“মানুষ বড় ভয় পেয়েছে, মানুষ বড় নিঃসহায়…!”

সুমনা রহমান চৌধুরী

 

…… তারপর আর্মি পোষাক পরা হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ চার-পাঁচজন লোক একটা ভ্যান থেকে নেমে আসে। গ্রামের মানুষরা সারাদিনের কাজ শেষে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলেন। অস্ত্র ঠেকিয়ে পরপর পাঁচজনকে তুলে নিয়ে যায় তারা লোহিতের তীরে। লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাইফেলে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় পাঁচজনের বুক। কিসের অপরাধে সেটা জানা যায় না। কোনও সাক্ষী-সাবুদ থাকে না। কোনও প্রমাণ থাকে না। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারেই গা-ঢাকা দেয় হত্যাকারীরা। অথচ যেখানে এই হত্যালীলা চালানো হচ্ছে তার মাত্র ৩০০ মিটার দূরেই পুলিশ চৌকি। হত্যা এবং খুনীদের পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়। তারপর ধীরে-সুস্থে মঞ্চে আসেন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তাগণ। জানানো হয় মৃত পাঁচজনই বাংলায় কথা বলত।

না, কোনও হিন্দি কিংবা তামিল সিনেমার গল্প শোনাতে বসিনি। শোনাতে চাইছি অসমের পাঁচ বাঙালিকে ঠান্ডা মাথায় খুন করার প্লটের কথা। বোঝাতে চাইছি অসমে বাঙালি হয়ে জন্মানোর খেসারত এভাবেই দিতে হয়। নাহ্, শুধু বাঙালি নয়, এই ভারতবর্ষে গরীব হয়ে জন্মানোর খেসারত এভাবেই দিতে হয়। এভাবেই রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, আর প্রাণ যায় শ্যামলাল বিশ্বাস, অনন্ত বিশ্বাস, অবিনাশ বিশ্বাস, সুবোধ দাস, ধনঞ্জয়, আফরাজুল, পেহলু খান, আখলাক, জুনেদ, আসিফা, নির্ভয়াদের মতো উলুখাগড়াদের। ভারতের ইতিহাস তার সাক্ষী। অসমের ইতিহাস তার সাক্ষী। আখলাক, আফরাজুলদের সাথে শ্যামলাল, অনন্তদের মিল একটা জায়গায়ই। এরা সবাই গরীব শ্রমজীবী মানুষ। এরা সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। এরা ধর্ম বলতে বিকেলে চাল নিয়ে ঘরে ফিরে আসা বোঝে। শ্যামলালের বিড়ি ধার করে আহমেদ খায়। আর বারে বারে দাঙ্গা, ইলেকশন, রাজনীতিতে এদের গলাটাকে ব্যবহার করা হয় বলির বকরার মতো।

এতসব লিখতে গিয়ে “তমস” বলে একটা সিনেমার কথা মনে পড়ল। দাঙ্গার উপর নির্মিত এই ছবিতে দেখা যায়, গরীব খেটেখাওয়া এক লোককে কীভাবে টাকার লোভ দেখিয়ে মন্দিরে গরুর মাথা রাখানো হয়, তারপর চারদিকের সেই জলন্ত দাঙ্গার আগুনের মধ্যে রাস্তার মাঝে তার স্ত্রী জন্ম দেয় এক সন্তানের।

যাই হোক, যা বলছিলাম, এবারে পাঁচটা মানুষ খুন হল। আর সেই খুনটাকেও ফেলা হল হিন্দু-মুসলমানের কাজিয়ায়। অবশ্য ২০১৯-এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে একইরকম প্রচার চলছে সমস্ত দেশ জুড়েই। গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে, জেলায় জেলায়। শুরু থেকেই এনআরসি’র চল্লিশ লক্ষ খসড়াছুট মানুষের পরিচয় বের করা হচ্ছে হিন্দু আর মুসলমান। হিন্দুদের বলা মুখে বলা হচ্ছে, “তোমরা থাকবে, না হলে শরণার্থী হিসেবে রাখা হবে, তবুও তোমরা থাকবে”, ওদিকে হাজার কোটি টাকা দিয়ে বানানো হচ্ছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ ডিটেনশন ক্যাম্প! খসড়াছুট হিন্দুরাও এনআরসি আসলে “মুসলমান খেদা” মেনে খানিকটা নেচেও নিচ্ছে।

বাঙালি শ্রমিকরা খুন হলেন। তার আগে হুমকি স্বরূপ আলফা বোমাও ফাটিয়েছিল গৌহাটিতে। কিন্তু অসমের মিডিয়ার তো এই ঘটনার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান আনতেই হবে, নাহলে শাসকের পা-চাটা সারমেয় হিসাবে কীভাবে প্রমাণ করবেন নিজেদের? তাই প্রমাণ হিসেবে পরদিন পত্রিকার প্রথম পাতা জুড়ে মৃত শ্রমিকের পরিচয় লেখা হল  “পাঁচ হিন্দু বাঙালি খুন”। তার পরদিন লেখা হল, “জেহাদী কায়দায় খুন”! কেন? কারণ খুব সূক্ষ্মভাবে বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমানের (যাদেরকে কিনা বরাকে বাঙালি বলা হয় না) মধ্যে ঘৃণা তৈরি। কারণ ১৯-এর ভোট এবং আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের আগে হিন্দু এবং মুসলমান লাইন ধরানো। কারন অসমীয়াদের ‘বিদেশী হটাও’ এজেন্ডায় নাগরিকত্ব বিলের মূলা ঝুলিয়ে হিন্দু বাঙালিদের সুবিধার কথা প্রচার করে মুসলমান বিদ্বেষকে রাজ্যের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দেওয়া। অর্থাৎ ভাষিক সংঘাতকে সাম্প্রদায়িকতায় পরিণত করে অসমকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার শাসকের পরিকল্পনাকে জল সার দিয়ে সতেজ সবুজ করে তোলা।

একটা মানুষ, একটা মিডিয়া বলল না, যারা খুন হয়েছেন তাদের একটাই পরিচয়— তারা বাঙালি। তাদের একটাই পরিচয় তারা গরীব মেহনতী প্রান্তিক মানুষ। তাদের খুন করা হয়েছে কারণ তারা বাংলায় কথা বলে। তাদের খুন করা হয়েছে কারণ অসমীয়া উগ্র জাতীয়তাবাদীদের চরম বাঙালি বিদ্বেষ। আলফা, বিজেপি সবাই এক সুতোয় বাঁধা। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহই তো বলেছিলেন, “শরণার্থীরা উইপোকার মতো, এদের টিপে টিপে মারতে হবে!” এই চূড়ান্ত বিষাক্ত বক্তব্য কি আলফাকে প্ররোচিত করেনি? উগ্র অসমীয়া জাতীয়বাদীদের প্ররোচিত করেনি? তাহলে এই মৃত্যুর জন্য, এই উগ্রতার জন্যে আলফা যতটা দায়ী বিজেপির সভাপতি অমিত শাহও কি ততটাই দায়ী নন? এই প্রশ্নগুলোই যাতে সাধারণ মানুষেরা করতে না পারে সেজন্য পোষা সারমেয়দের দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে লেখানো হয়েছিল “জেহাদি কায়দায় খুন”। যাতে হিন্দুদের মনে আরও সন্দেহ, আরও বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। অসমিয়া জাতিবাদকে কিভাবে সর্বভারতীয় হিন্দুত্ববাদের রূপ দেবার চেষ্টা চলছে তা বোঝার জন্য অসমের এই ঘটনাগুলির পর্যালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এনআরসি তালিকা থেকে বাদ যাওয়া ৮০ শতাংশ প্রান্তিক অশিক্ষিত নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মুসলমান যেভাবে সম্মলিতভাবে লড়াই করছেন, বিজেপি এবং আলফা সহ উগ্র অসমীয়াপন্থীদের সমস্যা সেখানেই। তাই “ডিভাইড এন্ড রুল” গেম খেলছেন তারা মিডিয়া এবং প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতায়। এখানেই বোধহয় পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে ছোট করে আরেকটা তথ্য জানিয়ে রাখা খুব দরকার, এবারের কালীপুজো এবং দেওয়ালিতে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা বা মিশ্র এলাকা দেখে হাইলাকান্দি এবং শিলচরের প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে, ভাসানে সম্পূর্ণ পুলিশি সহযোগিতায় চালানো হয়েছে একটা গান—

“মেরে ভারত কা বাচ্চা বাচ্চা জয় জয় শ্রী রাম বোলেগা/ মেরে ভারত কে মোল্লা মৌলানা জয় জয় শ্রীরাম বোলেগা/ দুশমন কে ঘর মেঁ ঘুস কর শির কাট কর লায়েঙ্গে/ খোলি চুনৌতি দেতা হুঁ

মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে….”

খুব সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করে এই গান চালানো হয়েছে যাতে এনআরসি থেকে মানুষের চোখ এবারে রামমন্দিরের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। যাতে এনআরসির কারণে আত্মহত্যাগুলোকে ইলেকশনের আগে ভুলিয়ে দেওয়া যায়। যাতে ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ জন মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া যায়। ঠিক ৯০-এর দশকের মতো সারা রাজ্যে, সারা দেশে এক নিখুঁত ষড়যন্ত্র চলছে। সেই ষড়যন্ত্র যারা বুঝতে পারছে তাদের ভয় দেখিয়ে, খুন করে, চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটি বহুত্ববাদী দেশ ও সমাজকে ধ্বংস করার এই যে  রাজনীতি বিজেপি করছে তা প্রতিহত করতে এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রত্যেকজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেই। যেকোনও মূল্যে প্রতিহত করতে হবে এদের। পিঠটা দেওয়ালে ঠেকানো আর শত্রু দোরগোড়ায়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অবস্হা যা দাঁড়াচ্ছে ক্রমশ… তাবত পৃথিবীময় এই যে বিদ্বেষের এত বিষ, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত আলাপচারীতা.. এসবই থেকে যাবে..মানুষ থাকবে না হয়ত…

Leave a Reply to নাহার তৃণা Cancel reply