটি চলে যেত জবার। কিন্তু তাঁদের গোষ্ঠীর নেত্রীরা স্কুলের এক-একটি পোশাক বাবদ বরাদ্দ অর্থের অর্ধেকের সামান্য একটু বেশি তাঁদের হাতে তুলে দেয়। জবার চোখে চশমার পাওয়ার ক্রমেই বাড়ছে, তাও মেশিন চালাতেই থাকে। মেশিনের চাকাটা থামলেই তাঁর ভয় করে, যেন তাঁর সংসারের চাকাটা থেমে যাবে। ১০০০ পোশাক বা তার বেশি বানিয়েও তিনি যা রোজগার করেন তা এই আগুন লাগা বাজারে কিছুই নয়। তবে যাঁদের সঙ্গে তিনি সেলাই করেন তাঁরা তাঁকে সন্তানস্নেহে আগলে রাখেন। কেন্দ্র থেকে পড়ুয়াপিছু পোশাকের জন্য ৬০০ টাকা বরাদ্দ, তার সামান্য অংশ এই সেলাইকর্মীদের কাছে আসছে।  পোশাকের কাপড়ও নিম্নমানের দেওয়া হচ্ছে। ফলে বরাদ্দের বেশিরভাগটাই গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এ-নিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকরা ইনসাফের লড়াই শুরু করেছিলেন, আজ সেই লড়াই দাবানলের মতো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের দাবি, প্রাপ্য টাকা দিতে হবে। কিন্তু দলনেত্রীরা দাবি তোলা মহিলাশ্রমিকদের আর কাজ দিতে চাইছেন না। মহিলারা দলবদ্ধভাবে এরও প্রতিবাদ করছেন।

কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত মহিলার সংখ্যা প্রায় এক কোটি। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রভাব অনেকখানি। অথচ সরকারের গৃহীত নীতির কারণেই সংগঠিত ক্ষেত্রগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর ততই অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ভিড় বাড়ছে। সঙ্গে বেড়েছে মালিকের শোষণ। কিন্তু শ্রমিক এই শোষণের বিরুদ্ধে নিজের প্রাপ্য অধিকারের দাবি জানাতে পারছে না। কারণ, কাজের কোনও নিশ্চয়তা নেই। চাইলেই কর্মদাতা অনেক কম পারিশ্রমিকে অন্য শ্রামিক নিযুক্ত করবেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনিশ্চয়তাই এই শোষণের মূলে। এই অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। এঁদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন রাস্তায় নেমেছে। মূল দাবি কাজের নিরাপত্তা। সঙ্গে ন্যূনতম মজুরি। অন্য দাবির মধ্যে রয়েছে সমকাজে সমবেতন। এগুলি সম্ভব করতে স্লোগান তুলতে হবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলাদের জন্য— চাই প্রাপ্য সম্মান, চাই ন্যায্য মজুরি।


*প্রবন্ধে ব্যবহৃত নামগুলি সামাজিক কারণে পরিবর্তন করা হয়েছে

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...