পাঁচটি কবিতা

শ্যামশ্রী বিশ্বাস সেনগুপ্ত

 

একশো একাত্তর দিন দেখাসাক্ষাৎ না হওয়ার পর

বলেছিলাম

আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে ঈশ্বর

চোখ বন্ধ করো; আপনি বললেন

সেই থেকে
সম্যকরূপে সরে সরে গেছি সংসার থেকে
নিরক্ষরেখা থেকে কর্কটক্রান্তি
প্রতিটি ডিগ্রিতে দ্বিখণ্ডিত করেছি নিজেকে
সভায়, মজলিশে আমায় চেয়ার টেবিলের উপস্থিতি
পাহাড় পর্বতে খুঁজেছি আগ্নেয় শিলা
চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিতে গায়ে দিয়েছি রেনকোট
আনখশির বদলে গেছি স্নানের পর
দিনে দিনে তাপক্ষয় করেছি অক্ষম প্রার্থনায়

আর বন্ধ চোখের ধারা দিয়ে

অবিরাম আপনি স্পষ্ট হয়ে উঠছেন…

 

ফির তেরে কুচেকো যাতা হ্যায় খয়াল
দিল্‌এ গুমগশতা মগর ইয়াদ আয়া

দাঙ্গাবিধ্বস্ত মনের ছুটোছুটি থেমে গেলে
আবার তোমার পাড়ায় ফিরতে ইচ্ছে করে

আততায়ীর মতো

দরজায় দরজায় আঘাত করি
সন্দেহজনক কুশল বিনিময় করে

বন্ধ হয়ে যায় দরজা

তোমাকে ঢেকে দিয়ে বিশ্বাসঘাতক চাঁদ ওঠে
গাছেরা প্রতিবেশী গাছকে অবিশ্বাস করে
দাঙ্গাবিধ্বস্ত মনের ছুটোছুটি থেমে গেলে

তোমার পুরনো পাড়ায় আবার ফিরতে ইচ্ছে করে

ট্রেনে বাসে করে বাড়ি ফেরে

তোমাকে হারানোর পূর্ব মুহূর্তগুলো

আড্ডা দেয়, সিনেমা দেখে, আপোস করে

সরাতে পারে না

তুমি এই পৃথিবীর কেউ নও বলে

ভুলে থাকতে চায় শহর

অপূর্ণ অভিলাষের গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়ে

দাঙ্গাবিধ্বস্ত মনের ছুটোছুটি থেমে গেলে
বারবার তোমার পুরনো পাড়ায় ফিরতে ইচ্ছে করে।

 

এবার অসুখ সারলে
তোমার পর্দাগুলো সরিয়ে রাখব
দুশ্চিন্তার সরু কোণে
চৈত্রের অল্প গাঢ় রোদ
তোমার ভেজা মাথা বেয়ে মুখে পড়বে
উরলির নিস্তেজ হয়ে যাওয়া ফুল
তোমার হাসি ঘোরাফেরা করবে
আপাত সুখী চোখে
তোমাকে ছুঁয়েও বোঝা যাবে না
তোমার উষ্ণতা; বারান্দায় পড়ে থাকা
ডাকঘরের চিঠি
লুকিয়ে ফেলব সন্তর্পণে
ভোরের সূর্যের তাপ রেখে দেব
তোমার আয়ুতে; অসুখ সারলে
অথচ সারলে, রাখব, পড়বে, করবে, যাবে, ফেলব, দেব
শব্দগুলো, হাঁসফাঁস করে
আমার দূরত্ব আর তোমার অসুখের মধ্যে
তোমার অসুখ সারে না—

 

ইশক্‌ সে তবীয়ৎ নে জিস্তকা মজা পায়া
দর্দকা দওয়া পায়ী দর্দে বেদবা পায়া

যুদ্ধসাজ ছেড়ে ফ্যালো
প্রতিপক্ষ জীবন্মৃত; সঙ্গহীন
রণকৌশল স্থির করার
অবস্থায় নেই
তোমার বিগত পরাজয়
তাকে মেদুর করেছে
তোমার ব্যর্থতার উৎসব
তাকে প্রাণিত করেছে
তোমার সংবৃত আপসে
সে নিতান্ত কুন্ঠিত
আর কখনও গাঁথবে না
সে বেদনভার
চেয়ে দেখো, যুদ্ধের আগেই
অস্ত্র অর্ধনমিত
তুমি তাও যুদ্ধে আহ্বান করলে?
তুমি তাও যুদ্ধে আহ্বান করছ?
তুমি তাও যুদ্ধে আহ্বান করবে?
পরাজিত প্রতিপক্ষকে হারিয়ে
তোমার কি লাভ হল?
তোমার কী লাভ হল বলো?

 

এইখানে এসে বসেছি আজ
বেলা পড়ে এলে
পৃথিবীর পুরনো বাদাম বিক্রেতারা
দু দণ্ড জিরিয়ে নেয় ছায়ায়
আর মুঠিবদ্ধ ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে
আমি এক এক করে খুলে রাখি
শোক-তাপ-অভিমান–দাম্পত্য
মহাকাশচারী মনে হয় নিজেকে
অনন্ত সম্ভাবনার মাঝে
পুড়তে পুড়তে
জ্বলে উঠেছিল কল্পনা চাওলা।
কৈবর্ত্তের মেয়ে গন্ধকালি।

ঠিক দহন নয়; দাহ্য হয়ে ওঠা
অনিবার্য সন্ধ্যা আসে পূর্ব গোলার্ধে
প্রতীকী অন্ধকারে
পথ ফিরতি লোকজন মেপেজুপে নেয়
ক্ষমা-প্রেম-বাৎসল্য-লালসা
আর আমি অলক্ষ্যে ধারণ করি পারলৌকিক বর্ম
জীবন নাট্যমঞ্চ হয়ে ওঠে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

5 Comments

  1. অসাধারণ ! অকিঞ্চিকর জীবনের জাদুর রোজনামচা। বিরহ আর ছাতিমের গন্ধ মাখা

  2. এরপর কথা বলা দায় হয়/এরপর চুপ হতে হয়/দূরে থাকা কী কঠিন সে কেবল বৃক্ষের জানে/অথচ এ দূরে থাকা সুখে থাকার মতোই প্রায়।

Leave a Reply to আকাশ বিশ্বাস Cancel reply