খিদে, তোমাকে : একটি খোলা চিঠি

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

খিদে। তোমাকে জন্ম হতে দেখেছি। আমাদের হাতের সামনে খিদে, মাথার ভেতর খিদে, চোখের ভেতর সাদা চাপা চাপা রক্তের মতো তরল এক খিদে। তোমাকে জন্মাতে দেখেছি। পারিবারিক মধ্যবিত্তপনার ভেতর, এটা ওটা টুকরো হয়ে যাওয়ার ভেতর।

মফস্বল। আমাদের ডিকশনারিতে প্রেস ক্লাব থাকে না। ধর্মতলা বলতে মিটিং মিছিল, নগরপারের রূপনগর কলকাতার নাগরিক হাব আর নিউ মার্কেট বোঝায়। বিকিকিনির ভেতর সারহীন কিছু ম্যানেকিন বোঝায়। দোকানের এদিকে ওদিকে। চলমানতায় যাদের আপাত তফাৎ। খিদে, ওদের শরীরে কোনওদিন ঢুকেছ? কাচের দেওয়ালের ভেতর থেকে ছটফট করা বিজ্ঞাপনের জিরো আওয়ার পেরিয়ে, খিদে, ওরা তোমাকে প্রতীক্ষা করছে। শরীরে, যৌবনে, নিয়ন আলোর পরিসীমায়।

পরিসীমা। মেট্রোর সাত নম্বর গেট থেকে প্রেস ক্লাব। শহরের চেনা চৌহদ্দি। বাস। ট্যাক্সি। সারি সারি দূরপাল্লার অপেক্ষা। বিহার, ঝাড়খন্ড। এসব পেরিয়ে মিনিট সাতেক হেঁটে আলাপ। শতরঞ্চি, ত্রিপল, অস্থায়ী টেবিলের সঙ্গে। খিদে, তোমাকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। চমকে উঠেছি। এরাই? এদেরই প্রকাশিত হতে দেখেছি বড় কাগজের উপেক্ষার পাতায়? কোলের বাচ্চাগুলোর ঠোঁট থেকে জলের গেলাসের ভেতর এক ধরনের অপেক্ষা থাকে। প্রিয় খিদে, এদের সঙ্গে তোমাকেও যুগপৎ ফুটে উঠতে দেখি। অপেক্ষায়। ওদের ভাষায় ওয়েটিং লিস্ট। শুয়ে, বসে, হোর্ডিং হাতে।

পড়ুন — যে যেখানে লড়ে যায়

হোর্ডিং। আমার সামনে হাতে লেখা অক্ষর। অনভ্যস্ত মিডিয়া। কখনও ক্যামেরার ক্বচিৎ ঝলক। ওরা তুলে ধরে। যদি কেউ দেখে। ‘গিভ আস জব অর গিভ আস বুলেট’। কবিতার মতো দেখতে। মুখ চোখ। নবারুণ আপনি বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। ‘ছেলেমেয়েরা রাজপথে গহীন অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছে’। রাস্তায়, মনে। অন্ধকার। পাশে কখনও মন্দাক্রান্তা, শমিতা, শুভ্রা। স্যানিটারি ন্যাপকিন। অস্থায়ী কিছু ত্রিপল, তাও একটা অংশে। যখনতখন খুলে দেওয়ার হুমকি। ‘আমরা রোদ ঝড় জল সহ্য করে লড়াই করছি, করব’। আমার দুপুরের গলা কাকের পালক পায়। জল খেতে ইচ্ছে করে। আমার গরম হয়। গলা ফাটে। আমি…। প্রিয় খিদে, আমি, জল খাই।

জল। ঘন ঘন তেষ্টা মেটানো। আলাপ। দূরে অর্পিতা। সামনে তানিয়া। কিছুটা পরেই সংজ্ঞাহীন। একটার পর একটা কথা নির্মাণ করছিল লিঙ্কন। খিদে, এস, আলাপ করাই। বনগাঁর লিঙ্কন। ‘দাদা, লালাবমি জানেন। খাবার নেই। সাত দিনের রাতে গা গুলিয়ে এল। কী বেরোল জানেন? পিত্তি। লালা। পাশেই তো মেয়েগুলো শুয়ে। একটু দূরে গিয়ে ঢাললাম। আহ…’। আরাম। খিদে না, খিদের স্মৃতি বেরিয়েছিল লিঙ্কনের গলা দিয়ে। ‘বাসের খালাসি। ড্রাইভার। পাশেই। কে একটা এঁটোকাঁটা ফেলল। ওরে, প্লিজ, তুলে নে। ওখানেই তো আমাদের ঘর। গন্ধে টেকা যাবে না। ছেলেটা দুটো কাঠ জড়ো করে তুলল’। লিঙ্কনের গলা। কৃতজ্ঞতায় ভেজা। দূরের রাজ্যের সহমর্মী তরুণ। বাস চালক। কামারাদেরি। ‘এই দেখুন দাদা, ওষুধ, ওষুধ…’। ছেঁড়া প্যাকেটে অন্ডেম, ওআরএস। ছেলেটা হীরে বের করল। কাচ কাটা হীরে। প্রাণদায়ী। ‘বছরগুলো পেরিয়ে গেল দাদা। বারোর পর থেকে। তেরো। চোদ্দো। পনেরো। প্রার্থীতালিকা। মেরিট। চাকরি। কই, কিছু হল না তো’। বছরগুলো জমতে দেখছে লিঙ্কন। ভারী। খুব ভারী। খিদে, আমার ভর্তি পেটে আগের রাতের বায়োস্কোপ মনে পড়ে। ‘লা নোত্তে’। আন্তোনিওনির রূপকথা। মনিকা ভিত্তি। জাঁ মর্নিউ। একটু কোণায় মার্সেলো মাস্ত্রেওনি। ‘ইউ ডোন্ট নো, টু ফিল দ্য ওয়েট অফ ইয়ার্স ইন ভেইন’।

প্রিয় খিদে, কীভাবে জন্ম হয় তোমার? যে মেয়েটার আগামী নষ্ট হয় অনশন শিবিরে, তার পেটের ভেতর কতটা দূরত্বে তোমার সহবাস। প্রোটিন, সুগার, ফ্যাট আর সুষম খাদ্যের একটা ঠিকঠাক রেশিওর থেকে কতটা দূরে সেই জন্ম না হওয়া ছোট ছোট আঙুল, অস্তিত্ব। অস্তিত্ব। অসুখের ভেতর। ওদের মশারি দরকার। অসুখের ভেতর, মশার ভেতর, অ্যাপোলো হাসপাতালের ভেতর ওদের আশংকাজনক সহযোদ্ধা। চুরি হওয়া ব্যাগ, ওষুধ, বেঁচে থাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার। খিদে, তোমাকে থোড়াই পরোয়া। ওদের শুয়ে থাকার সামনে একটা টেবিল। বোতল। ছিপি খুলে উঁকি মারা প্যারাসিটামল। ‘একটা দেবে দাদা, ওখান থেকে? ছিঁড়ে দিও’। জোর নেই। ঘন ঘন প্রেশার চেক। ‘ইয়েস। আমার আশি একশ কুড়ি’। পাশ থেকে সোল্লাসে চেঁচিয়ে রোদ, আর অনিশ্চয়তা ধরে চোখ চকচক করা একটি ছেলে। অর্থাৎ এখনও লড়াই। এখনও আশা। এখনও প্রাণ। আশ্চর্য সম্পদ। মেডিকেল কলেজের বন্ধুরা। প্রিয় খিদে, জঠরের বাইরে বেরিয়ে তোমারও চেনা হয়ে যায় বন্ধুত্ব। হাতে হাত। মাথা রাখার মতো একটা কাঁধ।

কাঁধ। কখনও সরে যায়। অসহযোগিতা। বাইশ পেরিয়ে একদিন নড়ে ওঠা সরকারি টনক। ‘কী হয়েছে দেরি করেছি তো? তোমরা তো অনশন করতেই। দুদিন এদিক ওদিকে কী যায় আসে?’। বিবেক। পাড়ার যাত্রায় তবু থাকে। এখানে বিরল। এমপ্যানেল্ড লিস্ট। আপডেটেড ভ্যাকেন্সি? স্যার, আপনারা বের করবেন না? ‘ওটা আমাদের মনের ইচ্ছের ওপর’। বেশ তো। তুলে দিন না সিস্টেমকে। ডেমোক্রেসিকে। ইচ্ছে তো…। আমাদেরও। ভীষণ। বাঁকুড়া জেলায় একাই চোদ্দোশ শূন্যপদ। আরটিআই স্যার। আমাদের বানানো না। এমপ্যানেল্ড, ওয়েটিং মিলেই ফাইনাল মেরিট লিস্ট। সেই ওয়েটিং লিস্ট। ‘ওরা তো অকৃতকার্য’। হাসি….। রাজনীতিজ্ঞ হতে অভিধান লাগে না। প্রিয় খিদে, ভোটের বাজারে, ডায়েট লিস্ট। কোন প্রার্থী কোন ডায়েটে সহনশীল? মিডিয়া। খিদে, সত্যি বলছি, লজ্জাবোধ হয়, অভিধানে তোমাকে দেখে। জিভ উপড়ে নিতে ইচ্ছে হয়। মনের ইচ্ছে…

পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯

আর কী লিখি বলো? বেঁচে থাকতে কষ্ট হয়। ববি স্যান্ডস মনে পড়ছে। সেই হাঙ্গার স্ট্রাইক। আইরিশ আত্মা। ‘আই অ্যাম স্ট্যান্ডিং অন দ্য থ্রেশহোল্ড অফ অ্যানাদার ট্রেম্ব্লিং ওয়ার্ল্ড। মে গড হ্যাভ মার্সি অন মাই সোল’। অথবা ওরা। লিঙ্কন। অর্পিতা। তানিয়া। যাদের সঙ্গে আলাপ হল না তেমনই চারশো মুখ চোখ নাক হাত। রোগারোগা চেহারা। সংজ্ঞাহীনতা। আমাদের জন্য। বৃষ্টিতে আটকে রাখা ত্রিপল। ত্রিপল বললেই পুজো মনে পড়ে। দুর্গাপুজো। মফস্বলের। প্রতিবছর হয়। এসএসসি সেসব না। সাত আট বছরে একবার হয়। এরপর হয়ত বারো বছরে একবার। সেই একটা ফুল ফোটে না? নীলাকুরুঞ্জি। কথা অসংলগ্ন হয়ে আসছে। আমার ভরা পেটের সেফ-খেলা মধ্যবিত্তবোধে, কথা জড়িয়ে আসছে। চলি।

লিঙ্কনের কথাটা রাখা হয়নি। ফেরার আগে দেখা হল না। ফোনে বলল ‘দাদা, কাল আসবেন তো? কাল…?’

প্রিয় খিদে, কাল থেকে অফিস। তবু, কাল থেকে আমি তোমাকে লালন করব। খারাপ পাড়ার মাটি দিয়ে একদম শুরুতেই যেভাবে নির্মিত হন প্রতিমা। লালিত হন আগামীতে। মনে পড়বে বনি রাইট। ওই কথাগুলো…।

‘ইউ বিল্ড হাঙ্গার ফর অ্যাক্টিং, ওয়ার্কিং অ্যান্ড এ বিজি লাইফ’।

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4245 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...