
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
ছবি আঁকাতেই আমাদের আদিম পূর্বসূরিদের হাতেখড়ি। একালের মতো বিচিত্র বর্ণমালা এসেছে অনেক পরে, বিবর্তনের নানা পথ বেয়ে। আদিম গুহাবাসী মানুষ গুহার পাথুরে দেওয়ালকেই ক্যানভাস হিসেবে বেছে নিয়েছিল। সেখানেই প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে আনা রঙে রাঙিয়ে তুলেছিল তাদের প্রথম ক্যানভাস। যে-কালের কথা বলছি, সে-কালের মানুষ তখনও এক ঠাঁইয়ে থিতু হয়নি। শিকার আর বনজ ফলমূল, কন্দ ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য এই জঙ্গল, সেই জঙ্গলে পাড়ি দিয়ে ফিরত। জীবনের এমন ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা তাদের শৈল্পিক সত্তাকে হারায়নি— বরং বলা যায়, দীর্ঘ পরিব্রাজনের পথে নানান গুহা-আবাসে রেখে গিয়েছে তাদের শৈল্পিক ভাবনার অতুলনীয় স্বাক্ষর— তা সে স্পেনের আলতামিরার গুহা হোক বা ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি কিংবা ভারতবর্ষের ভীমবেটকার পাথুরে ক্যানভাস।
বহু লক্ষ বছর আগে, নাম-গোত্র-পরিচয়বিহীন মানুষের হাতে যে চিত্রকলা শৈলীর আশ্চর্য সৃষ্টি ঘটেছিল, তা যেন আজও সমানভাবে বহন করে চলেছে ১৪২ কোটির ভারতের প্রায় ৯ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন। শহুরে হই-হট্টগোল, প্রতিদিন নিজেদের বদলে ফেলা জীবনের পরিসীমার অনেক অনেক বাইরে, নিভৃত যাপনে অভ্যস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা আজও নিবিড় মমতায় আগলে রেখেছে তাদের পূর্বজদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির স্বতন্ত্র পরম্পরা। ভারতের আদিবাসী মানুষদের নিজস্ব চিত্রশৈলীর মধ্যেও যেন প্রতিভাসিত হয় সেই বিনম্র ট্র্যাডিশনের উজ্জ্বল ধারা। এই নিবন্ধে আমরা ভারতের তেমনই এক আশ্চর্য আদিবাসী চিত্রশৈলীর সঙ্গে পরিচিত হব।
আদিবাসী মানুষরা আজও পরম্পরাগতভাবে সামূহিক জীবনধারায় বিশ্বাসী। আর তাই দীপাবলি উৎসবের ঠিক পর পরই আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, একটু দূরে থাকা ছত্তিশগড়, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে বসবাসকারী ভূমিজ, কুড়মি, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কুমহার, বাউরি, প্রজাপতি, গোয়ালা ইত্যাদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন মেতে ওঠেন ফসল কাটার উৎসব— সোহরাই— উপলক্ষে। ভারতীয় হিন্দু বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, কার্তিকী অমাবস্যার দিন উদযাপিত হয় এই বর্ষবরণের লোকজ উৎসব।
এই উৎসবকে ঘিরেই আমরা আজ পৌঁছে গেছি ঝাড়খণ্ড রাজ্যের চিরুড্ডি গ্রামে। আসন্ন সোহরাই উৎসবের প্রস্তুতিতে গোটা গ্রাম এবং গ্রামের বাড়িগুলোর মাটির দেয়াল রঙিন হয়ে উঠেছে বিচিত্র সব চিত্রকলায়। প্রবীণ মহিলাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন মধ্যবয়সী ও তরুণী, এমনকি কিশোরী মেয়েরাও। আগে থেকেই বিশেষভাবে প্রস্তুত করে রাখা দেয়ালগুলো রঙে রঙিন হয়ে উঠছে— তবে এ নিছক বাড়ির দেওয়াল রাঙানো নয়, বরং এক আশ্চর্য সাংস্কৃতিক পরম্পরার বাহন। এই পরম্পরা মা-দিদিমার হাত ধরে পৌঁছে যাচ্ছে নব্য কিশোরী, তরুণী ও যুবতী প্রজন্মের কাছে।
আঁকার কাজের শুরু হয় ছোট ছোট কাগজে খসড়া তৈরি দিয়ে। তারপর সেই খসড়াগুলিই রূপ পায় বিচিত্র রঙের অলঙ্করণে। শিল্পীদের হাতে শুধু রং নয়, মিশে থাকে গোটা গ্রামের মানুষের হৃদয়ের উষ্ণতা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
এই গ্রামেরই এক প্রবীণা শিল্পী অনীতা দেবীর কথায়, “আমি এই গ্রামেরই মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আমার মা আর দিদিমা উৎসব-অনুষ্ঠানের সময় নাওয়া-খাওয়া ভুলে, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বাড়ির দেয়াল রাঙিয়ে তুলতেন বিচিত্র চিত্রকলায়। আজ আমার তিন মেয়েও সেই ধারাতেই, প্রাকৃতিক আর ভেষজ রঙের প্রলেপে দেয়ালে ছবি আঁকছে। এটা আমাদের কাছে একরকম সংস্কার। ছবি না আঁকলে যেন উৎসবের আমেজটাই ঠিক মতো আসে না।”
কিন্তু কেন এই দেয়ালচিত্র অঙ্কনের বিষয়টি আজও চিরুড্ডি গ্রামের মানুষের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ? আদিম গুহাবাসী মানুষের উত্তরাধিকার বহন করে চলা এই সহজ-সরল আদিবাসী সম্প্রদায় মনে করে, এভাবেই তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য আর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখছে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়— সোহরাই চিত্রশৈলীর আঙ্গিক কি তবে একেবারেই অপরিবর্তিত? স্থানীয় শিল্পী মীনা কুমারী কিন্তু তেমনটা মনে করেন না। তাঁর মতে, “পরিবর্তন তো সময়ের ধর্ম। আমাদের চিত্রশৈলীতেও সেই বদলের ছোঁয়া লেগেছে। একদম গোড়ার দিকে সোহরাই চিত্রের বিন্যাস ছিল অনেকটাই সহজ— বৃত্ত, ফুল, লতা-পাতা আর একান্তভাবে আদিবাসী মোটিফেই সীমাবদ্ধ থাকত। এখন আমরা নানান ভঙ্গিমায় মানুষের ছবি আঁকি, প্রতিদিনের দেখা দৃশ্যগুলোও উঠে আসে আমাদের ক্যানভাসে। এভাবেই, বোধহয়, আমরা বছরের পর বছর ধরে আমাদের জীবনের গল্প এঁকে চলেছি— প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।”
সোহরাই উৎসব যেহেতু কৃষির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত, সেই কারণে গরু-সহ গৃহপালিত পশুদের পূজা এই উৎসবে বিশেষ গুরুত্ব পায়। ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, ছত্তিশগড় এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে গোবর্ধন পূজার আয়োজন হয় ধুমধাম সহকারে। মানুষ ও গৃহপালিত পশুর মধ্যে সম্পর্ক আত্মিক ও হার্দ্য, সেই আন্তরিকতারই প্রতিফলন ঘটে এই দিনে। গরুর পাশাপাশি অন্যান্য পোষ্যদেরও বিশেষভাবে সজ্জিত করা হয়— ফুলের মালা, হলুদ আর সিঁদুরে। পরিবেশিত হয় বিশেষ আহার্য, যা দৈনন্দিন খাবারের তুলনায় অনেক বেশি যত্নে ও বৈচিত্র্যে সাজানো। এই উপকারী প্রাণীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মানুষ যেন স্মরণ করিয়ে দেয় পারস্পরিক নির্ভরতার চিরন্তন সত্য।
কেবল চিরুড্ডি গ্রামের মানুষদের কাছেই নয়, গোটা সাঁওতাল পরগণার আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছেই সোহরাই পরব এক গভীর তাৎপর্য বহন করে। এই পরবের নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে এই সহজ সরল মানুষরা জীবনের গভীরে প্রোথিত শিকড়ের সঙ্গে নিজেদের পুনরায় সংযুক্ত করার আন্তরিক প্রয়াস চালায়। নিজেদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি নিবেদন করে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সেই কারণেই তারা রঙের প্রলেপে রাঙিয়ে তোলে তাদের ছোট ছোট ঘরবাড়ি— যেখানে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও মিশে থাকে অনাবিল আনন্দের উচ্ছ্বাস, আর চিত্রকলার বর্ণময় মূর্ত রূপ। উৎসবকে ঘিরে এই শিল্পরচনার মধ্যে দিয়েই যেন উদ্ভাসিত হয় তাঁদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও আত্মগরিমা।
কথায় আছে— চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। যেমন জোয়ারের পরে আসে ভাঁটা, দিনের পরে রাত, তেমনি উত্থানের পর কিছুটা পতনও যেন অনিবার্য। সোহরাই চিত্রকলার ক্ষেত্রেও হল ঠিক তাই। ‘উন্নয়ন’-এর স্লোগান উঠল— আদিবাসী মানুষদের জন্য চাই আধুনিক সুবিধা, আর তাই মাটির বাড়িগুলিকে ঢেকে দিতে হবে ইট, বালি, সিমেন্টে। ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে কাজও শুরু হল। চিরুড্ডি গ্রামের একের পর এক মাটির বাড়ি রাতারাতি রূপ নিল পাকা বাড়িতে।
সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হল সমস্যার। মাটির দেয়ালের ক্যানভাসকে কেন্দ্র করেই যে অনন্য চিত্রকলার জন্ম ও বিকাশ, সেই দেয়ালই যদি বদলে যায়, তবে আঁকা চলবে কীভাবে? মাটির দেয়াল পরিবেশবান্ধব হলেও ক্ষয়িষ্ণু— প্রতি বছর তা নতুন করে মেরামত করতে হয়। কিন্তু সিমেন্ট-ইটের দেয়ালে সে প্রয়োজন নেই বটে, তবে সেখানে সোহরাই ছবির সূক্ষ্ম রং-রেখা তেমনভাবে আঁকা যায় না। এই নতুন ক্যানভাস যেন শিল্পীদের কাছেই ধীরে ধীরে অপছন্দের হয়ে উঠল। ফলত, অনেকেই উৎসবের সময় ছবি আঁকার প্রতি উৎসাহ হারাতে শুরু করলেন।
তবে কি এই শিল্পের আর ভবিষ্যৎ নেই?
এই সমস্যার সমাধানে যেন দেবদূতের মতো এগিয়ে এলেন গ্রামেরই এক তরুণ, মণীশ কুমার মাহাতো। চিরুড্ডির অন্য ছেলেমেয়েদের মতো মণীশের শৈশবও কেটেছে সোহরাই চিত্রকলার রঙিন আবহে— কখনও নিজের বাড়ির দেওয়ালে, কখনও প্রতিবেশিনীদের আঁকাআঁকিতে মুগ্ধ হয়ে। আর তাই যখন দেখলেন বদলে যাওয়া ক্যানভাসের কারণে এই শিল্পধারার ধারা প্রায় থমকে গেছে, তখন মণীশ আর চুপ থাকতে পারলেন না।
তাঁর বিশ্বাস, সোহরাই চিত্রকলার মতো এক অনন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। এই শিল্পের অস্তিত্ব শুধু কয়েকটা রেখা আর রঙে নয়, এর মধ্যে রয়েছে এক গোটা সমাজের আত্মপরিচয়, পূর্বজদের সঙ্গে যোগসূত্র। তাই এই ধারার বিলুপ্তি মানে যেন নিজের শিকড় ছিঁড়ে ফেলা— এমন এক বিচ্ছেদ, যা মেনে নেওয়া যায় না।
আর ঠিক সেই জায়গা থেকেই শুরু মণীশের লড়াই। তিনি বলেন—
আমি কখনওই চাইনি যে এমন এক অতুলনীয় পরম্পরা কেবলমাত্র ক্যানভাস বদলে যাওয়ার কারণে থেমে যাক। আমাদের মা, বোন, দিদি-দিদিমারা, যাঁরা এত যত্নে, এত ভালোবাসায় এমন এক প্রাণময় ধারাকে এতদিন ধরে আগলে রেখেছেন— তাঁরা নতুন সৃষ্টির আনন্দ থেকে বঞ্চিত হোন, এটা আমি মেনে নিতে পারি না। আমি চেয়েছিলাম, এই চিত্রধারাকে যেমন জীবন্ত রাখা দরকার, তেমনি এখান থেকে গ্রামের মহিলাদের কিছু আর্থিক সুরাহা হোক— সেই ব্যবস্থাও গড়ে উঠুক।
আসলে সোহরাই চিত্রকলা আমাদের অস্তিত্বের স্মারক, আমাদের সৃষ্টি-সুখের উল্লাস, আমাদের আত্মপরিচয়ের উজ্জ্বল অভিজ্ঞান। এটা হারিয়ে যাওয়া মানে, আমাদের শিকড় থেকে ছিন্ন হয়ে পড়া। সেটা আমি মেনে নিতে পারি না। আমি যাঁদের বছরের পর বছর ধরে এই কাজে মগ্ন থাকতে দেখেছি, তাঁদের সেই কাজ এভাবে বন্ধ হয়ে যাবে— এটা ভাবাই যায় না। প্রতিটি দেয়ালচিত্র এক-একটি স্বপ্নের কথা বলে, ভাবনার কথা বলে, সৃষ্টির কথা বলে। তাকে কি হারানো যায়?
বলার সময় মণীশ স্বাভাবিকভাবেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে মণীশ আয়োজন করলেন এক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। উদ্দেশ্য একটাই— গ্রামীণ মহিলাদের আবার একত্রিত করা, তাঁদের মিইয়ে পড়া সৃজনশীলতাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলা। ক্ষেত্র ছিল প্রস্তুত, মজুত ছিল ইন্ধন— অপেক্ষা ছিল শুধু অগ্নিসংযোগের। সেই কাজটিই ফের করে দেখালেন ভূমিপুত্র মণীশ কুমার মাহাতো।
প্রথম দিকে গ্রামের মহিলারা ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। এমন কোনও প্রয়াসের পেছনে লাভের বিশেষ সম্ভাবনা আছে বলে তাঁরা ভাবতে পারেননি। জমে বরফ হয়ে যাওয়া জলকে আবার গলিয়ে ফের তরল করতে যেমন লাগে তীব্র উত্তাপ, এখানেও প্রয়োজন ছিল তেমনই একটা দৃঢ়, উষ্ণ আগুন। মণীশ ধৈর্য ধরে বোঝালেন— কীভাবে এই অনন্য চিত্রশৈলীর সৌন্দর্য গোটা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে, কীভাবে এর হাত ধরে পুনরায় ফিরে আসতে পারে স্বীকৃতি, গরিমা আর ঐতিহ্যের আলোকছটা, কীভাবে এর সুবাদেই তৈরি হতে পারে অতিরিক্ত আয়ের পথ।
মণীশের আন্তরিক প্রয়াস বিফলে যায়নি। তাঁর উপর বিশ্বাস রেখেই হতাশ হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকা মহিলারা আবার রং-তুলি হাতে ময়দানে নামলেন। নতুন করে যেন প্রাণ ফিরে পেল এক প্রাচীন পরম্পরা।
এখন চিরুড্ডি গ্রামের প্রায় ১৫ জন মহিলা সক্রিয়ভাবে সোহরাই চিত্রকলার স্তিমিত হয়ে যাওয়া গরিমাকে ফিরিয়ে আনার কাজে যুক্ত। এবং আশার কথা এই যে, সংখ্যাটা প্রায় প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ছে। আরও আনন্দের বিষয়, অনেক কিশোরী— তাদের পড়াশোনার ব্যস্ততার মধ্যেও— সাগ্রহে অনুশীলন করছে এই ঐতিহ্যবাহী চিত্রশৈলী।
মীনা দেবীর কথায়, “সোহরাই চিত্রকলার সুবাদে যে কোনওদিন বাড়তি আয়ের সুযোগ আসতে পারে, তা আমরা কল্পনাও করিনি। এখন অনেক না হলেও কিছুটা আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা নিজেরাই কিছু করছি নিজেদের জন্য। এই অনুভবটাই আমাদের অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আর সবচেয়ে গর্বের ব্যাপার হল, নিজেদের এই কাজের মাধ্যমে আমরা আমাদের পরম্পরাকে রক্ষা করতে পারছি। এর চেয়ে বড় গর্বের কাজ আর কীই বা হতে পারে!”
চিরুড্ডি গ্রামের এই কাজ পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। রাঁচি জেলার এই একদা অখ্যাত গ্রামের শিল্প পেয়েছে জিআই ইনডেক্সের গৌরবজনক তকমা। গ্রামের মহিলাদের এই কাজ এখন আর শুধুমাত্র দেয়ালচিত্রণে সীমাবদ্ধ নেই। মণীশের কথামতো, যেমন তাঁরা নিজেদের বদলে নিয়েছেন, তেমনই বদলেছে তাঁদের ক্যানভাসও। চিরকালের মাটির দেয়াল ছেড়ে এখন তাঁরা কাপড়ের নানা উপকরণের উপর তুলির বর্ণিল আঁচড় কাটছেন সৃজনের অপার আনন্দে। আর এতেই বাড়ছে আয়ের সুযোগ। আগে এই কাজ শুধুমাত্র উৎসবের সময়েই হত, এখন তা সারা বছর ধরেই চলছে।
তরুণী শিল্পী সুনীতা কুমারীর কথায়— “আমাদের চিরুড্ডি গ্রামের শিল্পীদের আঁকা শাড়ি বা চাদর গায়ে দিয়ে কাউকে যখন ঘুরে বেড়াতে দেখি, তখন আনন্দ আর উত্তেজনায় মন ভরে যায়। আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো চলছেই। একবার যখন আমরা আমাদের শিল্পকে গ্রামের সীমানার বাইরে পৌঁছে দিতে পেরেছি, তখন আর পেছনে তাকানোর প্রশ্নই ওঠে না। এখন শুধু এগিয়ে চলা— আমাদের ঐতিহ্যকে বিশ্বজনীন করে তোলার পথে।”
তবে কিছু পেতে গেলে যে কিছু ছাড়তেই হয়। ক্যানভাসের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গেছে তাঁদের চেনা রঙের চরিত্রও। আগে শতভাগ প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হত— যেমন, সাদা রঙের জন্য দুধি মাটি, লালের জন্য লাল মাটি (রেড অক্সাইড), আর কালোর জন্য কালি মাটির (ম্যাঙ্গানিজ ব্ল্যাক) ব্যবহার ছিল নিয়মিত। এছাড়াও গাছগাছড়া থেকে পাওয়া যেত আরও নানা রং। বর্তমানে অবশ্য বিভিন্ন সিন্থেটিক রং দেয়ালচিত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে— কারণ, একালের হামলে পড়া শহুরে ক্রেতারা তেমনটাই চান।
শুরুতে মণীশের এই লড়াই মোটেই সহজ ছিল না। একটা চলতি গাড়ি মাঝরাস্তায় হঠাৎ থেমে গেলে তাকে আবার নতুন করে চালু করাটা যেমন কঠিন, এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক তেমনই হয়েছিল। তবে ভূমিপুত্র হওয়ার একটা বড় সুবিধা মণীশের ছিল, আর এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় মূলধন। সোহরাই শিল্পের গলি-ঘুপচি ছিল তাঁর নখদর্পণে। ফলে কীভাবে কাজ করতে হবে, তা অজানা ছিল না মণীশের।
নতুন করে কাজ শুরু করতে গিয়ে বহুবার উপেক্ষা, অবহেলা, এমনকি তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। শুনতে হয়েছে অনেক নেতিবাচক কথা। তবুও মণীশ লড়াই ছাড়েননি। গ্রামীণ মহিলাদের তিনি নিরন্তর সাহস আর ভরসা দিয়ে গিয়েছেন। বলেছিলেন নিজেদের শিকড়ের প্রতি, অন্তর্লীন যাপনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কথা।
আজ আদিবাসী সোহরাই চিত্রকলার কথা মধুবনীর মতোই পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ জানেন। লড়াইয়ের কঠিন দিনগুলোতে যাঁরা মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, আজ সাফল্য দেখে তাঁরাই গদগদ হয়ে প্রশংসা করছেন। এসব ভাবলে কষ্ট হয়, তবে ভাবার সময় আর নেই মণীশের কাছে। কারণ, তাঁর এই প্রয়াস শুধু একটা ছাইচাপা আগুনকে উসকে দেওয়া নয়— এ একদল দারিদ্রপীড়িত, অসহায়, সম্বলহীন গ্রামীণ মহিলার জীবনে নতুন আলো ফেরানোর উপায়। চিরুড্ডি গ্রামের চিত্রকলার পুনর্জাগরণ এখন নারী-সশক্তিকরণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মণীশ স্বপ্নদ্রষ্টা। তাই তিনি স্বপ্ন দেখেন— একদিন গড়ে তুলবেন সোহরাই চিত্রকলা কেন্দ্র। ঘরে ঘরে এই চিত্রধারা নিয়ে চলবে চর্চা, গড়ে উঠবে এক বিশাল মিউজিয়াম। খুব সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে পরিচিতির সূত্রে ১,০০০টি টাওয়েলে ছবি আঁকার অনুরোধ এসেছে। এই বাবদ প্রতিটি তোয়ালের জন্য শিল্পীরা ১৫০ টাকা করে পাবেন— এটাও এক বড় স্বীকৃতি।
আজ মণীশ একজন আন্তর্জাতিক শিল্পী হয়ে উঠেছেন এই চিত্রশৈলীর দৌলতে। আমরা চাই, মণীশের সব স্বপ্ন পূর্ণ হোক। সোহরাই চিত্রকলার ধারা হোক আরও বেগবতী, আরও বিস্তৃত। আমাদের শুভকামনা রইল সবার সঙ্গে।
ঋণস্বীকার: দ্য বেটার ইন্ডিয়া, ট্রাইবাল আর্ট অফ ইন্ডিয়া
এতো বিচিত্র বিষয়ের অনন্য কথাকারকে নমস্কার জানাই। অনেক নতুন কথা শোনাচ্ছেন তিনি।
মনীশের জন্য শুভেচ্ছা। নূতন নূতন বার্তার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
গ্রামের কাছে একটি আদিবাসী পাড়ায় দেওয়াল চিত্র দেখেছি ছোটবেলায়। এখন সেখানে কংক্রিটের খাঁচা ।দেওয়ালে ভোট চিত্র।
অসম্ভব বর্ণিল এক আলোচনা। এমন সৌন্দর্যায়ন মন ছুঁয়ে যায়।