অক্সিজেন সঙ্কট: এতদিন কী করছিল কেন্দ্রীয় সরকার?

শমীক ঘোষ

 



লেখক, গদ্যকার

 

 

 

একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম পঞ্চাশ হাজার টাকা!

শেষ অবধি সেটাই কিনে ফেলেছিল দিল্লির ছেলেটা। কী করবে? অক্সিজেন জোগাড় না করতে পারলে কিছুতেই বাঁচবে না তার করোনা আক্রান্ত বাবা। এদিকে হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছে অক্সিজেন শেষ।

বাবাকে বাঁচাতে সকাল থেকে শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে ফেলেছে। বহু চেষ্টার পর কালোবাজার থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারটা কিনে তাই সে দৌড়েছিল হাসপাতালে।

কিন্তু সিলিন্ডারটা খারাপ। সেটা কিছুতেই চালানো যাচ্ছে না। ছেলেটা আবার ছুটেছিল সিলিন্ডার বদলে আনতে। অবশেষে নতুন সিলিন্ডার নিয়ে সে যখন ফিরল, ততক্ষণ তার বাবা মারা গিয়েছেন।

ছেলেটা একা নয়। ওর মতোই অবস্থা অনেকের।

হাঁ করা সারি সারি মুখ। হাঁপরের মতো জোরে ওঠা নামা করছে বুক। শ্বাস নেওয়ার মরিয়া চেষ্টায় মানুষগুলো গিলে নিতে চাইছে একটু বাতাস। পারছে না কিছুতেই।

ওদের বাঁচাতে পারে একমাত্র অক্সিজেন। কিন্তু সেটাই যে নেই কোথাও।

হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছেন নার্স ডাক্তাররা। কেঁদে ফেলছেন খুব দামি বেসরকারি হাসপাতালের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ!

কেউ আবার ছেড়ে দিতে চাইছেন রোগীদেরই!

আর অকাতরে মরে যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ! সামান্য অক্সিজেন না পেয়ে। সুপার পাওয়ার, বিশ্বগুরু হতে চাওয়া, ‘আত্মনির্ভর’ ভারতবর্ষ জুড়ে।

 

কতটা অক্সিজেন দরকার?

এই মাসের ১৫ তারিখে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানায়, দেশে প্রতিদিন ৭১২৭ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদন হয়। এছাড়াও প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন অক্সিজেন মজুত করা আছে। মন্ত্রক আরও জানায়, এই মাসের ১২ এপ্রিল মোট অক্সিজেন উৎপাদনের ৫৪ শতাংশ, অর্থাৎ ৩৮৪২ মেট্রিক টন স্বাস্থ্যখাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

১২ এপ্রিল এই দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১২ লক্ষ। গত কয়েকদিনে এই সংখ্যাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। শুধু ২৫ এপ্রিলেই গোটা দেশে নতুন করে প্রায় তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে।

ফলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ১২ এপ্রিলের তুলনায় স্বাস্থ্যখাতে অক্সিজেনের প্রয়োজনও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।

২১ এপ্রিল দিল্লি হাইকোর্টে কেন্দ্র সরকার জানায়, বর্তমান অবস্থায় স্বাস্থ্যখাতে অক্সিজেনের প্রয়োজন বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮০০০ মেট্রিক টন।

এর আগে ১৮ তারিখে, কেন্দ্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়েছিল, যে ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম, পারমাণবিক, ওষুধশিল্প, অ্যাম্পুল ও ভায়াল উৎপাদনের মতো ৯টা ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনও শিল্পে অক্সিজেন ব্যবহার করা যাবে না। অনলাইন নিউজ পোর্টাল স্ক্রল জানিয়েছে, শুধুমাত্র এই ৯টা ক্ষেত্রেই প্রতিদিন ২৫০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন ব্যবহার করা হয়।

২২ তারিখ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানান, গত কয়েকদিনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার অক্সিজেন সরবরাহ করায় প্রতিদিন অতিরিক্ত ৩৩০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি আরও জানান, করোনা সংক্রমিত ২০টা রাজ্যের দৈনিক ৬৭৮৫ মেট্রিক টন চাহিদার পাশাপাশি প্রতিদিন ৬৮২২ মেট্রিক টন বরাদ্দ করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের মোট ২৯টা রাজ্য ও ৯টা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অক্সিজেনের মোট চাহিদা কতটা তা তিনি স্পষ্ট করেননি।

যদি দিল্লি হাইকোর্টে দেওয়া কেন্দ্রের প্রতিদিন ৮০০০ মেট্রিক টন অক্সিজেনে প্রয়োজন ধরা হয়, তাহলে তা দেশের দৈনিক অক্সিজেন উৎপাদনের থেকে ৮৭০ মেট্রিক টন বেশি।

 

কেন্দ্রের তৎপরতা

গত কয়েকদিনের এই বীভৎস সঙ্কটের পর নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্র সরকার। রবিবার দুপুরেই টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, অক্সিজেনের আকাল কাটাতে দেশের সব জেলাতেই অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা হবে। এই জন্য প্রধানমন্ত্রীর পিএম কেয়ারস তহবিল থেকে সারা দেশে মোট ৫৫১টি পিএসএ (প্রেসার সুইং অ্যাডসর্বশান) মেডিকেল অক্সিজেনের প্ল্যান্ট বসানো হবে।

এছাড়াও, বিদেশ থেকে মোট ৫০ হাজার মেট্রিক টন অক্সিজেন আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি, চিকিৎসায় ব্যবহৃত অক্সিজেনের আকাল সামলাতে এগিয়ে এসেছে এদেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাও।

 

কোথায় অসঙ্গতি

বিশেষজ্ঞদের মতে, এক একটি পিএসএ অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় এক থেকে দেড় মাস। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার জেলায় জেলায় নতুন ৫৫১টা প্ল্যান্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলেও, সেখান থেকে হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করতে প্রায় এক থেকে দেড় সপ্তাহ সময় লাগবে।

বিদেশ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন অক্সিজেন কবের মধ্যে আমদানি করা সম্ভব হবে সেটাও এখনও স্পষ্ট নয়।

 

মেডিকাল অক্সিজেনের সাপ্লাই চেন

সামান্য প্রাথমিক স্তরে বিজ্ঞান পড়া যে কোনও ছাত্রছাত্রীই বলে দেবে যে পৃথিবীর বাতাসে প্রায় ৭৯ শতাংশ নাইট্রোজেন এবং ২১ শতাংশ অক্সিজেন থাকে। পিএসএ অক্সিজেন প্ল্যান্টে এই সাধারণ বাতাসকেই জমিয়ে লিকুইড মেডিকেল অক্সিজেন বা এলএমও উৎপাদন করা হয়। পরে, এই লিকুইড অক্সিজেনকেই আবার গ্যাসে পরিণত করে বিভিন্ন স্বাস্থ্যপরিষেবায় ব্যবহার করা হয়।

আমাদের দেশে এই লিকুইড অক্সিজেনের প্রায় ৮০ শতাংশই উৎপাদন হয় মহারাষ্ট্র, গুজরাত, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে।  দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহারের মতো যে রাজ্যগুলোয় অক্সিজেন সঙ্কট ভয়ঙ্কর মাত্রা নিয়েছে সেখানে অক্সিজেন উৎপাদনের তেমন কোনও ব্যবস্থাই নেই।

এই লিকুইড অক্সিজেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার বিশেষ ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার। সরকারি বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে আমাদের দেশে মাত্র ১১৭২টা তরল অক্সিজেন পরিবহণ করার মতো ট্যাঙ্কার আছে। এই সংখ্যক ট্যাঙ্কার সাধারণ সময়ে দেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যবহৃত অক্সিজেন জোগান দিতে সক্ষম। কিন্তু এই করোনা পরিস্থিতিতে এই সামান্য সংখ্যক ট্যাঙ্কার দিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব নয়।

অক্সিজেন সঙ্কটের পরে কেন্দ্র সরকার এবং বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে এই ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার আমদানি করার ব্যবস্থা করেছে। এই লিকুইড অক্সিজেন বিমানে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পরিস্থিতি সামলাতে কেন্দ্রীয় সরকার এখন বায়ুসেনার বিশেষ বিমানে উত্তর ভারত থেকে পূর্ব ভারতে ফাঁকা ট্যাঙ্কার নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু লিকুইড অক্সিজেন ভরার পর এই ট্যাঙ্কারগুলোকে সড়ক পথেই যেতে হচ্ছে। এছাড়াও ট্রেনে করেও লিকুইড অক্সিজেন পরিবহণের বিশেষ ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্র। কিন্তু এই সবই অক্সিজেন সঙ্কট হওয়ার পরে। আগে থেকে এই বিষয়ে কোনও বিশেষ ব্যবস্থাই করেনি সরকার।

এই লিকুইড অক্সিজেন মজুত রাখার জন্যও দরকার বিশেষ ক্রায়োজেনিক সিলিন্ডার। দেখা যাচ্ছে, যতটা অক্সিজেন দরকার ততটা মজুত করবার মতো নির্দিষ্ট ক্রায়োজেনিক সিলিন্ডারও এই মুহূর্তে এই দেশে নেই।

এই ক্রায়োজেনিক সিলিন্ডার নির্মাতা সংস্থারা অনলাইন নিউজ প্ল্যাটফর্ম স্ক্রলকে জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে দেশে যত সিলিন্ডার প্রয়োজন তার সামান্যই উৎপাদন করার মতো ব্যবস্থা আছে। জানা যাচ্ছে, এই ধরণের সিলিন্ডার উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে এক সময় চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল। কিন্তু জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় সেটা আর শেষ পর্যন্ত করে ওঠা হয়নি।

 

সরকারের আট মাসের ঘুম

গত বছরের ১৪ মার্চ, করোনা পরিস্থিতিকে জাতীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণা করে কেন্দ্র। মাত্র দশ দিনের মধ্যে বিশ্বের কঠোরতম লকডাউন জারি করা হয়।

কিন্তু করোনা চিকিৎসায় প্রচুর অক্সিজেন দরকার একথা জানা স্বত্ত্বেও, প্রথম দফার করোনা সংক্রমণের পর দেশের অক্সিজেন সরবরাহ নিয়ে তেমন কোনও চিন্তাভাবনাই করেনি কেন্দ্রীয় সরকার।

প্রায় আট মাস পরে, গত বছরে ২১ অক্টোবর, বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য মোট ১৬২টা পিএসএ অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর জন্য টেন্ডার ডাকে কেন্দ্র। এর ফলে অক্সিজেন উৎপাদন বাড়ত মাত্র ১৫৪ মেট্রিক টন। দেখা যায় এর জন্য পিএম কেয়ারস তহবিল থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ২০১ কোটি টাকা! সেই পিএম কেয়ার ফান্ড, যেখানে প্রথম চারদিনেই জমা পড়েছিল প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

বলা হয়েছিল, এই সব কটা অক্সিজেন প্ল্যান্টই যত দ্রুত সম্ভব চালু করা হবে।

গত ১৮ এপ্রিল, এই নিয়ে অনলাইন নিউজ পোর্টাল স্ক্রল একটা খবর প্রকাশ করার পর, নড়ে চড়ে বসে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক। টুইট করে জানানো হয়, চালু হয়েছে মাত্র ৩৩টা প্ল্যান্ট। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে প্রস্তাবিত ১৪টার মধ্যে একটাও চালু হয়নি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক আরও জানায়, এপ্রিলের শেষ অবধি মোট ৫৯টা চালু করা সম্ভব হবে। আর মে মাসের শেষে মোট ৮০টা। অর্থাৎ টেন্ডার দেওয়ার প্রায় ৯ মাস পরেও এই অক্সিজেন প্ল্যান্টের অর্ধেকও চালু করা সম্ভব হবে না।

এই বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে স্ক্রলের সাংবাদিকরা আরও জানতে পারেন, বরাত পাওয়া সংস্থার মধ্যে একটি ইতিমধ্যেই ব্ল্যাকলিস্টেড। অন্য সংস্থাগুলোও নামমাত্র কাজ করেছে। বেশিরভাগ কাজই অসম্পূর্ণ।

স্ক্রলের এই প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় রবিবার প্রধানমন্ত্রী যতই জনমত সামলাতে আরও ৫৫১টি প্ল্যান্ট চালু করার কথা বলুন না কেন, এই প্ল্যান্টগুলো আদৌ কবে হবে কেউ জানে না।

প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ঘটা করে প্রচার করা ৫০ লক্ষ টাকা বিমা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের ৫০ কোটি মানুষের টিকাকরণের জন্য প্রথমে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও, এখন কেন্দ্র স্পষ্ট করে দিয়েছে ৪৫ বছরের কমবয়সিদের টিকার কোনও দায় তারা নেবে না।

 

জিনোম সিকোয়েন্সিং-এ অবহেলা

ভাইরাস বারবার মিউটেট করে নতুন স্ট্রেন তৈরি করে। এর মধ্যে কিছু স্ট্রেন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ইতিমধ্যেই ভারতে এই দ্বিতীয় দফার কোভিড সংক্রমণের জন্য ডবল এবং ট্রিপল মিউট্যান্ট ভাইরাসের কথা শোনা যাচ্ছে।

এই কারণেই ভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্সিং করার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার বলে গিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

ইংরাজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস একটা প্রতিবেদনে জানায়, প্রথম ছ মাসে যখন আমেরিকা, ব্রিটেন এবং চিনের মতো দেশগুলো কয়েক হাজার জিনোম সিকোয়েন্সিং এর কাজ করেছিল, তখন ভারতে মেরে কেটে কয়েকশো জিনোম সিকোয়েন্সিং-এর কাজ হয়।

অবশেষে জানুয়ারি মাসে ঘুম ভাঙে সরকারের। দশটা বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এই জন্য একটা বিশেষ কনসরটিয়াম গড়া হয়। এর নাম দেওয়া হয় ইন্ডিয়ান সার্স কোভ-২ জেনোমিক কনসরটিয়াম। এর জন্য বরাদ্দ করা হয় মাত্র ১১৫ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ অবধি এই টাকার জন্য কোনও বাড়তি ব্যবস্থা করেনি কেন্দ্র। উল্টে বায়োটেকনোলজি মন্ত্রককে বলা হয়, তাদের বরাদ্দ থেকে এই টাকার সংস্থান করতে। শেষ অবধি, গত আর্থিক বছরের শেষ দিন, অর্থাৎ ৩১ মার্চ এর জন্য ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে পারে বায়োটেকনোলজি মন্ত্রক। তাদের পক্ষে এর থেকে বেশি টাকা বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি।

এই কনসরটিয়াম দেশের মোট সংক্রমণের পাঁচ শতাংশ জেনোম সিকুয়েন্সিং করতে চায়। কিন্তু বর্তমানে পাঠানো স্যাম্পেলের পরিমাণ মোট সংক্রমণের এক শতাংশও নয়।

অর্থাৎ এই ক্ষেত্রেও নতুন সংক্রমণ আটকাতে, এবং নতুন স্ট্রেন চিহ্নিত করে তার জন্য নির্দিষ্ট সতর্কতা নিতে বিন্দুমাত্র উৎসাহী ছিল না কেন্দ্রীয় সরকার।

 

আত্মনির্ভর ভারতের ফাঁকা গল্প

দেশের মানুষের টিকাকরণ করবে দুই ভারতীয় কোম্পানি— সেরাম ইন্সটিউট অফ ইন্ডিয়া এবং ভারত বায়োটেক। শুধু তাই নয়, বিদেশের মানুষকেও টিকা দিয়ে কোভিড থেকে বাঁচাবে ভারতই। ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের এই গল্পই ফলাও করে প্রচার করে গিয়েছে কেন্দ্র সরকার ও কেন্দ্রীয় শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরা।

প্রধানমন্ত্রীর ‘ভ্যাক্সিন ডিপ্লোমেসি’-এর গল্প জাহির করতে সেই টিকা পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন দেশেও। ফলাও করে সেই কথা প্রচার করা হয়েছে।

অথচ এপ্রিল অবধি শামুকের গতিতে এগিয়েছে দেশের টিকাকরণের কাজ। এই মাসের শুরুতে এসেই সরকার প্রথম বুঝতে পারে দেশে যত টিকা প্রয়োজন তার সিকিভাগও নেই।

গত নভম্বরে দেশজ টিকার প্রচার করতে, ফাইজারের টিকা নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু সরকারের টনক নড়ার পর তড়িঘড়ি বিদেশি টিকাকে ছাড়পত্র দেওয়া হল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আসলে দেশে কত টিকা উৎপাদন করা সম্ভব তা নিয়ে কোনও পরিসংখ্যানই জোগাড় করেনি কেন্দ্র। এমনকি দেশজ কোম্পানিগুলোকে কোনও বাড়তি টাকাও বরাদ্দ করেনি। প্রসঙ্গত বলা চলে, বিল ও মেলিন্ডা গেটস-এর ফাউন্ডেশন প্রায় ২২০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল সেরাম ইন্সটিউটকে।

উৎপাদন বাড়াতে অনুদান তো দূরের কথা, টিকার জন্য আগাম কোনও টাকাও বরাদ্দ করেনি সরকার। দুটো ভারতীয় সংস্থাকেই নিজেদের ঘাড়ে দায় নিয়ে টিকা মজুত করতে হয়েছিল।

এখন দায়ে পড়ে সেরাম ইন্সটিটিউটকে ৩ হাজার কোটি এবং ভারত বায়োটেককে দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার।

অর্থাৎ টিকার সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কোনও চিন্তাভাবনাই আগে থেকে করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। আসলে ‘গোষ্ঠী অনাক্রমণ’-এর তত্ত্বের ওপরে ভর করেই ফাঁকা গল্প দিয়ে আসছিল সরকার। সুইডেন এবং ব্রিটেনের মতো দেশে ‘গোষ্ঠী অনাক্রমণ’ তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ হওয়ার পরেও তাদের টনক নড়েনি।

লকডাউন তোলার পরেও, কোভিড নিয়ে আলাদা করে মানুষকে সতর্ক করেনি তারা। বরং সরকারের প্রথম সারির মুখেরা মাস্ক খুলে ভোটের বাজারে তুমুল ভিড় জনসভা করার দিকেই মন দিয়েছিলেন। ধর্মীয় আবেগ বজায় রাখতে কোভিড বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কুম্ভমেলা আয়োজন করতেও তাঁদের দ্বিধা হয়নি।

কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ সামলানোর কোনও কাজই তাঁরা করেননি। দিল্লির সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্টের জন্য যে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে পারে, আমদাবাদ-মুম্বাই বুলেট ট্রেন প্রকল্পের জন্য এক লক্ষ কোটি টাকার প্রজেক্টের কথা ভাবে, কোভিড অতিমারি নিয়ে সেই সরকার বিন্দুমাত্র ভাবেনি।

না হয়েছে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি, না হয়েছে দেশে কোভিডে দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ রোখার কোনও সঠিক ব্লু-প্রিন্ট। আর তার ফল ভুগতে হচ্ছে দেশের মানুষকে।

নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to Swapan Bhattacharyya Cancel reply