৮ মার্চের অন্তঃসারটুকু একান্তই শ্রমজীবী নারীর

অপর্ণা ঘোষ

 


হেনস্থার কাহিনি শেষ হওয়ার নয়, হবেও না যতদিন না হাতধরাধরি করে চলা পিতৃতন্ত্র ও পুঁজিবাদের অন্ত হয়। তবুও প্রতিস্পর্ধা ও প্রতিবাদ জারি রেখেছেন মেহনতি মেয়েরা। ৮ মার্চ তারিখ নানাভাবে দখল হতে পারে, কিন্তু তার অন্তঃসারটুকু শ্রমজীবী নারীর

 

 

৮ মার্চ, আরেকবার এল। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস, শ্রম আন্দোলনের ইতিহাস থেকে যার ‘মার্চ ফরোয়ার্ড’ শুরু। ১৯১৭-র রাশিয়ায় দুনিয়া তোলপাড় করা ঘটনার শুরুয়াৎ হয়েছিল সেই বছরের মার্চে, টেক্সটাইল শিল্পক্ষেত্রের নারীশ্রমিকদের পেট্রোগাদ শহর ঘিরে ফেলে প্রতিবাদ-প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে। তাঁরা চেয়েছিলেন ‘রুটি ও শান্তি’। শিশুর জন্য খাদ্য দাবি করেছিলেন, চেয়েছিলেন যুদ্ধের অন্ত। জারের বিরুদ্ধে ব্যানারে ছিল জোরালো বয়ান ‘মাতৃভূমি রক্ষা করছে যারা, তাদের শিশুদের খাবার দাও।’

এরপর নানা নদী দিয়ে নানা জল বয়ে গেছে। বিশ্বের আরও অনেক প্রতিস্পর্ধার বয়ানের মতোই পুঁজিবাদ আত্মসাৎ করেছে নারীদিবস। উদযাপন আর পণ্যমূল্য ছাড়ের উৎসব এবং আলোর তলায় সামগ্রিকভাবে নিরাপত্তাহীন অসুরক্ষিত নারীসমাজের প্রান্তে থাকা শ্রমজীবী নারীর অন্ধকার শ্রমক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীন মুখবন্ধ। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার জোরালো দাবিপত্রে কতটা উঠে এসেছে তাঁদের বাতচিত!

 

কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা

কর্মক্ষেত্রে নারী-র সুরক্ষার ধারণাটি এই পুরুষতান্ত্রিক, পণ্যক্লিষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থায় সোনার পাথরবাটির মতো শোনায়, আবার সুরক্ষার প্রশ্নটিও উঠে আসে এইখান থেকেই। ব্যবস্থা এমন না হলে সুরক্ষা-র কথা ভাবতেই বা হবে কেন! বিশ্বজুড়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর প্রত্যক্ষ যোগদান যতই বৃদ্ধি পেতে থেকেছে ততই কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার প্রশ্নটি গুরুতর আকার ধারণ করেছে। ভারতের মতো দেশে নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক দ্রুত ঊর্ধ্বগতি পুরনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলিকে আঘাত করেছে যার ফল কর্মক্ষেত্রে নারীর বিরুদ্ধে সুবিপুল হিংসার বাড়বাড়ন্ত। ২০১৩ সালে POSH আইন জোরালো নারী আন্দোলনের ফলশ্রুতি। আরজিকরের ঘটনা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, ডাক্তারির মতো একটি হাই-প্রোফাইল পেশায় নিযুক্ত একজন নারী তাঁর কর্মক্ষেত্র সরকারি হাসপাতালে ধর্ষিত ও খুন হয়ে যান– সেখানে শ্রমজীবী, বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে কর্মরত নারীর সুরক্ষার হালৎ কী দাঁড়াতে পারে! উচ্চবর্গের চিন্তার চালচিত্রে তার প্রকৃত ভয়াবহতা ধরা পড়াটা একান্তই অসম্ভব– কিছু পরিসংখ্যান থেকে যায় মাত্র। POSH-এর মোদ্দা কথাগুলিতে একবার চোখ বোলানো যাক।

  • বৈষম্য ও হয়রানিমুক্ত কর্মক্ষেত্র
  • শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষা
  • সমকাজে সমবেতন ও সমসুযোগ
  • ন্যায়সঙ্গত কর্মসময় (ডিউটি আওয়ার্স)
  • মর্যাদা ও গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার
  • প্রয়োজনে সবধরনের সহায়তার ব্যবস্থা থাকার সুযোগ

মেহনতি নারীর কর্মক্ষেত্রে উপরোক্ত সুরক্ষাবিধির একটিও অনুসৃত হচ্ছে এমনটি কল্পনাতেও আনতে পারা যায়? বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে?

গৃ্‌হশ্রমিক, গৃ্‌হ-স্বাস্থ্যসহায়িকা, নির্মাণক্ষেত্র, কৃষিমজুর, ইটভাটা, হকার, ছোট কারখানা বা ওয়ারহাউস বা শপিংমলে কর্মরতা, বাজারে ফুল বা সব্জিবিক্রেতা, ডেলিভারি কর্মী-সহ সকল গিগ কর্মী ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই যে সমস্যাটি সকলকে সর্বাধিক পীড়িত করে তা হল মৌখিক ও শারিরীক যৌন হেনস্থা। এর গভীরে যে বিষয়টি মুখ্যত কাজ করে তা হল কর্মক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্যবোধ। সব্জিবাজারেই ধরা যাক, রাস্তার পাশে সবজি নিয়ে বসবার জন্য একজন মহিলাকে তোলা দেওয়া ছাড়াও আরও অন্য হেনস্থাও সহ্য করতে হয় যদি না তার পুরুষ সঙ্গীও ব্যবসাটিতে যুক্ত থাকেন। পুলিশ এবং রাজনৈতিক দাদাদের অক্লেশে তাদের গায়ে হাত তুলতে দেখেছি, মারধর নয়, এমনিই, গায়ে হাত দেওয়া জনসমক্ষেই। মারধর তো দরিদ্র দুর্বল সাধারণকে লিঙ্গনির্বিশেষে খেতে হয়। কিন্তু সেই নিপীড়িত পুরুষ-সমাজ নিপীড়কের ভূমিকাই নেয় স্বভাবত। বনগাঁ লাইনের ট্রেনে যাই-আসি। মহিলা কামরায় বড় বড় বস্তা নিয়ে অনেকখানি জায়গা আটকে রাখেন কিছু মহিলারা, কখনও ফুল, কখনও জামাকাপড়, কখনও খাদ্যদ্রব্য বা সাজের জিনিস। অনায়াসে ওই ভারি ভারি বস্তা ওঠান নামান, আমাদের গালি খান। সকলেরই জিজ্ঞাসা “এরা ভেন্ডরে ওঠে না কেন?” এক ফুলবিক্রেতা দিদি আমাকে বলেছিলেন, “ভেন্ডারে আমাদের উঠতে দেয় না দিদি। উঠলে অসভ্যতা করে।” আর বেশি বলেননি। কিন্তু আমার বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি অসভ্যতার ধরনটি কী।রেলের কামরায় যে নারীরা হকারি করেন তারাও একই অভিজ্ঞতায় আহত। টিটি, জিআরপি, আরপিএফ… অত্যাচারের অন্ত নেই। কদর্য যৌন ঈঙ্গিত, বাচন, হেনস্থা ও পয়সা নিষ্কাশন একই সঙ্গে চলে।

ইটভাটাতে কাজ করেন যে নারীরা স্বাস্থ্য ও শরীর কোনওটিতেই তাদের নিজেদের অধিকার নেই। পুরুষ শ্রমিক ও মালিকের দ্বারা যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন খুব স্বাভাবিক ঘটনা। মজুরির বৈষম্য নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সুরক্ষার নামগন্ধহীন দিন কেটে যায় তাঁদের।

কৃষিমজুর মেয়েদের নিত্যসঙ্গী মজুরির বৈষম্য ও যৌন হেনস্থা। ছোট ছোট সাপ্লাই চেন কারখানাগুলি সামগ্রিকভাবে কেড়ে নিয়েছে অর্জিত শ্রম-অধিকারগুলি। মেয়েদের অবস্থা সেখানে করুণতর। নির্মাণক্ষেত্রে নারীশ্রমিকরা গভীর মজুরি বৈষম্য ও শারীরিক হেনস্থার শিকার। এইসব ক্ষেত্রগুলিতে মেয়েদের কাজের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা একেবারেই নেই। গর্ভবতী হয়ে পড়লে বা অন্যান্য অসুস্থতায়, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে (পরিবার দেখভাল করার দায়িত্ব যেহেতু মেয়েদের) কাজ কামাই হয় ও বিনা নোটিসে তাদের বার করে দেওয়া সহজ। কাজ হারানোর ভয়ে তাঁরা নানা আপসে বাধ্য হন ও ক্রমাগত অসুরক্ষিত হয়ে পড়তে থাকেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় মহারাষ্ট্রের বিড় জেলার আখশ্রমিক নারীদের কথা। গর্ভবতী হয়ে কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে জরায়ু বাদ দিয়ে দিতেন তাঁরা।

এমনিতেই নিও-লিবারেল জমানায় শ্রমিক অধিকারের দফারফা হয়ে গেছে। তার সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার মেহনতি মেয়েরা। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা দূরস্থান, কাজে টিকে থাকার সামাজিক সুরক্ষাও তাঁদের নেই। পুরুষদের তুলনায় ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার দিকেও যে তাঁদের পাল্লা ভারী এ বোঝার জন্য পরিসংখ্যানের দরকার পড়ে না।

সম্প্রতি, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট গৃ্‌‌হশ্রমিক নারীদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। ২০১৭-তে দাখিল হওয়া একটি কেসের নিরিখে সুপ্রিম কোর্টের সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ— উন্নত দেশগুলোর তুলনায় ভারতে গৃ্‌হশ্রমিকদের (যার সিংহভাগ নারী) অধিকার ও সুরক্ষা প্রায় নেই। তারা কম মজুরি, দুর্ব্যবহার, মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার, যৌন হেনস্থা, মৌখিক চুক্তির বাইরে বাড়তি শ্রমদান, মানবপাচার, আটক করে রাখা ইত্যাদি অসঙ্গত অধিকারভঙ্গের শিকার। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ— আমরাও কি আর জানি না! বাড়িতে স্বাস্থ্যসেবা দিতে আসেন যাঁরা (পড়ুন আয়া) একই ধরনের অধিকারভঙ্গের শিকার। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো গজিয়ে উঠেছে গৃ্‌হশ্রমিক বা আয়াদের নিয়োগ এজেন্সি। এরা নিয়োগের জন্য অসঙ্গত পরিমাণ কমিশন নেওয়া থেকে শুরু করে কমিশন-বহির্ভূত লাভ নেওয়ারও চেষ্টা করতে থাকে। অনথিবদ্ধ এই ধরনের এজেন্সি অনেক সময়ে যুক্ত থাকে ট্রাফিকিং-এও।

পরিবারের দেখভাল, সন্তান পালন ও নানাবিধ সাংসারিক সমস্যার প্রত্যক্ষ চাপ নারীর উপরেই পড়ে। সামান্য আয়ের সংস্থান থাকায় প্রান্তিক শ্রমজীবী নারী সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় মাইক্রোফাইনান্স কোম্পানিগুলির ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। মেয়েদের ক্ষমতায়নের নামে এই কোম্পানিগুলি আসলে কী করে তার একটা চিত্র কোভিডের সময় দেখা গেছে। ওই পরিস্থিতিতে যখন সমস্ত আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, কোম্পানির এজেন্টদের চাপ তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এক্ষেত্রেও তাঁদের জন্য কোনও সুরক্ষাবলয় নেই।

হেনস্থার কাহিনি শেষ হওয়ার নয়, হবেও না যতদিন না হাতধরাধরি করে চলা পিতৃতন্ত্র ও পুঁজিবাদের অন্ত হয়। তবুও প্রতিস্পর্ধা ও প্রতিবাদ জারি রেখেছেন মেহনতি মেয়েরা। ৮ মার্চ তারিখ নানাভাবে দখল হতে পারে, কিন্তু তার অন্তঃসারটুকু শ্রমজীবী নারীর।

  • খারাপ কাজের পরিবেশ ও মালিকপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে নারী গিগকর্মীদের ডিজিটাল স্ট্রাইক
  • কাজের অযৌক্তিক শর্ত ও মজুরি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আরবান কোম্পানির নারীকর্মীদের আন্দোলন
  • হরিয়ানার মানেসরে আমাজনের ওয়্যারহাউসে কাজের পরিবেশের উন্নতি ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে নারীকর্মীদের আন্দোলন
  • কাজের নিরাপত্তা, মজুরি বেঁধে দেওয়া ও আরও দাবিদাওয়া নিয়ে গৃহশ্রমিকদের লাগাতার প্রতিবাদ আন্দোলন
  • বিভিন্ন রাজ্যে আশা কর্মীদের আন্দোলন
  • তামিলনাড়ুর দিন্দিগুলে বস্ত্রশিল্পে নিযুক্ত দলিত নারীশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে হিংসার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন
  • কান্নান-দেবান টি-এস্টেটে নারী শ্রমিকদের ধর্মঘট আন্দোলন

এসবই সাম্প্রতিক কালে ঘটতে থাকা নারীশ্রমজীবীদের অসংখ্য প্রতিবাদ-প্রতিস্পর্ধার কয়েকটি সংবাদ, সংবাদমাধ্যমের প্রত্যন্ত কোণায় কখনও-সখনও তাদের দেখতে পাওয়া গেছে।

 

উপসংহার

মনে রাখা দরকার প্রান্তিক শ্রমজীবী নারীর সন্তানপালনের জন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা নেই। ইটভাটায়, চা বাগানে, সাপ্লাইচেন কারখানার অন্ধকার ঘরগুলিতে, আতসবাজি কারখানায় এবং এমন অজস্র অস্বাস্থ্যকর সংস্থানে শ্রমজীবী মায়েরা তাঁদের শিশুদের নিয়ে কাজে যান। প্রতিদিন তাঁদের অধিকারভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিরও অধিকারভঙ্গ হতে থাকে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...