মারাদোনা অথবা একটি টিভির গল্প

শুভ্র মৈত্র

 

লেখক সাংবাদিক, গল্পকার, গদ্যকার

 

 

 

 

বিশ্বকাপ ফাইনালের কপিলদেব হোক বা পরের বছরে চিতাকাঠে শুয়ে থাকা ইন্দিরা— তখন দেখার জন্য ‘যেতে’ হত। গায়ে না মাখা তাচ্ছিল্য আর অনুকম্পা নিয়ে প্রতিবেশী বাড়িতে গিয়ে দাঁড়াতে হত চিত্রহারের ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য। তখন হারুকাকা সময় পেত পাশের বাড়ির মধুজ্যাঠার বাতের ব্যাথার খবর নেওয়ার। বিকেলে তখন জানালা দিয়ে ভেসে আসত, সাথে ‘বিশ্ব সাথে যোগে যেথায়…’। নতুন ক্লাসে উঠে পুরনো বই কিনতে হত। পাড়ার পলিদিরা তখন বিকেলে হাঁটত কোনও গন্তব্য ছাড়া, চিঠি পেত শ্যামলদার। মুখার্জিবাড়ির মেয়ের বিয়েতে পাড়ার ছেলেরাই পরিবেশন করত। মফঃস্বল শহরে খবরের কাগজ আসত বিকেলবেলা। সে কাগজে প্রথম পাতায় ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’ আর ‘আহ্বান নতুন একটি সন্দেশ’-এ আগ্রহ ছিল না কিশোরের, সে দেখত খেলার পাতা। সেখানে তখন সুব্রত-মনোরঞ্জন, টেস্ট ক্রিকেটের নির্জীব ড্রয়ের মাঝে গাভাসকারের রেকর্ড আর রমেশ কৃষ্ণন-বিজয় অমৃতরাজ লড়ে হারলেন অথবা অঘটন ঘটালেন।

স্থিতিজাড্য মেনেই তখন দেখা যাচ্ছে ইতিউতি ছাদের আলসেতে অ্যান্টেনা। না, হুড়মুড়িয়ে নয়, ধীরে। আপট্রন, কোনার্ক, সোনোডাইন, কেলট্রন— সব বিজাতীয় শব্দগুলি ঢুকে পড়ছিল মফঃস্বলের শব্দকোষে। তখন টিভি গরম হওয়ার সময়, তখন ছাদে গিয়ে অ্যান্টেনা ঠিক করার সময়। আর টিভিতে রঙ্গোলি দেখার জন্য ভিড়। রায়বাড়িতে রঙিন টিভি এসেছে শুনে কাজলদা বিশেষজ্ঞের মতামত দিল, ‘ক্রিকেটটা যাই বল, সাদা কালোতেই ভালো লাগে।’ তখন ক্রিকেট মানে সাদা পোশাক আর লাল বল। আর কী জানি কোন কারণে পর্দায় হঠাৎ করে ‘সরি ফর ইন্টাররাপশন’।

টিভি যে রাতেও দেখা যায়, মানে নুক্কর, বুনিয়াদ-এর পরেও, তা জানার জন্যই তো এল ছিয়াশি। সেই ছিয়াশি— টিভি আর বিশ্বকাপের যুগলবন্দিতে রাতের মালকোষ। বাবিকাকু, কিশোরমামা, সন্তোষজেঠু— অবলীলায় টিভির দখল নিয়ে নিল। এখন অধিকার জন্মেছে। হাফটাইমে চা লাগবে, বৌদিকে বলা যায়? টিভির ঘরটা তো ছেড়েই দিয়েছে। মার গুলি। বিড়ির প্যাকেট তো সঙ্গে আছে। ‘উফফ, এই ব্যাকপাস! এক্ষুনি হয়েছিল’— আরে এ কি চিন্ময়ের ব্যাকপাস নাকি?… নয় নম্বরটাকে দ্যাখ, শালা কী কাটাচ্ছে!… আরে পাস দে পাস দে। ম্যান আছে পিছনে… এই শালা, এতক্ষন তো ঘুমোচ্ছিলি? এখন উঠেই লেকচার?

সবজি নিয়ে বাজারে যাওয়ার আগে বাপি সকালে মাঠে যায়। ইনসাইড, আউটসাইড ডজ করে পৌঁছে যায় গোলের কাছে। তারপর কিছুতেই আর শটটা করতে পারে না। ধ্যুস, ও কি গোল করতে পারে? পাস করে দেয়। টিভি তখন দেখাচ্ছে এক বেঁটে প্লেয়ারকে। থামের মতো থাই। বল নিয়ে এগোচ্ছে, কাটাচ্ছে, আবার কাটাচ্ছে। সামনে প্লেয়ার, ইনসাইড করে দৌড়াচ্ছে। আবার একজন। কিছুতেই এগোতে দেবে না। এবার ড্রিবল, প্রায় পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। দৌড়চ্ছে ছেলেটা। সাদা কালো চেক গেঞ্জি, কোনও রং ছিল জার্সির? টিভিতে তো সব সাদা-কালো! গোলপোস্টের কাছে পৌঁছে গেছে, বাপি চিৎকার করে— ‘পাস, পাস…!’ না, কিছুতেই বল ছাড়বে না ও, গোলকিপারকেও কাটাবে, তারপর— গো ও ও ল। মাঝরাতে শহর শাসনের ভার উঠে এল ওদের কাছে। উফফ, এই দশ নম্বর!

তখন রূপকথার সময়, তখন অলৌকিকের সময়। কেম্পেস-লুকের নাম শোনেনি ওরা। জানল এই প্রথম, ভূগোলের ম্যাপে আর্জেন্টিনা নামে এক দেশ আছে। সেখানে স্বপ্নসুন্দরী গ্যাব্রিয়েল সাবাতিনি আছে, স্টেফি গ্রাফের কাছে হারলে আমার খুব কষ্ট হয়। হ্যাঁ সেই আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের পাশেই। ব্রাজিল মানে পেলে। এই শহরে অমল দত্ত দেখিয়েছিল তাঁর কীর্তি। মনে তো নেই, আমার ওসব মনে তো নেই। আমি জানি একটা দশ নম্বর, ট্রফি হাতে দিগ্বিজয়ের হাসি, আমি জানি একটা দশ নম্বর, ট্রফি না পেয়ে কান্না। এই টিভিটায় দেখানো ছোট একটা মানুষ। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। যার গায়ে কাস্ত্রোর রং লাগেনি, পোঁচ পড়েনি নীল নেপলসের। সবজির ভ্যানে ডালির ভিতরে তাকে নিয়ে যাওয়া যায়, বাবার ওষুধের বাক্সে সে থাকে, মালিকের চোখে ফাঁকি দিয়ে ফুটবলে লাথি মারার সময় ওই বাঁ পা-টা শেখায় গোলের মুখে গিয়ে পাস নয়, শট মারতে হবে জোরে, আরও জোরে। শৃঙ্খলা, সে তো বড়লোকেদের ব্যাপার, বড় শহরের ব্যাপার। এই মফঃস্বলে তো হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়াই রীতি। সেই বেঁটে মানুষটার মতো। পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানো। গালিগালাজ, হাতাহাতির পরেও তো পাশের বাড়ির কাকুর জন্য হাসপাতালে রাত কাটাতে হয় এখানে। আবেগ শুধু আবেগেই চলে এই যাপন যা ওই মানুষটার ছোট্ট শরীরটা জুড়ে ছিল।

তারপর, কত কত চন্দ্রভুক অমাবস্যা কেটেছে। সেই সাদা-কালো টিভিটা রান্নার মাসি বন্দনার মাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওখানে আর কেউ কাঁদে কিনা জানা নেই। কেবলের তার অ্যান্টেনার জায়গা নিয়েছে, আর হারিয়ে গেছে টিভির ঘরের সেই জমায়েতটা। এখন রঙিন টিভির পর্দা জুড়ে রোনাল্ডো-মেসি। বল পায়ে দৌড়ায়, ড্রিবল করে, ঝুঁকে পড়ে, আবার ওঠে… কিন্তু সোফায় বসা এক দর্শক চিৎকার করে বলতে পারে না… ম্যান বিহাইন্ড…। পেছনে কেউ নেই। একা। এই পরিমিত শৃঙ্খলায় দিয়েগো?— নাহ, এক্কেবারে মানাইছে না…।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. নস্টালজিয়ার সোনালী সরণী দিয়ে হেঁটে গেল আমাদের কিশোর বয়স…যে ছাদ তখনো ঢাকেনি করোগেটেড শিটে, যে ছাদে গ্রীষ্মের রোদ হু হু করে শুষে নেয় কাকীমার শাড়ি থেকে ওম, শীতের দুপুর মানে উলকাটা, কমলার কোয়া আর যাপন তখনো পোশাকী গয়না পড়েনি…নিরবিচ্ছিন্ন মৌতাতের দীর্ঘস্থায়ী জলসায় রাজপুত্র মাঠে নেমেছেন আকাশী, সাদা ডোরাকাটা, চামড়ার গোলকটিও হাঁ করে দেখে নিত জাদুকরকে…এই অনবদ্য রাংতায় মুড়ে রাখা অতীতকে কি অবলীলায় ফ্ল্যাশব্যাক থেকে নিয়ে এলেন! কি অসাধারণ!

  2. লেখাটা পড়তে পড়তে কত পুরোনো স্মৃতির ভেলায় ভেসে চললাম…

  3. অসাধারণ এক সময়ের অনন্য চালচিত্র… আবেগমাখা…

Leave a Reply to অরিত্র চট্টোপাধ্যায় Cancel reply