ভাল থাকা কোনও বিশেষ মানসিক অবস্থা নয়, একটা প্রক্রিয়া

অনন্যা রায়

 



মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী, ‘ওয়েলবিইং অ্যান্ড হ্যাপিনেস ফর ইউ’-এর (WHY) সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

 

The good life is a process, not a state of being. It is a direction, not a destination…

যে শিরোনাম দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছে, সেটি, বলা বাহুল্য, আমার কথা নয়— বিখ্যাত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্স-এর। কেন রজার্স-এর এই বিশেষ উদ্ধৃতিটি দিয়েই এ লেখা শুরু করতে হল, সে সম্পর্কে একটু পরে আসছি। তার আগে, মানসিক স্বাস্থ্য বলতে ঠিক কী বোঝায়, সেটা একটু পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার।

‘মানসিক স্বাস্থ্য’ শব্দবন্ধটি আজকের দিনে আর অপরিচিত নয়। মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নিয়ে খোলামেলাভাবে আলোচনা হচ্ছে, চেষ্টা চলছে মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি করার। সচেতনতা অবশ্যই বেড়েছে, এবং তা থেকে হয়তো বা সহমর্মিতার একটা জায়গাও তৈরি হচ্ছে।

মানসিক স্বাস্থ্য বা সুস্থতা সংক্রান্ত যে আলোচনা, তার দুটো দিক রয়েছে। এক, যেসব মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের কীভাবে সাহায্য করা যেতে পারে; আর দুই, এই সমস্যার জায়গাটা যাতে তৈরি না হয় তার জন্য আমরা কী করতে পারি। আমি মূলত এই দ্বিতীয় দিকটা নিয়েই আমার অভিজ্ঞতার নিরিখে দু-চার কথা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

জীবনে উন্নতি আমাদের প্রত্যেকের কাম্য— আজ আমার কাছে যা রয়েছে কাল তার চেয়ে আরও বেশি পেতে চাই। এই আরও বেশিটা অনেক কিছুই হতে পারে— মোটা মাইনের চাকরি, দামি গাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি। আমাদের সন্তানের ক্ষেত্রেও বড় হওয়ার অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে তার পড়াশোনা ও কেরিয়ার-সংক্রান্ত চিন্তা। উন্নতির ভাবনা তার মনেও জায়গা করে নেয় একেবারে ছোটবেলা থেকেই। এই ভাবনার বীজই পরবর্তীকালে ডালপালা ছড়িয়ে বিশাল আকার ধারণ করে।

মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ক্ষেত্রেও কি আমাদের চিন্তাভাবনা একইরকম? মানসিক স্বাস্থ্য যাতে আরও সুন্দর হয়, আরও পরিপূর্ণ হয়, আমরা কি সর্বতোভাবে সে চেষ্টাও করে থাকি? আমরা কি মাথায় রাখি যে, এই চেষ্টা আমাদের নিজেদের ভাল থাকতে ও আশেপাশের মানুষদের ভাল রাখতে সাহায্য করবে? একই কথা নিজের সন্তানের প্রতিও প্রযোজ্য— তার বা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়াও কাম্য। ভাল থাকার চেষ্টা একটা অভ্যাস, আর তা সারা জীবনের। জীবনের কিছুটা সময় কাউন্সেলিংয়ের মধ্য দিয়ে গিয়ে নিজেকে আবার চিনেছি, অনেক চিন্তাভাবনার জট কেটেছে, মনে জমে থাকা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি এবং কীভাবে ভাল থাকা যায় তার রাস্তা খুঁজে পেয়েছি।

 

আপাতদৃষ্টিতে নিখুঁত ছকে বাঁধা, সাজানো জীবন ছিল আমার। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। নামকরা সংস্থায় ভাল চাকরি করতাম। বিবাহিত জীবনও নির্ঝঞ্ঝাট। কিন্তু কাজের জগতে একটা পরিপূর্ণতার অভাব বোধ করতাম। অডিটের কাজ ভাল লাগত না, কিন্তু কী কাজ ভাল লাগবে সেটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। মাঝে-মাঝেই চাকরি ছাড়ার ইচ্ছে মাথা চাড়া দিত। যদিও আমি তাতে নিজেকে প্রশ্রয় দিতাম না মোটেই।

কয়েকবছর পর ধরা পড়ল ক্যান্সার। তখন আমি সদ্যোজাত সন্তানের মা। সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল সে সময়ে। একটা ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে যায় সার্জারির সময়। জীবনের প্রথম ভালবাসা, গান— মনে হতে লাগল অতীতের স্বপ্ন। গলার স্বর ফ্যাসফেসে— প্রায় শোনাই যেত না। অফিস, ডাক্তারের চেম্বার আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই পুরো সময়টা চলে যেত, মেয়ের সময় কাটত আয়ার কাছে। চাকরি ছাড়ার ইচ্ছেটা দিন-দিন প্রবল হয়ে উঠছিল। প্রায় বছরতিনেক এভাবে কাটার পর দুম করে একদিন ছেড়েই দিলাম চাকরিটা। ইচ্ছে ছিল, কিছুদিন একটু নিজেকে সময় দেব, সবদিক সামলে আবার না-হয় শুরু করা যাবে। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না— হয়তো নিজের পেশার প্রতি ভালবাসার অভাবের দরুণ চাকরির চেষ্টায় উৎসাহ, আনন্দ বা তাগিদ কোনওটাই ছিল না।

চাকরি ছেড়েও যে ভাল ছিলাম, তা নয়। একটা অপরাধবোধ কাজ করত সর্বক্ষণ, আর তা বহুগুণ বাড়িয়ে দিত আশেপাশের মানুষজনের মন্তব্য, উপদেশ, কখনও বা বক্রোক্তি। সময়ের সদ্ব্যবহার করতে আর মন খারাপ, ও অভিমানের সঙ্গে যুঝতে এই সময়ে বাড়ি থেকেই বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছি— কিছু নিজের পেশা-সংক্রান্ত, কিছু একেবারেই অন্যরকম। নতুন নতুন জিনিস শিখেছি, শিখিয়েছি। ভয়েস থেরাপি এবং নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে গলার স্বর প্রায় ৭০ শতাংশ ফিরে পেয়েছি। আবার গান শেখা ও শেখানো শুরু করেছি। কিন্তু অপরাধবোধ পিছু ছাড়েনি। লোকের কথা, বিশেষত কাছের মানুষজনের কথা সাংঘাতিক আঘাত করত, কষ্ট দিত। ভেতরে প্রচুর রাগ, অভিমান জমা হচ্ছিল। মানসিক যন্ত্রণায় কেটেছে বেশ কয়েকটা বছর। একেবারেই ভাল ছিলাম না। এর মাঝেও প্রতি মুহূর্তে খুঁজেছি, ঠিক কী চাই।

কিছু বছর এভাবে কাটার পর ঠিক করলাম, সাহায্য নেব। আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্স এর Person Centred Counseling বা Client Centred Counseling হয়েছিল আমার। কাউন্সেলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে সে সংক্রান্ত পড়াশোনাও শুরু করেছিলাম, যার ফলে আমার থেরাপি কম সময়ে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়েছিল। পড়াশোনা, থেরাপি ও পরবর্তীকালে কাজের মধ্য দিয়ে মনে হয়েছে, সমস্যাগুলো জন্ম নেয় কীভাবে সেটা জেনে তা নিয়ে কাজ করা খুব প্রয়োজন।

 

প্রত্যেক মানুষের, সে শিশুই হোক বা প্রাপ্তবয়স্ক, ভালোবাসার প্রয়োজন। রজার্স এই প্রয়োজনকে বলেছেন ‘need for positive regard from others’। একটি শিশু জন্মানোর পর কয়েক মাস বা বছরখানেক পর্যন্ত নিঃশর্ত ভালোবাসা পায় (unconditional positive regard)। সে হাসুক, কাঁদুক বা বিছানা নোংরা করুক— সবেতেই তার কাছের মানুষরা আপ্লুত। বছরখানেক পর থেকে সে ভালবাসা আর শর্তহীন থাকে না। সে শুনতে শুরু করে “খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি, তুমি গুড বয় না”— অর্থাৎ তাড়াতাড়ি না খেলে সে আর গুড বয় থাকবে না। কিংবা, “ইশ, গুড গার্লরা কখনও এরকম বায়না করে না”— অর্থাৎ বায়না করলে আর গুড গার্ল থাকবে না।

প্রতি ক্ষেত্রেই শিশুটিকে বোঝানো হয় তার কাছে কী ধরনের ব্যবহার, আবেগ ও কাজ আশা করা হচ্ছে। এর ফলে কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ, কোন কাজ বা ব্যবহার সমর্থন পাবে আর কোনটা পাবে না— এই ফারাকটা শিশুটি বুঝতে শেখে ধীরে-ধীরে। সে বোঝে তার প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে। অন্যের কাছে ভালবাসা পাওয়া, মূল্য পাওয়া, গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রয়োজন মেটাতে শর্তগুলো মানতে শুরু করে সে। শর্ত অনুযায়ী চলতে গেলে দমন করতে হয় নিজের অনুভূতি, ইচ্ছে, আবেগ। একটা ছোট উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে।

একটি নরম মনের ছেলের কথা ধরা যাক। কষ্ট হলেই সে কেঁদে ফেলে। আর কাঁদলেই সে শোনে, “ছেলেদের কাঁদতে নেই, তুমি কি দুর্বল?” সে তখন নিজেকে বোঝাতে শুরু করে— “আমি ছেলে, তাই আমার কান্না পাওয়া মানে আমি দুর্বল” এবং “আমার বাবা মা চায় না আমি দুর্বল হই”। এভাবেই ‘আদর্শ সন্তান’ হতে গেলে কেমন হওয়া দরকার সেই শর্ত আরোপিত হতে থাকে তার ওপর। এভাবে একটা সময় আসে, যখন সে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, “আমার কষ্ট হয় না, কান্না পায় না”। ক্রমে এই ভাবনাটা তার নিজের সত্তার একটা অংশ হয়ে ওঠে (বলে রাখা দরকার, এখানে সত্তার অর্থ ‘আমার কাছে আমি কী বা কেমন— Rogers-এর concept of self)।

যার নিজস্ব সত্তায় যত বেশি অন্যের মূল্যায়নের দ্বারা তৈরি বৈশিষ্ট্য থাকবে, পরবর্তীকালে তার ভাল থাকা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি। সহজ করে বলতে গেলে, আমার আসল ‘আমি’ থেকে যত দূরে সরে যাব, ততই আমার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা।

অন্যদিকে, শিশু যদি তার কাছের মানুষের থেকে শর্তহীন সম্মান ও ভালবাসা পায়, তবে সে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করবে এবং অবিকৃতভাবে গ্রহণ করতে পারবে। নিজের সত্তার সঙ্গে তার sensory ও visceral experiences যত বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, তার মানসিক গঠন হবে ততই সুসংহত। নিজের সবটা নিয়ে সে নিজেকে গ্রহণ করতে পারবে; তার নিজের মূল্যায়ন সে নিজেই করতে সক্ষম হবে। এর ফলে সে অন্যের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখবে না। নিজের সঠিক মূল্যায়ন সে নিজেই করবে এবং লোকে কী বলবে বা ভাববে সেটা তাকে বিচলিত করবে না। অতএব ভাল থাকার পথে প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে অভিভাবকদের। নিঃশর্ত ভালবাসা মানে কিন্তু এটা নয় যে, শিশুটি যা ইচ্ছে তাই করবে বা তাকে কিছু শেখানো হবে না। শেখানোর সঙ্গে-সঙ্গে তার সব আবেগ, অনুভূতি ও ইচ্ছে প্রকাশের জায়গা তাকে দিতে হবে।

সন্তানদের মধ্যে ঝগড়া থামাতে, ধরা যাক, মা বললেন, “আমি বুঝতে পারছি, ভাই তোমার খেলনা ভেঙে দিয়েছে বলে তোমার ভীষণ রাগ হয়েছে। তাই তুমি ভাইকে মেরেছ। ভাইকে মেরেছ বলে ব্যথা পেয়ে ভাই কাঁদছে। কিন্তু আমি এই কাজটা পছন্দ করি না।” একটু খুঁটিয়ে মায়ের কথাটা লক্ষ করুন। সন্তান বুঝতে পারল যে, তার যে রাগ হয়েছে সেটা মা বুঝতে পেরেছেন। আমরা যখন বুঝতে পারি যে, অন্যরা আমাদের বুঝতে পারছেন, তখন কতটা আরাম লাগে, কতটা নিশ্চিন্ত লাগে, সে অভিজ্ঞতা আমাদের প্রত্যেকেরই আছে। এভাবেই শিশুটির অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি অবিকৃতভাবে তার সত্তায় জায়গা পেতে পারে। এতে তার ভাবনা, অনুভূতি এবং ব্যবহারে সামঞ্জস্য গড়ে ওঠে, এবং সে চট করে কোনও মানসিক অস্থিরতা বা টানাপোড়েনের শিকার হওয়াকে প্রতিরোধ করতে পারে।

পরিবর্তে, মা যদি তাকে প্রচণ্ড বকাবকি করতেন এবং বলতেন যে, সে ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছে, ছোট ভাইকে কখনও মারা উচিত নয়, নিজের ব্যবহারে তার লজ্জা পাওয়া উচিত ইত্যাদি, তবে তার সত্তার অংশ হয়ে দাঁড়াবে ‘ছোট ভাইয়ের ওপর রাগ করতে নেই, আমার রাগ হয় না’।

এর ফলে যেটা হবে, ভবিষ্যতে তার যখনই রাগ হবে সেই অনুভূতিটাকে সে বিকৃতভাবে চিহ্নিত করবে (অথবা করবেই না) যাতে তার তৈরি সত্তার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে না-যায়— “আমি ভাইকে বকলাম ভাইয়ের ভালর জন্য, আমি রাগ করিনি কিন্তু ভাইকে ঠিক-ভুল আমাকেই শেখাতে হবে।” তার রাগের অনুভূতিটা স্বীকৃতি পেল না, কারণ সে তার সত্তার অংশ থেকে তা বাদ দিয়ে দিয়েছে। এখন, সেটা সঠিকভাবে চিহ্নিত করলে তার সত্তার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, আর আমরা যে কোনও প্রকারে নিজের সত্তাকে রক্ষা করতে চাই। এ ধরনের অভিজ্ঞতা (যা তার সত্তার অংশ নয়) যত বেশি হতে থাকবে, তার সত্তা ততই ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগবে, যার ফলে একটা সময়ের পর তার মানসিক স্বাস্থ্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রজার্স-এর তত্ত্ব বলে, প্রত্যেকের একটা সহজাত প্রবণতা থাকে নিজের মধ্যে থাকা সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করার ও তার বিকাশ ঘটানোর। একটা গাছকে যদি জানালা থেকে একটু দূরেও রাখা হয়, সে সহজাতভাবেই তার ডালপালা নিয়ে আলোর দিকেই ঝুঁকবে। আমাদের ক্ষেত্রেও এ প্রবণতা নিরন্তর চলতে থাকে, যদি না প্রতিকূল পরিবেশ বা পরিস্থিতি আমাদের কোনওভাবে বাধা দেয়। আমাদের চারপাশের পরিবেশ, মানুষজন, তাঁদের আচরণ, কাজকর্ম— এইসবেরই অবদান থাকে আমাদের এই বিকাশের পথে। এই অনুকূল পরিস্থিতিতে অবশ্যই থাকতে হবে শর্তহীন ভালবাসা, সম্মান ও সহমর্মিতা। এরকম পরিবেশে বড় হলে, যা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে আমরা তার দিকে ঠিকই এগিয়ে যেতে পারব।

অভিভাবকদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তাঁরা তাঁদের সন্তানের জন্য কী চান। অনেকেই বলবেন, আমরা চাই ও ভাল থাকুক, আনন্দে থাকুক। অভিভাবক হিসেবে আমরা নিঃসন্দেহে তা-ই চাই। কিন্তু সেই চাওয়ার সঙ্গে নিজেদেরও কিছু চাহিদা কি লুকিয়ে থাকে না? এই কথাটা আমায় ভাবাতে শুরু করে আমার কাউন্সেলিংয়ের সময়। ধরা যাক আমার পড়শিদের মধ্যে একজন হয়তো সিভিল সার্ভিসেস-এ চান্স পেয়ে গেল, আর অন্য একজন হয়তো এঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বিদেশে চাকরি করছে। আমিও সারাজীবন চাকরি করেছি, অথচ আমার মেয়ে বলল, “আর পড়ব না, চাকরিও করব না, বিয়ে করে স্রেফ সংসার করব।” সে হয়তো সত্যিই সেটা করলেই আনন্দে থাকবে। কিন্তু, মা হয়ে আমি কি পারব তার সিদ্ধান্তটাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে? আমরা যারা এটা পারি না, তাদের এই না-পারার অন্যতম কারণ সমাজ। সমাজের তোয়াক্কা না-করে সন্তানের সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়ানো কেন সম্ভব হয়ে ওঠে না? কারণ, বড় হওয়ার সময়ে আমরাও শর্তহীন ভালবাসা পাইনি। অন্যের চোখে আমি কী, তা দিয়েই নিজের মূল্যায়ন করতে শিখেছি। নিজেকে শর্তহীনভাবে গ্রহণ করতে না-পারলে, ভালবাসতে না-পারলে নিজের সন্তানকে বা অন্য কাউকে সেভাবে ভালবাসা সম্ভব নয়।

আমরা ভাবি, সন্তানের কিসে ভাল হবে, আমরাই যেন সবচেয়ে ভাল বুঝি। তাদের ভাল করতে গিয়ে তার কী ভাল লাগবে বা খারাপ লাগবে, সেটাও আমরা ঠিক করে দিই। একজন মানুষ কিসে আনন্দ পাবে সেটা বোধহয় সে নিজে ছাড়া আর কারও পক্ষে ঠিক করে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা তার চোখ বা মন দিয়ে তার জায়গাটা দেখি না, দেখি আমার চোখ দিয়ে, আমার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাই আমি যাতে আনন্দ পাই, ভাবি তারও তাতেই আনন্দ পাওয়া উচিত।

আমরা যদি অভিভাবক হিসেবে নিজের সন্তানকে একটা সুস্থ, নিরাপদ পরিবেশ দিতে পারি, যেখানে সে ও তার সমস্ত অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছে সম্মান পাবে, গ্রহণীয় হবে। কোন অভিজ্ঞতা ভালো আর কোনটা ভালো নয় তার সঠিক মূল্যায়ন করা তবেই তার পক্ষে সম্ভব হয়ে। এই মূল্যায়নকে ভিত্তি করে এগিয়ে গেলে তার মধ্যে যা যা সম্ভাবনা রয়েছে তার সদ্ব্যবহার হবে ও তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে। এতে তার মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে যা ভাল থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

নিজের ভাল থাকার রসদ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। তার জন্য— কী চাই, কীভাবে চাই, এই চাহিদা কি আমার নিজের— এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা দরকার। এই যেমন আমি খুঁজেছিলাম অর্থপূর্ণ কোনও কাজ। সবসময় ভাল লাগা ও পেশা এক না-ও হতে পারে বিভিন্ন কারণে। সেক্ষেত্রে, আমার ভাল থাকা কীভাবে বজায় রাখব; দুটো কাজই করা সম্ভব কি না; আর কোনও বিকল্প আছে কি না, সেইসব খুঁজে দেখা যেতে পারে। এই অন্বেষণ সকলের কাছে সহজ কাজ না-ই হতে পারে। সাহায্য নিয়ে নতুন জীবনের খোঁজ পেতে পারি আমরা; নতুন ভাবে বাঁচতে পারি; ভাল থাকতে পারি।

 

বিশেষ সচেতনা: মানসিক সমস্যা বা অসুস্থতা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যা হয়তো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমাদের হাতে যেটুকু আমাদের হাতে রয়েছে সেইটুকু সম্পর্কে যদি আমাদের সচেতনতা থাকে, আর আমরা তা চর্চা করতে পারি, তা হলে সেই অংশটুকু এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4647 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

Leave a Reply to Mrinmoy Pratihar Cancel reply