পরিবেশ-দূষণ ও কোভিডের আকালে এক আঁকিয়ের বোধোদয়

রাহুল রায়

 


লেখক মার্কিন-নিবাসী অধ্যাপক

 

 

 

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন ‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি/ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের বিভীষিকার পর এই কবিতা লেখা। বাংলা ভাষায় তখনও রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার দৃঢ় প্রভাব বর্তমান, আর কল্লোল যুগের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকরা সেই প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। সঙ্গীত জগতেও একই ব্যাপার, সেখানেও চাঁদ-চকোর আর প্রেম-ভালোবাসার প্রভাব থেকে সরে আসার চেষ্টা করে চলেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ। গান-বাজনা-সাহিত্য ছাড়াও শিল্পের অন্যদিকেও এর ব্যতিক্রম নেই। যোগেন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার প্রমুখ শিল্পীরা অজস্র এঁকেছেন মন্বন্তরের ভয়াবহ সব ছবি। শুধু ছবি আঁকার আনন্দে নয়— মানুষের দুঃখ-দারিদ্র, নিরালম্বতার প্রকৃত চিত্র তাঁরা তুলে ধরেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যাতে আমরা এই চিত্র, এই পরিস্থিতি, এই ভয়াবহতা ভুলে না যাই। যেন ভুলে না যাই মানুষের সৃষ্ট এই ভয়াবহতার কারণ।

মানুষের সৃষ্ট নানা ভয়াবহতার মধ্যে অন্যতম পরিবেশ দূষণ, যা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে সেই দূষণের ফল আমাদের গায়েই আছড়ে পড়ছে। অনেকটা সেই যে গাছের ডালে বসে আছি তার গোড়া কাটার মত।

আনুমানিক ৪৫০ কোটি বছরের পুরনো আমাদের এই পৃথিবী। প্রথমে ছিল জ্বলন্ত আগুনের গোলা, তারপর সুদীর্ঘ ধারাপাতের পর পৃথিবী ঠান্ডা হল, তৈরি হল পৃথিবীর মাটি বা আর্থ-ক্রাস্ট। সৃষ্টি হল অনেক-অনেক-অনেক যোজন দুরের সূর্য দিয়ে প্রভাবিত ও পরিচালিত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। সমুদ্রের জলে দেখা দিল এককোষী অ্যামিবা, তারপর জল থেকে আস্তে-আস্তে উঠে এল উভচরী স্যালাম্যান্ডার। কোটি কোটি বছরের এই প্রক্রিয়া থেকে জীবজগত, গাছপালার সৃষ্টি হল, আর শুরু হল জীবজগতে ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’-এর লড়াই। আর সেই প্রক্রিয়ায়ই আদিম মানুষ হোমো-স্যাপিয়েন ইরেকটাস হয়ে দু-পায়ে উঠে দাঁড়াল। এল প্রস্তর-যুগ, তারপর লৌহ-যুগ। মানুষ, তার অপেক্ষাকৃত বেশি বুদ্ধিবৃত্তির জোরে আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। শীগগিরই তারা হয়ে দাঁড়াল জগতের অধীশ্বর বা ‘লর্ড অফ দ্য ইউনিভার্স’।

‘জোর যার মুলুক তার’। একজন শক্তিশালী মানুষ অন্যের ওপরে প্রভুত্ব করবে, মেনে নিতে কষ্ট হলেও স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে, এটা শুধু ব্যক্তিগতভাবে হয় তা মনে করার কোনও কারণ নেই। এক দেশ, এক সমাজ, এক গোষ্ঠী অন্যের ওপর অত্যাচার করেছে, এমন উদাহরণ মানুষের ইতিহাসে ভুরি-ভুরি আছে।

পৃথিবীর বুকে মানুষ ছাড়াও অন্য জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ থেকে গাছপালা ইত্যাদি আছে। এদের সবায়েরই প্রাণ আছে। কিন্তু মানবসভ্যতার অগ্রগতির ফলে এই মানুষেতর জীবজন্তু, গাছপালা ইত্যাদির কী অবস্থা হয়েছে, তাদের স্বাভাবিক বিচরণের জায়গা বা ‘ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাট’ আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তা বোঝার প্রয়োজন আমাদের। সেই বোঝাটা মানুষের স্বার্থেই, বিশেষ করে বর্তমানের কোভিড ১৯ অতিমারির পরিপ্রেক্ষিতে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘আরণ্যক’-এর মতো উপন্যাস বাংলা সাহিত্য তো বটেই পৃথিবীর সাহিত্যে বিরল, কারণ এই উপন্যাসে প্রধান, এমনকি একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আদিম অরণ্যানী। ছায়ার মতো দূরে মাথা তুলে দাঁড়ানো মহালিখারুপ পাহাড়ের কোলে লবটুলিয়া, নাড়া বইহার, সেখানে বয়ে চলা পাহাড়ি ছোট নদী, সেখানকার আদিম অধিবাসী, সেখানকার হতদরিদ্র রাজা ও তার প্রজা ও পারিষদবর্গ। সেখানে গাছগাছালির কোনও অভাব না থাকলেও কে এক যুগলপ্রসাদ সেখানে নদীর ধারে চারাগাছ লাগায়। তাতে একদিন ফুল ফুটবে। সে যেন গাছপালা, পরিবেশের রক্ষকের ভূমিকা নিতে চায়। নীরবে মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির কুফলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চায়।

কিন্তু লেখক এক জমিদারের প্রতিনিধি। তার কাজ এই বিশাল বনজঙ্গল বিক্রিবাটা করে সেখানে লোকের বসতি গড়ে তোলা। এই নিস্পাপ অরণ্যানীর সব গাছপালা কেটে ফেলে, এখানের সব জীবজন্তু সরিয়ে দিয়ে সেখানে গড়ে উঠবে মানুষের বস্তি, ভাঙাচোরা টালির চালের ঘর, সেখানে হনুমানের ঝান্ডা উড়ছে, এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে নেড়ি কুকুর আর শুয়োরের পাল, বাতাসে কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ, এখানে-ওখানে বর্জ্যদ্রব্য ছড়ানো। বিভূতিভূষণ মনের চোখে এই দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তাঁর অসহায়তা ও মানসিক যন্ত্রণা এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছে।

বিভূতিভূষণের উপন্যাস একেবারে আমাদের মানুষের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আমরা একেবারে আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর আরণ্যকে বর্ণিত হাল করেছি। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফেডারেশনের ২০১৭ সালের ক্রোড়পত্রে জানা যাচ্ছে যে গত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীর বুকে মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।[1] এই সাতশো কোটি জনগণের বাসস্থান, খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মেটাতে ক্রমশই পৃথিবীর বুক থেকে বনজঙ্গল হারিয়ে যাচ্ছে। আর বনের পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদির স্বাভাবিক বিচরণভূমি ক্রমশই সঙ্কুচিত হচ্ছে। আমরা তাদের মেরেধরে শেষ করে দিচ্ছি, আর যারা বেঁচে আছে তাদের খোঁয়াড় নামক অভয়ারণ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছি। অন্যদিকে নিয়মিতভাবে নানান জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, গাছ দুষ্প্রাপ্য হয়ে ‘এনডেঞ্জারড স্পিসিস’-এর তালিকায় নাম লিখিয়ে, শেষে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে।

এবার দেখা যাক মানুষেতর জীবজন্তু, গাছপালা ইত্যাদির সঙ্কোচন ও ধ্বংসের সঙ্গে কোভিড ১৯ অতিমারির সম্পর্ক কী। এটা জানা যে এক বিশেষ ধরনের করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকেই কোভিড ১৯-এর উপসর্গ দেখা দেয়। আর এও জানা যে বাদুড়ের কোনও এক বিশেষ প্রজাতি থেকেই মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের শুরু। চিন দেশের কোথাও কেউ এক বিশেষ বাদুড় প্রজাতির সংস্পর্শে আসে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। কারণ সেই বাদুড় ছিল করোনা ভাইরাসের ‘ক্যারিয়ার’। শীগগিরই লোকটির মধ্যে দেখা দেয় বর্তমানের কোভিড ১৯ সম্পর্কীয় সব উপসর্গ। আর সে কিছু না বুঝে, নির্বিচারে অন্যদের মধ্যে এই অসুখ সংক্রামিত করে দেয়। আর সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে এই রোগ আজ অতিমারি হিসাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় এক বছর হতে চলেছে— সারা পৃথিবীতে কয়েকশো লক্ষ লোক এতে মারা গেছে। অন্যদিকে এই অসুখের কোন প্রতিষেধক (ভ্যাকসিন) সম্প্রতি আবিস্কার হলেও তা সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের মধ্যে আসা এখনো প্রচুর অর্থ ও সময়-সাপেক্ষ। অন্যদিকে এই অসুখের কোন ওষুধ (থেরাপিউটিক মেডিসিন) আবিস্কারের কথাও এখনো কেউ শোনে নি। তার ফলে এর কোভিদ ১৯-এর সংক্রমণ ও তাতে মৃত্যু সমান তালে এগিয়ে চলেছে। এই প্রসঙ্গে প্রতিষেধক ও ওষুধের মধ্যে তফাত একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আমার ছোটবেলায় প্রতিষেধক (ভ্যাকসিন)-কে বলা হত টীকা। এই প্রক্রিয়ায় খুব অল্প পরিমানে জীবন্ত বা ‘লাইভ’ জীবানু শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে শরীরে এর প্রতিরোধ বা ইম্যুনিটি তৈরি হয়, ও আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরের ফলে বর্তমানে ‘লাইভ’ ভাইরাসের বদলে গবেষণাগারে তৈরি নানান ‘সিন্থেটীক’ প্রতিষেধক ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ওষুধ বা থেরাপিউটিক মেডিসিন-এর প্রয়োজন অসুখ হওয়ার পর, অর্থাৎ এই ওষুধ খেলে অসুখ সেরে যায় বা কমে যায়, যেমন মাথা ধরলে অ্যাসপিরিন উপকার দেয়। কোভিদ ১৯-এর এমন কোন ওষুধের কথা জানা নেই।

এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো যে কোভিড-পূর্ববর্তী অন্যান্য মহামারি-অতিমারির উৎসও নানান জীবজন্তু। যেমন কয়েক বছর আগের ইবোলা ভাইরাসের উৎস ছিল গোরিলা, হিউম্যান ইম্যুনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা এআইডিএস এসেছে শিম্পাঞ্জি থেকে, কুখ্যাত ইউরোপিয়ান প্লেগ-এর উৎস ইঁদুর, স্প্যানিশ ফ্লু-র মুরগি ইত্যাদি। এতে মানুষ অসুস্থ হয়েছে, মরেছে, কিন্তু ‘ক্যারিয়ার’ জীবজন্তুরা দিব্বি বেঁচে ছিল ও আছে। যেমন বর্তমানে কোভিড ১৯ দাবানলের মতো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে ও এর শেষ যে কোথায় তা কেউ জানে না। কিন্তু বাদুড়ের দল, এমন কি ‘ক্যারিয়ার’ বাদুড়ের প্রজাতি অসুস্থ হয়ে পড়েছে এমন কথা জানা নেই। মনে রাখা ভালো যে মহামারি-অতিমারির সময় ঐ বিশেষ শ্রেণির জন্তুর সবাই যে ‘ভাইরাস-ক্যারিয়ার’ হবে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। কোনও জন্তুর এক বিশেষ প্রজাতি ‘ক্যারিয়ার’ হয়েও কেন অসুস্থ হয় না তার বৈজ্ঞানিক কারণের গভীরে যাওয়া এই প্রবন্ধে সম্ভব নয়। উল্টোদিকের উদাহরণও আছে। আমাদের শরীরে কোষের পরিবর্তন বা সেল-মিউটেশন সর্বক্ষণই চলছে, তার ফলে আমরা সাধারণত অসুস্থ হয়ে পড়ি না, কিন্তু কোনও কোনও দুর্ভাগার ক্ষেত্রে তা ক্যান্সার বা অন্য অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু বড় প্রশ্ন হল, লক্ষ-লক্ষ বছর ধরে আমরা এই জীবজন্তুদের সঙ্গে পৃথিবীতে বসবাস করছি। তাহলে বিগত তিন-চারশো বছরে এমন কী ঘটনা ঘটল যার ফলে এই জীবজন্তুদের থেকে ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া ইত্যাদি জীবাণু আমাদের, অর্থাৎ মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হচ্ছে, আমরা অজান্তে নিজেদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিচ্ছি ও সবাই দলে দলে অসুস্থ হয়ে পড়ছি?

এই সমস্যার অন্যতম কারণ সংক্রমণের সম্ভাবনার ঊর্ধ্বমুখী গতি। এর কারণ খুঁজতে বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই। আমরা, মানুষেরা ক্রমাগত জীবজন্তুদের নিজেদের বিচরণের জায়গা বা ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাট কেড়ে নিয়ে নিজেরা সেখানে বসবাস শুরু করেছি। আর জীবজন্তুরা তাদের বসবাসের জায়গা না পেয়ে ক্রমশ আমাদের ধারেকাছে চলে আসছে। আর তার ফলে আমাদের করোনার মত বিপদজনক ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এটা যেন বনজঙ্গল আর সেখানে বসবাসকারী জীবজন্তুদের,তাদের ওপর মানুষের অত্যাচারের প্রতিশোধ।

কোভিড ১৯-এর হাত থেকে বাঁচতে মানুষ এখন অনেকখানি ঘরবন্দি। আর জীবজন্তুরা? তারা পড়েছে বিরাট ধাঁধায়। কোথায় গেল সব দুপেয়েগুলো? তারা তো আর আমাদের দেখে লাঠি বা বন্দুক নিয়ে তাড়া করছে না। বিবিসি-র ৩০ শে মার্চের খবরে দেখা যাচ্ছে যে একদল লোমওলা ছাগল ওয়েলসের ল্যানডুডনো শহরের ফাঁকা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে ইকনমিক টাইমসের খবরে দেখা যাচ্ছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে নানান জীবজন্তু ফাঁকা লোকালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হরিণ, নীলগাই ছাড়াও গুয়াহাটি শহরে রাস্তায় নেমেছে এক একশিঙ্গা গণ্ডার। অন্যদিকে বহু বছর বাদে মুম্বাই-এর মেরিন ড্রাইভ ও মালাবার হিলস অঞ্চলে ডলফিন বা শুশুকদের জলে লাফালাফি করতে দেখা যাচ্ছে। কোভিড ১৯-এর সুবাদে মানুষের মতোই এরাও মস্ত ধাঁধায় পড়েছে।

ছোটবেলা থেকেই আমার আঁকার শখ। একটু বড় হয়ে ছুটির দিনে বা হাতে একটু সময় পেলেই কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, তাতে আঁকার কাগজ, রং-তুলি, ফ্লাস্কে জল ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। স্কুল থেকে কলেজ গিয়ে, বা তার পরে, এমনকি, এখনও সেই শখটা কম হলেও হারিয়ে যায়নি। এক সময় মানুষের ছবি আঁকতে ভালবাসতাম, এখন অবশ্য সুন্দর নিসর্গের ছবি, স্টিললাইফ ইত্যাদি ছবি আঁকি, যেমন সবাই আঁকে। কিন্তু ৪৩-এর মন্বন্তর–পরবর্তী আর্টিস্টদের মতো কোভিড ১৯ অতিমারির সময় আমারও আঁকার ব্যাপারে চিন্তার পরিবর্তন হয়েছে।

এখন মনে হয় আঁকা ছবির যেন একটা উদ্দেশ্য থাকে, শুধুমাত্র ‘সুন্দর ছবি’ ছাড়াও এর যেন একটা অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে। যেমন বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ছবিতে আঙুল তুলে দেখানো মানুষের কৃত পরিবেশ-ধ্বংসের কুফল। স্বাভাবিকভাবেই সাম্প্রতিক কোভিড ১৯-এর নানান রূপ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যখন আমরা ঘরের মধ্যে বন্দি, তখন বন্য জীবজন্তুদের দিশাহারা অবস্থা নিয়ে একটা ছবি এঁকেছি। বনের বাঘ ধাঁধার ঘোরে শহরের ফাঁকা পথে নেমে পড়েছে— বলি, লোকগুলো সব গেল কোথায়? সমুদ্রে নাচছে শুশুক— তাদের ধরার কেউ নেই তো। 

 

কিন্তু গাছপালা, জীবজন্তুদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। এটা নিশ্চিত যে কোভিড ১৯-এর বিভীষিকা একদিন কেটে যাবে। আর, আমরা, মানুষেরা শীগগিরই ভুলে যাব যে কোভিড ১৯ কোনওদিন হয়েছিল, ভুলে যাব কত চেনা-অচেনা লোক এতে প্রাণ হারিয়েছে। শেষ হয়েছে কত লোকের জীবিকা ও রুজি-রোজগারের উপায়। আমরা কিছুই শিখি না। তাই আবার আমরা জীবজন্তুদের মেরেধরে শেষ করব। 

 

আবার আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ব লাগামহীন পণ্যমনস্কতায়। আবার শুরু হবে নতুন করে পরিবেশ হনন। আবার আমরা নির্বিচারে বন কেটে বসত তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ব, আর জীবজন্তুরা নিরুপায় হয়ে আমাদের কাছাকাছি বসবাস করতে শুরু করবে। আর, তার ফলে আবার আমরা পশু, কীটপতঙ্গ বাহিত ভাইরাস ও ব্যাকটিরিয়া আমাদের শরীরে টেনে নেব। আবার আসবে নতুন অতিমারি-মহামারি। নতুন নামে।


  1. www.wwf.org.au › ArticleDocuments › pub-fact-sheet-…
  2. https://www.bbc.com/news/uk-wales-47535311
  3. https://economictimes.indiatimes.com/news/politics-and-nation/coronavirus-lockdown-unusual-sightings-of-animals-in-india/nilgai-in-noida/slideshow/75230929.cms
  4. ২ নং টিকা
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. লেখাটি ভালো লাগলো। লেখক সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী অধ্যাপক। তাঁর বক্তব্যের সারবত্তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মানুষ অবশ্যই আজ এই নীল গ্রহের আত্মধ্বংসী নিয়ন্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সমূহ সতর্কতার প্রয়োজন, আগামী দিনে নয়, এই মুহূর্তে। লেখকের আঁকা ছবিগুলো এ নিবন্ধের উপভোগ্য ভ্যালু অ্যাডিশন।

Leave a Reply to নিরুপম চক্রবর্তী Cancel reply