কোর্ট মার্শাল

কোর্ট মার্শাল | প্রতিভা সরকার

প্রতিভা সরকার

 

বছর চার পাঁচ বয়সের কথা যে কারও এত স্পষ্ট মনে থাকতে পারে, নিজের ব্যাপার না হলে বিশ্বাস করতাম না।

ঘুম থেকে উঠেই রোজ ঘ্যানর ঘ্যানর করতাম, আমার খিদে পেয়েছে।

মা কাজ করতে করতেই উত্তর দিত—

আরে দাঁত তো মেজে নে। পেটে কি রাক্ষস?

কখনও গোয়ালঘরের দিক থেকে, কখনও পুকুরের ছোট ছোট ঢেউয়ের ছলাত শব্দ ভেদ করে আসা মায়ের গলাটা শুনতে পেলেই আমি তড়াক করে খাট থেকে নেমে কুয়োতলার দিকে হাঁটা দিতাম। তারপর কচুপাতার ওপর পাছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলা পেচ্ছাপের ফোঁটা কতক্ষণ থাকে দেখা শেষ না হতেই মা কুয়োর বালতি থেকে কাঁসার ঘটিতে জল ঢেলে দিত, নরম করে ডাকত—

আয় বাবা, পুচু ছেলে আমার, এই যে ব্রাশ রাখলাম পেস্ট ভরিয়ে।

 

সেদিন সব শুনশান! কতবার খিদের কথা জানান দিলাম, সারা বাড়ি চুপ করে রইল। মা মা করে কত কাঁদলাম, তেজপাতা গাছের ডাল থেকে গন্ধমাখা সড়াৎ হাওয়া এসে চুল ঘেঁটে দিয়ে গেল, কিন্তু মায়ের হাতের মতো অত নরম কিছু তো নয়। আমি আশ্চর্য, বিরক্ত আর অসহায় হতে হতে, ঘ্যানঘেনে কান্না গলায় নিয়েই মাকে খুঁজতে বেরোলাম। তাড়সে আমার হিসু বন্ধ হয়ে গেল।

–মা

আমার গলা রাগে কাঁপছিল, যেন তার রোজ সকালের একমাত্র কর্তব্য আমার ব্রাশে পেস্ট ভরিয়ে দেওয়া, সেইটে না করে অন্য কাজ করার স্পর্ধা মায়ের হয় কী করে!

কিন্তু সারা গায়ে ঘুঁটে মাখা কাঁঠাল গাছের বেড় পেরোতেই চোখের সঙ্গে নাকের জল মিশে হাঁ মুখে বেজায় নোনতা স্বাদ ঢুকতে থাকল। এখন আমার কান্নায় মনখারাপ আর ভয়। মা আসছে না কেন, এত বড় বাড়িতে তাকে আমি কোথায় খুঁজব!

ভাড়াটেদের ভিটে ছাড়িয়ে খুচরো কাঠ, ভাঙা ফার্নিচার, ফালতু জিনিস রাখবার ছোট অন্ধকার ঘরটার দিকে যখন যাচ্ছিলাম, মিত্র কাকিমা হেসে বলল—

এই এত বড় ছেলে মা মা করে কাঁদে নাকি! পায়খানায় দেখেছিস দরজা বন্ধ কিনা? নাহলে পুকুরে নেমেছে হয়তো স্নান করবে বলে।

আমি তো দেখে এসেছি পায়খানার দরজা হাট করে খোলা। আর সারাক্ষণ এত জোরে চিৎকার করেছি, মা সাতখানা ঢেউয়ের নীচে থাকলেও শুনতে পেত। বাঁ হাতে হাফপ্যান্ট ধরে ডান হাতে লম্বা করে নাক মুছি। পুরো কব্জি থেকে কনুই অব্দি ভিজে যায়। মা নিশ্চয় আমাকে ভয় দেখাবে বলে এইখানে লুকিয়ে আছে।

–মা

অবাধ্য ঘোড়ার মতো পা ঠুকি। একটা পাল্লা পুরো ভেজানো, আর একটা একটু খোলা। প্রথমেই ভেতরের অন্ধকারে ঢুকতে আমার ভয় করে। মা যেসব দানোর গল্প বলে তাদের প্রত্যেকটাকে আমি কখনও না কখনও এই দরজার ফাঁকে উঁকি দিতে দেখেছি। তাদের কারও মাথায় সবুজ শিং, কারও কষের দুপাশে লম্বা সাদা সরু দাঁত। কাঁচা আম ছিলবার ছোট ছুরিটার মতো। একা সেখানে সুরুৎ করে ঢুকে যাওয়া কী চাট্টিখানি কথা!

আমি নারকেল গাছের তলা থেকে মরা নারকেল বাচ্চাদের কুড়িয়ে নিই। বাঁ হাতে দুটোই আঁটে, কারণ প্যান্টের কোমর মুঠোর অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। তারপর ঐ সরু ফাঁক দিয়ে ডানহাতেরটাকে ছুঁড়ে দিই অন্ধকারের ভেতরে। ঠুং করে একটা শব্দ হয়। পুরনো বালতি টালতিতে লেগেছে হয়তো সেটা। রাগে এবার বাঁহাতের দুটোই ডানহাতে চালান করি। যত শক্তি ছিল সব দিয়ে ছুঁড়ে দিই। চিৎকার করি, মা আ আ!

এই তো গতকাল মা আর আমি কড়াইশুঁটির খেতের ভেতর দিয়ে ভানুমামার বাড়ি যাচ্ছিলাম। সরু পাকানো আঁকশিগুলো আমাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল বলে আমি রেগে গিয়ে কচিমতো একটা ছাড়িয়ে মুখে চালান করে দিলাম। অমনি মা হাঁ হাঁ করে উঠল—

তুলিস না তুলিস না। যাদের খেত তারা দেখতে পেলে বকবে।

আমি জানি এসব মায়ের বাড়াবাড়ি। ঠাকুমার পাঠানো কাসুন্দির বোতল নাকি বাসি জামাকাপড়ে ছুঁলে পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাবে। হাত ভালো করে ধুয়ে ন্যাংটো হয়ে তবে ঢেলে নিতে হবে আমাকে। চিনের সঙ্গে নাকি যুদ্ধ চলছে, তাই লণ্ঠনের কাচে যত্ন করে ভুসো কালি মাখায় মা, শত অনুরোধেও একটুও ফাঁকা রাখে না। ওই ভুতুড়ে না-আলোয় আমার গা আরও ছমছম করে। রোজ আলনা যত্ন করে গুছোবে, আমি টান মেরে গেঞ্জি বার করে নিলেই কটমট করে তাকাবে আমার দিকে।

মেজাজ ভালো থাকলে বাবা ঠিকই বলে, তোর মায়ের সবেতেই বাড়াবাড়ি।

 

তা বাবার মেজাজ আর ভালো থাকে কোথায়। বাজারের ভেতরে কাঠ চেরাইয়ের দোকানেই সে বেশিক্ষণ থাকে। কোনও কোনওদিন রাতেও। কর্মচারীরাও তাকে যমের মতো ডরায়। মা আর আমিও। চশমার পেছনে রাগী চোখদুটো শুধু ভয় উগরে দেয় মনে। ঐ চোখ দিয়ে বাবা কেঁদেছে বা হেসেছে কখনও, এরকমটা আমার এখনও বিশ্বাস হয় না।

বরং আমলাপাড়ায় নিজের বাবার বাড়িতে আমাকে নিয়ে এক দুদিন থাকতে পেলে মায়ের উদাস চোখদুটো কী হাসি হাসি হয়ে উঠত। কপালের ওপর গোল্লা পাকানো এক টুকরো কোঁকড়া চুলের গুছি খুব খুশি হয়ে দোল খেত। মা দিদার সঙ্গে কলকল করে গল্প করত। আমি কান পেতে থেকে জেনে যেতাম অনেক অজানা কথা।

অনেক দূরের সীমান্তে চিন নামে এক বিশাল দুষ্টু  দেশের সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে। চিনে ড্রাগন পাওয়া যায়, মা-ই হয়তো বলেছিল আমায়। পরিষ্কার যেন দেখতে পেতাম হিমালয় পর্বত পেরিয়ে জয়ন্তী নদীর পাথুরে খাতের ওপর দিয়ে নেমে আসছে এক হিলহিলে লম্বা গলা। তার দুপাশে নিষ্ঠুর দুটো চোখ, খাঁজকাটা ঘাড়, আঁকাবাঁকা শরীর আর নাক দিয়ে ছুটে বেরোচ্ছে তুবড়ির মতো আগুন। রাতে সাইরেন বাজলে মনে হত বিশাল সাপের মতো জন্তুটা ছুটোছুটি করছে আতা গাছ ছাওয়া প্রান্তরে, যা পেরিয়ে বাবা রোজ বাজারে কাঠের দোকানে যায়। আমি বাবাকে বলতে চাইতাম, বাবা আজ গিয়ে কাজ নেই, থাকো; কিন্তু ভয়ে মুখে কথা ফুটত না। দেখতাম মা দরজায় হেলান দিয়ে বাবার যাওয়া দেখছে, বিড়বিড় করে কিছু বলছে, আর থেকে থেকে কপালে হাত ছোঁয়াচ্ছে।

গতকাল আমলাপাড়ায় গিয়েই মা দিদাকে বলল—

মামণি, ভানুদা নাকি ফিরে এসেছে?

দিদা ঠোঁটে আঙুল তুলে জোরে মাথা নাড়ল—

চুপ চুপ, দেওয়ালেরও কান আছে।

এরপর ওরা দুজন ফিসিরফিসির করে কত কী বলাবলি করল, শুনব যে এমন সময় আমার ছিল না, মামাতো দাদা হাতে নতুন বল নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

বিকেলে কড়াইশুঁটির সাদাটে সবুজ খেতের ভেতর দিয়ে ভানুমামার কাছে যাবার সময় এমন আহ্লাদ হল, মাকে ফেলেই খানিক ছুটে গেলাম সামনে। হঠাত দুটো ঘেমো গন্ধমাখা তাগড়াই হাত আমাকে লুফে নিল, মাকে জিজ্ঞাসা করল—

মিঠু, তোর ছেলে, না? এত বড় হয়ে গেল! নাম কী রে তোর?

মা তড়িঘড়ি আঁচলের তলা থেকে একটা টিফিনবাটি বার করে দিল—

চালতামাখা ভানুদা। তুমি ভালবাসতে, তাই মা পাঠিয়েছে।

আমি নিজে দেখেছি মা সাদা চালতার টুকরো জলে ভিজিয়ে রেখে সেগুলো শিলনোড়ায় থেঁতো করেছে। তারপর গুঁড়ো মশলা মাখিয়ে নুন চিনি দিয়ে টিফিন বাটিতে ভরেছে। পাঠাবার বেলা কেন দিদা পাঠাল এই ভেবে অবাক হলাম আমি।

–ভালবাসতাম কিরে! এখনও বাসি। আগের মতোই আছি তো।

আমি জোয়ান লোকটাকে খুব খুঁটিয়ে নজর করছিলাম। কোঁকড়া চুল মাথাভর্তি, নাকের ডগাটা কেমন একটু বাঁকা। কড়াইশুঁটির ঘন আঁকশিগুলো একহাতে সরিয়ে বড় বড় পা ফেলে হাঁটছে, আর একহাতে আমাকে লটকে রেখেছে চওড়া বুকের সঙ্গে। এ হল সৈনিক, ফ্রন্টে যে লড়াই করে। কাল রাতে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মা দিদার সঙ্গে টুকটাক কথা চালাচালি করছিল। তাইতে জেনেছি।

সৈনিক তো এখানে কেন, সবাই যে বলছে তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে অসমের কাছাকাছি, এর তো তাহলে সেখানেই থাকবার কথা। ভাবতে ভাবতেই লোকটার চোখে চোখ পড়ল আমার। বড় বড় শান্ত চোখ। আনন্দ আর সান্ত্বনায় ভরা। যেন জন্মে কখনও গোলাগুলি দেখেনি। আমি এমন সেপাইয়ের কাছে একটা খেলনা বন্দুকের আবদার করলে মা বকবে কিনা ভাবতে ভাবতেই ভানুমামা আকুল হয়ে বলল—

ওই যুদ্ধফুদ্ধের কথা আর শুধোসনি মিঠু। অসহ্য। একতরফা কচুকাটা করছে আমাদেরকে। আমার পাশেই যেদিন শঙ্করের মাথা উড়ে গেল গোলায়, আমি বুকে হেঁটে নদী পার হয়ে পালিয়ে এসেছি।

মা মাথা নীচু করে আলে বসে পড়ল, টেনে টেনে বলল—

–তোমাকে ধরতে পারলে ওরা…
–কোর্ট মার্শালের পর গুলি করে মারবে।

ভানুমামা এমন আচমকা কথাগুলো বললো যে ওর বুকের ভেতরে আমি কেঁপে উঠলাম। মায়ের পাশে বসে পড়েও সে আমায় কোল থেকে নামায়নি।

মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখে আঁচল-চাপা। এই বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ঠান্ডা বাতাসে হাজার কড়াইশুঁটি মাথা নাড়িয়ে ঐ নিষ্ঠুর কথায় সায় দিচ্ছে দেখে আমিও ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে কোল বদল করলাম। মেরে ফেলা, মরে যাওয়া খুব বাজে জিনিস, আমি জানি।

ওরা দুজনেই আমাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বুকে পিঠে থাবড়া দিয়ে, চুমাটুমা খেয়ে সে এক একাকার কাণ্ড। আমাকে থামাবার জন্য মামা হাসতে হাসতে বলল—

আরে আমায় ধরতে পারলে তো। পরশু থানা থেকে এসেছিল গভীর রাতে ওয়ারেন্ট নিয়ে। আগেই টের পেয়ে এই খেতের ভেতর শুয়ে ছিলাম সারারাত। আজই চলে যাব পটাশপুর। সেখান থেকে অন্য কোথাও।

মায়ের মুখ দেখে মনে হল না খুব একটা আশ্বস্ত হয়েছে। ভানুমামা ফেরার পথে কী কী দেখেছে সেসবও বলল সবিস্তারে। তেজপুর বলে একটা জায়গায় নাকি সব বাড়িতে তালা বন্ধ করে লোকেরা ব্রহ্মপুত্র নদের এপারে চলে এসেছে। ফাঁকা রাস্তায় শুধু কুকুর বেড়াল কেঁদে বেড়াচ্ছে। সবাই চলে যাবার আগে তেজপুর ট্রেজারির টাকা কাগজ সব রাস্তায় কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে শত্রুসৈন্যের হাতে সেগুলো না পড়ে। ফাঁকা একটা শহরে শুধু জানোয়ারের কান্না আর অলিতে গলিতে উড়ে বেড়াচ্ছে কালো ছাই, এই ছবিটা মাথায় বসে গেল আমার।

কিছুক্ষণ বাদে টিফিনবাটিটা ফেরত নিয়ে মা বলল—

–যাই গো ভানুদা। বেশিক্ষণ তো থাকা যাবে না। তোমারও লুকিয়ে থাকা, আর আমার কথা তো শুনেছ নিশ্চয়ই।
–হ্যাঁ, মা বলছিল, তোর বর খুব…। মানিয়ে নে, মানিয়ে নে, মিঠু, আমরা কেউই যা চাই তা পাই না। নাহলে তোর ইচ্ছের কথা আমি জানি, আমারটাও তুই।

শুনতে শুনতে আমার কান খরগোশের মতো টান টান হয়ে গেল। এইজন্য আসবার আগে মা বলছিল, ভানুদার সঙ্গে যে দেখা করতে যাচ্ছি বাবাকে বলিস না যেন বোকার মতো।

বলিনি তো। তবু বাবা কী করে সব জেনে ফেলে! আমরা সন্ধেয় ফিরে এলে বিশ্রী হেসে মাকে জিজ্ঞাসা করল—

কী তুমি নাকি ভানুর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলে? শালা কাপুরুষ। ডেসার্টার। ওকে সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া উচিত।

মা তাড়াহুড়ো করে লক্ষ্মীপুজোয় বসেছিল সবে। পিদিমের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম মায়ের ছাই হয়ে যাওয়া মুখের চঞ্চল চোখগুলো আমার চোখ ছুঁয়ে গেল। যেন মা বলতে চাইল, পুচু তোকে বারণ করেছিলাম যে!

তারপর কী হয়েছিল আর জানি না। এত হাঁটাহাঁটিতে সন্ধে থেকেই বেজায় ঘুম পেয়ে গেছিল। মা উঠিয়ে খাইয়ে দিয়েছিল কিনা তাও মনে নেই।

সকালে উঠেই মাকে অমন গরুখোঁজা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। ঢিলের পর ঢিল খেয়ে অন্ধকার ঘরটার দরজা আর একটু ফাঁকা হলে অনেক কষ্টে প্রথমেই যা দেখলাম তা হল একটা কাঠের টুলের ওপর পাশাপাশি দুটো পা। চোখ সয়ে এলে দেখলাম বুড়ো আঙুলের পাশের আঙুলগুলোয় রূপোর আঙটি পরা। উঠে যাওয়া আলতার অস্পষ্ট ছোপ লেগে আছে গোড়ালিতে। পরিষ্কারই দেখলাম, কারণ ততক্ষণে আমি আবিষ্কারের উত্তেজনায় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েছি। যত চোখ তুলছিলাম তত দেখছিলাম মায়ের ছাপা শাড়ির পাড়, কুঁচি, বেড় দেওয়া আঁচলে থোকা থোকা ছাপা গোলাপ, লাল ব্লাউজ আর গলার ওপর একটা কিসের ছায়া। সেদিকে নজর না দিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম, কোটরে ঢোকা শূন্য চোখ, যেন দৃষ্টি নেই, শূন্যতার মধ্য দিয়ে শূন্যতাই দেখছে। আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমাকে ভেদ করে কোথায় চলে গেল সেই চাহনি কে জানে। শুধু ডানহাতের আঙুলগুলি নেড়ে আমায় বলল—

–যাঃ পালা।
–কোথায় যাব মা?

আমি বুজে আসা গলায় অতি কষ্টে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম। এই সম্পূর্ণ অচেনা মা একটা অদ্ভুত অচেনা ঘরঘরে গলায় আমার দিকে না তাকিয়েই বলল—

বাবার কাছে যা পুচু।

ঠিক তখুনি আমার নজর গেল তার গলার গাঢ় ছায়াটির দিকে, কুয়োর বালতির জন্য কেনা নতুন দড়িটা মা গলায় বেড় দিয়ে আলগা মালার মতো পরে নিয়েছে, আর দড়ির আর এক প্রান্ত ঝুলছে কড়িবর্গা থেকে। এবার একটু টানলেই…।

দেখেই আমার বুকের ভেতর কী যেন লাফিয়ে গলায় চলে এল! আমি গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছিলাম না না এইরকম কিছু বলে। ছিটকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে যে রাস্তায় এসেছিলাম সেটাতেই ফের দৌড় লাগালাম। জানতাম আমাকে সাহায্য জোগাড় করতে হবে, এমন সাহায্য যা মাকে নামিয়ে আনবে কড়িবর্গার কাছ থেকে, ঐ মালাটা এঁটে বসবার আগেই। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমি মিত্রকাকিমাকে ডাকিনি। অন্য কাউকেও না। শুধু দৌড়োচ্ছিলাম আর মাঠ পার হতে হতে ভাবছিলাম আমি হয়তো বাবাকে ডাকতে বাজারের কাঠের দোকানে যাচ্ছি। কিন্তু যখন প্রচণ্ড তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল, নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই কড়াইশুঁটির খেতে, যেখানে আমরা তিনজন বসে চালতামাখা খেয়েছিলাম সেইখানে। হঠাত একটা ঢেলায় পা বেঁধে আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।

পরে আমি ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমার পা দুটো নিজের অজান্তেই আমাকে ভানুমামার কাছে নিয়ে যাচ্ছিল বোধহয়, ভুলেই গেছিলাম সে চলে গেছে পটাশপুর না কোথায় যেন!

সে যাই হোক, কাউকে না বললেও আজও আমার দৃঢ় ধারণা, আমার মা ইন্দো-চায়না যুদ্ধের বলি এবং তার কোর্ট মার্শাল হয়েছিল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. অসম্ভব ভাল লেখা। পড়ে মাথা ঝিমঝিম করছে। খুব মায়াবী গদ্য। ভালবাসা রইল।

  2. সন্তানের চোখে মায়ের আত্মহত্যার মুহূর্তটিতে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের দোলনা মনে পড়ল অবধারিত – সেখানে বাবা আর ছেলে, গল্পটিও একেবারেই আলাদা-তবু মনে পড়তে বাধ্য। কাকতালীয়বৎ একটি সাম্প্রতিক গল্প পড়ছিলাম পত্রিকায়-্সেখানে মেয়ে ও মা র একটি মুহূর্ত ছিল, মা যার পর আত্মহত্যা করবে-সে গল্পও ভিন্ন। সন্দীপনের গল্পের সেই মুহূর্ত ভুলবার নয়- ‘বাবা তুমি গলায় দড়ি দিচ্ছ?’

    কোর্ট মার্শাল গল্পের ভরকেন্দ্র সম্ভবত শেষ লাইন যা মনে থেকে যাবে আমার মত অসংখ্য পাঠকের।

Leave a Reply to ইন্দ্রাণী দত্ত Cancel reply