দৃষ্টি প্রদীপ

স্বর্ণেন্দু সরকার

 

আপনি জিগ্যেস করেছেন আপনার কবিতাগুলো ভালো হয়েছে কি না। আমাকে এখন যেমন জিগ্যেস করছেন এর আগে অন্যদেরও জিগ্যেস করেছেন। আপনি ম্যাগাজিনেও কবিতা পাঠিয়ে থাকেন। সব কবিতার সাথে আপনি আপনার কবিতাগুলোর তুলনা করেন আর যখন কোনও সম্পাদক আপনার কবিতা বাতিল করে দেন— হতাশ হয়ে পড়েন আপনি। এখন যেহেতু আপনি আমার উপদেশ চেয়েছেন— আপনাকে অনুরোধ করছি, এসব বন্ধ করুন। আপনি বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন আর এখন সেটাই সবচেয়ে বেশি করে ত্যাগ করতে হবে আপনাকে। কেউ আপনাকে উপদেশ দিতে বা সাহায্য করতে পারবে না— কেউ না। মাত্র একটি কাজই আপনার করা উচিত— নিজের ভিতর ঢোকা। খুঁজে বের করুন সেইসব কারণ যা আপনাকে লিখতে নির্দেশ দেয়; দেখুন এদের শেকড়-বাকর আপনার হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত হয়েছে কি না— নিজের কাছে স্বীকারোক্তি দিন— কেউ আপনার লেখালেখি থামাতে বাধ্য করলে আপনি মারা যেতেন কি না। এ সবকিছুই, রাতের গভীরতম নীরব সময়ে জিজ্ঞাসা করুন নিজেকে— আমি কি অবশ্যই লিখব? গভীরতর জবাবের খোঁজে নিজেকে খুঁড়ে চলুন। আর যদি এর উত্তর অনুমোদনের সুরে বেজে ওঠে, যদি এই ভাবগম্ভীর প্রশ্নের উত্তর পান এক শক্তিশালী, সরল ‘অবশ্যই আমি’— তখন এর প্রয়োজনীয়তার সাথে সঙ্গতি রেখে আপনার জীবন গড়ে তুলুন।

(তরুণ কবিকে বলি/ সুহৃদ শহীদুল্লাহ, ভাষালিপি)

চোখ আছে অথচ দৃষ্টি নেই, এমন মানুষের সাথে দেখা হল বইমেলার মাঠে। বই ও মানুষের মুখ, ওদের কাছে অন্ধকারের।

বাড়িটির কথা লিখিয়া রাখি। লিখিয়া রাখিতে হয়, নয় ত চিরতরে হারাইয়া যায়। এখন সেই বাড়িটি নাই, সেখানে একটা গির্জা উঠিয়াছে। সেখানে গেলে কেউ তোমাকে চিনিবে না, সেখানে নতুন লোক, নতুন শিশু, হয়ত তাদের কুকুর তোমাকে তাড়া করিবে। নাই, কোনও চিহ্ন আর নাই। এ কীভাবে সম্ভব হইল? কিন্তু হইয়াছে। কেউ জানিবে না, এখানে একটা বাড়ি ছিল, একটা হাসিখুশি সংসার ছিল, উঠানে কাপড় শুকাইত, অতিথি অসিত। পৃথিবীর কত জীবন্ত দৃশ্য, কত স্থিতিশীল নিলয় মুছিয়া গিয়াছে। এই বাড়িটিও আকাশে মিলাইয়া গিয়াছে।

(হাসিঘর/ দেবাশিস তরফদার, ভাষালিপি)

অন্ধ দম্পতি এসেছে এই কলকাতা শহর থেকে বহু দূর, প্রায় নাম না-জানা কোনও গঞ্জের অন্ধদের ইস্কুলের জন্য অর্থ জোগাড় করতে। শীত ও বসন্তের বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে ওদের শরীরে। মেয়েটা গোলাপি আর ছেলেটা সবুজ চাদর গায়ে জড়িয়ে ভিড়ের ভিতর মিশে যাচ্ছে ক্রমশ।

সে ছিল ঝাড়া হাত-পা লোক। পাহাড়ে ঘোরা ছিল তার নেশা। ছোট একটা মেয়েকে একবার, বনের কোলে ফোঁপাতে দেখে একা। কাঠ কেটে বাবা ফিরছে না এখনও। খুব খিদে পেয়েছে। আর, মা নেই তার।

কবেকার এক গোম্পা দেখার কথা ছিল। হল না যাওয়া। ছোট মেয়ের পিছু নিয়ে, ফিরে চলল তার বাড়িতে।

সেই থেকে পুরো একটা শীতকাল, বারবার সে এসেছে ঐ বাড়িটায়।

(সিঙ্গালীলা ঠাকুর/ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাষালিপি)

চোখের ভাষা পড়ার মত চোখ আমার নেই, আমি উৎকর্ণ হয়ে থাকলাম। রাশি রাশি বইয়ের স্তূপের ভিতর নজর যাওয়া মাত্রই মনে এল— এই যে অন্ধজন, সে তো কিছুই দেখে উঠতে পারছে না। তার কাছে আমি তুমি আপনি এবং তাঁরা, সকলেই সমান। দৃষ্টিবান মানুষের চোখে যে বিভেদের ছায়া ঘনিয়ে আসতে চায়, এইক্ষণে সেই আলো আর ছায়া, তার কোনওটাই নেই।

নজর থাকুক :

কাব্য সংগ্রহ — প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাবণ।
গদ্য সংগ্রহ — গৌতম বসু। আদম।
লাল দেদ/ লাল্লেশ্বরীর বাক সংগ্রহ — অনুবাদ : জয়ন্ত ঘোষাল। অস্ট্রিক।
বাসুদেব দাশগুপ্ত রচনা সমগ্র-২। গাঙচিল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4874 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...