দক্ষিণ এশিয়ায় মাইগ্রেশন: একটি প্রতিবেদন

নীলাঞ্জন দত্ত

 

গোড়াতেই একটা মুশকিলে পড়েছি। ‘মাইগ্র্যান্ট’ শ্রমিকদের নিয়ে একটা নতুন রিপোর্ট বেরিয়েছে, তার রিভিউ করতে হবে। কিন্তু মাইগ্র্যান্ট কথাটার বাংলা কী করব? আজকাল, এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণের পর লকডাউনের পর্যায়ে, ‘পরিযায়ী’ শ্রমিক কথাটা খুব শুনতে পাচ্ছি। আগে এই কথাটা শুনতাম পশুপাখিদের, বিশেষ করে মরসুমী পাখিদের, প্রসঙ্গে। প্রধানত শীতকালে তারা সুদূর সাইবেরিয়া না কোথা থেকে যেন আসে, এখানে উষ্ণমণ্ডলে কিছুদিন থাকে, ডিম পাড়ে, তাদের অনেককে মানুষেরা মেরে খেয়ে ফেলে, যারা বেঁচে থাকে তারা ছানাদের একটু বড় করে তুলে উড়ে ফিরে যায়। আবার পরের শীতে তারাই, বা অন্যরা, ঝাঁক বেঁধে আসে। কিছু জীবজন্তুও আছে এইরকম, যারা এক জায়গায় থাকে না, বিভিন্ন কারণে ঘুরে বেড়ায়। এদের নিয়ে একটা পত্রিকাও দেখেছি, যারা পরিযায়ী’ নামে। আমার বেশ ভালো লাগে, মাঝে মাঝে কিনে পড়ি। কিন্তু তাতেও শ্রমিকদের কথা তো কিছু বেরোয় না।

এখন, ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ বলা হচ্ছে কাদের? যারা জীবিকার জন্য তাদের স্বাভাবিক বাসভূমি ছেড়ে দূরে কোথাও পাড়ি দেয়, তা সে দেশের ভেতরেই হোক বা বাইরেই হোক। এখানে একটা ধাঁধা আছে। অনেকে এরকম দূর-দূরান্তরে গিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে, যেমন, চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষক, গবেষক, ইত্যাদি হিসেবে; অনেকে ভিন দেশে বা ভিন রাজ্যে গিয়ে ব্যবসাও করে। আরও বেশি টাকা যাদের হাতে আছে, তারা গিয়ে বিনিয়োগ করে, শিল্পটিল্প খোলে। অথচ ‘পরিযায়ী ডাক্তার’ ‘পরিযায়ী ইঞ্জিনিয়ার’, ‘পরিযায়ী গবেষক’— এরকম তো বলা হয় না। ‘পরিযায়ী প্রফেসার’ বা ‘পরিযায়ী পুঁজিপতি’ কথাগুলোর মধ্যে প-এর অনুপ্রাস থাকলেও শুনতে কি উৎকট লাগবে, ভেবে দেখুন তো একবার।

তাহলে আসল কথাটা কী? কাজের খোঁজে স্থানান্তরে বা দেশান্তরে গেলেই পরিযায়ী বলা হচ্ছে না। এর জন্যে দুটো শর্ত আছে। যে যাচ্ছে সে ভদ্রলোক হলে চলবে না, তার গায়ে একটু গরিব-গরিব গন্ধ থাকতে হবে। এবং সে যে কাজ করতে যাচ্ছে, অথবা গিয়ে যে কাজ করছে, সেই ‘কাজ’টা কোনও ‘ভদ্রলোকের কাজ’ হলে চলবে না, সাধারণত মিস্তিরি-মজুরের কাজ হতে হবে। এবং গরিব বলেই তাদের পশুপাখির সঙ্গে তুলনীয় একটা আখ্যা দেওয়া যাচ্ছে।

লক্ষণীয় যে, এই বৈষম্যমূলক আখ্যা দেওয়াটা চালু হয়েছে বিশেষ করে বাংলা ভাষাতেই এবং তা বহুল প্রচলিত হয়েছে অতি সম্প্রতি। হিন্দিতে এখনও ‘প্রবাসী মজদুর’ বলা হচ্ছে। ‘প্রবাসী’ কথাটা যেমন মজদুরের আগে বসে তেমন স্বচ্ছন্দেই বৈজ্ঞানিকের আগেও বসতে পারে। কিন্তু ‘পরিযায়ী’ তা পারে না, তার স্থান নির্দিষ্ট। আগে ইংরেজি ‘মাইগ্র্যান্ট’ শব্দের বাংলা পরিভাষা সাধারণত ‘অভিবাসী’ করা হত। ভারী এবং তৎসম শব্দ হলেও তার মধ্যে অন্তত এই বৈষম্যের ঝোঁকটা ছিল না। অভিবাসী যে কেউ হতে পারে। কিন্তু হালে, এই করোনার কালে, কেন জানি না, বৈষম্যমূলক অভিধাগুলোই আমাদের খুব পছন্দ হয়ে গেছে।

যেমন, ‘সামাজিক দূরত্ব’ কথাটা। ‘সোশাল ডিস্ট্যান্স’ কথাটা কোন সাহেবের মাথা থেকে বেরিয়েছিল জানি না, কিন্তু আমাদের এতই মনে ধরে গেছে যে, সাহেবরাই এখন জিভ কেটে ‘ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্স’ বললেও ‘শারীরিক দূরত্ব’ বলতে আমাদের যেন জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে। হিন্দির ‘দো গজ কি দূরী’, অ্যাবসার্ড হলেও, সমাজে নৈকট্য বা দূরত্ব রাখা সম্পর্কে কোনও জ্ঞান দেয় না। অথচ, বাঙালিরাই এতদিন হিন্দি বলয়ে জাতপাতপ্রসূত সামাজিক অসাম্যের দিকে আঙুল তুলেছে আর নিজেরা তা থেকে কতটা মুক্ত তার ঢ্যাঁড়া পিটিয়েছে। তবে কি এর মধ্যে বাঙালির সাংস্কৃতিক বিচারধারাটাই পালটে যেতে শুরু করেছে আমাদের অলক্ষ্যে? জানি না। তবে এটা দেখতে পাচ্ছি যে ইংরেজি ভাষার এলিটিস্ট নুয়ান্সটা আমরা ভালোভাবেই নিজেদের ভাষায় নিয়ে আসতে পেরেছি। মাইগ্রান্ট-এর পরে ‘লেবারার’ বা ‘ওয়ার্কার’-ই বসে, ‘আর্টিস্ট’ বা ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বসে না। তেমনি ‘পরিযায়ী’ বলতেও গরিবদেরই বোঝায়, বাবুদের বোঝায় না।

তো, গরিব মানুষ কাজের সন্ধানে কেন পরবাসে যায়? শখ করে যায় না। যখন দেখে কাছাকাছি কাজ জুটছে না, নিজের এবং পরিবারের বাঁচার রসদ জোগাড় করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেই সময় কেউ যদি এসে বলে, “চল মিনি আসাম যাব/ দেসে বড় দুখ রে/ আসাম দেসে রে মিনি/ চা বাগান হরিয়াল…, তখন তারা পাড়ি দিতে বাধ্য হয় সেই সবুজ প্রান্তরের খোঁজে। গিয়ে হয়ত আশা পূরণ হয় না, ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে, “হায় যদু রাম/ ফাঁকি দিয়া চলাইলি আসাম…।” কিন্তু তখন আর কোনও উপায় থাকে না, এই জীবনটাকেই আপন করে নিতে হয়। দেশে ফিরে গিয়েও কোনও লাভ হয় না, সেখানেও তো “বড় দুখ”, তাই আবার ফিরে আসতে হয় দূরবর্তী কর্মক্ষেত্রে। নইলে লকডাউনের মধ্যে জীবনপাত করে এত পথ পেরিয়ে এসেও মাস ঘুরতে না ঘুরতেই আবার মানুষগুলেকে ফিরে যেতে হয়?

এই যে গরিবদের মধ্যেও দুর্বলতর, নিতান্ত চাপে পড়া অংশের মানুষের স্থানান্তরী হওয়া, এটা স্বাভাবিকভাবেই গরিব দেশগুলো থেকে এবং গরিব দেশগুলোর মধ্যেই বেশি করে হয়। আমাদের দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোতে তাই এই ঘটনা অবিরতই ঘটে চলে। এই নিয়েই সদ্য একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সাউথ এশিয়া অ্যালায়েন্স ফর পভার্টি ইর‍্যাডিকেশন। প্রতিবেদনের শিরোনাম— মাইগ্রেশন ইন সাউথ এশিয়া: পভার্টি অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি। সবমিলিয়ে ১৬৫ পাতার এই রিপোর্টে দেশের ভেতরে স্থানান্তরী হওয়া এবং সীমান্ত পেরিয়ে দেশান্তরী হওয়া, দুটো ছবিই ধরা পড়েছে। বিশদভাবে যে তথ্যগুলো তুলে উপস্থিত করা হয়েছে, তার একটা ঝলকই নাড়া দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

রিপোর্টটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করার জন্য ছবিতে ক্লিক করুন

ভারতে প্রতিদিন ২,০০০ কৃষিজীবী দারিদ্রের তাড়নায় গ্রাম থেকে শহরমুখী হয় এবং সেখানে গিয়ে অনিয়মিত, অনিশ্চিত শ্রমিকের দলে নাম লেখায়। পাকিস্তানে এই শহরমুখী হওয়ার হারটা এতই বেশি, যে অনুমান করা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে সেখানকার জনসংখ্যার অর্ধেকই শহরাঞ্চলে চলে আসবে। নেপাল থেকে রোজ ১,৬০০ মানুষ কাজের খোঁজে বিদেশে পাড়ি দেয়। ভারতে কতজন আসে তা এই হিসেবে ধরা নেই, কারণ তাদের নথিভুক্ত করা হয় না। বর্তমানে নেপালের প্রায় অর্ধেক পরিবার চলে বিদেশ যাওয়া স্বজনদের পাঠানো টাকায়। বাংলাদেশ থেকে ২২টি দেশে যায় বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবীরা, যাদের মোট সংখ্যা ২০১৭ সালে ছিল প্রায় ৯৩ লক্ষ। এই অসচ্ছল দেশটিকে আবার বর্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কা থেকে প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা গত দুই দশকে দশ গুণ হয়েছে। এখন সে দেশের প্রায় ১৭ লক্ষ শ্রমিক বিদেশ কাজ করছে এবং প্রতি বছর তার সঙ্গে আরও লাখ দুয়েক যোগ হচ্ছে। অবস্থা এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে শ্রীলঙ্কার প্রতিবেশী ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট মালদ্বীপেও বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও নেপাল থেকে হাজার হাজার মানুষ কাজ করতে যাচ্ছে, অনেকেই যাচ্ছে সেখান থেকে আবার অন্য কোনও দেশে চলে যেতে পারবে এই আশায়।

কিন্তু মালদ্বীপেই কতদিন মানুষ থাকতে পারবে কে জানে। কারণ, জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের জলস্তর উঠে আসছে। এইসব দ্বীপগুলো একদিন জলের তলায় চলে যাবে এবং সেখানকার লক্ষ লক্ষ অধিবাসী উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে, এমন আশঙ্কাও জাগছে। এমনিতেই যেসব চাপে পড়ে প্রধানত গরিব মানুষ ঠাঁইনাড়া হতে বাধ্য হয়, তার মধ্যে পরিবেশ বা প্রকৃতির বিপর্যয় ক্রমশই একটা বড় জায়গা নিচ্ছে। তার সঙ্গে আছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের স্বার্থে চওড়া চওড়া রাস্তা, বড় বড় বাঁধ, ইত্যাদি বানানোর জন্য উচ্ছেদ হওয়া। এসব চাপ সামলে উঠে যদি বা কোথাও মানুষ একটু রোজগারের ব্যবস্থা করে নিল, সেই সময় যদি করোনার মত কোনও মহামারি এসে পড়ে তবে তো আর রক্ষে নেই। বর্তমানের এই পরিস্থিতির বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে রিপোর্টটিতে। যেমন আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়েছে নারী শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবারের নারীদের নিয়ে। পৃথক পৃথক অধ্যায়ে এরকম বিশেষ বিশেষ আলোচনা প্রতিবেদনটির পাঠককে বিষয়ের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...