শূদ্রদিগের আস্পর্ধা প্রসঙ্গে রঘুপতি রাঘব রাজা রামচন্দ্রের খোলা চিটঠি

শৈলেন সরকার

 


লেখক গদ্যকার, ঔপন্যাসিক। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

প্রিয় পশ্চিমবঙ্গবাসী,

শুনিলাম, অযোধ্যায় আমার জনমস্থানে মন্দির তৈরির ভিত গড়িতে এই বঙ্গ হইতে শূদ্রদের পাঠানো জল ও মাটি ফিরত আসিয়াছে। আর তোমরা নাকি এই জন্য দুঃখ পাইয়াছ। ভক্তদের দুখে আমি দুখ পাই, আমার অন্তরে খুব দুখ উৎপন্ন হইয়াছে। তাই আমার এই চিট্‌ঠি।

আমার জনমভূমির জন্য শূদ্রদের জল ও মাটি পাঠানো ছিল মাতব্বরদিগের ভুল। ভাল করিয়া রামায়ণ পাঠ থাকিলে উহাদিগের এই ভুল হইত না। যাহাই হউক, এই প্রসঙ্গে বরং এই পুবদেশীয় (তখনও বঙ্গ নামের জনপদ আসে নাই) এক শূদ্রের কী কারণে আমি হত্যা করিয়াছিলাম শ্রবণ করো।

সীতাকে বনে পাঠাইয়াছি। স্ফূর্তির আর শেষ নাই। পুত্রদের খবর লইবার অবকাশ কোথায়? আজ রাজসূয় তো কাল অশ্বমেধ। মচ্ছবের একেবারে হট্টছট্ট। রাজসভায় বসিয়া মুনি-ঋষিদের চাটুকারিতায় বিভোর। এর মধ্যেই হঠাৎ শুনি সভার বাইরে কেউ ক্রন্দন করে। কে? মন্ত্রীকে খোঁজ নিতে বলি। খবর আসে, এক ব্রাহ্মণ তাঁর অকালমৃত পুত্রকে লইয়া প্রাসাদদ্বারে বিলাপ করিতেছে, আর বিনাইয়া বিনাইয়া পুত্রের মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করিতেছে। নিজের সম্বন্ধে সাজাইয়া গুছাইয়া হাজার কথা বলিতেছে। বলিতেছে, সে নাকি জীবনে কোনও মিথ্যা কথা বলে নাই, মিথ্যা আচরণ করে নাই। সে নাকি কোনও দিন কোনও প্রাণী বা মানুষকে ক্লেশ দেয় নাই, তবে কেন, কেন তাঁহার পুত্রের এই অকালমৃত্যু হইল। তাঁহার মতে তাঁহার নিজের কোনও দোষে তাঁহার পুত্রের এই অকালমৃত্যু হয় নাই, আর আ-পামরদের যা অভ্যাস, হাজার দিলেও যেমন পাই নাই-পাই নাই কান্না, তেমনি স্বরগ সুখ দিলেও কহিবে তেমন কিছু আর পাইলাম কোথায়? তবে অসুখ হয় কেন? মরিতেছি কেন? আরে বাবা, কবি যেখানে বলিতেছেন, ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?’ সেখানে মর্ত্যভূমে মৃত্যু লইয়া প্রশ্নের কোনও মানে আছে? না, স্বর্গের ন্যায় মর্ত্যভূমেও মৃত্যু কেন বিদায় লইবে না। ব্রাহ্মণপুত্র কেন মারা যাইবে? সুতরাং সব দোষ রাজার। রাজার দোষে। সেই ব্রাহ্মণ পুরাণ হইতে শ্লোক খুঁজিয়া বাহির করিয়া বলিতেছে, রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট, রাজার পাপে প্রজার বিনাশ। বলিতেছে, পাপ দূর করিয়া অধর্মের বিনাশ করিয়া ধর্ম স্থাপন না করিতে পারিলে তাঁহারা অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী নাকি পুত্রশোকে প্রাণ বিসর্জন দিবে। আর অধর্মের বিনাশ করিলেই নাকি তাঁহার পুত্রের প্রাণ ফিরিবে।

ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কেউ হইলে প্রাসাদদ্বারেই কোতলের নির্দেশ দিতাম। কিন্তু ব্রাহ্মণদের জান-মানের দায় নেওয়া রাজার কর্তব্য। মহামুনি বশিষ্ঠ ও মার্কণ্ডেয় রাজসভায় উপস্থিত। উহাদের উপস্থিতিতে কোনও ইতরামো  করা ঠিক হবে না। তাঁহাদের এক-একটি অভিশাপে আমি ফুৎকারে উড়িয়া যাইব। অর্থাৎ রাজসভায় তখন আমাকে সাপোর্টের জন্য কিছু ক্ষমতাশালী ব্রাহ্মণ দরকার। সুতরাং ডাকো বছরভর বসে বসে খাওয়া অষ্টবসুদের। আসুক বদবুদ্ধির নারদ, কিছু একভাবে সে সামলাবেই। সামলাতেই হবে। রাজধানীর প্রবীণ নাগরিক অর্থে আমার ভূমিদানে উপকৃত নিকম্মা ব্রাহ্মণেরা আসিলেন, আসিলেন স্বর্গের আমোদে-আহ্লাদে থাকা অষ্টবসুরাও। এঁরা এসেছেন অনিচ্ছায়ই। বাধ্য হয়ে। আমার এক কথায় ইন্দ্র একেবারে পদাঘাতে স্বর্গ থেকে—।

নারদকে আলাদা ডাকিয়া যাহা বলার বলিলাম। এবার নারদের দায়িত্ব। ওঁর উপর ভরসা করা যায়। নারদ সুতরাং আলাদা করিয়া অষ্টবসুদের ও প্রবীণ ব্রাহ্মণদের লইয়া বসিয়া যেভাবে পারিলেন ম্যানেজ করিলেন। এবার শুরু হইল রাজসভার কাজ।

আমাকে প্রথমে রাজপ্রাসাদের সদর দরওয়াজায় মৃত পুত্র কোলে হাজির হাহাকাররত ব্রাহ্মণের ক্রন্দনের বিবরণ দিতে হইল এবং ব্রাহ্মণের অভিযোগের কথা তুলিলাম। সবশেষে রাজকর্তব্য বিষয়ে পরামর্শ চাহিলাম।  উপস্থিত অষ্টবসু, প্রবীণ নাগরিক ও সভাসদদের হইয়া মহামুনি নারদ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ম্যানেজ হওয়া মুনি কীভাবে কীভাবে এক মনগড়া গল্প বানাইলেন কে জানে? মনগড়া গল্প শেষে সেই বালকের অকালমৃত্যুর কারণ ও বালকের পুনর্জীবন লাভের উপায় জানাইলেন। তাঁহার কথায়, সত্যযুগে ঈশ্বরীয় ক্ষমতা লাভের জন্য শুধু ব্রাহ্মণরাই তপশ্চর্যা করিতে পারিতেন, ধর্মাচরণের অধিকার ছিল শুধু ব্রাহ্মণদেরই। কিন্তু কালের বিধানে ত্রেতাযুগে ক্ষত্রিয়রা ক্ষমতার ভাগ চাহিলে অমান্য করা গেল না, উহারা যুদ্ধ করে। উহাদের চটানো বোকামি হইবে। অর্থাৎ ত্রেতাযুগে ব্রাহ্মণের সঙ্গে ক্ষত্রিয়রাও ঈশ্বর হওয়ার ইচ্ছায় তপশ্চর্যা ও বেদপাঠের অধিকার পাইলেন। এবার দ্বাপর যুগে এসে বৈশ্যরাও ভাগ চাইল ক্ষমতার। ব্যাটারা হাওলা করে, বাট্টা নিয়ে, সুদে টাকা খাটিয়ে এত মুদ্রা করেছে, আর জানোই তো রাজকর্মচারী বা মন্ত্রী বা পারিষদবর্গ সবই মুদ্রার বশ। সুতরাং ক্ষমতার ভাগ দিতে হল বৈশ্যদেরও। ওরাও বেদ পাঠ বা তপশ্চর্যার বা ধর্মাচরণের অধিকার পাইল। আর শূদ্রদের বেলা সিদ্ধান্ত হল, ব্যাটাদের বেগার খাটতে হবে সবার জন্য। বেদপাঠ বা ধর্মাচরণের চেষ্টা করিলেই ওদের মুণ্ডচ্ছেদের বিধান হল। নারদ জানাইলেন, সবশেষে এই কলিযুগে এসে ভগবান রামচন্দ্রের রাজত্বে এক শূদ্র অনাচার ঘটাইয়াছে। এই শূদ্র ধর্মাচরণ করিয়াছে শুধু নয়, বেদপাঠ করিয়াছে আর সর্বোপরি স্বয়ং ঈশ্বর হওয়ার জন্য নিজেকে কঠোর তপস্যায় লিপ্ত করিয়াছে। রঘুপতি রাঘব রাজারাম, এর বিহিত করুন।

নারদের বিচার শুনিয়া লক্ষণকে রাজপ্রাসাদের ফটকে যাইয়া ব্রাহ্মণের অসহ্য বিলাপ বন্ধ করার ব্যবস্থা করিতে বলিলাম। তাহাকে কানে কানে স্বর্ণমুদ্রা ও ভূমিদানের কথা দিতে বলিলাম। আর যাহাতে তাঁহার মৃত পুত্রের শরীরে পচন না ধরে, তাই মৃত দেহটিকে তেল-ঔষধের মিশ্রণে সংরক্ষিত করিতে বলিলাম। এইবার আমি পুষ্পক রথ ও বিমানবাহিনীকে ডাক করাইলাম। এবং সসৈন্যে সেনাদের বিমানে করিয়া সেই শূদ্র তপস্বীকে খুঁজিতে বাহির হইলাম। উত্তরে হিমালয়ের দিকে বা পশ্চিমে মরুভূমির দিকে বা দক্ষিণে মহানদী বা গোদাবরী নদীতীরে তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া না পাইয়া এবার পুবে রওয়ানা হইলাম। এই পুবভূমি বরাবরের রাজবিদ্রোহী বরাবরের দুঃসাহসী। তখনও পুবভূমি বঙ্গ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে নাই। ঘৃণ্য স্থান, পক্ষীজাতির বাসভূমি। এক বিশাল সরোবর তীরে উপস্থিত হইয়া দেখি এক তপস্যী কঠোর তপশ্চর্যায় রত। শরীর হইতে তেজ নিঃসৃত হইতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, কে তুমি? তুমি কি ব্রাহ্মণ, না কি ক্ষত্রিয়? না কি বৈশ্য? না কি তুমি দুরাচারী শূদ্র?

না, আমার মেঘনিনাদসদৃশ কণ্ঠস্বরেও সেই তপস্যীর অন্তস্থলে কোনও কাঁপন উঠিল না। দূরে দাঁড়ানো আমার পুস্পক রথ, সেনাবাহিনী। তপস্যী স্থির কণ্ঠে কহিল, আমি ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য নই, আমি এক শূদ্র। নাম, শম্বুক। আমি আপনার ন্যায় ঈশ্বর হইতে চাই।

তখনও বঙ্গদেশের নাম জগতে প্রচারিত হয় নাই। তখনও পুবের দেশ হিসাবেই খ্যাতি, আর রাজবিদ্রোহের জন্য কুখ্যাতি। ইহারা বর্ণভেদ মানে না। ইহারা ভাবে মানুষে মানুষে কোনও ভেদ হয় না। ইহাদের কথা মানিতে গেলে রামরাজ্যের আর কোনও মাহাত্ম্য থাকে না। এই শম্বুককে সুতরাং বাড়িতে দেওয়া যায় না।  কালক্রমে দল তৈরি করিয়া ধর্মাচরণ বা শিক্ষার অধিকার বা সমান নাগরিক অধিকার দাবি করিয়া বসিবে। মহামুনি বশিষ্ঠ বা মার্কণ্ডেয়দের রাজশিক্ষা বলে, নীচজাতি শূদ্রকে বাড়িতে দিতে নাই। আর কালক্ষেপ করিলাম না। আমার কোষবদ্ধ তরবারিতে বিদ্যুত ঝলক উঠিল। ঈশ্বর হইতে অভিলাষী শূদ্র শম্বুকের মস্তক ধরচ্যুত হইয়া ধরণীতে পতিত হইল। আর স্বর্গ হইতে শঙ্খনাদ ও পুষ্পবৃষ্টি শুরু হইল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর বা অন্য অন্য দেবতারা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন।

আমার রামরাজ্যে সুতরাং শূদ্রের জ্ঞানচর্চা বা ধর্মচর্চার অধিকার ছিল না এবং নাইও বা ভবিষ্যতেও এই অধিকার পাইবার কোনও সম্ভাবনা নাই। শূদ্রদের সমানাধিকারের অর্থ ধর্মের বিনাশ আর কে না জানে ধর্মের বিনাশকালে ওই স্বর্গের নারী-সুরা আর ভোগ-বিলাসের ফায়দা ছেড়ে এই অধমকেই যুগে যুগে ধরাধামে গাধার খাটুনি দিতে মনুষ্য হয়ে জনম নিতে হবে।

শূদ্রদের কাজ বাকি সবার জন্য বেগার খাটা। ওদের স্পর্শ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যদের কাছে অশুচি। অর্থাৎ রামায়ণ পাঠ থাকিলে আমার সেবক নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির হনুমানবৃন্দের পাট্টি মার্কা করমকর্তারা এত বড় ভুল করিত না। উহাদের অবশ্য দোষ দিব না, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাসের অনুগতদের কারওই পুস্তক পাঠে কোনও মতি নাই। উহারা নরেন্দ্রভাইয়ের আদেশ পালনেই অভ্যস্ত। আর নরেন্দ্রভাইয়ের পাঠাভ্যাস নিয়া প্রশ্ন তোলাও অবান্তর। সুতরাং যাহা ঘটিবার ঘটিয়াছে। বামন হইয়া চাঁদ ধরার চেষ্টা বাতুলতা। শূদ্র হইয়া আমার জনমভূমির মন্দিরের ভিত্তিভূমিতে জল-মাটি পাঠানোর কল্পনা করাটাও ছিল আর এক বাতুলতা।  আশা করি, এইমতো ভুলের আর পুনরাবৃত্তি হইবে না।

মনে রাখিবে, ভক্তের দুখে ভগবান নিজেও দুখি।

আজ এই পর্যন্তই,

রাজা রামচন্দ্র,

পিতা— দশরথ, নিবাস—  নরেন্দ্রভাই দামোদরদাসের ভারত বা ওলিসাহেবের নেপাল বা থাইল্যান্ডেও হইলে হইতে পারে— বা গগৈ সাহেবের আনুকূল্যে উত্তরপ্রদেশের সরযু নদীতীরস্থ অযোধ্যা।

পুনশ্চ: আমার কথা বিশ্বাস না হইলে ওই ডাকাত হইতে কবিতে পরিণত হওয়া বাল্মিকীর লেখা রামায়ণের হরিপ্রসাদ শাস্ত্রীর করা ইংরেজি অনুবাদের পাতা খুলিতে পারো।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4657 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...