চিচিং ফাঁক

আলেকজান্ডার রোমানোভিচ বেলিয়ায়েভ

 

তর্জমা : লীলা সরকার

 

প্রথমাংশের পর

যান্ত্রিক চাকরগুলি

তৃতীয় দিন সকালে গানে যখন প্রাতঃকালীন আহার শেষ করেছেন, গাড়ির আওয়াজ শুনলেন। যোহান জানালা দিয়ে দেখলেন, মিচেল একটা লরিসহ গাড়িতে আসছেন। লরিতে বড় বড় বাক্স, যেন কফিন। কেন এইসব বাক্স— এই চিন্তাই যোহানকে উদ্বিগ্ন করল। যোহান জানাল, “মিচেল এসেছে।” চাকরদের তাড়াতাড়ি নির্দেশ দিয়ে যেন বন্ধুর বাড়িতে এসেছে এইভাবে মিচেল ঘোরে ঢুকলেন। “আমার যান্ত্রিক চাকরগুলি কেমন আছে? আপনি সন্তুষ্ট তো?”

“হ্যাঁ, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট”— গানে উত্তর দিলেন।

“আমি কিন্তু সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নই”— হাসতে হাসতে বললেন মিচেল।

“যান্ত্রিক চাকরগুলি কেন আপনাকে সন্তুষ্ট করছে না?” গানে জিজ্ঞাসা করলেন।

“এই কারণে মিস্টার গানে, ওদের কাজের মাত্রা খুব সামান্য। বিশেষ বিশেষ কাজ ওরা করতে পারে কিন্তু আপনাকে পোষাক পরাতে বা কফি দিতে পারবে না।”

যোহানের মনটা এই কথাগুলিতে একটু দমে গেল। তাই কি মিচেল? যোহান তার চিন্তা সম্পূর্ণ করতে পাড়ার আগেই মিচেল তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করল, “আমি আপনাকে অস্বাভাবিক নতুন জিনিস দিয়ে ভয় দেখাতে চাইনি,”— মিচেল বলতে লাগল।

“এইসব সরঞ্জাম, যান্ত্রিক ঝাঁটা আর শিশুর খেলনা যদি ভেস্তিনগাউজ কোম্পানির সাম্প্রতিক আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করা যায়”— যোহান চিৎকার করে উঠল। তার হাত কাঁপতে লাগল এবং হাত থেকে পাত্র পড়ে গেল।

“ভয় পাবেন না, যোহান”— ওর দিকে তাকিয়ে মিচেল বললেন। “আপনি তাহলেও প্রয়োজনীয়। যান্ত্রিক চাকরগুলির যত্ন ও দেখাশুনো করতে হবে, চাকরগুলি তখনই আপনার সব কাজ সম্পূর্ণ করবে। সেগুলি হয় আপনারা করতেই পারবেন না। আপনি একটু দেখবেন?”

মিচেল, গানে ও যোহান ঘর থেকে বেরোলেন। শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই কফিনের মতো বাক্সগুলি মাটি থেকে নামিয়েছে এবং ঢাকনাগুলি খুলছে।

ভয় ও আগ্রহের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে গানে বাক্সগুলির দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত বর্মে আবদ্ধ নাইটের মতো দুটো লোহার মূর্তি দেখলেন। এই মূর্তিগুলি স্পাইরাল স্প্রিং-এর সাহায্যে যুক্ত করা হয়েছে। শ্রমিকরা মমিগুলিকে মাথার পিছনে ধরে উঁচু করল। মিচেল চাকরদের দিকে গেলেন এবং কালো রঙের বেড়ানোর ছড়ি দিয়ে ওদের মুখে আঘাত করলেন যাতে ধাতুর শব্দ হল। তারপরে চাকরগুলিকে বাড়ির দিকে সিঁড়ির পায়ের কাছে স্থাপন করা হল। মিচেল ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে চাকরগুলির মাথার পিছনে ছোট সুইচ টিপে দিলেন।

আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। ক্লিক শব্দ করে চাকরগুলি বেঁকে গেল এবং সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির দিকে উঠতে লাগল। এই মুহূর্তে কোথা থেকে আবার জিপসি আবির্ভূত হল। লাফিয়ে গিয়ে ও একটা চাকরের পা কামড়ে ধরল এবং চাকরটির পা ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল।

মিচেল রেগে চিৎকার করে উঠলেন, “কুকুরটাকে সরিয়ে নিয়ে যান।” মালি এসে কুকুরটাকে ধরে ওর কাছে নিয়ে গেল। এরপরে চাকরগুলি না থেমে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল এবং পাখা পর্যন্ত গিয়ে বসার ঘরে ঢুকল।

“দাঁড়াও”— মিচেল পিছনে আসতে আসতেই বললেন। চাকরগুলি থেমে গেল। “সামনে দশ পদক্ষেপ, তারপরে ডানদিকে ঘোরো, নিয়ে এসো, পিছনে যাও, দাঁড়াও”— মিচেল আদেশ করলেন। চাকরগুলি সমস্ত আদেশ পালন করল। ঘরের পর ঘর ওরা গেল। ছোট টেবিলের দিকে ঘুরল, বেঁকে খুব সাবধানে গিয়ে টেবিল থেকে অ্যালবামটা নিল এবং মিচেলকে দিল। গানে আশ্চর্য হয়ে গেলেন এবং যোহান বিস্মিত হল।

“দেখছেন, এটা কেমন সহজ। যা কিছু আপনি আদেশ করবেন, ওরা তাই-ই করবে। আর আপনার ওদের আদেশ করতে ভালোও লাগবে। যেমন ধরুন, আপনি ওদের আদেশ করলেন বুফেতে গিয়ে কিছু খাবার নিয়ে আসতে। এরা সঙ্গে সঙ্গেই সেটা করবে। যোহানকে শুধু মাঝেমাঝে আদেশ করতে হবে ‘কফি’ অথবা ‘খাবার’ যন্ত্রগুলিকে তেল দেবার জন্য।”

শ্রমিকদের দিকে ঘুরে মিচেল বললেন, “তেলের পাত্রটা দাও। তোমাদের ধন্যবাদ। এদিকে এগিয়ে আসুন যোহান এবং খুব মন দিয়ে দেখুন।”

চাকরগুলির দিকে তাকিয়ে মিচেল আদেশ দিলেন, “বেঁকে যাও।”

চাকরগুলি বেঁকে গেল। “যোহান, ছোট্ট ছিদ্রটা দেখতে পাচ্ছেন কি? তেল এখানে দিয়ে দিন। যান্ত্রিক চাকরেরও খাবার দরকার হয়। তেলের পাত্র নিন। ভয় পাবেন না। কী কারণে আপনার হাত কাঁপছে?”

যোহানের সত্যি সত্যিই হাত কাঁপছিল এবং সে কোনওমতেই ছিদ্রটাতে তেল দিতে পারল না।

“কিছু ব্যাপার নয়, আপনি অভ্যস্ত হয়ে যাবেন”— মিচেল ওকে উৎসাহিত করলেন। তিনি যান্ত্রিক চাকরগুলিকে তেল দিলেন। কীভাবে সব দরকারি কাজ করা যায় তাই দেখাতে লাগলেন। ওরা মিচেলের কাছ থেকে ডিনার জ্যাকেট নিয়ে আবার সেটা তাকে পরিয়ে দিল। এইসব কাজই ওরা নিখুঁতভাবে করল।

“ওরা যে শুধু সুন্দর চাকর তাই নয়, ওরা খুব ভালো গার্ড। আপনি স্টাডিতে যাবেন?” এবং উত্তরের অপেক্ষা না করে চাকরগুলিকে বললেন, “আমার পিছনে এসো।”

গানে এতই আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে নিজের ইচ্ছা হারিয়ে ফেললেন এবং যান্ত্রিক চাকরগুলির মতো তিনিও মিচেলের পিছন পিছন গেলেন। মিচেল স্টাডিতে প্রবেশ করে চাকরগুলিকে সিন্দুকের কাছে স্থাপন করলেন। একপাশে গিয়ে তিনি চিৎকার করলেন, কপিতে যেমন আছে তেমনই আলাদা লাইনে হবে। সেই মুহূর্তে চাকরগুলি অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে লাগল। “প্রত্যেকটি ডাকাত যে সিন্দুকের দিকে যেতে সাহস করেছে, তাকে মেরে এই স্টিল লিভারের মতো একটা কেকে পরিবর্তিত করতে হবে। কী ভালো না?” গানের দিকে ঘুরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

“ভীষণ ভালো”— বিবর্ণ গানে উত্তর দিলেন।

“এই সময়ে ওরা খুব নিরীহ হয়ে যাবে। আপনাদের ওদের আদেশ দিতে হবে।”

“না জানেন, এইরকম চাকর আমার দরকার নেই,”— হঠাৎ খুব নিশ্চিন্তভাবে গানে ঘোষণা করলেন। “এরা ভীষণ অদ্ভুত। পরে যদি এই চাকরেরা পাগল হয়ে যায় যেমন যান্ত্রিক ঝাঁটা হয়েছিল, তখন ওদের হাত থেকে মুক্তি পাব না।”

“সমস্ত সম্ভাবনা ভাবতে হবে”— মিচেল তাড়াতাড়ি বললেন। “আপনাকে শুধু বলতে হবে, ‘থামো’, আর ওদের কাজ থেমে যাবে।”

জানালার বাইরে লরিগুলো চলে যাবার শব্দ শোনা গেল। গানে খুব উদ্বিগ্নভাবে জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখো ওরা কোথায় যাচ্ছে। আমি এই যান্ত্রিক চাকর চাই না। লোকগুলো ওদের ফিরিয়ে নিয়ে যাক।”

“দেখুন, আমি যদি এত নিশ্চিন্ত না হতাম যে যান্ত্রিক চাকরগুলি আপনাকে সন্তুষ্ট করবে, তাহলে আমি ওদের অপেক্ষা করতে বলতাম। আপনি যদি না চান, এটা এখনও সংশোধন করা যায়।” জানালার দিকে অগ্রসর হয়ে মিচেল চিৎকার করে বললেন, “এই তোমরা ফিরে এসো।” কিন্তু লরিটা ইতিমধ্যে রাস্তার কোণে অদৃশ্য হল।

“শুনতে পেল না। চলে গেল। যাই হোক, কিছু ব্যাপার নেই। আমি কাল ওদের ডেকে আনব। যদিও আমি আশা করি, একদিনে আপনি এদের সঙ্গে এত অভ্যস্ত হয়ে যাবেন যে নিজেই আপনি ওদের ফেরত আনতে চাইবেন। আমি এখন বিদায় চাইছি। আপনি চিন্তা করবেন না। সব কিছু ভালো হবে।”

“কিন্তু এখন কী হবে?”

হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে মিচেল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। “কাল পর্যন্ত”— এই বলে উনি গাড়ির দিকে চলে গেলেন।

সিন্দুকের পাশে দাঁড়ানো ধাতুর মমিদের নিয়ে এডওয়ার্ড গানে ও যোহান চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

“কী ঝামেলা”— গানে চুপিচুপি বললেন। তিনি ভয় পেলেন যে গলার স্বরে যান্ত্রিক চাকরগুলি চলতে থাকবে। হাত দিয়ে ইশারা করে গানে পা টিপে টিপে বন্ধ দরজার দিকে গিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “খুলে যাও।” দরজা খুলে গেল। গানে ও যোহান আস্তে আস্তে স্টাডি থেকে শোবার ঘোরে গেলেন। দরজা ওদের পেছনে নিজেই বন্ধ হয়ে গেল। ওরা আরামের নিশ্বাস ফেলল।

“ওরা যেন এখানে না আসে”— সতর্কভাবে গানে নীচু স্বরে বললেন। মিলের চাকার মতো ঘোরা যান্ত্রিক হাতগুলোর কথা তিনি ভয়ের সঙ্গে স্মরণ করলেন— “সাংঘাতিক ব্যাপার।”

“যদি ওদের এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়”— যোহান মন্তব্য করল।

“কিন্তু কী করে?” বিক্ষুব্ধ চিত্তে গানে জিজ্ঞাসা করলেন।

“আমরা এইভাবে করব”— যোহান ভেবে বলল। “মিস্টার গানে, আপনি উপরে গিয়ে নিজেকে লক করে রাখবেন। উপরের ঘরগুলিতে কোনও ‘খুলে যাও’ নেই। পুরনো তালাটা খুব নির্ভরযোগ্য। আর আমি দরজা থেকে সরে জানালা থেকে এমন চিৎকার করব যে ওরা কোথাও চলে যাবে।”

“ঠিক আছে, তাই হবে”— সম্মত হলেন গানে। গানে উপরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন আর যোহান ঘর থেকে বেরিয়ে জানালা দিয়ে চিৎকার করল, “খুলে যাও”।

যখন স্টাডি থেকে শোবার ঘরের দরজা খুলে গেল যোহান দ্বিতীয়বার চিৎকার করল, “সামনের দিকে দশ পদক্ষেপ। মার্চ করে যাও। এখান থেকে চলে যাও।”

কিন্তু চাকরগুলি চুপ করে রইল। “এখান থেকে চলে যাও। চলে যাও।” চাকরগুলি আগের মতোই না নড়ে সিন্দুকের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। এই সময়ে দরজাগুলি বন্ধ হয়ে গেল এবং যোহান আবার পুনরাবৃত্তি করল, “খুলে যাও”। সে গলার স্বর পরিবর্তন করল এবং গলার সবরকম স্বরেই চিৎকার করল কিন্তু সকলই বৃথা। চাকরগুলি একইরকম রইল।

যোহান ওদের অনুরোধ করল। অনুনয়-বিনয় করল। অবশেষে ওদের ভর্ৎসনা করতে লাগল। কিন্তু ভর্ৎসনাতে স্টিল বিচলিত হয় না। চরম হতাশায় যোহান গানের দিকে ফিরে বলল, “ওরা যাচ্ছে না।” গানে আরাম চেয়ারে মাথা নীচু করে বসেছিলেন। তার এইরকম অনুভূতি হচ্ছিল যে ডাকাত তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে উপরের ঘরে বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু চাকরগুলির সঙ্গে কী ঘটছে?

গানে তাঁর কপালটা চাপড়ালেন। “এইগুলো খুব সহজ”— আনন্দিত চিত্তে তিনি বললেন। “ব্যাখ্যা করতে করতে মিচেল চাকরের উপস্থিতিতে বলেছিলেন, ‘থামো’। এই শব্দটা তাদের কার্যপ্রণালী অচল করে দিয়েছিল। মনে হচ্ছে ওরা সত্যি সত্যি আমাদের জন্য বিপজ্জনক নয়।”

নীচের তলায় নেমে তিনি নিজে নিজে শোবার ঘরে যেতে সাহস পেলেন। কিন্তু সন্ধ্যায় ঘুমোবার সময় তিনি যোহানকে বললেন বসার ঘর থেকে টেবিল, ডিভান এবং চেয়ার এনে স্টাডির দরজাটা ব্যারিকেড করতে। “এইভাবে শান্ত হবে”— বিছানায় শুয়ে বললেন। “আর যোহান, আজ তুমি আমার কাছে থাকো। এই ডিভানের উপর তুমি শুতে পারো।”

যোহান এই ব্যারিকেডের মধ্যে রাত কাটানো পছন্দ করল না। কিন্তু অভ্যাসবশত কোনও প্রতিবাদ না করে শুয়ে পড়ল।

 

দুঃস্বপ্নের রাত

যোহান এবং তার প্রভুর জীবনে এটা সবচেয়ে অশান্তির রাত ছিল। বৃদ্ধ দুজন ঘুমোতে পারল না। স্টাডিতে কিছু একটা শব্দতে তারা আশ্চর্য হয়ে গেল। উদ্বিগ্ন চিত্তে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন ওদের তাড়া করতে লাগল। স্টিলের লোকগুলি যেন ওদের ধরলে ওদের হাতগুলি লোহার হয়ে গেল।

ভোর হওয়ার কিছু আগে যোহান ঘুমন্ত প্রভুকে জাগাল— “মিস্টার গানে, মিস্টার গানে, স্টাডিতে কোনও একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।”

গানে উঠে বিছানা থেকে নেমে শুনলেন। না এটা শোনবার ভুল নয়। স্টাডি থেকে সত্যিসত্যিই নানারকমের শব্দ আসছে। কার্পেটের সঙ্গে ধাতুর জিনিসের আঘাত ও তারপর হিসহিস শব্দ শোনা গেল।

“জীবন্ত হয়ে গেছে”— ভয়ে যোহান চুপিচুপি বলল। তার দাঁতে দাঁত লেগে গেছে আর হাতগুলি এত কাঁপছিল যে সে পোষাক খুলতে পারল না।

ভয়ে ঠান্ডা হয়ে বৃদ্ধ দুজন কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে রইল। তাদের নড়াচড়ার কোনও শক্তি ছিল না। পড়ার ঘরে শব্দ বেড়ে চলেছে, কোনও কিছু জোরে শব্দ করে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। তাদের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। গানে হঠাৎ দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন এবং ভীত স্বরে চিৎকার করে বললেন, “খুলে যাও”।

কিন্তু দরজা খুলল না।

“খুলে যাও”— যোহান প্রতিধ্বনি করল। তাঁদের বৃদ্ধ গলা থেকে সবরকম মানবিক স্বর বের করবার জন্য তাঁরা গর্জন করলেন ও চিৎকার করলেন যাতে কোনওভাবে যান্ত্রিক দরজাকে জাগানো যায়। কিন্তু সবই বৃথা গেল। ‘হাজার এক রাত্রি’র ভয়ঙ্কর গল্প সত্যি বলে মনে হচ্ছিল। তাদের মনে হল যে পড়ার ঘরের দরজাগুলো কারও শরীরের চাপে নড়ছে। এক মিনিটের মধ্যেই সেখান থেকে চল্লিশ জন ডাকাত বেরিয়ে এসে তাদের বৃদ্ধ শরীরকে ছিন্নভিন্ন করবে। পরে যোহান শুনল— বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া জিপসির উচ্চ ডাক। তারপর সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে গেল। যোহান ও তার প্রভু জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

তারা যখন জ্ঞান ফিরে পেল তখন সকাল হয়েছে। আনন্দের সঙ্গে তারা নিশ্চিন্ত হল যে, তারা সুস্থ ও নিরাপদ আছে। পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ আছে এবং চেয়ার টেবিল ও ডিভানের ব্যারিকেড ভাঙা নয়। যোহান বসার ঘরের দরজার হাতলে চাপ দিতে দরজা খুলে গেল। তারা মুক্ত হল। মালি আর রাঁধুনিকে যোহান জাগিয়ে দিল। কিন্তু তাদের কেউ পড়ার ঘরে ঢুকতে চাইল না। “পুলিশকে ডাকো”— গানে বললেন। বাইরের ঘরে গিয়ে মালি কাছের পুলিশ স্টেশনকে জানাল। আধঘণ্টার মধ্যেই মোটর সাইকেলের শব্দ শোনা গেল।

গানে কিন্তু এইসময় যান্ত্রিক উন্নতির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করলেন না। মোটর সাইকেলের অপ্রিয় শব্দ তাঁর কাছে স্বর্গীয় সঙ্গীতের মতো মনে হল।

পুলিশের উপস্থিতিতে গানে একটু সাহস পেলেন। পড়ার ঘরে ঢুকে তিনি সামনের চাকরগুলিকে যেন মৃত মনে করে আবেগভরে বললেন, “আমি ওদের প্রতি ঠিক ব্যবহার করিনি। আমি ওদের ভয় পেয়েছি। আর ওরা ওদের জায়গায় থেকে আমার সম্পত্তি শত্রুদের থেকে রক্ষা করেছে। দুষ্ট লোকেরা জানালা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে।”

পুলিশ পড়ার ঘরের দরজা খুলে ফেলল। মেঝের উপর কেউ যান্ত্রিক চাকরগুলিকে ছুঁড়ে ফেলেছে। সিন্দুকের দরজাগুলি খোলা। মূল্যবান সব কিছু হারিয়ে গিয়েছে।

ফলে গানেকে স্বল্পক্ষণের জন্যই তাঁর বিশ্বস্ত চাকরদের জন্য শোক করতে হল। পুলিশ খুব আনন্দের সঙ্গে দেখল যে এই যান্ত্রিক চাকরগুলির শুধু খোলসটাই রয়েছে।

গানের কাছে সব স্পষ্ট হয়ে গেল। মিচেল তাঁর সাথে একটা নোংরা খেলা খেলেছে। যান্ত্রিক চাকরের ছদ্মবেশে সে নিজের দক্ষতা ধাতুর কেসে রেখেছে। ডাকাতরা এই ধাতুর কেস থেকে বেরিয়ে সিন্দুক ভেঙেছে, মূল্যবান জিনিসগুলো চুরি করেছে, এবং জানালা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। এইজন্যই মিচেল কুকুরকে এত ভয় পেত।

“মি. গানে, ভেস্তিনগাউজ কোম্পানির এজেন্ট আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান”— পড়ার ঘরের দিকে তাকিয়ে যোহান বলল।

“কী ব্যাপার মিচেল? আসুন, আসুন।”

পুলিশের দিকে তাকিয়ে গানে তাড়াতাড়ি বললেন, “এই ডাকাতকে গ্রেপ্তার করুন।”

পুলিশ এবং গানে বসার ঘরে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন, সেখানে একটি যুবক কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে হতবুদ্ধিভাবে পুলিশের দিকে তাকিয়ে গানেকে সম্মান দেখিয়ে বলল, “মি. গানে, আপনাকে ধন্যবাদ। যান্ত্রিক চাকর স্থাপন করবার খরচ আপনার কাছ থেকে জেনে যেতে এসেছি।”

“যান্ত্রিক চাকরগুলির খরচ?” গানে গর্জন করে উঠলেন। “বরং মাকড়সা আমার মাথায় পড়ুক আর ইঁদুর আমার পোশাকে ঘুরে বেড়াক। আপনি মিচেল এবং এই যান্ত্রিক চাকরগুলির দ্বারা আমাকে ডাকাতি করেছেন। এই লোকটাকে গ্রেপ্তার করুন।”

“আমি মিচেলকে জানি না। একটা কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আপনার স্টুয়ার্ড আমাদের ঝাঁটা, পাখা, চিচিং ফাঁক দিতে বলেছিল। আপনি অর্ডার দিয়েছেন এবং দস্তখত করেছেন। এটা হল বিল।”

“এত টাকার?”— গানে দুশ্চিন্তা করতে লাগলেন। “হে যুবক ডাকাত, এখানে আসুন।”

অনুসরণ করতে বলে গানে ছেলেটিকে নিয়ে পড়ার ঘরে ঢুকলেন এবং তাকে পড়ে থাকা চাকরগুলিকে দেখালেন।

ভেস্তিনগাউজ-এর এজেন্ট ওদের দেখে ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “আমাদের ফার্ম এইরকম পুতুল তৈরি করে না।”

গানের রাগ বাড়তেই থাকল কিন্তু এইসময় পুলিশ অফিসার বাধা দিলেন। তিনি ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে বিলটা দেখলেন ও জিনিসগুলো পরীক্ষা করে বললেন, “মি. গানে, আমার মনে হয় এই ছেলেটা এই দুষ্টচক্রের সঙ্গে যুক্ত নয়। আমরা এটা অনুসন্ধান করব। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে মিচেল আপনার নামে ভেস্তিনগাউজকে শুধু ঝাঁটা, পাখা আর চিচিং ফাঁকের অর্ডার দিয়েছে। এইসব চাকরদের কেস সে নিজেই তৈরি করেছে এবং আপনার বাড়িতে নিয়ে এসেছে তার দুষ্কর্মের সহায়ক হিসেবে। এটার মূল্য অবশ্যই তাকে দিতে হবে কিন্তু বিলের টাকা আপনাকে দিতে হবে। সিন্দুকে আপনার কত টাকা ছিল?”

“সমস্ত মূল্যবান জিনিস মিলিয়ে হাজার ডলারের মতো।”

“দেখা যাচ্ছে এটা বেশ বড় টাকা। সম্ভবত দুষ্কৃতীরা তাদের নিজেদের গাড়িতে পালিয়ে গিয়েছে। কোনও কিছু তাদের তাড়াতাড়ি যেতে বাধ্য করেছে।”

“কুকুরটা ডাকছিল”— যোহান বলে উঠল।

“কিন্তু এই ষড়যন্ত্রে চিচিং ফাঁকেরও অংশ আছে”— গানে বলতেই লাগলেন। “কেন ডাকাতির সময় দরজাগুলো খুলল না?”

“হয়তো ভয়ে আপনি একটু বেশি জোরে চিৎকার করেছেন ‘চিচিং ফাঁক’, আর তাতেই ওদের কাজ বন্ধ হয়েছে”— এজেন্টটি বলল। “আমাদের যন্ত্রগুলি ক্ষমতা ও গলার উঁচু স্বরে কাজ করে না।”

গানে স্বীকার করলেন না, এই ব্যাখ্যাটা সত্যি। তিনি চিৎকার করেননি বরং গর্জন করেছেন।

“মি. স্টলপ,” পুলিশ অফিসার যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করছি না কিন্তু তাহলেও আপনাকে আমি অনুরোধ করছি আমার সঙ্গে যেতে। এই সমস্ত ঘটনা পরিষ্কারভাবে জানা প্রয়োজন।”

পুলিশ অফিসার ধাতুর চাকরগুলিকেও প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে সংগ্রহ করে এজেন্টকে নিয়ে চলে গেলেন। এডওয়ার্ড গানে তার নিজের চাকরের সঙ্গে রইলেন।

গানে ক্লান্তভাবে বললেন, “আমি এখনও কফি খাইনি।”

“এক মিনিট মহাশয়”— যোহান বুফের দিকে গেল।

রাত্রির এইসব অশান্তিতে যোহানের হাতগুলো স্বাভাবিকের চাইতে বেশি কাঁপতে লাগল এবং বিস্কুটের পাত্রটা ফেলে দিল।

“যোহান ভেবো না। এইরকম ঘটনা প্রত্যেকের সঙ্গেই হতে পারে”— গানে দয়ালুভাবে বললেন। ধূমায়মান কফি পান করতে করতে তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, “যোহান, চিচিং ফাঁক, পাখা আর যান্ত্রিক ঝাঁটা আমরা রাখতে পারি। এগুলি উপকারী আবিষ্কার। এরা তোমার পরিশ্রমকে কমিয়ে দিচ্ছে। আমার মতে, ভেস্তিনগাউজের এই সত্যি সত্যি যান্ত্রিক চাকরগুলির একটা ক্ষমতা নেই— ওরা ঘেউ ঘেউ শব্দ এবং উঁচু স্বরে আদেশ সহ্য করে না। কিন্তু কী আর করা যাবে। যুগ এখন এইরকমই।”

 

সমাপ্ত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to Sumita sarkar Cancel reply