রাগন্তী কুয়া

রাগন্তী কুয়া | প্রতিভা সরকার

প্রতিভা সরকার

 

ট্যাপ কল চালু হওয়ার পর এই আধাশহরের সব কুয়ো ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে, শুধু এইটি ছাড়া। সন্তুদা চারপাশের এতটা জায়গাশুদ্ধ এটা কী ভেবে রেখে দিয়েছে শিবা জানে না, কিন্তু কুয়োটার দিকে তাকালে তার বেদম ভাল লাগে। কালো টলটলে জল ভর্তি কুয়োটার নিখুঁত বৃত্তটা শান্ত হয়েই থাকে বেশিরভাগ সময়। দিনের বেলা আকাশের ছায়া পড়ে। মেঘের টুকরো অলস ভঙ্গিতে উড়ছে, তার আড়ালে এখুনি যে পাখিটা উড়ে গেল সেটা বাজ না পায়রা, তাও বলে দেওয়া যেতে পারে, এত স্পষ্ট ছায়া!

সেসব থাক, এ কুয়োর অলৌকিক ক্ষমতার কথা এখানে সবাই জানে। নামটা খুব অদ্ভুত, হতে পারে রাবণ কা কুঁয়া থেকে এর নাম রাগন্তী কুয়া। ভেতরের জল দেখতে ভারী শান্ত, কিন্তু খেলে নাকি মানুষ হঠাৎ রাগে পাগল হয়ে যায়। কেউ মুখ লাল করে চেঁচেমেচি করছে, অন্য পার্টির ছেলেকে চেম্বার নিয়ে তাড়া করছে, কারও পেটে ছুরি ঢোকাচ্ছে, নিদেনপক্ষে বৌ পেটালেও সবাই ফিসফাস করে, নিশ্চয়ই ব্যাটা চুপিচুপি রাগন্তী কুয়োর জল খেয়েছে।

কিন্তু ঘটনা হল এই যে, ও কুয়োর কাছ ঘেঁষে না কেউ। জল খেলে ব্রহ্মতালু গরম হয়ে ধোঁয়া বেরোতে থাকে বা মানুষের মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য শ্বদন্ত দুটি হঠাৎ করে লম্বা হয়ে যায়, এই সব চালু গল্পকথা শুনে ভয়ে গুণ্ডা-বদমাসরাও এদিকে ঘেঁষে না। যতই হোক, নিজের চেহারা খারাপ করতে কেই বা চায়। শিবাই যা দৌড়ে আসে মন-টন খারাপ হলে। এমনিও আসে, প্রায় রোজই আসে। কুয়োর মধ্যেকার ওই গোল আকাশের টুকরো দেখতে তার খুব ভাল লাগে। মনে হয় কুয়োটার ভেতর আর একটা বসতি আছে। তাতে এত জটিলতা নেই, সবকিছু জলের মতো ঠান্ডা, শান্ত, সহজ। সন্তুদা, রানিবৌদির মতো লোকেদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। সেখানে এরকম বেমক্কা গরম পড়ে না, শীতলপাটি বিছিয়ে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করে আছে ওপাশে, সে তার না-দেখা মা না অন্য কেউ, শিবা জানে না।

আরও একটা ব্যাপার হল, খুব ভারী গ্রীষ্মে রাগন্তী কুয়োর জল একেবারে তলায় নেমে যায় বটে, কিন্তু অন্য সময়ে তার ভেতর বেশ জল থাকে। মাঝখানেরও অনেক ওপরে। নাকি কোন হারিয়ে যাওয়া অন্তঃসলিলার সঙ্গে যোগ আছে এই কুয়োর। সব মিলিয়ে রাগন্তী একটা রহস্যময় জ্যান্ত কুয়ো, যে পেটের ভেতর একটা অন্য জগৎ লুকিয়ে রাখে আর অনবরত শিবাকে কিছু বলতে চায়। সেও কুয়োটাকে অনেক কথা বলে। তবে দুপক্ষই বলে মনে মনে।

কাকেই বা মনের কথা বলবে, এই জঙ্গলের মধ্যে গাছপালা ঘেরা রাগন্তী কুয়ো এবং কিছু পশুপাখি ছাড়া শিবার আর কেউ নেই। এদের সঙ্গেই কথা বলে শিবা। ফাটা সিমেন্টের উঁচু কানা ধরে সে ঝুঁকে পড়ে জলের দিকে, তারপর শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেঁচায়, সন্তুদা, তোমায় আমি দেখে নেব, কিংবা রানিবৌদি, তুমি মরো, মরো, মরো। মরো-র শেষ ‘ও’ ধ্বনিটা কুয়োর কানা ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠতে থাকে, ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ফিকিরে পড়ে সেটাকে নতুন বাচ্চার কান্নার মতো শোনায়, ওঁওঁওঁওঁওঁ, ওঁঙা ওঁঙা। নিজেই তাজ্জব বনে যায় শিবা। সে রেগে কিছু বললেও তা কান্নার মতো শোনাবে! এই অন্নদাসের জীবনে ঘেন্না ধরে যায় তার! ভাবে একদিন রাগন্তী কুয়োর জল খেয়ে দেখবে অভিশাপ দিলে তা সিংহগর্জনের মতো শোনায় কিনা। সাহসে কুলোয় না।

তবে কিছুদিন যাবত একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটছে। লোকালয় থেকে দূরে জঙ্গলে ঘেরা এই ভাঙা প্রাচীন কুয়োর আশেপাশে যত পশুপাখি তাদের অনেকেরই কথা, চালচলন, সবই বুঝতে পারছে শিবা। এদেরকে সে লক্ষ করে ভাল করে, কারণ রোজ রোজ তার হাতে কোনও কাজ থাকে না। যেদিন সন্তুদা তাকে প্যাকেট বা বাক্স দিয়ে সালানপুর, রূপনারায়ণপুর, দোমোহনি বা আরও দূরে দূরে ডেলিভারি দিতে পাঠায় সেদিন সেদিনই শিবার ব্যস্ততা, সেদিন সেদিনই তার হাতখরচের ব্যবস্থা। দুবেলা খায় আর বিনেপয়সায় থাকে বলে সন্তুদা তাকে চাকরের মতো দেখে, কারণে অকারণে বেদম গালমন্দ করে, মারতে আসে, আজকাল রানিবৌদিও ইন্ধন জোগায়। তবে এটা ঠিক, ভাতের ঋণ শোধ করতে পারা যায় না বলেই হয়তবা সন্তুদা ভেবে নিল শিবা আমরণ কৃতজ্ঞ থাকবে। তাই তাকে ধীরে ধীরে নিজের ডানহাত করে তুলল, এখন কাজ হয়ে গেলে প্রত্যেকবারই কিছুমিছু দেয়, আর এ কথা মানতেই হবে যে শিবার মতো বিশ্বাস সন্তু নিজের বৌ রানিকেও করে না।

রানির কথা মনে হতেই শিবা থ্যাপ করে একদলা থুথু ছুড়ে দেয় কাঁটাঝোপের দিকে, শালি— রানি! রানি না বাঁদি! সেই মুহূর্তে ডোরাকাটা কাঠবেড়ালিটা কিচকিচ করে তাকে বকে ওঠে, যাওচ কেচন তুমি, ডাকচলেই যেচতে হবেচ?

ডাকলেই যেতে হবে কিনা, এ বড় কঠিন প্রশ্ন! শিবার মাথা তাই বুকের ওপর ঝুলে পড়ে, তার কাছে এর কোনও উত্তর নেই।

এই কাঠবেড়ালিরা বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাধীনচেতা আর স্নেহময় প্রাণী। কোনওদিন শিবা ক্লান্তি আর ঘেন্নায় কুয়োতলার নিঝঝুমে ঘুমিয়ে পড়লে ওরা তার মাথার কাছে এসে বসে থাকে। নিজেদের মনে খেলা করে। যেন পাহারা দেয়। একটু বেচাল দেখলেই জাগিয়ে দেবে। একজন কবে যেন ল্যাজ দিয়ে তার নাকে সুড়সুড়ি দিল, শিবা লাফিয়ে উঠে দেখে সন্ধে হয়ে গেছে, গাঢ় লাল আলোয় কিছু শিমূলতুলো বেহায়া মেয়ের ভাসিয়ে দেওয়া ওড়নার মতো তখনও উড়ছে বটে, কিন্তু লজ্জাবতী ফুলেরা সারাদিন বুক চিতিয়ে থাকার পরে একেবারেই চুপসে গেছে। শিবা উঠে বসতেই পাশের ঝোপটা নড়ে উঠল, এই তল্লাটে গর্ত খুঁড়ে বাস করা ভুঁড়ো শেয়ালিটির ল্যাজের সাদা ফুলো আগা সে নির্ভুল দেখল। তার মানে কাঠবেড়ালিরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই তাকে জাগাতে এসেছিল! কিন্তু হাতে বাদাম নিয়ে সাধাসাধি করো, পেট ভরা থাকলে ফিরেও দেখবে না। গুঁড়ি বেয়ে একবার উঠবে, একবার নামবে, এর পেছনে ও দৌড়ে যাবে, মুখে অবিশ্রান্ত কিচকিচ। শিবা বোঝে, ওরা বলছে, যখনতখন খাই না বাপু। পেট ভর্তি থাকলে তো একেবারেই নয়। রেখেচ দাওচ গাছের গোচড়ায়। বাসাচায় তুচলে নিয়েচ যাব’খন!

কৃতজ্ঞতায় মাথা ঝুঁকিয়ে ধুলোর ওপর লেটকে বসে থাকে শিবা। কিন্তু ডাকলে তো তাকে যেতেই হয়। অন্ন উঠে যাবে যে! বামুনের ছেলে, সাতকুলে কেউ নেই দেখে সন্তুদার মা, তার মা-ঠান, দুবেলা দুমুঠো খেতে দিত। ভাতের জন্য দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করতে করতে সে হয়ে উঠল পড়াশুনো বা অন্য কাজ না জানা ভারী শান্ত, ধৈর্যশীল, কিন্তু মূর্খ এক যুবক। অন্য সময় ফলপাকুড় খুঁজে বেড়ানো, এর ওর টুকটাক কাজ করে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই শেখেনি শিবা। অথচ বংশগতির কারণেই কিনা কে জানে, বড় হলে বেশ দিব্যভাব জাঁকিয়ে বসল তার চেহারায়। টকটকে ফর্সা গায়ের রং, শালগাছের কাণ্ডের মতোই দীর্ঘ শরীর, টিকালো নাক আর আশ্চর্য সরল চোখ নিয়ে সে হাল ধরতে অথবা ঠেলা চালাতে গেলে সবাই হাঁ হাঁ করে উঠত, বামুনের পো কি সব কাজ পারে, না তারে দিয়ে সব করাতে আছে!

মা-ঠান তার বর্ণপরিচয় করিয়েছিল, ব্যস ওটুকুই। তারপর থেকে সে মন দিয়ে পশুপাখির ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছে আর ইদানিংকালে ভয়ঙ্কর রাগ হলে সে রাগন্তী কুয়োয় মুখ ঢুকিয়ে আঁআঁআঁ ওঁওঁওঁ চিৎকার ছেড়েছে, যেন অজয় নদের জলে গা ডোবানো ক্রুদ্ধ মহিষ!

কিন্তু সন্তু চৌধুরী এলাকার মাতব্বর হয়ে ওঠার পর সবকিছু পালটে গেল। আগে সন্তু ছিল চুপচাপ প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার, কালো ফ্রেমের চশমা চোখে সাইকেল চড়ে যখন স্কুলে যেত সামনের মাটির রাস্তাটি ছাড়া আর কিছু দেখছে বলে মনে হত না। এখন রাগন্তী কুয়োর ওপর ঝুঁকে থাকা মহুয়াগাছের কোটরের পেঁচাটির মতো চতুর্দিকে তার মাথা ঘোরে বনবন। সর্বত্র তার নজর। শিবাও একদিন সেই চড়কি নজরে মাছের মতো আটকে গেল। সন্তুর মনে হল বেকার বেকার এই ছেলেটা তার বাপের আমল থেকে দুবেলা পাত পেড়ে খাচ্ছে। অল্প কিছুর বিনিময়ে এ তার অনেক কাজে লাগতে পারে। শান্তশিষ্ট সুদর্শন শিবার সম্ভাবনা অনেক!

সেই শুরু। বাক্স, বস্তা, প্যাকেট গাড়িতে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার শুরু, রানিবৌদি একা থাকে বলে তাকে পাহারা দেওয়ার শুরু, নিজে বোবাকালা সেজে সব মেনে নেওয়ার প্রতি ঘেন্নার শুরু। প্যাকেটগুলোর ভেতরে কী আছে শিবার জানবার অধিকার নেই, কিন্তু রানিবৌদির মনে কী আছে সে বিলক্ষণ জানে। সন্তুদা আজকাল ঘন ঘন কলকাতা যায়। ঘরে ছেলেপুলে  বা অন্য কেউ নেই বলে ‘শিবা, রাতে বাইরের ঘরে সজাগ হয়ে ঘুমোস কিন্তু’ বলে সে হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর রানিবৌদিকে স্নানের বাতিকে পায়। হাতে গামছা নিয়ে স্নানঘরে ঢোকার আগে জোড়া ভুরু নাচিয়ে  শিবাকে ডাকে, এসো, দেরি কোরো না। অবুঝ, উলঙ্গ শিশুর মতো রানি অপেক্ষা করে থাকে কখন তাকে স্নান করিয়ে দেওয়া হবে। শিবা্র দেরি হলে অ্যালুমিনিয়ামের মগ ঠোকে মেঝেতে। ভেতর থেকে দরজা ধাক্কা দেয়। চাপা গলায় ভয় দেখায়। না গিয়ে উপায় আছে!

প্রথম প্রথম শিবার ভাল লাগত শীতগ্রীষ্মের এই স্নানখেলা। গরমে তেতে থাকা ট্যাঙ্কের জল হোক বা গিজারের, তার হাত পিছলে পিছলে যেত রানির উষ্ণ শরীরের সর্বত্র। সাবানের ফেনামাখা উঁচু ঢেউ নিচু খাদ, সব তার ভাল লাগত। পেছন থেকে, সামনে থেকে সে জড়িয়ে ধরত রানিকে, দুটো ভেজা শরীর শঙ্খলাগা সাপের মতো কিলবিলোত ঠান্ডা মেঝেতে, দুজনেই আনন্দের শিখরে উঠে তবে পরস্পরকে ছাড়ত। কিন্তু শিবার এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে এই অভ্যাস। ভাল লাগে না আর ভাতের আর শরীরের গোলামি। সন্তুদা কলকাতা যাবে শুনলেই তার গা গোলাতে থাকে, ছুটে চলে যায় রাগন্তী কুয়োর ধারে, রাত-চরা, উচ্চকণ্ঠ, লোমশ, বড় কানের ইঁদুরগুলো তার পাশ দিয়ে ছুটোছুটি করবার সময় অবাক হয়ে তাকে দেখে, বলাবলি করে, এই অন্ধকারে মানুষটা কী করে এখানে! মাদি শেয়ালটিও ইঁদুরের পেছন পেছন হাজির হয়। শিবাকে দেখে পিছিয়ে গিয়ে ঝোপের আড়ালে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ বাদে বাদে তার গলা দিয়ে যে মৃদু আওয়াজ বার হয়, তার অর্থ শিবা ভালই বোঝে। ও বলছে, এবার ঘরকে যাও হে, অনেক রাত হল। আমাকে শিকার ধরতে দাও।

এদের এইসব বলাবলি ছাড়াও শিবার নিজেরও অসহ্য খিদে পায়, নাড়িভুঁড়ি পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠে। কিন্তু সে ভালই জানে, রানিবৌদি সাবান হাতে বসে আছে সন্তুর সংস্পর্শে আসা শরীরের সমস্ত দুর্গন্ধ পাঁক ধুইয়ে নেবে বলে। আগে স্নান, পরে থালাভর্তি ভাত। এর অন্যথা হওয়ার যো নেই।

শিবার কাঁধদুটো সামনে ঝুলে পড়ে, এলোমেলো পায়ে সে রানির বাড়ির রাস্তা ধরে। শুনতে পায় কোটর থেকে প্যাঁচা ডাকছে, হুতুম থুম, আয় রে ঘুম। আর ঘুম! অনিচ্ছা টের পেয়ে রানিবৌদি ইদানিং তাকে মারধোর করে, অজায়গা কুজায়গায় লাথি ছোড়ে। জঘন্য গালি দেয়। শিবা তাকে সাবান মাখাতে মাখাতে নিজের অপারগ শরীর আর বেপথু মন সামলায়। নখের আঁচড়ে জ্বালা করতে থাকা হাতে কাঁচালঙ্কা ডলে তরকারি দিয়ে একথালা ভাত খায়। তারপর উসখুস করে করে ক্লান্ত হয়ে ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে।

তাই সেদিন যখন সন্তুদার স্করপিওটা বাড়ির সামনে এসে হর্ন দিল, শিবা শুনতে পায়নি মোটে। কলিংবেল ক-বার টিপেছে কে জানে, দরজা খুলে সে দেখে উস্কোখুস্কো চুলে রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে সন্তুদা দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই বলল, মৌজ করে ঘুমোচ্ছিস শিবশঙ্কর, ওঠ শালা, অনেক কাজ আছে।

রেগে গেলে সন্তুদা তার ভাল নাম ধরে ডাকে। সে কিছু বলার আগেই ঘরের ভেতর এসে ঢোকে হরিশ আর রামা, তাদের হাতে বিরাট প্যাকিং বাক্স, পলিথিন দিয়ে খুব ভাল করে মোড়ানো। দড়ির বাঁধনে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। ঢুকেই বলে, চল ব্যাটা। কুয়োর ধারে চল।

ততক্ষণে চেয়ারে বসেছে সন্তুদা। হতভম্ব শিবাকে সে বলতে থাকে ওই বাক্সটার গায়ে দড়ি বেঁধে চুবিয়ে দিতে হবে কুয়োর জলে। ওয়াটারপ্রুফ করে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অতএব ভেতরের মালে জল লাগবার ব্যাপার নেই। মহুয়াগাছের গায়ে বাঁধা থাকবে দড়ির অন্য প্রান্ত। দুটো তো দিন। শিবা দিনরাত ওখানে পাহারা দেবে, টের পাবে না কাকপক্ষীতেও।

ওর মধ্যে আছেটা কী, এই প্রশ্নে সবাই মিলে তাকে এই মারে তো সেই মারে। তাতে তোর কী রে হারামি? রাতদিন তো পড়ে থাকিস কুয়োর পাড়ে। একা বকবক করিস। করে নে করে নে, কদিন আর করবি, দাদা ও জায়গা পরিষ্কার করে কালী আর হনুমানজির মন্দির তৈরি করবে। প্ল্যান হয়ে গেছে। বিরাট মন্দির, একান্নটা ধাপ উঠে, আবার গর্ভগৃহে নেমে তবে বিগ্রহের দেখা পাওয়া যাবে। দাদার কথা শুনে চললে মন্দিরের সেবায়েত হয়ে যেতে পারিস। তুই তো আবার বামুন। পুজোআচ্চা খানিক শিখে নিলেই তো হল, নাকি? নাহলে অং বং চং করে দিবি, কে আর বোঝে! কুয়োর কাছাকাছি পৌঁছে রামা এই বকবকানির মধ্যেই বলে বসে, এই বাক্সভর্তি মন্দির বানাবার মাল আছে রে শিবা। তুই জানিস একটা মন্দির থেকে আয় কতটা? শিবা উত্তর দেওয়ার আগেই হরিশের থাপ্পড় খায় সে, বোকাচোদা, বেশি কথা বলছিস বে!

সারা রাস্তা এইভাবে বকবক করে ছেলে দুটো। রাগন্তী কুয়োর কাছে আসতেই উঁচু গলার আওয়াজে কাঠবেড়ালিরা ছিটকে গাছে উঠে পড়ে। উঁচু থেকে দেখতে থাকে সবাইকে। কালো কুচকুচে কাকটা, শিবা যার নাম রেখেছে কালী, ঠোঁটে খড়কুটো নিয়ে কুয়োর কানায় রণং দেহি ভাব নিয়ে বসে থাকে। যেন সে বলতে চায়, এখন আমার বাসা বানানো, ডিম পাড়বার সময়, তোরা এখানে কী করছিস! শিবা হাতে তালি দিয়ে বলে, ধুসসস। মুখ বন্ধ থাকলেও উড়ে যাওয়ার সময় কালী গলা দিয়ে ক্ক ক্ক আওয়াজ করে, মানুষগুলো সব বেইমান। নাহলে তুমিও ওদের দলে ভিড়ে গেলে!

মাথা নিচু করে মহুয়াগাছের গুঁড়িতে অন্যমনস্কভাবে দড়ি প্যাঁচাতেই থাকে শিবা। গাছের তলায় ফল পড়ে সাদা হয়ে আছে, কী নেশা-ধরানো গন্ধ তার! ঠিক দেখতে পেল, কোটরে প্যাঁচার গোল বড় চোখে বোঝাই হয়ে আছে আশঙ্কা আর ভয়। বনবন করে চর্তুদিকে মাথা ঘুরিয়ে, ঘাড় কাত করে সে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে, কী ঘটতে চলেছে এখানে। বেচারা, রোদ উঠে গেলে আর কিছুই দেখতে পাবে না।

তিনজনে মিলে বিশাল প্যাকিং বাক্সটাকে যখন জলে ফেলে, প্রচণ্ড শব্দ হয়, যেন বিস্ফোরণে জল ছিটকে উঠে শিবার চোখমুখ ভিজিয়ে দেয়। রাগন্তী কুয়োর জল সে ঠোঁটের ওপর থেকে চেটে নেয়। হরিশ আর রামা আগেই সরে গিয়েছিল, ভেজা মুখ নিয়ে কুয়োর কানায় উপুড় হয়ে পড়ে শিবা। ভেঙে গেছে শান্ত জলের বৃত্ত, ওপরের আকাশের গোল ফ্রেমে আটকে থাকার ছবি ভেঙে টুকরো টুকরো। সে অপেক্ষা করে থাকে কখন আবার আগের মতো হবে সব কিছু। কিন্তু তার ব্যগ্রতাকে উপেক্ষা করে কুয়োটাকে লাগতে থাকে যেন বধ্যভূমি, ফাঁসির মঞ্চ, যেখানে পাটাতনের ওপর টান টান ঝুলে আছে একটা বেখাপ্পা মোটা দড়ি।

কুয়োটা আর আগের অবস্থায় ফিরবে না, কিছুদিন পর সন্তুদা এই বনজঙ্গল সাফ করে মন্দির করবে। গায়ে জড়িয়ে থাকা নানা কল্পকথার কারণে কুয়োটা টিকে গেলে যেতেও পারে, কিন্তু এই স্নেহশীল স্বাধীন কাঠবেড়ালিরা, ল্যাজ দুলিয়ে তুরতুর করে চলা স্ফুর্তিবাজ মেঠো ইঁদুর, সদাসতর্ক পেঁচা, প্রবল বুদ্ধিমতী ভুঁড়ো শেয়ালি, এদের সকলের কপালে লেখা হয়ে গেছে নির্বাসন আর মৃত্যু! শিবার মাথার ভেতর কারেন্ট মারার মতো চিড়িক চিড়িক করতে থাকে, রাগন্তী কুয়োর জল চেটে নেওয়ার ফল কিনা কে জানে, মনে হচ্ছিল সিনেমায় দেখা মানব-বোমার মতো ফেটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে সে।

অনেক কষ্টে দু হাতে কুয়োর কানা সাপটে খাড়া হয়ে রইল শিবা। গভীর ক্রোধে সে চেঁচামেচি করে অভিশাপ দিতেও ভুলে গেছে যেন। অথচ এই জঙ্গলে বাস করা হেলেসাপের মতো কিলবিলানো সব প্রতিশোধের চিন্তা ঘুরছে মাথায়। শিবার মুখে রক্ত ফেটে পড়ছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। অনেক সয়েছে সে আর নয়, আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতেই হবে।

এদিক ওদিক তাকিয়ে তার নজরে পড়ে হরিশ আর রামার আনা বড় ধারালো ছুরির ওপর। বাড়তি দড়ি কেটে ফেলতে হবে বলে আনা। পাছে রাগন্তী কুয়ার জল ছিটকে মুখে ওঠে তাই তারা ঝপাং শব্দ হওয়ার আগেই পালিয়েছে। ছুরিটা ধুলো থেকে তুলে হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ দেখে শিবা। এটা দিয়ে সে রানিবৌদিকে স্নান করাতে করাতে পেছন থেকে জাপটে ধরে গলার নলি কেটে দিতে পারে, সন্তুদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ইদানিংকালে ঠেলে ওঠা তার সুপুষ্ট ভুঁড়িতে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিতে পারে। অথবা… অথবা…।

নানান কথা ভাবতে ভাবতেই প্যান্টটা খুলে ফেলে শিবা। ভেতরের লাল চকরাবকরা জাঙ্গিয়াটা রানিবৌদি তাকে উপহার দিয়েছিল। এখন সেটা পরেই দড়ি ধরে রাগন্তী কুয়ার ভেতর নামতে থাকে শিবা। দাঁতে ধরা থাকে চকচকে ছুরি।

দড়িতে টান পড়তেই মহুয়াগাছের গুঁড়িতে ঝাঁকুনি লাগে। সন্ত্রস্ত প্যাঁচা কোটর থেকে অন্ধ চোখ বার করে বলে, হুট হু! কে, ওখানে কে! দাঁতে ছুরি চেপে রেখে তো আর কথা বলা যায় না। মনে মনেই তাকে আশ্বস্ত করে শিবা, আমি যা করছি তোদের ভালর জন্যই করছি। একটু ধৈর্য ধর।

কুয়োর ভেতরটা কী ঠান্ডা, আর নরম আবছা আলো মাখা। যেন পেতে রাখা শেতলপাটিটি সে দেখতে পাচ্ছে, এইভাবে উদগ্রীব হয়ে ঝুঁকে পড়ে শিবা। আর কিছু চোখে না পড়লেও দেখে জলের অর্ধেক গভীরতায় ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ভারহীন দুলছে সেই বিরাট প্যাকিং বাক্স। ভর্তি টাকা, মন্দির হবে।

কোমর অব্দি জলে ডুবে যেতেই শিবা দেখল বিরাট মন্দিরের চূড়া। ঢুকেই চাতালে দাঁড়িয়ে বিশাল হনুমানজি, সর্বাঙ্গে লেপে দেওয়া কমলা সিঁদুর। পাশেই ঝুলছে হাতি সাইজের পেতলের ঘন্টা। কী মধুর গম্ভীর আওয়াজ! অন্যমনস্ক শিবা ঘন্টা নাড়িয়ে দিয়ে মন্দিরের একান্ন সিঁড়ি ভাঙে খুব আস্তে আস্তে, যেন সে জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ। আসলে মনেপ্রাণে সে খুবই ভারগ্রস্ত হয়ে আছে। এত দ্বিধা বামুনের ছেলের, এত দ্বন্দ্ব! কালীর সোনা দিয়ে বানানো লোলজিহ্বা দেখে তার অস্বস্তি হয়, পাপের শাস্তি মৃত্যু, তাকেও ওই জিহ্বা দিয়ে সাপটে নেবে নাকি! কিন্তু পিছু হটা যাবে না, আজকের পর তাকে এই তল্লাটে আর দেখবে কে! সে পালাবে কলকাতায়। অনেক মানুষের ভিড়ে লুকিয়ে থাকবে, যতক্ষণ না সন্তুদার লম্বা হাত তাকে ওই জিভের মতোই পাকলে ধরে। বিশাল প্রতিমার দিকে তাকিয়ে সে মার্জনা চাইবার ভঙ্গিতে ছুরিশুদ্ধ হাত কপালে ঠেকায়, তারপর জয় মা কালী বলে সমস্ত শক্তি দিয়ে এক হাতেই ছুরিটাকে বর্শার মতো গেঁথে দিতে চায় প্যাকিং বাক্সের গায়ে। চার পুরু পলিথিন, মোটা কার্ডবোর্ড, ভেতরে ঠাসা মাল, তাকে ভেদ করা কি অতই সহজ! তবু শিবা বারবার চেষ্টা চালিয়ে যায়, ছোট ছোট ফুটো হতে থাকে, জলে বুড়বুড়ি ওঠে, বাড়তে থাকে শিবার উন্মত্ততা। জল ছিটকে ওঠে তার নাকে মুখে চোখে, এখন আর চাটতে হয় না, নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁ করলেই দমকে দমকে মুখে জল ঢুকে যাচ্ছে, শব্দ উঠছে ছপাৎ ছপাৎ।

দড়ি ধরে এক হাতে ঝুলতে ঝুলতে একবারই ওপরে তাকিয়েছিল শিবা। একদিকে কাঠবেড়ালির পুরো পরিবার, অন্যদিকে কালীর আত্মীয়স্বজন কুয়োর কানায় বসে জলের দিকে কখনও ঝুঁকে, কখনও ঘাড় কাত করে তার পাগলামি দেখছে। অন্ধ প্যাঁচা কিছু বুঝতে না পেরে কোটরে বসেই সমানে ডেকে যাচ্ছে। শিবা জানে শেয়াল আর মেঠো ইঁদুরেরাও মাটির নিচে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কোত্থেকে তার এত জোশ আসে কে জানে, সে একবার করে ছুরি মারে আর চেঁচিয়ে ওঠে, এইটা আমার জন্য, এইটা তোদের জন্য, এইটা আমাদের সক্কলের জন্য।

কুয়োর বাঁধানো ঘেরে ধাক্কা খেলেও আজ আর তার গর্জন  শিশুর কান্নার মতো শোনায় না, বরং মনে হয় রোদ ঠা ঠা আকাশ থেকে নেমে আসা অসম্ভব এক বজ্রনির্ঘোষ!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. বিষয়টি রাগ নয়, অনুরাগের গল্প এটি। গভীর অনুরাগ। মানুষের পৃথিবী শয়তানের উচ্ছিষ্ট হয়ে যাবার আগে যে প্রতিরোধ, তাকেই তো অনুরাগ বলি। সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার মন্ত্র তা। লিখন কৌশলের দিক দিয়ে বিচার করলে গল্পটি নিখুঁত এক নির্মাণ।

  2. শিবা তুমি নষ্ট সময়ের পষ্ট মুখ…..প্রতিটি শব্দ,শব্দবন্ধ,বাক্য দু’হাতে জড়াই,বলি প্রতিভাদি,রাগাও আরো রাগাও,পুড়ে যাক কুৎসিত,সুন্দর থেকে যাক।

Leave a Reply to PRAJNA PARAMITA Cancel reply