রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান

নাদীম পারাচা

 

 

নাদীম পারাচা পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকার বিশেষ কলমলেখক ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সমালোচক। পাকিস্তানের সমাজেতিহাসের ওপর দুটি গ্রন্থের প্রণেতা – End of the Past এবং The Pakistan Anti-Hero.

 

 

‘রাজনৈতিক ইসলাম’ – এই শব্দবন্ধ একটা কেতাবি খিচুড়ি বই কিছু নয়। মোটের ওপর এটা হল একটা আলোচনার ছাতা, যার নীচে রাজনীতির বিশ্লেষকেরা এমন নানাবিধ রাজনৈতিক প্রবণতাকে একজোট করেন যা আধুনিক রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিল করবার লক্ষ্যে মুসলিম ধর্মশাস্ত্র ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে আপাতভাবে মেনে চলে।

এই শব্দবন্ধের উৎপত্তি সম্ভবত বিংশ শতকের চল্লিশের দশকে, ইয়োরোপে। এর লক্ষ্য ছিল ইসলামী ঝোঁক আছে এমন উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনগুলোকে সংজ্ঞায়িত করা। ১৯২৭ সালে তৈরী হওয়া ঈজিপ্টের মুসলিম ব্রাদারহুডকে এই সংজ্ঞায়নের প্রথম প্রকট অভিব্যক্তি বলে ধরে নেওয়া হয়।

একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক প্রবণতা স্বত্ত্বেও রাজনৈতিক ইসলাম বহুবিধ মুসলিম সম্প্রদায়, উপদল, জাতিসত্তার আন্দোলন, বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী অভিধা এবং ন্যারেটিভের প্রশস্ত পরিসরে বিচরণ করে। আলোচকেরা এই বহুধাবিভক্ত আন্দোলনের মধ্যেকার মিলটুকু নিয়ে একটা একক মতাদর্শিক সত্তা হিসাবে তার অধ্যয়ন করেন।

রাজনৈতিক ইসলামের একটা বামপন্থী ও আরেকটা দক্ষিণপন্থী দিক রয়েছে।

ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত, রাজনৈতিক ইসলামের সম্পূর্ণ দক্ষিণবাদী আন্দোলনগুলোকে অনেকটা বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনা হিসাবে দেখা হত। এর রাজনৈতিক প্রভাবও ছিল সীমিত।

রাজনৈতিক ইসলামের মূল বিষয়গুলো যেসব আন্দোলন বা দলে গৃহীত হয়েছিল, বা যারা এর সঙ্গে কিছুটা বামপন্থী আদর্শকে মিলিয়ে একটা নতুনতর পথের কথা ভাবছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেই দক্ষিণবাদীদের কার্যক্রমকে সন্দেহের চোখে দেখতেন।

সুতরাং, এ-কথা বলা যেতেই পারে, যে কোল্ড ওয়রের (১৯৪৯–১৯৯০) সময়কালে অধিকাংশ মুসলিম দেশের ভেতরের রাজনৈতিক লড়াই ‘ইসলামিস্ট’ বনাম ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মীয় দল বনাম কম্যুনিস্ট-– এমনধারা ছিল না। আসল লড়াইটা ছিল দক্ষিণবাদী ইসলামীদের সঙ্গে বামবাদী ইসলামীদের।

দক্ষিণবাদীদের প্রবণতা যেমন ‘ইসলামী মৌলবাদ’, ‘ইসলামবাদ’ আর ‘নব্য–মৌলবাদ’-এর দিকে, বামবাদীদের ধারা তেমনি ‘ইসলামী সমাজবাদ’, ‘বা’আথ সমাজবাদ’ আর ‘আরব জাতীয়তাবাদ’ বা ‘আরব সমাজবাদ’-এর দিকে। এঁদের সকলের মোটামুটি কেন্দ্রে অবস্থান করে মুসলিম জাতীয়তাবাদ।

কোল্ড ওয়রের সময় পশ্চিমী শক্তি আর তেলসমৃদ্ধ আরব রাজতন্ত্রগুলো এই দক্ষিণবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে। কারণ, বামবাদীরা স্বাভাবিকভাবেই সরে গিয়েছিলেন ‘সোবিয়েত ক্যাম্প’-এর দিকে।

দক্ষিণবাদীরা এতকাল রাজনৈতিক ইসলামের বাম অংশ থেকে আসা মুসলিম শাসকদের দ্বারা যারপরনাই অবদমিত ছিল। কিন্তু এতদিনেও দক্ষিণপন্থী শক্তি উল্লেখযোগ্য কোনও জনসমর্থন পায়নি।

সত্তরের দশক থেকে চিত্র পরিবর্তনের সূত্রপাত। ১৯৭০ সালে ঈজিপ্টের জনপ্রিয় নেতা এবং ‘আরব সোশালিস্ট’ গামাল আবদুল নাসেরের মৃত্যুর পর থেকে দক্ষিণপন্থী ইসলামবাদীদের পালে হাওয়া লাগল বলা যায়।

পরবর্তীকালে, আশির দশকে আফঘানিস্তানে অ্যামেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের প্ররোচনা ও সমর্থনে সোবিয়েত-বিরোধী ‘জিহাদ’ রাজনৈতিক ইসলামের বাম ছেড়ে দক্ষিণের দিকে ঝুঁকে পড়ায় অনুঘটকের কাজ করে।

‘আফঘান জিহাদ’ দক্ষিণপন্থী ভাবধারায় রণলিপ্সার বিষয়টা যোগ করল। সমস্যা শিখরে ওঠে আশির দশকের শেষের দিকে। আফঘান বিবাদ চূড়ান্ত হয় ও সোবিয়েত সৈন্য আফঘানিস্তান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়।

নব্বই দশকের গোড়ার দিকে নিজেদের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধবাজ দক্ষিণপন্থীরা ক্রমে ক্রমে অ্যামেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের ঠিক করে দেওয়া পথ থেকে সরে আসতে আরম্ভ করে। বিভিন্ন মুসলিম দেশে ‘ইসলামী বিপ্লব’-এর যোগাড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়।

গণ-অভ্যুত্থান ত্বরান্বিত করবার লক্ষ্যে জায়গায় জায়গায় বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা তৈরীর চেষ্টা এদের পূর্বতন সমর্থকদের ক্ষেপিয়ে তোলে। কারণ, তাঁরাও আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠলেন।

অভ্যুত্থানের সমস্ত চেষ্টা বিফল হলেও বিস্ফোরণ রইল অব্যাহত। হতাশ জঙ্গীদের ধ্বংসবাদী ভাবনা ও কাজকর্মের ফলে হাজার হাজার মানুষ আর সৈন্য মরল– পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আলজিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, নাইজিরিয়া, সোমালিয়া, সিরিয়া আর লেবাননে।

ইতিমধ্যে দক্ষিণপন্থী জঙ্গীদের দ্বারা সাধিত ক্ষতি সারাই করতে সচেষ্ট হল ইসলামী রাজনীতির এক ধ্রুপদী সংস্করণ। তারা অংশ নিল পাকিস্তান, ঈজিপ্ট, তিউনিসিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সুদান এবং তুরস্কের মতন দেশগুলোর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।

কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইসলামের ‘মধ্যপন্থী’ রাইট-উইং গণতান্ত্রিক প্রকাশ সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক বেশী কার্যকর হয়েছে। কিন্তু দুই ত্রুটি থেকে এঁরা বেরোতে পারে নি। এক, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এদের দুর্বলতা, আর দুই, চরমপন্থী ভাইবেরাদরদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান না নিতে পারা।

সুতরাং, ত্রিশ-চল্লিশের দশকে যে রাজনৈতিক ইসলামের শুরু আর আশির দশকে চূড়ায় পৌঁছনো, তা কি আজ একটা ক্ষয়িষ্ণু ব্যাপার? এমন প্রশ্ন তোলা যায় কি?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের তাকাতে হবে রাজনৈতিক ইসলামের ইতিহাসে আরও কিছু লক্ষণীয় ফলাফলের দিকে।

প্রথম ত্রিভুজ

রাজনৈতিক ইসলামের সবথেকে গোড়ার দিকের প্রকাশ ছিল তিনটে ফর্মে-– তথাকথিত ইসলামী মৌলবাদ, প্যান-ইসলামিজম এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদ।

‘ইসলামী মৌলবাদ’ শব্দবন্ধ পরিভাষা হিসাবে কিঞ্চিৎ অস্পষ্ট। মুসলিম দুনিয়ার বিভিন্ন সংস্কারবাদী ও জঙ্গী প্রবণতার সঙ্গে একে সাধারণভাবে জড়ানো হয়ে থাকে। এই সংজ্ঞার কট্টর সমালোচকদের মতে-– এর অর্থ কেবলমাত্র ইসলামের ধর্মাচারবাদ।

সুতরাং, আজকের মুসলিম দুনিয়ায় ঘটে চলা চরমপন্থী কার্যকলাপের সঙ্গে এই শব্দবন্ধকে জুতে দেওয়া হলেও, ইসলামী মৌলবাদ মূলগতভাবে ধ্রুপদী ইসলামী গুরুদের চিন্তন আর ঐতিহ্যের প্রতি এক গভীর আনুগত্য।

এই প্রবণতার ‘রাজনৈতিক শিকড়’, খুঁজলে দেখা যাবে, পোঁতা আছে দ্বাদশ শতাব্দীতে, যখন ইসলামী দুনিয়ায় ঐতিহ্যবাদীদের সঙ্গে মুতাজিলাপন্থী বা যুক্তিবাদীদের তিনশ বছরের তুমুল বিতর্কের পর ইমাম ঘাজালির মতন প্রভাবশালী মুসলিম চিন্তক দাবী করলেন যে, এই দুই যুযুধান দলের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় সাধিত হয়েছে, এবং ইসলামের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দর্শন পূর্ণরূপ পরিগ্রহ করেছে।

ইসলামী মৌলবাদের শিকড় রয়েছে দ্বাদশ শতাব্দীতে। যুক্তিবাদীদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক লড়াইয়ে ঐতিহ্যবাদীদের জয়ে।

 

ইমাম ঘাজালি, দ্বাদশ শতাব্দীর ইসলামী চিন্তক যিনি ইসলামী ভাবধারার পূর্ণবিকাশের ঘোষণা করে ‘ইতজিহাদ’ বা স্বাধীন যুক্তিবাদের অন্ত ঘোষণা করেন

 

‘মৌলবাদীদের’ উত্থান হয় সাধারণভাবে উলেমা, মৌলবি ও ইমাম রূপে, যাঁরা রাজসভায়, মসজিদে অথবা মাদ্রাসায় পরামর্শদাতা হয়ে নিযুক্ত হতেন।

সত্যি কথা বলতে কি, উনবিংশ শতাব্দী থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো একে একে ভেঙে যাওয়া শুরু হলে নানান সংস্কারবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই প্রতিটা আন্দোলন উপরোক্ত মৌলবাদীদের ভূমিকাকে দায়ী করে। তাদের অভিযোগ ছিল-– এই সমস্ত মৌলবাদীরা খুব বেশীরকম রাজানুগত হয়ে পড়ায় ইসলাম একপ্রকার অবহেলিত ও ফলস্বরূপ দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার অন্তিম ফলাফল এই সমস্ত সাম্রাজ্যের পতন।

এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম সমাজের ‘সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিচ্যুতি’গুলো ঠিক করা, এবং মসজিদ আর ধর্মপ্রচারকদের এই ঠিক করবার কাজে লাগানো।

কিন্তু শত শত বছর পুরোনো বিশ্বাস আর ইসলামী পণ্ডিতদের রচনা করা প্রাচীন পুঁথির নিগড়েই বদ্ধ হয়ে রইল ইসলামী মৌলবাদ।

‘ইসলামী আইন’ বা শারিয়া লাগু করতে এরা যতই আগ্রহী হোন না কেন, এই ইসলামী মৌলবাদীদের কোনও রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। কোনওকালে ছিল না।

ইসলামী মৌলবাদ শব্দবন্ধ এখনও মূলত রাজনীতিবিমুখ উলেমা, ধর্মগুরু ও প্রচারকদের প্রসঙ্গেই উচ্চারিত হয়, যদিও কিছু ক্ষেত্রে এইসব ধরণের মানুষেরা ‘সমাজে ইসলামী নিয়ম লাগু করা’ বা জঙ্গীবাদকে সমর্থন করার দোষে অভিযুক্ত হয়েছেন।

 

পাকিস্তানের তাবলিঘি জামাতের সদস্যেরা। এই জামাত ধর্ম প্রচার আন্দোলন হিসাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম।ণ্ডিতেরা একে বলেন খাঁটি ‘ইসলামী মৌলবাদী’ আন্দোলন, যেখানে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচী নেই।

 

রাজনৈতিক ইসলামের সর্বপ্রথম বড়সড় আধুনিক প্রকাশ (প্যান-ইসলামিজমের সঙ্গে) সম্ভবত মুসলিম জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে। দুয়েরই জন্ম উনিশ শতকে-– ধ্রুপদী ইসলামী মৌলবাদের রাজনীতিবিমুখ, বস্তাপচা ধ্যানধারণা ও অনগ্রসর রূপের সমালোচনার মাধ্যমে।

প্যান-ইসলামিজম আর মুসলিম জাতীয়তাবাদ, এই দুইই আবার ইয়োরোপীয় উপনিবেশবাদের ফসল। প্যান-ইসলামিজম দুনিয়ার সমস্ত মুসলিমকে অভিন্ন সত্তা হিসাবে দেখে (উম্মাহ), এবং তার লক্ষ্য এদের সকলকে এক ছাতার তলায় এনে একটা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বা বিশ্বব্যাপী খিলাফতের সৃষ্টি করা।

জালালউদ্দীন আফঘানি (১৮৩৯–৯৭)-র মত অগ্রগণ্য প্যান-ইসলামী চিন্তকেরাই সম্ভবত সর্বপ্রথম এই ‘ইসলামী রাষ্ট্র’-এর কথা ভাবান। এই ধারণাটা, বলাই বাহুল্য, ইয়োরোপের স্টেটের ধারণা থেকে নেওয়া। এই ধারণার সঙ্গে মেলানো হল সপ্তম শতাব্দীর মক্কার শাসনব্যবস্থা, এবং বলা হল ইসলামের উদয়ের সেই ঋতুতে যে সমস্ত অঞ্চল ইসলামের অধীনে আসে, তারা হচ্ছে ‘স্বাভাবিক’ ইসলামী রাষ্ট্রের অংশীদার।

রাজনৈতিক সীমানা অনুযায়ী জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করবার ধারণাকে প্যান-ইসলামিজম ঘৃণাভরে পরিহার করলেও তা মুসলিম জাতীয়তাবাদকে অনুপ্রেরণা যোগায়। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ হওয়া, এবং ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহে বৃটিশদের জয়লাভের পরে-পরেই মুসলিম জাতীয়তাবাদ ভারতে প্রবেশ করে।

স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও সৈয়দ আমীর আলীর মুসলিম জাতীয়তাবাদকে প্যান-ইসলামিজম সমর্থন করেনি। উদাহরণ-– আফঘানি ভারতের মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের সমালোচনা করে বলেন-– এরা একটা ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে মুসলমানদের বেঁধে রাখতে চায়।

 

উনিশ শতকের অগ্রগণ্য প্যান-ইসলামিক চিন্তক জালালউদ্দীন আফঘানি। যদিও ইনি প্রাচীন ইসলামী ধ্যানধারণাকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন, ইনি ছিলেন ভারতের মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের কট্টর সমালোচক। এঁর কথায়—দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের দক্ষিণ এশিয়া বাসভূমির বাসিন্দা হিসাবেই বেঁধে রাখা হচ্ছে।

 

যেমন করে প্যান-ইসলামিজম রাষ্ট্র সম্বন্ধে পাশ্চাত্যের আধুনিক ধারণাকে গ্রহণ করেছিল, তেমন করেই মুসলিম জাতীয়বাদও আরও একটা ইয়োরোপীয় ধারণাকে গ্রহণ করে— সে ধারণা জাতীয়তাবাদের। ভারতের মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের থেকে আলাদা, এবং একটা গোটা আলাদা জাতি— এই কথা বলে মুসলিম জাতীয়তাবাদ।

প্যান-ইসলামিজম বা মুসলিম জাতীয়তাবাদ-– দুইয়েরই লক্ষ্য ছিল মুসলমানেদের মধ্যে আধুনিক ইয়োরোপীয় শিক্ষার প্রসার ঘটানো, এবং ইসলামের নিয়মাবলীর আরও ‘যুক্তিনিষ্ঠ’ উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া। সেই অর্থে এই দুই ভাবধারাই ছিল প্রগতিশীল।

 

স্যার সৈয়দ আহমদ খান (সৈয়দ আমীর আলীর সঙ্গে) ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রথম দিকের প্রবক্তা। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানেদের মধ্যে পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদী ধারণা ছড়িয়ে দেবার অভিযোগে তিনি প্যান-ইসলামিস্ট ও গোঁড়া ধর্মবেত্তাদের দ্বারা সমালোচিত হন।

 

এত কিছুর পরেও মুসলমান জাতীয়তাবাদ মুসলিম বুর্জোয়া লালিত একটা শহুরে সংস্কারবাদী ধারণা হিসাবেই থেকে যায়। দার্শনিক ও কবি মুহাম্মদ ইকবাল তাঁর কাজের মাধ্যমে এই ধারণাকে আরও পোক্ত ও বিস্তৃত করেন। এর ফলে উনবিংশ শতকের ত্রিশের দশকে জাতীয়তাবাদের এই ধারণাকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ভিত্তি হয়ে উঠতে দেখা গেল।

এভাবেই (১৯৪৭-এ) পাকিস্তান গঠনের ক্ষেত্রে মুসলিম জাতীয়তাবাদ একটা বড় ভূমিকা পালন করল-– ‘মুসলমান ভারত’-এর জন্য একটা আলাদা দেশ তৈরী করতে সাহায্য করে।

 

কবি ও দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭–১৯৩৮) চেয়েছিলেন প্যান-ইসলামিজমের বিশ্বায়ন তত্ত্বের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম জাতীয়তাবাদের তত্ত্বের মেলবন্ধন সাধন করতে

 

নতুন দেশ হবে মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তি-– যথা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানেদের একটা গঠনমূলক ও পৃথক জাতি হিসাবে তৈরী করা, এবং এই জাতির মাধ্যমে পুরোনো মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সাফল্যসমূহের আধুনিক যুক্তিবাদী প্রকাশ ঘটানো।

ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে প্যান-ইসলামিস্টদের কট্টর একটা অংশের থেকে মুসলিম জাতীয়বাদের ওপর আঘাত নেমে আসে।

বলা যেতে পারে ঠিক এইখান থেকে তথাকথিত ইসলামিজমের শুরু। প্রাজ্ঞ আবুল আলা মাউদুদির মতন প্যান-ইসলামিজমের প্রথম দিকের প্রবক্তারা ‘অতি পাশ্চাত্যঘেঁষা’ এবং ‘রাজনৈতিকভাবে চূড়ান্ত সেক্যুলার’ বলে মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের ভর্ৎসনা করেন।

মাউদুদি মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন-– এঁরা ভারতের মুসলমানেদের দক্ষিণ এশিয়াবাসী জাতির অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে আখেরে ইসলামের বিশ্বজনীনতাকেই অস্বীকার করছেন।

যাই হোক, মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের ‘বিশ্বজনীন’ ধারণার একটা মেলবন্ধন ঘটতে শুরু করল পাকিস্তান সৃষ্টির পরেই।

সত্তরের দশকের মধ্যভাগ থেকে মুসলিম জাতীয়তাবাদের মেজাজ মাঝের থেকে দক্ষিণে সরে যাওয়া শুরু করে দিল। আর আশির দশকে ইসলামিজমের বহু ধারণাকে ধারণ করে পাকিস্তানকে একটা জাতীয়তাবাদী মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র থেকে উম্মাহদের লীলাক্ষেত্রে বদলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল।

নজরে রাখুন

পরিভাষা হিসাবে ‘ইসলামিজম’-এর প্রথম আত্মপ্রকাশ ফ্রান্সে, সত্তরের দশকে, যদিও (কম করে হলেও) উনবিংশ শতকের ইয়োরোপীয় লেখকদের রচনায় এই শব্দ মাঝেমধ্যে মুখ দেখিয়েছে।

আধুনিক রাজনৈতিক অনুষঙ্গে বলতে গেলে, ইসলামিজমের অর্থ হল উনবিংশ শতক-পরবর্তী ইসলামী আন্দোলনগুলো যা কেবলমাত্র ইসলামী মূল্যবোধ বা ধর্মাচারকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি, চেয়েছে ইসলামকে একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ হিসাবে তুলে ধরতে।

উনবিংশ শতকে আরব ও দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী সংস্কার আন্দোনলগুলোর মধ্যেই ইসলামিজের বীজ প্রোথিত আছে।

মুঘল আর ওটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ‘সহি ইসলামের’ সনাতন ও শুদ্ধ পথে ফিরে আসার লক্ষ্যে বহু সংস্কার আন্দোলন গড়ে ওঠে।

এদের মধ্যে কিছু কিছু আন্দোলনে ধর্মের নিয়মাবলীতে আধুনিক যুক্তিবাদ আনয়নের সপক্ষে বক্তব্য থাকলেও, অনেকেই পশ্চিমী ঔপনিবেশিকতা, দুর্নীতিগ্রস্ত ধর্মগুরু ও সুফীদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’-এর ডাক দেন। এই তিন দলের সকলেই, এদের মতে, ‘অপাপবিদ্ধ’ ইসলামকে অশুচি করছে।

ওটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর (১৯২২) ইরান, আফঘানিস্তান আর তুরস্ক সহ আরও বহু মুসলিম শাসনে উদারবাদ ও জাতীয়তাবাদের (গণতন্ত্র ব্যতিরেকে) মত আধুনিক পশ্চিমী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণার প্রকোপ দেখতে পাওয়া যায়।

সৌদি আরবের ক্ষেত্রে অবশ্য এই পর্যবেক্ষণ প্রযোজ্য নয়।

ইসলামিজমের প্রথম উল্লেখযোগ্য পরীক্ষা (বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়) ঘটল, যখন আল-সৌদ পরিবার বৃটিশদের মৌন সমর্থন নিয়ে আরবের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করল। বৃটিশদের সমর্থনের কারণ-– ওই অঞ্চলে ওটোমানদের শাসনকে দুর্বল করা।

 

ইবন সৌদ

 

সৌদ পরিবারের বড়কর্তা ইবন সৌদ ছিলেন আব্দ আল-ওয়াহাবের (অষ্টাদশ শতকের গোঁড়া ইসলামী সংস্কারক) একনিষ্ঠ অনুগামী। সৌদ পরিবার তড়িঘড়ি লাগু করলেন বিশ্বের সর্বপ্রথম ‘ইসলামী রাষ্ট্র’, যদিও রাজতন্ত্রের ছাতার নীচে।

ইসলামের বিশুদ্ধবাদী ঝোঁক আর তদ্ভূত নিয়মাবলীর (অষ্টম শতকের গোঁড়া ইসলামী ধর্মগুরু ইবন হানবলের মতবাদের থেকে, আর চতুর্দশ শতকের ধর্মতত্ত্ববিদ তেম্মিয়ার থেকে নেওয়া) প্রতি সৌদ পরিবারের একনিষ্ঠতা ওই অঞ্চলের মানুষেরা গ্রহণ করেন ঠিকই, কিন্তু বৃটিশদের সঙ্গে দহরম মহরমকে আর প্রভুত্ব ফলাবার ধরণকে তাঁরা মোটেও খুব ভালোভাবে নেননি। এই রাজতন্ত্র ছিল ঘোষিতভাবে বিশুদ্ধবাদী।

অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জায়গায় আধুনিক মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা যখন বিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিকতাবিরোধী লড়াই লড়ছেন, ইসলামিজমের প্রবক্তারা তাঁদের ‘ইসলামবিরোধী’ বলে দেগে দিলেন।

ঈজিপ্টের হাসান আল-বান্না বা সায়িদ কুতবের মতন নেতৃস্থানীয় ইসলামী পণ্ডিতেরা, বা দক্ষিণ এশিয়ার আবুল আলা-মাউদুদি আধুনিক রাজনীতির ভাষায় এবং ধারণায় কুরআন এবং অন্যান্য ইসলামী পুঁথির ব্যাখ্যা শুরু করলেন।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কুরআনের তৌহিদের (ঈশ্বরের একত্ব) ধারণাকে মাউদুদি অনেকটা বিস্তৃত করেন। তিনি বলেন-– তৌহিদের নিহিতার্থ হল বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ-এর একজোট হওয়া, যা সম্ভব হবে শুধুমাত্র ‘সমাজের ইসলামীকরণের’ মাধ্যমে, এবং কালক্রমে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে।

 

লেখক ও ইসলামী পণ্ডিত আবুল আল-মাউদুদি ছিলেন ইসলামিজমের প্রথম প্রধান প্রবক্তাদের অন্যতম

 

সায়িদ কুতব, অন্যদিকে, বলেন যে বিংশ শতাব্দীর মুসলমানেরা রয়েছে ‘জাহিলিয়া’-র দশায়। ধ্রুপদী ইসলামী পণ্ডিতেরা এই জাহিলিয়া শব্দের অর্থ করেছেন একরকম অজ্ঞানতার অন্ধকার, যাতে ইসলামের আগমনের আগে আরবের মানুষ নিমজ্জিত ছিল।

কুতব বলেন, মুসলিম দেশগুলোতে জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিয়ে মুসলমানেদের ‘জাহিলিয়ার আধুনিক শক্তি’দের থেকে রক্ষা করতে হবে। এই ‘আধুনিক শক্তি’ বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতা, মার্ক্সবাদ, জাতীয়তাবাদ, এবং পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের মতন ‘অপশক্তি’দের কথা।

 

জনৈক অ্যামেরিকান বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে ঈজিপ্টের ইসলামী দার্শনিক সায়িদ কুতব (ডানদিকে)। গামাল আবদুল নাসেরের সরকার ১৯৬৬ সালে কুতবকে ফাঁসি দেয় দেশদ্রোহিতা ও হিংসায় মদত দেবার অভিযোগে।

 

বিভিন্ন ইসলামী শাস্ত্রের ও শারিয়ার প্রচুর প্রাচীন ভাষ্যকে ইসলামিজম জেনেশুনে পরিহার করে। যুক্তি হিসাবে বলা হয়, এই নিয়মগুলি মসজিদের আঙ্গিনার বাইরে আসতে অসমর্থ হয়েছে, বা সেইসব রাজাদের সেবার জন্য রচিত হয়েছে যারা রাজনীতি থেকে ইসলামকে বিসর্জন দিয়েছেন।

ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি যে কোল্ড ওয়রের সময়কালে ইসলামিজমের পুষ্টি হয়েছে পশ্চিমা শক্তি ও তেলসমৃদ্ধ আরবদের দ্বারা। এঁদের লক্ষ্য ছিল সেইসব মুসলিম শাসন যারা হয় তথাকথিত ‘সোবিয়েত ক্যাম্পে’ নাম লিখিয়েছিলেন, নয়তো পশ্চিমা শক্তিগুলোর অর্থনৈতিক বা ভূরাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক ছিলেন।

এই প্রসঙ্গে ইরানের শিয়া ইসলামবাদীদের ইসলামিজম ছিল ব্যতিক্রমী। ইরানের ১৯৭৯-এর অভ্যুত্থানের জমিকর্ষণ বামপন্থী ও সংবিধানবাদীরা করলেও ইরানের ইসলামবাদীদের শক্তিই আন্দোলনের গতি ইসলামবাদের দিকে নিয়ে যায়। ইরানকেই ইসলামিজমের ফসল এমন একমাত্র শাসনব্যবস্থা হিসাবে দেখতে পাওয়া যায়, যদিও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে এই দেশের ভোগান্তি হয়েছে বিস্তর।

ইসলামবাদী ও তাদের পশ্চিমী ও সৌদি সমর্থকদের মধ্যে বোঝাপড়া উচ্চতায় ওঠে আশির দশকে, ‘সোবিয়েত-বিরোধী জিহাদের’ সময়।

সোবিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সৌদি ও পশ্চিমের থেকে আসতে থাকা অর্থসাহায্যে টান পড়ে। ফলতঃ ইসলামিজমের প্রধান চালিকাশক্তিগুলো দুর্বল হয়ে আসে আর ভেঙে যেতে শুরু করে। পরিণামে রাজনীতির আঙিনায় ইসলামিজমের বৌদ্ধিকভাবে অনুন্নত (আর অনেক বেশী হিংস্র) ভাতিজা তার কর্মসূচি গুছিয়ে নিয়ে মাথা চাড়া দিতে শুরু করে, যার নাম নিও-ফান্ডামেন্টালিজম বা নব্য-মৌলবাদ।

ইসলামিজমের সঙ্গে এতদিন যাবত জড়িত শক্তিগুলো কোল্ড ওয়রের পরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যেতে চায়। কিন্তু তারা জঙ্গী নব্য-মৌলবাদীদের পরোক্ষ সমর্থনকারী-– এই অভিযোগে প্রত্যাখ্যাত হয়। তারা সমাজের ইসলামীকরণের সপক্ষেও তেমন উচ্চকণ্ঠ নয়-– এই অভিযোগে প্রত্যাখ্যাত হয় অন্যপক্ষের দ্বারা।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেখানেই তারা ক্ষমতায় আসতে সমর্থ হয়, সেখানে শুরু হয় আরেক সমস্যার। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যকর করবার চেষ্টাগুলো শেষ হয় মেরুকরণে বা চূড়ান্ত প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলায়। কারণ, ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়গুলোর সমাধানের চেষ্টাতেও ধর্মপ্রদত্ত বিকল্প ও কৌশলের প্রয়গের ব্যর্থ চেষ্টা চালায় এইসব ইসলামবাদীরা।

 

কোল্ড ওয়র-পরবর্তী ইসলামিজম ভোটের আসরে যতটা সফল হয়, সুশাসন দিতে ততটাই ব্যর্থ। ঈজিপ্টের মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য মুহাম্মদ মোরসি ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এক বছরের মধ্যেই তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ধূলিসাৎ হয়, এবং কাতারে কাতারে মানুষ পথে নেমে তাঁর অপসারণ দাবী করতে থাকেন। ২০১৩-র জুলাইয়ের সামরিক বিদ্রোহে তাঁর শাসনকালের সমাপ্তি হয়।

 

উন্মত্ততায় পতন

রাজনৈতিক ইসলামে নব্য-মৌলবাদ এমন একটা প্রবণতা যা ইসলামী মৌলবাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলোর রাজনীতিকরণ ঘটায় ও তার অভিমুখ থাকে গোঁড়ামির দিকে।

‘নব্য-মৌলবাদ’-– এই পরিভাষার জন্ম দেন ফরাসী লেখক অলিভার রয়। তাঁর কথায়-– আফঘানিস্তান আর পাকিস্তানে ১৯৯৬ সালে তালিবানের সূত্রপাতের সঙ্গেই কোল্ড ওয়র-পরবর্তী ইসলামিজমের দুর্বলতাজনিত শূন্যতা বুজিয়ে দিতে নব্য-মৌলবাদের জন্ম।

ঐতিহ্যগত ইসলামী মৌলবাদের মত নব্য-মৌলবাদও মনে করে-– ধর্মশাস্ত্রের লিখন বুঝতে যুক্তির প্রয়োজন নেই। যা লেখা আছে, তাই অনুসরণীয়।

তথাপি, নব্য-মৌলবাদ জোর করে বা সশস্ত্র যুদ্ধের সাহায্যে (‘ইসলামী আমিরশাহী’ গঠনের মাধ্যমে) নিয়মাবলী, নৈতিকতা ও ভক্তি চাপিয়ে দিতে চায়, যা তার পূর্বসূরী ইসলামী মৌলবাদের পথ ছিল না। তালিবান ছাড়াও রয় বলছেন আল কাঈদা বা অন্যান্য জঙ্গী শক্তিগুলো, এবং আই এস আই এসের উত্থানের কথা, যারা নব্য-মৌলবাদী।

ইসলামী মৌলবাদীরা মুসলিম সমাজের ‘কলুষ’কে সাফ করার জন্য প্রচারকদের সাহায্য নেয়। নব্য-মৌলবাদীরা সাহায্য নেয় শক্তির বা হিংসার।

নব্য-মৌলবাদ দলটি তার বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিকে আরও সংকীর্ণ করে ফেলেছে যা গত এক দশকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়ে চলেছে। এই পথ ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত সমৃদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের পথ নয়, বরং ঘৃণা ছড়ানো বিশুদ্ধতাবাদী কুযুক্তির পথ যা ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে হিংসার প্রয়োগকে সমর্থন করে।

 

কেউ কেউ নব্য-মৌলবাদকে ইসলামের ইতিহাসে একটি অরাজক ও হতাশাজনক উপসর্গ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, এবং আশঙ্কা করেছেন যে এর ফল হবে এক ভয়ানক সংঘর্ষের মাধ্যমে রাজনৈতিক ইসলামের চূড়ান্ত পতন।

 

যদি সত্যিই এই অবস্থা হয়, মুসলিম দেশগুলোতে কোন ব্যবস্থা একে সরাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর, রাজনৈতিক ইসলামের বামপন্থী ঝোঁকের কী অবস্থা? তারা কি এখনও প্রাসঙ্গিক?

বামদিকের কথা

রাজনৈতিক ইসলামের বামপন্থী প্রবণতার মধ্যে অন্যতম শক্তি ছিল ইসলামিক সমাজতন্ত্র। ইসলামিক সমাজতন্ত্রকে পরিভাষা হিসাবে প্রথম মান্যতা দেয় ১৯১৭-র বিপ্লবের ঠিক আগে রাশিয়ার কাজানের সমাজতন্ত্রী সম্প্রদায়। সম্পূর্ণ উলেমাবিরোধী এই সম্প্রদায় কম্যুনিস্ট শক্তিকে সমর্থন জানিয়েও নিজেদের মুসলিম পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখে।

এই পরিভাষা পরবর্তীকালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কিছু বাম-মনোভাবাপন্ন মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের কাছে জনপ্রিয় হয়।

ইসলামী সমাজতন্ত্র এমন এক ভাবাদর্শ যা কুরআনের সমভাব ও দাক্ষিণ্যের ধারণাকে আধুনিক সমাজতন্ত্রী অর্থনীতির ধারণার সঙ্গে মেলাতে চায়, এবং ফলস্বরূপ মুসলিম বিশ্বে এক সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক নবজাগরণ ঘটানোর চেষ্টা করে। আরবে এর নাম হয় ‘আরব সমাজতন্ত্র’। ইরাক, সিরিয়া আর ঈজিপ্টে ‘বা’আথ সমাজতন্ত্র’। এই ভাবাদর্শে মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতারা সাম্য ও ন্যায়ের ইসলামী ধারণার সঙ্গে সমাজতন্ত্র ও আরব জাতীয়তাবাদের মিল ঘটানোর চেষ্টা করেন।

ইসলামী প্রতীকের ব্যবহার সত্ত্বেও ইসলামী সমাজতন্ত্র ছিল উলেমাবিরোধী, উদারবাদী এবং সোবিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মতন কম্যুনিস্ট শক্তির প্রতি অনুরক্ত।

এভাবেই ইসলামী সমাজতন্ত্র রাজনৈতিক ইসলামের বাম-পথ হিসাবে গড়ে ওঠে। গামাল আবদুল নাসের, ঈজিপ্টের জনপ্রিয় নেতা, হন আরব সমাজতান্ত্রিক শক্তির প্রমুখ প্রবক্তা ও পরিকল্পক। সিরিয়া ও ইরাকে এই ধারণা বা’আথ সমাজতন্ত্রের চেহারা নেয় (আরবী ভাষায় ‘বা’আথ’ শব্দের অর্থ নবজাগরণ)।

 

বিশ্বখ্যাত মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী চে গেভারার সঙ্গে গামাল আবদুল নাসের (ডানদিকে), কায়রো ১৯৬০

 

যথাক্রমে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আরব ও বা’আথ সমাজতন্ত্রের সাফল্যের পর ইসলামী সমাজতন্ত্রের ভাবনা পাকিস্তান, আলজিরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সুদান, সোমালিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়াতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে ফ্রান্সের থেকে আলিজিরিয়ার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট নিজেদের ইসলামী সমাজতন্ত্রের অনুসারী বলে ঘোষণা করে। পাকিস্তানে জনপ্রিয় পাকিস্তান পিপলস পার্টিও নিজেদের ইসলামী সমাজতন্ত্রী বলেই দাবী করে।

১৯৬৯-এর সেনাবিদ্রোহের পর লিবিয়ার রাজ পরিবারকে হঠিয়ে শাসনের আসনে বসা মুয়াম্মর আল-গাধাফি নিজেকে ইসলামী সমাজতন্ত্রী বলে পরিচয় দেন। ইয়াসের আরাফাতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্টও নিজেদের ইসলামী সমাজতন্ত্রী বলে ঘোষণা করে। এই সময়ে (ষাট ও সত্তরের দশকে) ইসলামী সমাজতন্ত্রীরা পাকিস্তান, সুদান ও সোমালিয়াতে ক্ষমতায় আসে।

 

কবি, চিত্রকর ও লেখক হানিফ রামেকে বলা হয় পাকিস্তানের আধুনিক ইসলামী সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা ও পরিকল্পক। হানিফ ছিলেন পিপিপি-র একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

 

ঈজিপ্ট, সিরিয়া ও ইরাকের বা’আথ ও আরব সমাজতন্ত্রীদের আর প্যালেস্টাইনের পি এল ও-র সমর্থনে বামপন্থী ছাত্রদের আন্তর্জাতিক গ্রুপ ইয়ং সোশালিস্ট অ্যালায়েন্সের ১৯৭০ সালের পোস্টার

 

ইরানেও শাহবিরোধী শক্তিদের একাংশ মার্ক্সবাদী/সমাজতান্ত্রিক ধারণার সঙ্গে ইসলামের প্রতীকের সমন্বয় ঘটায়। ১৯৭৯-র অভ্যুত্থানে এরা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নেয়। কিন্তু বিপ্লব শেষ হলে ইসলামী শাসন এসে তাদের নিষিদ্ধ করে সমূলে বিনাশ করে।

 

ইরানের বিশিষ্ট চিন্তক ও নেতা আলী শারিয়তী বিপ্লবী ইসলামকে মার্ক্সবাদী চেহারায় প্রকাশ করেন।শাহের অনুগামীদের হাতে ১৯৭৫ সালে তিনি নিহত হন।

 

রক্ষণশীল মুসলমান রাজশক্তিগুলো, বা ইসলামবাদী অন্যান্য শক্তিগুলো ইসলামী সমাজতন্ত্রকে মোটেও ভালো চোখে দেখেনি।

এরা বলেন-– ইসলামী সমাজতন্ত্র সোবিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের মতন ‘নাস্তিক’ শক্তিদের তৈরী করা একটা খিচুড়ি ভাবনা ছাড়া আর কিছু নয়। মাউদুদি বলেন-– ইসলামী সমাজতন্ত্র হল ‘মুসলিম সমাজ ও রাজনীতিকে ধ্বংস করবার উদ্দেশ্যে  মুসলিমবিরোধী শক্তির খাড়া করা ট্রয়ের ঘোড়া’।

ইসলামী সমাজতন্ত্রের বিভা ১৯৭০-এ নাসেরের মৃত্যুর পর থেকে ক্রমে কমতে থাকে। ঠিক এই সময়েই অধিকাংশ মুসলিম দেশ রক্ষণশীল তেলসমৃদ্ধ আরব রাজতন্ত্রগুলোর দিকে ঝুঁকতে শুরু করে।

১৯৭৩-৭৪-এর আন্তর্জাতিক তেলসঙ্কটের সময় ইসলামী সমাজতন্ত্রের ছাতার নীচে থাকা দেশগুলোর অর্থনীতিতে বড় আঘাত আসে। এর ফলে সেইসব দেশের নাগরিকদের সমাজতন্ত্রের ওপর আস্থা টলে যায়। তাঁরা ধীরে ধীরে ইসলামবাদের দিকে ঢলতে থাকেন।

ইসলামী সমাজতন্ত্রের শেষ উল্লেখযোগ্য প্রকাশ ঘটে ১৯৭৮-এ, আফঘানিস্তানে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি-কর্তৃক সংঘটিত ও সোবিয়েত-সমর্থিত ‘সর বিপ্লবের’ সময়কালে।

সত্তরের দশকের শেষের দিকে ইসলামী সমাজতন্ত্র প্রায় মুছে গেল। তবু, শুনতে হাস্যকর লাগলেও, এখনও কিছু দক্ষিণপন্থী মুসলিম পার্টি সমাজতান্ত্রিক স্লোগান দিয়ে থাকে, যদিও তাদের পূর্বসূরীরা কোল্ড ওয়রের সময় ইসলামী সমাজতন্ত্রের যারপরনাই বিরুদ্ধতা করে গেছেন।

ইসলামী সমাজতন্ত্রের মৃত্যুতে তৈরী হওয়া শূন্যস্থান পূরণ করল দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক ইসলাম। কিন্তু দক্ষিণপন্থার এই উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে উদারবাদী ইসলামও মাথা তোলা শুরু করল।

অন্তিম কেল্লা

যদিও অষ্টম ও নবম শতকের যুক্তিবাদী মুতাজিলাপন্থীদের থেকে উদারবাদের শুরু বলে অনেকে ধারণা করে থাকেন, তবু বলব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে উদারবাদী ইসলামের জন্ম উনিশ বা বিশ শতকেই (যদিও এ কথা অস্বীকার করা যায় না, যে প্রাচীন মুসলমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশই ছিল বহুত্ববাদী)।

সুতরাং, উদারবাদী ইসলামের শিকড় উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনগুলোর মধ্যেই রয়েছে, আর রয়েছে ইরান, আফঘানিস্তান ও তুরস্কের মতন দেশে বিশ শতকের গোড়ায় পশ্চিমী অর্থনৈতিক ও সামাজিক মডেল গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে।

মুসলিম দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অভ্যুদয়ের সঙ্গেই উদারবাদী ইসলামের ভাবনার বীজ অঙ্কুরিত হয়, যার অন্যতম ফল ইসলামী সমাজতন্ত্রের মতন ভাবাদর্শের উদ্ভব।

 

তুরস্কের আধুনিক জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা কামাল আতাতুর্ক ছিলেন রাজনীতির বিচারে উদারবাদী ইসলামের অন্যতম প্রকটতম দৃষ্টান্ত।

 

উদারবাদী ইসলাম সত্তা হিসাবে নমনীয়। পশ্চিমবিরোধী ও পশ্চিমের সমর্থক-– মুসলিম দুনিয়ার এই দুই দলই এই কথা স্বীকার করবে।

মুসলিম দুনিয়ার দক্ষিণ ও বামের বহু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, এমনকি কিছু একনায়কতন্ত্রও ইসলামের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্বন্ধে উদার মত নিয়ে চলে।

এই দলগুলো, আর এদের শাসনব্যবস্থা উলেমাদের বিষয়ে খুবই সন্দিহান। এরা ইসলামবাদ ও নব্য-মৌলবাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করে।

এরা কুরআন ও শারিয়ার উপলব্ধির ক্ষেত্রে ইজতিহাদকে সমর্থন করে, এবং মনে করে যে ইসলামের হিতসাধনের পক্ষে রাষ্ট্র ও সরকারের থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই অধিকতর উপযুক্ত।

সংস্কৃতির বিভিন্নতা, জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদ জাতীয় ধারণাগুলোকে এরা মান্যতা দেয়, যদিও এমন অনেক উদারবাদী মুসলিম সংগঠন আছে যারা চিন্তাভাবনায় সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী।

 

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও উদারবাদের মধ্যেকার রাজনৈতিক দূরত্ব দূর করতে সচেষ্ট হন।

 

ইসলামের উদারবাদী ভাবধারাকে কোনও না কোনও স্তর পর্যন্ত মানছে, এমন কথা অধিকাংশ মূলধারার মুসলিম রাজনৈতিক দল সম্বন্ধেই বলা যায়। পশ্চিমী সংজ্ঞায় হয়তো সকলে ‘সেক্যুলার’ নয়, তবু শারিয়ার মতো বিষয়ে বা তথাকথিত ‘অমুসলিম’ বিষয়েও তাদের চিন্তা রক্ষণশীলেদের তুলনায় বেশী নমনীয়।

তথ্যসূত্র :-

 

Oliver Roy, The failure of Political Islam (Harvard University Press, 1998) p.2

Muhammad Ayoob, The Many Faces of Political Islam (University of Michigan, 2007)

Roger Hardy, The Muslim Revolt, (Harsh Publishers 1999) p.18

Ziauddin Sardar, Islam, Post-Modernism & Other Futures (Pluto Press 2001) p.100

Martin Kramer, Fundamentalists or Islamists? (Middle East Qutarly, 2003) pp.65-70

Abdullah Saeed, Freedom of Religion & Islam (Ashgate Publishing, 2004) p.90

James Toth, Syed Qutb (Oxford University Press, 2013) p.324

Nadeem F. Paracha, Islamic Socialism: A history from left to right (DAWN.COM, February 21, 2013)

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

5 Comments

    • আপনার ঘেন্না আপনার কাছেই রাখুন। ঘেন্না ছড়ানো কোনো কাজের কথা নয়। পত্রিকা যেহেতু আমাদের, আমরাই ঠিক করব কোন লেখা যাবে আর কোনটা যাবে না।

Leave a Reply to চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম Cancel reply