শতাব্দী দাশ
লেখক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক ও সমাজকর্মী
একটি তীব্র ভূকম্পনের পর, আক্রান্ত মানুষ সামলে উঠতে না উঠতেই, আবারও রিখটার স্কেল বিপদ সূচক ছুঁতে পারে। ২০১৫ সালে নেপালে যেমন প্রথম ভূকম্পনের ঠিক সতেরো দিনের মাথায় আবার মাটি টালমাটাল হয়েছিল। তেমনই, সরকারি বিজ্ঞপ্তি ‘ঝড় থেমে যাবে’ বলে যতই আশ্বস্ত করুক, ঝড়ের পরের ঝড়গুলিও ভাবাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের এক অভূতপূর্ব বিশ্বজনীন সঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়েছে। আপাতত আমরা প্রাণরক্ষার জন্য যুঝছি আপৎকালীন তৎপরতায়। কিন্তু অনেক প্রাণহানি পেরিয়ে একদিন এই আপৎকালীন অবস্থা যখন কেটে যাবে? সেই কোভিড-উত্তর পৃথিবী কেমন হবে? অর্থনীতিবিদরা বলবেন অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা। চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন, আরও বেশি মারণক্ষমতা যুক্ত ভাইরাস যদি এরকম সংক্রামক হয়ে ওঠে, তাহলে কী হবে? তেমনই সমাজকর্মীরা ভাবছেন, এর সুদূরপ্রসারী সামাজিক প্রভাবগুলো কী কী হতে পারে?
করোনা পরবর্তী সমাজের কোনও স্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া আমার সাধ্যাতীত। কিন্তু অতীতে কোনও বিশ্বজনীন বা জাতীয় সঙ্কটের পর যা যা ঘটেছে, তা বিচার-বিবেচনা করে কিছু অনুমান অবশ্যই করা যায়।
জাতিবিদ্বেষ, পরিযান ও অভিবাসন
করোনার কালে সংবেদনশীল মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি গভীর আঘাত হেনেছে বোধহয় পরিযায়ী শ্রমিক-সারির মাইলের পর পাইল হেঁটে বাড়ি ফেরার দৃশ্যগুলি। কাজের খোঁজে পরিযান তো শুধু দেশের মধ্যে ঘটে না। ঘটে দেশের বাইরেও। শুধু অদক্ষ বা অর্ধদক্ষ শ্রমিকের নয়, দক্ষ শ্রমিক ও পেশাজীবীদেরও পরিযান ও অভিবাসন ঘটে। পরিযানের এই প্রবণতার উপর কী প্রভাব ফেলবে এই মারি?
করোনার শুরু থেকেই দেখা গেছে, জাতিবিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন সরকারগুলির পোয়াবারো৷ আমাদের দেশের কথাই ধরা যাক। করোনাভীতিকে দক্ষিণপন্থী অতিহিন্দুরা মুসলিমভীতির সঙ্গে কেমন করে যেন মিলিয়ে দিয়েছে। এ প্রবণতা কিন্তু শুধু ভারতের নয়। যদিও এমন একটি সর্বজনীন সমস্যার ক্ষেত্রে সব প্রতিক্রিয়াই মানবিক হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল, তবু কার্যক্ষেত্রে জাতিবিদ্বেষ এই মারির ফলে বেড়েছে বৈ কমেনি। যেমন, জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য শোনা যাচ্ছে চিনাদের সম্পর্কে, এমনকী মোঙ্গোলীয় মুখের যে কোনও মানুষের সম্পর্কেই। চিন দেশে থেকে যেহেতু করোনার উৎপত্তি, তাই চিনাদের জীবনযাপন বা খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ঘৃণাসূচক মন্তব্যে সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে গেছে। বিংশ শতকে স্প্যানিশ ফ্লু-এর পরেও চিনাদের নিয়ে অযৌক্তিক ভীতি দেখা গেছিল৷ ‘ইনভেশন স্কেয়ার নভেল’ নামের এক জঁর দেখা গেছিল সাহিত্যে, যার প্লটে অ-ইওরোপীয়দের ভাইরাস-ষড়যন্ত্র ছিল মুখ্য উপাদান।
বলা বাহুল্য, জাতীয়তাবাদী ও ডানপন্থী রাষ্ট্রশক্তিগুলির কল্যাণে সেরকম জাতিবিদ্বেষ আবার মাথা চাড়া দেবে। ইউনাইটেড স্টেটস প্রয়োজনেই আজ বর্ডার সিল করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প তাঁর ভাষণে বলেছেন, ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের প্লেন ঢোকা নিষিদ্ধ করেছেন তিনি, কারণ তারা ‘ফরেন ভাইরাস’-কে আটকাতে তেমন কিছু করেনি। ঠিক কাকে তিনি দুষলেন, বোঝা যায়নি। হয়ত চিনকে, হয়ত ইওরোপীয় দেশগুলিকে, যদিও অনেক ইওরোপীয় দেশের থেকে করোনার প্রকোপ আমেরিকাতেই বেশি। এই সস্তা জাতীয়তাবাদ আজকের বিশ্ব রাজনীতিতে লোকে যে ‘খাচ্ছে’, তা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ এরই অন্য পিঠে আছে অপর-বিদ্বেষ, জাতি-বিদ্বেষ।
সেই ক্রমবর্ধমান জেনোফোবিয়ার ফলে মাইগ্র্যান্টদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়তে পারে না কি? প্রায় ২৭২ মিলিয়ন অভিবাসী আছেন পৃথিবীতে। তাঁরা কি করোনা-উত্তর পৃথিবীতে আরও তীব্র জেনোফোবিয়ার সম্মুখীন হবেন না? কিংবা ধরা যাক, গ্রিস বা ইউএস-মেক্সিকো বর্ডার বা বিভিন্ন দেশে যে রিফিউজি ক্যাম্পগুলি আছে, সেখানে রিফিউজিদের সঙ্গে এই ক্রমবর্ধমান জাতিবিদ্বেষের ফলে কী আচরণ করা হতে পারে? রিফিউজি ক্যাম্পে করোনার প্রাদুর্ভাব হলেই বা রাষ্ট্র কী নীতি নেবে? ভারতের মতোই, বিশ্বজুড়েই মাইগ্র্যান্ট শ্রমিকদের অবস্থা করুণ। যেমন, গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে যে শ্রমিকরা সঙ্কীর্ণ জনবহুল লেবার ক্যাম্পে থাকেন, তাঁরা কেমন আছেন করোনার কালে? কেমন থাকবেন করোনার পর?
সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে মেক্সিকো হয়ে আমেরিকায় আসার পথ বন্ধ৷ ঘটনাচক্রে ট্রাম্পের মাইগ্রান্ট-বিরোধী নীতির সঙ্গে এই নতুন কোভিড-সতর্কতায় বর্ডার বন্ধ করার নীতি মিলে গেছে। হাইতি বা আফ্রিকা বা সিয়েরা লিওনে থেকে আমেরিকায় আসার পথে হন্ডুরাস বা গুয়াতেমালা বা মেক্সিকোতে আটকে আছেন যাঁরা, তাঁদের তো এখন কোনও সরকারই আশ্রয় দিতে চাইছে না। অথচ এরপরে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট আসতে চলেছে, তাতে মাইগ্রেশনের প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। স্প্যানিশ ফ্লু-এর সময় পরিযান এত সর্বব্যাপী ছিল না, তাই পরিযানের উপর মারির প্রভাবও সর্বব্যাপী ছিল না৷ কিন্তু এখন প্লেন, অটোমোবাইল, ট্রেনের এত উন্নতির পর যখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগও সহজ হয়ে গেছে, তখন অনেকেই বাড়ি থেকে দূরে কর্মসংস্থানে আর দ্বিধাগ্রস্ত নন। এই পরিযানের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে গ্লোবাল ইকনমি, যেখানে ফ্লোরিডায় আসা সেন্ট্রাল আমেরিকার টোমাটো চাষি, আবু ধাবিতে আসা বাংলাদেশি রাজমিস্ত্রি— সকলেরই ভূমিকা আছে।
এই গ্লোবালাইজড ইকনমির চালিকাশক্তি পরিযায়ী শ্রমিকরা আজ হঠাৎ থমকে গেছেন৷ তাঁদের পেটের সংস্থান হচ্ছে না। অনেক সময় চিকিৎসার সংস্থানও হচ্ছে না বিদেশে৷ ইরানে যেমন আফগান পরিযায়ীদের হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর উপায় আছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের তা নেই। ইউনাইটেড নেশনস জানাচ্ছে, “[migrants] and their families are often part of marginalized and vulnerable groups that are already experiencing economic hardship as a result of containment measures.” এঁদের ভবিষ্যৎ কী?
করোনা কিন্তু ধ্রুপদী, উৎপাদন ভিত্তিক অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিতে পারে। যদি নিও লিবারেল অর্থনীতিরই জয়জয়কার হয়, যদি বাড়িতে বসে কাজেরই রেওয়াজ হয়ে যায়, তাহলে অদক্ষ শ্রমিকরা ছাঁটাই হবেন বহুল সংখ্যায়। আর অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যেও প্রথমে ছাঁটাই হবেন টেম্পোরারি ভিসায় আসা পরিযায়ীরা। নিউজিল্যান্ড বা আমেরিকা যে পরিযায়ীদের চেয়ে নাগরিকদেরই বেশি সুবিধা দিতে চাইবে, তা বলাই বাহুল্য। বৈষম্য বাড়বে। যে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উত্থান হয়েছে, তারা কোভিডকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে, মারির জুজু দেখিয়ে, ভবিষ্যতেও জাতিবিদ্বেষের আগুনে হাওয়া দেবে। হাঙ্গেরির রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ওর্বান বা আমেরিকার ট্রাম্প সেক্ষেত্রে অগ্রনায়কের ভূমিকা নিতে পারেন।
জাতিবিদ্বেষী মনোভাবের এই উত্থান লক্ষ করে কিন্তু United Nations Network on Migration চেয়েছে মানবতা ও সাম্যের ভিত্তিতেই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণ হোক। কিন্তু তা কতদূর কার্যকর হবে?
ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকরা
ভারতের জনসংখ্যা ও পরিযান বিশেষজ্ঞরা কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তাঁরা বলছেন, করোনাভাইরাস পরিযায়ী শ্রমিকদের শিখিয়েছে, দূরত্ব কখনও কখনও অনতিক্রম্য হয়ে ওঠে। দূরত্ব বড় ফেলনা বিষয় নয়। প্রফেসর ইরুদায়া রাজন একজন প্রখ্যাত জনসংখ্যা-বিশেষজ্ঞ। তিনি বলছেন, ২০০৮ সালের বিশ্বজনীন অর্থনৈতিক দৈন্যের শিক্ষা ছিল— ‘job matters’। এবারের শিক্ষা— ‘distance matters’। এর ফলে কি শ্রমিক পরিযান কমবে?
যাঁরা হেঁটে বাড়ি ফিরলেন বড় শহর থেকে, তাঁরা আবার শহরে নাও ফিরতে পারেন। হয়ত খেতি-বাড়ি করা বা নিকটবর্তী ছোট শহরে কোনও না কোনও কাজ জুটিয়ে নেওয়াকেই তাঁরা শ্রেয় ভাববেন। গুরগাঁও, সুরাট বা তিরুপ্পুর-এর শিল্পকেন্দ্রগুলিতে শ্রমিকের জোগান কমতে পারে। তাতে হয়ত সাময়িকভাবে মজুরি বাড়তে পারে। ছোট-মাঝারি শিল্প হয়ত রিসেশনের বাজারে সে সব সামলাতে পারবে না৷
ঠিক কত শ্রমিক রাজ্যান্তরে যায় এদেশে কাজের খোঁজে? ২০০ কিমির বেশি পথের জন্য নির্ধারিত অসংরক্ষিত টিকিটের সংখ্যা দেখে, ২০১৬-১৭ সালের ‘ইকনমিক সার্ভে’ আন্দাজ করেছিল, বছরে কম করে নয় মিলিয়ন ভারতীয় দেশের মধ্যেই অন্য রাজ্যে পাড়ি দেয় কাজের সন্ধানে। গন্তব্যের তালিকায় প্রথমেই আছে দিল্লি, তারপর মুম্বাই। তারপর আছে দক্ষিণের শহরগুলি। সবচেয়ে বেশি মানুষ অন্য রাজ্যে যায় বিহার, ইউপি, বাংলা, আর অসম থেকে। এঁরা যদি দক্ষিণে যান, তাহলে বাড়ি থেকে তাঁরা প্রায় ৩০০০ কিমি পাড়ি দিচ্ছেন।
এর আগে কি এরকম গণহারে হেঁটে স্থানত্যাগের ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাঁরা? নিয়েছিলেন দু-একবার। যেমন জাতিবিদ্বেষের ফলে বিহারি শ্রমিকরা রাতারাতি পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন মহারাষ্ট্র থেকে, ক বছর আগে। আবার ২০১৬ সালে ব্যাঙ্গালোর থেকে পালিয়েছিলেন উত্তর-পূর্বের শ্রমিকরা। কিন্তু করোনার সময়ের শত শত মাইল পথ পার হওয়ার আজকের চিত্রটি যতটা সার্বিক, ততটা সার্বিক ছিল না সেই সব বিচ্ছিন্ন নিষ্ক্রমণ।
প্রফেসর চিন্ময় তুম্বে, ‘India Moving: A History of Migration’ বইটির লেখক, বলছেন, আসলে পরিযায়ী শ্রমিক এক জায়গার কর্মসংস্থান হয়ে গেলে অন্য জায়গায় যাওয়ার আগে শতবার ভাবে। একেবারে অনোন্যপায় না হলে তারা বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে স্থান ত্যাগ করে না, হেঁটে যাওয়া দূরস্থান। তাই এবারের অভিজ্ঞতার অভিঘাত তাদের উপর হয়ত অন্যরকম হবে। লকডাউন উঠে গেলেও আরও দূরের শ্রমিকরা ট্রেনে চেপে বাড়ি-ই যেতে চাইবেন। আগেই যাঁরা বাসে চড়ে বা হেঁটে চলে গেছেন, তাঁরাও ফিরবেন কিনা, জানা নেই। তাই ভারতের অদক্ষ বা অর্ধদক্ষ শ্রমিক-জগতের চেহারাটি হয়ত দীর্ঘকালের জন্য বদলে গেল৷
তাঁর কথার সমর্থন মেলে মুম্বাই-এর ধারাভি বস্তির মানুষজনের কথায়। এশিয়ার বৃহত্তম বস্তিটির প্রতি সাতজনের মধ্যে তিনজন ফিরে গেছেন গৃহে। লকডাউন উঠলে হয়ত আরও অনেকে যাবেন। তাঁরা বলেছেন, মুম্বাই শহরে ৫০ টাকায় একজনের একবেলায় খাবার হয়। গাঁয়ে সে টাকায় একটা পরিবারের চারজনেরই হয়ত একবেলা চলে যায়। গাঁয়ে ফেরাই ভালো।
কিন্তু বাড়িতে যদি কর্মসংস্থান না হয়? আগেও চাকরির বাজারে আকাল ছিল, আর এখন তো কর্মহীনতাই সর্বব্যাপী হতে চলেছে। দীর্ঘদিন লকডাউন চললে ফিরে যাওয়া শ্রমিকদেরও ভাঁড়ারে টান পড়বেই। সাধারণত কাজের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে মে-জুনে। এদিকে এই অর্থবর্ষে একশো দিনের কাজের জন্য ব্যায়বরাদ্দ ৬০,০০০ কোটি, যা হওয়া উচিত ছিল অন্তত ৭১,০০২ কোটি। সরকার কীভাবে গ্রামের মানুষের কাজ ও অর্থাগমের ব্যবস্থা করেন, আদৌ করেন কীনা, সেটাই দেখার। চিন্ময় তুম্বে বলছেন, নিশ্চিত করে এখুনি হয়ত বলা যাচ্ছে না ঠিক কী কী প্রভাব পড়বে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর, কিন্তু অদৃষ্টপূর্ব কিছু বদল আসবেই৷ তিনি আরও বলেন, যারা সম্পূর্ণ অদক্ষ শ্রমিক, তারা যদি ‘রুরাল জব গ্যারান্টি’ পায়, তাহলে হয়ত বাড়িতেই থাকবে। অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ যারা, ড্রাইভার বা সেলসপার্সন, তারা হয়ত ফিরবে।
‘নারীকেও নিয়ে যায়…’
‘অশনিসঙ্কেত’-এর সেই কাটা-মুখ যদুকে মনে আছে? যে যুদ্ধ আর মন্বন্তরের মধ্যে গ্রামের অভাবী মেয়ে-বউদের পাচার করে দিত শহরে? যে কোনও ঐতিহাসিক মানবসঙ্কট ও তার পরবর্তী সময়ের এ-ও এক বাস্তবতা৷ বারবার দেখা গেছে, যে কোনও দুর্যোগ বা যুদ্ধ, বন্যা বা ভূমিকম্পের পর, বাড়ে নারীপাচার ও নারীনিগ্রহ, শিশুপাচার ও শিশুনিগ্রহ। সার্বিকভাবে বাড়ে বেশ্যাবৃত্তিও। কর্মসঙ্কোচনের ফলে পাচারকারীদের পাতা ফাঁদে সহজেই ধরা পড়ে মেয়ে ও শিশুরা।
আসলে এধরনের সঙ্কটাবস্থার পর একদিকে বাড়ে গরিবি, অন্যদিকে সমাজসেবী সংগঠন ও নাগরিক সমাজও কিছু সময়ের জন্য কম সক্রিয় থাকে বা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে, যেমন ব্যস্ত থাকে রাষ্ট্র ও তার নিয়ামক প্রতিষ্ঠানগুলিও। তাই পাচারকারীদের সক্রিয় হয়ে ওঠা সহজ হয়।
এই সূত্রে মনে পড়ল, বিশ্বজুড়ে তথা ভারতেও, যৌনকর্মীরা এখন বিপন্ন। ভারতে যদিও সরকার দরিদ্রদের জন্য রিলিফ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, কিন্তু তার মধ্যে যৌনকর্মীরা পড়বেন কিনা জানা যায়নি। যৌনব্যবসা ভারতে নিষিদ্ধ হয়েছে Immoral Traffic (Prevention) Act, 1956 দ্বারা। সুতরাং যৌনকর্মীদের সংখ্যা সম্পর্কে সরকারি তথ্য না থাকলেও, মনে করা হয় আনুমানিক ১.২৫ থেকে ৩ মিলিয়ন যৌনকর্মী আছেন এ দেশে। তাঁরা কাস্টমার পিছু ১০০ থেকে ৮০০ টাকা রোজকার করেন। হঠাৎ ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় তাঁরা পড়েছেন সমস্যায়। তাঁদের কাস্টমার ছিলেন মূলত পরিযায়ী শ্রমিক, ট্রাক ড্রাইভাররা, যারা বাড়ি থেকে দূরে থাকেন। যাইহোক, এতদসত্ত্বেও করোনার প্রাদুর্ভাব কেটে গেলে বেশ্যাবৃত্তির উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু পাচার বাড়বে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ইন্দোনেশিয়াতে বা মালেশিয়াতে ২০০৪ সালের সুনামির পর বা ২০০৮ সালে ভারতের ভূমিকম্পের পর মেয়েদের যৌন পেশায় আসার ঝোঁক বেড়েছিল। এমনকী বিরাট সংখ্যক ছোট মেয়েদেরও বেচে দেওয়া হয় এসব সময়ে, কখনও বধূ হিসেবে, কখনও বেশ্যা হিসেবে, কখনও চাকরানি হিসেবে। একইভাবে কন্যাশিশু ও যুবতীরা বেশ্যা হয়েছিল ১৯৯১ সালে ফিলিপিন্সের মাউন্ট পিনাতুবো-র অগ্নুৎপাতের পর, ২০১০-এর হাইতির ভূমিকম্পের পর, ২০১১-তে আফ্রিকার হর্নে খরার পর, ২০১৩-তে ফিলিপিন্সের টাইফুনের পর। ২০১৫ সালে নেপালে রিখটার স্কেল ৭.৮ ম্যাগনিচিউডে ভূমিকম্প দেখিয়েছিল। ৮০০০-এরও বেশি মানুষ মারা গেছিলেন। তারপর? তারপর সেখানেও বেড়েছিল শিশু পাচার, নারীপাচার। ক্যারিবিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার হার্ভে নামক হ্যারিকেন ঝড়ের পর হস্টনে বিজ্ঞাপন দেখা যেত, “Pretty girls wanting to make some quick money, and recover losses from Harvey may contact.”
সুতরাং, Coalition against Trafficking in Women-Asia Pacific (CATW-AP) কিছুদিন আগে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলেছে, যে কোনও দুর্যোগ, সে ওন্ডয় নামক নিরক্ষীয় ঝড় হোক আর টাইফুন পেপেং-ই হোক, তার পরে শিশু ও নারীদের শরীর ব্যবসায় আসার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই করোনার পরবর্তী সময়ে নারী ও শিশু পাচার সম্পর্কেও এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। সংস্থার এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর জাঁ এনরিকেজ সতর্ক করেছেন, কয়েক মাস পরে যখন বোঝা যাবে যে সরকারি ত্রাণ সব জায়গায় যথেষ্ট নয়, তখন এই ঝোঁক আবার বাড়বে৷
রাষ্ট্রসঙ্ঘের ড্রাগ ও অপরাধ সংক্রান্ত বিভাগ ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, এশিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ও পাচার চক্রগুলি এই অবস্থায় সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। তাদের মতে হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর সবচেয়ে চেনা রূপ অবশ্যই যৌনব্যবসার উদ্দেশ্যে নারী পাচার। তারপরেই আসে শিশু পাচার। কখনও কখনও আবার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ পাচার হয় কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গসমূহ চুরি করার উদ্দেশ্যে৷ কখনও আবার সেই উদ্দেশ্যে পাচারীকৃত মানুষ খুনও হয়ে যান।
২০০১ সালে শুধু নেপাল থেকে ভারতে ১২,০০০ মেয়ে পাচার হয়ে এসেছিল। সেসব কথা লেখা আছে ‘সোল্ড’ নামক বইতে, আর চিত্রিত হয়েছে একই নামের ছায়াছবিতে। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের পরে সে সংখ্যা হুড়মুড়িয়ে বেড়েছিল দু-তিনগুণ৷ সামরিক নথি অনুযায়ী সেই সংখ্যা ২০,০০০-এ দাঁড়িয়েছিল। করোনার পর সংখ্যাটা আবার অনেক গুণ বাড়বে, বলাই বাহুল্য।
বিশ্বে ঠিক কত শতাংশ মানুষ পাচার হন বছরে তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। কারণ যাদের পাচার হওয়ার কথা থানায় কেউ জানান, বা যাদের উদ্ধার করা হয়, পরিসংখ্যানে আসেন শুধু তাঁরাই। তবু মনে করা হয় মানবপাচারের বাৎসরিক সংখ্যাটা ২.৫ মিলিয়নের কাছাকাছি। করোনার পরে তাহলে সংখ্যাটা কোথায় দাঁড়াবে?
শৈশব চুরি
শিশুদের কথা আলাদা করে বলা দরকার। একটি ঘটনা উল্লেখ করি। করোনার সময় গৃহহিংসায় পীড়িত নারীদের সাহায্যের জন্য যে হেল্পলাইন ও সাপোর্ট সিস্টেমটি আমরা চালু করেছি, সেখানে দুদিন আগে এক খবর আসে। কলকাতার একটি কলোনির বাসিন্দা গৃহপরিচারিকা এক মহিলা জানান, তাঁর বোনের নাবালিকা মেয়েটিকে এই লকডাউনের মধ্যেই ক্যানিং-এ জোর করে ‘বিয়ে’ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নাবালিকার বিয়ে দেওয়া তো অপরাধ বটেই, তদুপরি এই ‘বিয়ে’-গুলি বেশিরভাগই সন্দেহজনক চরিত্রের। বরের চরিত্রে অনেক সময়ই অভিনয় করেন পাচারচক্রের কোনও সক্রিয় কর্মী। বাবা-মা টাকার বিনিময়ে বা এমনকী টাকা ছাড়াও, স্রেফ সংসারে একটি পেট কমবে বলে, মেয়েকে তাড়াহুড়ো করে পাত্রস্থ করেন৷ এই প্রবণতা এরকম সঙ্কটাবস্থায় বাড়ে। পশ্চিমবঙ্গের শিশু সুরক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় সত্বর। তাঁরা মেয়েটির বাঁচানোর ব্যবস্থা করেন৷ পাঠকেরাও এই সময়ে একটু সতর্ক থাকতে পারেন এ বিষয়ে। পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি সন্দেহজনক ঠেকলে যোগাযোগ করতে পারেন শিশু সুরক্ষা দপ্তরে বা কোনও সক্রিয় এনজিও-র সঙ্গে।
UNICEF এর মতে চাইল্ড ট্রাফিকিং হল— “the act of recruitment, transportation, transfer, harboring or receipt of a child for the purpose of exploitation either within or outside a country”
যে বাচ্চারা স্কুলছুট হয়, তাদের পাচারকারীদের জালে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। মনে রাখতে হবে, এখন দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ। সেই সঙ্গে আছে সংসারে অর্থাভাব। শিশু-পাচারকারীদের কাছে বর্তমান ও ভবিষ্যতের একটি-দুটি বছর তাই সোনার সময়।
গরিবের বাচ্চার আবার বার্থ রেজিস্ট্রেশনও হয় না ঠিক মতো। তাই কে পাচার হল না হল, তার হিসেব রাখা আরও কঠিন। গরিবের সামনে শিশু বা বাড়ির মেয়েদের বিক্রি করে পরিবারের সাময়িক হিল্লে করার পথটি লোভনীয়৷ কখনও আবার মেয়েটি বা শিশুটি নিজেই আশার ছলনে ভুলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পাড়ি দেয়।
ভূমিকম্পের পর নেপালের গ্রাম থেকে শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছিল। তাদের বাবা-মা ভাবছিলেন সেবামূলক সংস্থাগুলি তাদের পাঠাচ্ছে ভারতের কোনও বৌদ্ধ মঠে। খাওয়া পরা জুটবে ঈশ্বরের আশ্রয়ে। কিন্তু আসলে তারা বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল। UNICEF, নেপাল সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে তাদের কাউকে কাউকে উদ্ধার করেছিল। নেপাল সরকার ট্রাফিকিং বিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে শিশুকে স্কুলে ফেরানোর উপর জোর দিয়েছিল। ‘Taught Not Trafficked’ ধরনের ক্যামপেন শুরু হয়েছিল এনজিওগুলোর সহায়তায়। সমাজসেবী সংস্থা ও সরকারকে তাই এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে করোনার পর।
থাইল্যান্ড আর ফিলিপিন্সের মতো দেশ থেকে আবার ইতোমধ্যেই শিশুদের আন্তর্জালিক যৌনচক্রে নিযুক্ত করার খবর আসছে। তাতে আন্দাজ করা যায়, এর পরে যৌনব্যাবসার উদ্দেশ্যে শিশুর ট্রাফিকিং ও সাইবার-ট্রাফিকিং বাড়বে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মোটামুটি ১.৮ মিলিয়ন শিশু পাচার হয় বছরে। তার মধ্যে অবশ্য সাইবার-সেক্সের হিসেব ধরা নেই। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে৷ এফবিআই ইতোমধ্যে কম্বোডিয়া, ফিলিপিন্সকে এ বিষয়ে নজর রাখতে বলেছে। ‘ডিপফেক’ জাতীয় অ্যাপের দিকে কঠোর নজরদারি রাখতে বলা হয়েছে।
স্কুল নেই, বড়রা ব্যস্ত মহামারি ও বাড়ির কাজ নিয়ে, এমতাবস্থায় এমনকী মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শিশুরাও অনলাইনে বেশি সময় কাটাতে গিয়ে সাইবার সেক্স চক্রের ফাঁদে পড়তে পারে। শিশুর মুখচ্ছবি অন্য শরীরে সুপার ইম্পোজ করে পেডোফিলদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও কিন্তু আছে আন্তর্জালে। আন্তর্জাতিক লেবার অর্গানাইজেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী সাইবার ট্র্যাফিকিং, সেক্সটর্শন, সেক্সটিং, শিশুর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের লাইভ স্ট্রিমিং ইত্যাদি হল শিশু-বিরোধী অপরাধের নতুন নতুন অবতার, যা বাড়বে করোনার পর। ‘Recent statistics indicate that children are spending time online more than ever. This has developed a lot of room for online child exploitation. We have observed that there has been an increase on online grooming cases globally,’ জানাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড চিলড্রেন (ICMEC)।
বলা বাহুল্য, করোনার কালে ও করোনার পরে বড়দের তথা শিশুদের ডিজিটাল উপস্থিতি যতটা বেড়েছে/বাড়বে, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা ততটা বাড়েনি মোটেই।
***
ভবিষ্যদ্বাণী নয়, এই সবই ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা-নির্ভর অনুমান মাত্র, যা সম্বল করে আমরা প্রবেশ করব করোনা-উত্তর সময়ে। চ্যালেঞ্জ অজস্র। চ্যালেঞ্জগুলির চেহারা আন্দাজ করে, সেই মতো প্রস্তুতি থাকুক আমাদের। থাকুক ঝড়ের পরের ঝড়গুলি পেরোনোর তৎপরতা ও সদিচ্ছা।