বোকা বুড়োটা আজও পাহাড় ভাঙার সংকল্পে অবিচল

চিন

প্রশান্ত ভট্টাচার্য

 

‘I have become a Communist because our party strives more than any other to know and to build the world, to make men clearer thinkers, more free and more happy.’

–Pablo Picasso

মাও-য়ের সঙ্গে মা-য়ের একটা মিল আছে। উভয়েই ছিলেন স্কুল-শিক্ষক। মাও পড়াতেন ইতিহাস। মা পড়াতেন ইংরেজি। মাও-য়ের লক্ষ্য ছিল সমাজ পরিবর্তনে। মা-য়ের লক্ষ্য ধনপতি হওয়া। মাও লং মার্চের মধ্য দিয়ে চিনের সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে পেরেছিলেন। দু’দশকের চেষ্টায় মা চিনের তৃতীয় বৃহত্তম ধনকুবের। চেয়ারম্যান মাওয়ের দেশ এখন আলিবাবার চেয়ারম্যানের!

মা-য়ের। জ্যাক মা। রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করে চেয়ারম্যানের পার্টি হাইজ্যাক করেছেন মা-য়েরা। এটা যে প্রলাপ নয় তার প্রমাণ, চিনের অর্থনৈতিক সংস্কারের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মোট ১০০ জনকে সদস্যপদ দিয়ে সম্মান জানাচ্ছে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটি। তাঁদের মধ্যে জ্যাক মা বাদে আছেন টেনসেন্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পনি মা, বায়দু ইনকর্পোরেটেডের সিইও রবিন লি, বাস্কেটবল তারকা ইয়াও মিং, ভলিবল কোচ ল্যাং পেং-এর মতো ধনপতিরা। প্রায় ৯ কোটি সদস্যের চিনা কমিউনিস্ট পার্টি ও ১৪০ কোটি অধিবাসীর দেশের সরকারের প্রধান শি জিনপিং সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, কমিউনিস্ট পার্টিকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা পালন করতে হবে। একসময় পার্টি বেসরকারি উদ্যোগকে পছন্দ করত না। কিন্তু এখন সরকারের সঙ্গে শিল্পপতিদের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। চিনের পার্টির এই লাইন চূড়ান্ত সংশোধনবাদী নয়, একেবারে একটি বুর্জোয়া অবস্থান। তবে ভিন্ন মতও পাওয়া যাচ্ছে। যেমন কেউ কেউ ভাবছেন, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি বড় ধরনের ফাঁদ পেতেছে। যেমন গত চল্লিশ বছরে চিনে ব্যক্তিমালিকানাধীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু শিল্পপতি তৈরি হয়েছেন এবং তাঁরা চুটিয়ে বাণিজ্য করছেন। এখন এঁদের একাংশের জন্য পার্টি সদস্যপদ খুলে দেওয়ায় এই ধনকুবেরদের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় চিনা পার্টিতে ঢুকবে, কাউকে কাউকে বা ঢোকানো হবে। পরিস্থিতি তৈরি হলে পার্টি দেখা গেল টুক করে খোলা দরজা বন্ধ করে দিল। আর ততদিনে পার্টির ভিতরে চলে আসা শিল্পপতিদের যাবতীয় সম্পত্তি দেশ বা পার্টির বাজেয়াপ্ত করতে কোনও অসুবিধা রইল না। এই ভাবনাটার মধ্যে একটা সরলীকরণ আছে। যেমন আছে এই ভাবনাটার মধ্যেও। ধনপতিরা পার্টি সদস্য হওয়ার ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে পার্টির সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য হওয়া আর না মানতে পারলে, বিরোধিতা করলে শাস্তির মুখোমুখি হওয়া। আর চিনের পার্টির শৃঙ্খলায় ন্যূনতম শাস্তি হতে পারে সদস্যপদ বাতিল হওয়া। যা হলে ওঁদের কিছু হারাবার নেই। আর সর্বোচ্চ শাস্তি হলে সদস্যের যাবতীয় সম্পত্তি দেশ বা পার্টি বাজেয়াপ্ত করতে পারে! সেক্ষেত্রে সব হারিয়ে সত্যিকারের সর্বহারা হবেন জ্যাক মা বা ইয়াং মিং-রা। আদতে এসব ভাবনা কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে করা চলে। আমাদের এক বামপন্থী চর্চা। ওদিকে, তলে তলে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে চিন। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার নতুন রূপে পৌঁছে গিয়েছে। বাংলায় ‘চীন’ বানান এখন হ্রস্ব-ই হয়েছে তেমন চেয়ারম্যানের চিন-ও পালটে গিয়েছে। জ্যাক মা কমরেড হয়েছেন। ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠা ধারণাগুলো কেমন যেন ভ্যাবলা মেরে গেছে।

‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ আমাদের ছাত্রজীবনের গোড়ায় এই দেওয়াল-লেখা দেখে বেশ একটা রোমাঞ্চ লাগত। স্টেনসিলে সেই লেখার একদিকে ক্যাপ পড়া মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের একটা ভরাট মুখ। অন্যদিকে চোখে চশমা একটা গাল তোবড়ানো বাঙালি মুখ। নকশালবাড়ির তাপে একটু তেতে যাওয়া আমার এক কাকা চিনিয়েছিলেন, ওটা মাওৎসেতুং (তখন ওই বানানই লেখা হত) আর বাঙালিটি চারু মজুমদার। সত্তরের সেই আগ্নেয় দিন কয়েক বছরে মিইয়ে গেল। দেশে দেশে গড়ে উঠল এক নতুন রসায়ন। মাত্র দুই দশকে ৩৪৮০ কোটি মার্কিন ডলারের মালিক জ্যাক মা কমরেড হয়েছেন। এখন যদি শুনতে পাই মুকেশ আম্বানি দেশের কোনো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা তাঁর চেয়ে কমা কেউ, মানে আদিত্য বিড়লা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, তবে তো পিলেচমকানিয়া হাল হবে আমাদের সবারই। যদিও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন রাজ্যে শিল্প আনতে হাত ধুয়ে নেমে পড়েছিলেন, তখন সিপিআই (এম)’এর নিচের তলার নেতারা ‘কমরেড সালেম’, ‘কমরেড রতন টাটা’ সম্বোধন করতে প্রায় শুরু করেছিলেন। তারপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন সিপিএম-কে দুরমুশিয়ে রতন টাটাকে সিঙ্গুর থেকে পাতাতাড়ি গোটাতে বাধ্য করলেন, তখন তো আলিমুদ্দিনের অনুগামীরা প্রায় বলেই ফেলেছিলেন, ‘কমরেড রতন টাটাকে বাংলা ছাড়া করলেন তৃণমূলনেত্রী।’ সাজানো সিঙ্গুর শুকিয়ে যেতে বাম সরকারের লালদুর্গেরও ইন্তেকাল হয়ে গেল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেনরা চিনের সমাজতন্ত্র (যদি সাইন বোর্ড পড়ি!) থেকে শিখে সেজ বা এসইজেড করতে লপ্তের পর লপ্তে কৃষকের জমি হাতড়ে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন তখন প্রোমোটাররা সব দলের সদস্য হতে লাইন দিয়েছিল। সব কিছু কেঁচিয়ে না দিলে পশ্চিমবঙ্গে, আমাদের এখানেও মিলে যেত ‘কমরেড জ্যাক মা’ মার্কা বাঙালি শিল্পপতি কমরেড সিপিএম দলে। যেমন এসেছিলেন শিশির বাজোরিয়া। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে গোটা রাজনৈতিক জীবনে ‘মালিকের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ স্লোগানে অভ্যস্ত শ্রমিক সংগঠনের নেতা জ্যোতি বসুর একমাত্র সন্তান চন্দন বসুর কথা। তখন তাঁর শিল্পপতি হয়ে ওঠার ঋতু। সেই সময়ে, গত শতাব্দীর আটের দশকের মাঝামাঝি একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকে একটি লেখা বেরোল চন্দনকে নিয়ে। শিরোনাম– ‘কমিউনিস্ট পাপ্পা’জ ক্যাপিট্যালিস্ট সন’। তাই নিয়ে বাম মহলে বেশ তোলপাড় হয়েছিল। কিছু কট্টরপন্থী ‘চন্দন-জ্যোতি বসুর’ রিলেশনটাকে ‘দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি’ বলে সরব হয়েছিলেন। তাঁরা তখন ভাবতেও পারেননি, একবিংশ শতাব্দীতে কমিউনিস্ট পার্টি কি চেহারা নিতে পারে! কারা আদৃত হতে পারে কমিউনিস্ট পার্টিতে। চিন তা করে দেখিয়ে দিল। বিশ্বের অন্যতম ধনী, চিনের ‘মুকেশ আম্বানি’ জ্যাক মা চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছেন। তিনি বিখ্যাত ই-কমার্স কোম্পানি আলিবাবা গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান। তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ৩৮৪০ কোটি আমেরিকান ডলার। আজ থেকে ৫০ বছর আগে মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় যে কমিউনিস্ট পার্টি অনেক মহা মহা নেতাকে স্রেফ বুর্জোয়া ভাইসেস দেখা যাচ্ছে বলে ঠোঙা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন সেই কমিউনিস্ট পার্টির টাটকা সদস্য দেশের বিলিয়নারি ব্যবসায়ীদের একাংশ। চিনের কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক মুখপত্র, পিপলস ডেইলিতে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে অবশ্য জ্যাক মা দাভসে একবার বলেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালোবাসার, তবে বিয়ে করবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল মালাবদল হয়েই গেল। হায় কোথায় গেল সেই সোনালি দিন!

তবে শোনা গিয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে অবশ্য জ্যাক মা ঘোষণা করেছেন, বয়সের কারণে আলিবাবার চেয়ারম্যান পদ তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন। হয়তো আমাদের ‘রতনবাবু’ মানে রতন টাটার মতো স্বেচ্ছাবসর স্বেচ্ছাবসর খেলা! তবু মা-দের জয়। শ্রেণি ধারণা বর্জিত এক সর্বজনের পার্টি হলে যা হয় আর কী! একসময় কার্ল মার্কস হেগেলের দর্শনের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘হেগেল মাথা দিয়ে হাঁটছিলেন আমি তাঁকে উল্টে পা দিয়ে হাঁটিয়েছি।’ চিনের নেতারা কী সেরকম মার্কসকে উল্টে হাঁটাচ্ছেন? অথচ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) কিন্তু চিনের পার্টিকে কমিউনিস্ট পার্টিই মনে করে। ২০১২ সালে সিপিএম যে ‘ইডিওলজিক্যাল ডকুমেন্ট’ প্রকাশ করেছিল, তাতে চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে উদ্ধৃত করেই বলা হয়েছিল, চিন বলেছে চিন সমাজতন্ত্রে পৌঁছোতে হয়তো আরও ১০০ বছর সময় নেবে। তাহলে চিন এখন কোন তন্ত্র বয়ে চলেছে! বাস্তবিক চিন গত ৪০ বছর ধরে যা করছে তাতে বলা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্রিক শাসনে একটি শক্তিশালী ধনতান্ত্রিক দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে চিন। ফলে এই এক-মেরু বিশ্ব ব্যবস্থায় রুস্তম মার্কিন দেশকেও মাঝে মাঝেই ব্যোমকে যেতে হচ্ছে চিনের আচরণে। এতে হয়তো কোথাও গরিমা করার মতো কিছু থাকতেও পারে। কিন্তু সেখানে মার্কসের মতবাদের কোন চর্চাটা হল? পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব আর উদ্বৃত্ত শ্রম লুটে উদ্বৃত্ত পুঁজির মার্কসীয় নিদানের তো সাড়ে সর্বনাশ করে ছাড়ল এই চিন। অনেকেই মনে করছেন, ধনপতি কুবেরদের, শিল্প-বাণিজ্য সহ যাবতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলির ব্যক্তিমালিকদের বা সিইও-দের পার্টিতে সদস্যপদ দেওয়ার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শি জিঙপিঙ ধীরে ধীরে পুরো কমিউনিস্ট পার্টিকেই ব্যবসাদার, শিল্পপতিদের পার্টিতে পরিণত করে চিনে সম্পূর্ণ খোলা বাজার অর্থনীতির প্রবর্তন করতে এগোচ্ছেন। আসলে চিনের পার্টি নেতারা প্রত্যেকেই একেকজন ‘মিখাইল গর্বাচভ’।

এখন থেকে ৫০ বছর আগে চারু মজুমদার, জঙ্গল সাঁওতালরা কোন বাঁশি শুনে আগুনখেকো বিপ্লবী মন্ত্রে বুঁদ হয়েছিলেন। আর সেদিনের চিনা কমিউনিস্ট পার্টি হিমালয়ের পাদদেশে নকশালবাড়ি আন্দোলনে ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’ শুনতে পেয়েছিল। ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস থেকে সরোজ দত্তের কলম ঝলসে উঠবেই তো, ‘সেদিন আর বেশি দেরি নেই, যেদিন বড়লোকের চামড়া দিয়ে গরিবের জুতো তৈরি হবে।’ পরম বিশ্বাস আর চূড়ান্ত আবেগে দ্রবীভূত চারু মজুমদার গর্বের সঙ্গে বলতেন, ‘চিন-এর কমিউনিস্ট পার্টির ভারতীয় শাখার আমি সদস্য।’ সেই প্রবল সময়ের থেকে কয়েক’শো যোজন দূরে দাঁড়িয়ে চারু মজুমদার কি জ্যাক মা যে পার্টির সদস্য সেই পার্টির ভারতীয় শাখার সদস্য হতে চাইতেন! আর কি ওই আগ্নেয় সত্তরের কেউ বলতে পারবেন, ‘পেচ্ছাপ করতে গিয়ে মজুর যদি কিছু সময় চুরি করে, সেটাও শ্রেণি সংগ্রাম।’ চারু মজুমদার, সরোজ দত্তরা আজ বেঁচে থাকলে শিল্পপতিদের কমিউনিস্ট হওয়ার কী ব্যাখ্যা দিতেন কে জানে! যদিও তাঁদের উত্তরাধিকাররা একাংশ সেই সত্তরের দশকেই বলতে শুরু করেছিলেন, চিনা পার্টি সংশোধনবাদের গাড্ডায় পড়েছে। ব্যর্থ হয়েছে মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব। চিন বিপথগামী। প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়ে ধনতান্ত্রিক পথে পা দিয়ে উন্নয়ন করছে। চিনের নেতারা মুখে বলেন, তাঁরা চান, দেশের উন্নয়ন, সমাজতন্ত্রের উন্নয়ন আর মার্কসবাদের উন্নয়ন। জানি না চিন যে পথে চলছে তাতে দেশের উন্নতি হয়তো হচ্ছে তবে সমাজতন্ত্রের বা মার্কসবাদের যে কোনো উন্নতি হচ্ছে না, তা হলফ করে বলা যায়। যে ‘দাস ক্যাপিটাল’-কে বলা হয় মার্কসীয় তত্ত্বের আকর গ্রন্থ, যার পুরো নাম, ‘দাস ক্যাপিটাল দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি’ সেখানে পুঁজির জন্ম ও বেড়ে ওঠার সব বৃত্তান্তই একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গড়ে উঠেছে। পুঁজিবাদের রণ-রক্ত-সফলতা দেখাতে গিয়ে মার্কস ওই ব্যবস্থার পুঁজ ও ক্লেদ প্রকাশ্যে এনে দিলেন। অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিলেন, শোষণের হিমালয় তুল্য অনাচারের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে উদ্বৃত্ত, যা পুঁজিকে বিপুল শরীর দিয়েছে। তাই সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব শ্রমের ও পুঁজির। সেই দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করে যেটা গড়া যায়, সেটা আর যাই হোক সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ নয়। পুঁজির মন নিয়ে পুঁজিবাদকে বিলোপ করা যায় না। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে নিশ্চয় সমাজতন্ত্র লালিত হতে পারে না। মার্কসবাদের যে তাত্ত্বিক ভিত্তি, তার আরেকটি দিক হচ্ছে ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। যার ওপর দাঁড়িয়েই মার্কস-এঙ্গেলস সাম্যবাদে পৌঁছোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই মৌলিক নীতির ওপর দাঁড়িয়েই গড়া হয়েছে দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি। এখন যদি সেই পার্টি ধনপতিদের দলে সম্পৃক্ত করে নেয় তবে তো বিসমিল্লায় গলদ!

একবার ভেবে দেখুন, সিপিএমের সদস্য মুকেশ আম্বানি, সিপিআইয়ের সদস্য অনিল আম্বানি, সিপিআই (এমএল)’এর সদস্য আদিত্য বিড়লা আর সিপিআই (মাওবাদী)’র সদস্য রতন টাটা একটা মহাসম্মেলনে সম্মিলিত গলায় স্লোগান দিচ্ছেন ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ কিংবা ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’। সমাজজীবনে শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে এর চেয়ে বড় রসিকতা আর কিছু হতে পারে কি? অথচ চিন-এর কমিউনিস্ট পার্টি সেই রসিকতাই করছেন সেই দেশের শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে। মনে রাখতে হবে সর্বহারা শ্রেণির সামাজিক হাল সাইড লাইনে রেখে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে মার্কস কোনোদিনই গুরুত্ব দেননি। শ্রম ও পুঁজির লাগাতার সংগ্রামে জড়িত থাকা সামাজিক দিকগুলো মার্কসের বিশ্লেষণ থেকে বাদ যায়নি। আর সেই নিরিখে সমাজ বদলের লড়াইয়ে ঘরে-বাইরে শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক ভূমিকা ও তার বিকল্পের প্রতি তৎপরতা যেন প্রতিপদে বজায় থাকে, এটাই মার্কসের শিক্ষা। যা অনুসরণ করতে সজাগ ছিলেন মাওজেদং। কিন্তু মাত্র ৭০ বছরের সময়কালে বিপ্লবের উত্তরাধিকাররা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার শিকার হয়ে গেলেন। এই আত্মসমর্পণে মাওয়ের হাতে তৈরি পার্টির ভূমিকা আজ স্পষ্ট। পুঁজির কবলে মানুষের বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব ও তার যন্ত্রণা, যা নিজের কাছ থেকেই নিজে হারিয়ে যাচ্ছি, আজও হারাচ্ছি– ইতিহাসের রাজপথ ও গলি ঢুরে নিয়ম খুঁজে সেই ভীষণ দুর্গতি থেকে মুক্তির আলো এনে দিতে চেয়েছিলেন মার্কস। সোভিয়েতে সেই আশা মুড়িয়ে গেছে ৭০ বছরে, আর চিনে ৭০ বছরে তা নিয়ে এসেছে আলিবাবাকে! মার্কসীয় পথের যে ব্রতযাত্রায় লেনিন, মাও-রা এগিয়ে ছিলেন তা শুধু অসম্পূর্ণ-ই থাকল না, চোরাপথে পুঁজিবাদের এক পৃথক সংস্করণে সমর্পণ হল।

অথচ এই বাংলায় এখনও কৃষকের মিছিলে পা মিলিয়ে ধুক ধুক করে জ্বলা বিপ্লবী সত্তা গলা তোলে, ‘মন দুয়ারে সিঁদ দিয়েছি/আমার কীসের ভয়?/ হারার আছে প্রাণটা শুধু /জেতার বিশ্বময়।/ ভুলিনি, তাই বলছি আজও/ রাষ্ট্র শোষণযন্ত্র/ লক্ষ্য আমার ক্ষমতা নয়/ লক্ষ্য সমাজতন্ত্র।’ শুধু তাই নয়, প্যারিসের রাজপথে সেদিন গণবিক্ষোভে স্লোগান উঠেছে, ‘বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ করো’। আসলে যতই জ্যাক মা-রা কমিউনিস্ট পার্টিতে আসুক ‘বোকা বুড়োটা’ ঠিক পাহাড়টাকে ভাঙার সংকল্পে অবিচল থাকবেই। বলবে, “কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না!”

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...