উলুখাগড়ার বিলাপ

ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

 

কিছুদিন আগে গেল ভারত–পাকিস্তানের তরজা। এখন চলছে উত্তর কোরিয়া। মাস্‌লটা চেনা। পারমাণবিক।

তরজা যারই হোক, বিপদ সবার। ছেলেবেলা থেকে যে ঘটনাকে নিছক ইতিহাস বলে জেনে এসেছি, সে একেবারে জলজ্যান্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে মানবতাবাদের মুষলপর্ব ঘোষণা করে বসেছে।

মিচিহিকো হাচিয়া-র কথা অনেক দিন আগে শুনেছিলাম। হাচিয়া ছিলেন ডাক্তার, এবং হিরোশিমার অধিবাসী। উনিশশো পঁয়তাল্লিশের বোমাবর্ষণের পর হাচিয়া ঘটনাচক্রে বেঁচে যান, এবং পরে, তাঁর সেই সে-দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বই লেখেন-– হিরোশিমা ডায়ারি।

‘মানুষগুলো যেন ছায়ার মূর্তি। এদের কারও-কারও দিকে তাকালে মনে হয় যেন মানুষ নয়, চলন্ত প্রেতাত্মা। কেউ চলছে, যেন খুব যন্ত্রণা সয়ে, ঠিক কাকতাড়ুয়ার মতন তাদের শরীর থেকে ঝুলছে তাদের হাত আর মাথা… এক নগ্ন মহিলাকে দেখলাম, কোলে তার বাচ্চাও নগ্ন। তারপরে একটা নগ্ন লোক। আমারই মতন অবস্থা তারও। কোনও একটা আশ্চর্য ঘটনা যেন আমাদের সকলের পোষাক কেড়ে নিয়েছে। আমার সামনেই পড়ে ছিলেন এক বৃদ্ধা, মুখখানা যন্ত্রণায় বিকৃত, কিন্তু কোনও শব্দ নেই সেই ক্লিষ্ট মুখে। সত্যি বলতে, সকলের মধ্যে একটাই মিল-– সকলেই সম্পূর্ণ নিঃশব্দ।’

হাচিয়ার ডায়ারির কিছু অংশ।

বিশ্বমানবতার ধ্বজাধারী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কেউ কোনওদিন সাধারণ মানুষের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলে চেখে দেখেনি জ্যান্ত মানুষ গলিয়ে মারার মজা। তাই, আমেরিকা যখন যুদ্ধে যাবার কথা বলে-– এমনিতে তো বলে না, ‘নিতান্ত বাধ্য’ হয়েই বলে-– তখন ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কীই বা করবার থাকে আমাদের?

কিছুদিন আগে নিকি হেইলি-ও এইরকম বাধ্যতার কথা শুনিয়েছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘে আমেরিকার রাজদূত হেইলি নিরাপত্তা পরিষদকে উত্তর কোরিয়ার সম্বন্ধে বলেছেন-– ওরা যুদ্ধ ভিক্ষা করছে! ‘Begging for war’! আমেরিকার অপরিমেয় শুভচিন্তা ও বিবিধ বাবা-বাছাতেও আর কাজ হচ্ছে না। সুতরাং, ওরা যুদ্ধই চাইছে। সেটাই সাব্যস্ত হোক।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচজন স্থায়ী সদস্যের প্রত্যেকেই পারমাণবিক শক্তিধর-– চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইংল্যান্ড (যুক্তরাজ্য) এবং আমেরিকা। কিসে ভয় পাওয়া কর্তব্য আর কিসে নয়, তা ঠিক করে দেন এই পাঁচজন, এবং ভয়ের কারণকে ভয় দেখানোও এঁদের একটা প্রধান কাজ। ধরুন, নিধিরাম আপনাকে ভূত হয়ে খুব চমকাচ্ছে, তখন আপনার কাজ হবে এই পরিষদের কাছে নিধিরামের নামে নালিশ জানানো। পরিষদ যদি ভাবেন যে হ্যাঁ, নিধিরাম সত্যিই দুষ্টু এবং সত্যিই ভয় দেখাচ্ছে, তবেই সেটা ভয় দেখানো। পরিষদ ভাবলেন না অথচ আপনি ভয় পেতেই থাকলেন-– এমন অবস্থা হলে জানবেন দোষটা আপনারই। তখন হায় ভীরু প্রেম-ট্রেম বলে আপনি শোকতাপানলে দগ্ধ হোন ছাই যা করুন কেউ আপনাকে পুঁছবে না।

আমেরিকা ১৯৫২-তে প্রথম হাইড্রোজেন বোমা বানিয়ে ফেলে, এবং লোকজানানি পরীক্ষা করে বিকিনি আটলে-– ১৯৫৪ সালে। সেই বোমা না কী হিরোশিমার বোমার থেকে হাজারগুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। উত্তর কোরিয়ার সংগ্রহেও এই হাইড্রোজেন বোমাই আছে। এর যা শক্তি তাতে নিউ ইয়র্ক, সিউল বা পিয়ংইয়াঙ্গের মতন শহর ধ্বংস হতে পারে। তা ওই পাঁচ বড় ভাই তাঁদের সুখের সংসারে আর অনুপ্রবেশ চান না। কথাটা হচ্ছে, ক-বাবু মেয়েছেলে পুষবেন। খ-বাবু পুষলেও তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু গ-বাবু পুষতে গেলেই দুইজনে ফুঁসতে লাগছেন! মেয়েছেলেপোষণেচ্ছু বাবুর বাড়া ভাতে ছাই দিলে মটকা কেমন গরম হয় তা রসিক পাঠক অবগত আছেন।

কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে আসেই। সেটা হল-– উত্তর কোরিয়ার মতন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রায় হাভাতে একটা দেশের এ-হেন ঘোড়ারোগ হলই বা কেন?

উত্তর কোরিয়ার জাতীয় আয় পনেরো বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের কাছাকাছি, অর্থাৎ বোতসওয়ানা, সেনেগাল, জিম্বাবোয়ে বা লাও-এর মতন। এইরকম অবস্থায় পারমাণবিক অস্ত্র? কেন?

উত্তরে যাবার আগে, আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার বিরোধের ইতিহাসটা একবার দেখে নেওয়াটা জরুরী।

এই ইতিহাসের শুরু উনিশ শতকের মধ্যভাগে, ১৮৬৬-র ‘জেনারাল শেরম্যান’ ঘটনার মধ্য দিয়ে। কোরিয়ার বাহিনী আমেরিকার একটি গানবোট-– যা কি না কোরিয়ার দিকে বাণিজ্য-আলোচনার কারণে আসছিল (!) এবং কোরিয়ার বাহিনীর নির্দেশ লঙ্ঘন করে বিপথে চলতে চাইছিল-– তাকে ডুবিয়ে দেয়। এই ঘটনার জবার দেয় আমেরিকা, ১৮৭১ সালে, যা শিনমিয়াংগো নামে খ্যাত। এটাই কোরিয়ার মাটিতে আমেরিকার লড়া প্রথম যুদ্ধ।

এরপর চলে যেতে হবে ১৯০৫-এ। এই বছর শেষ হল রুশ-জাপান যুদ্ধ। যুদ্ধে পর্যুদস্ত রাশিয়ার অবস্থা তখন ভালো নয়। জারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করেছে তখন-– সেই আগুন যা জারতন্ত্রকে ছারখার করে দেবে আরও বারো বছর পর। দেশের অর্থনীতির অবস্থাও তেমন ভালো নয়। যুদ্ধের ফলাফলও অনুকূল নয়। এমতাবস্থায় জার দ্বিতীয় নিকোলাস এই ঝামেলার থেকে বেরিয়ে আসার কথা যখন ভাবছেন, দেবদূতের মতন উদয় হলে থিওডোর রুজভেল্ট-– মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়ে। দ্বিতীয় নিকোলাস ও জাপানসম্রাট মেইজি তাঁর প্রস্তাব মেনে নিলেন। স্বাক্ষরিত হল পোর্টসমাউথের চুক্তি। রুজভেল্টের নোবেলপ্রাপ্তি ঘটল। কোরিয়ার জাতীয়তাবাদী নেতাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে আমেরিকার সমর্থনে এই চুক্তির বলে কোরিয়ার একাংশ জাপানের হস্তগত হল।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধ শেষ হলে জাপানী উপনিবেশগুলোর ভাগ-বাঁটোয়ারা চলছে যখন, তখন কোরিয়াকে ভাগ করা হল দু’ভাগে। দক্ষিণ ভাগ নিল আমেরিকা আর উত্তর ভাগ নিল সোবিয়েত রাশিয়া। যদিও এই বিভাজন হবার কথা ছিল সাময়িক। কিন্তু আমেরিকা ও সোবিয়েত রাশিয়ার সম্পর্কে ক্রমাগত অবনতি ঘটতে থাকায় সেটা আর সম্ভব হল না। উত্তরের লোকেরা আমেরিকার প্রতি বিরূপ হল, কারণ দক্ষিণ অংশ ছিন্ন হবার পিছনে তারা দায়ী করেছিল অতীতে জাপানকে দেওয়া আমেরিকার মদত।

এর পরের ইতিহাসের অনেকটা জুড়ে আমেরিকা ও সোবিয়েত রাশিয়ার ঠাণ্ডা যুদ্ধ। এই ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৫০-এ উত্তর কোরিয়ার তৎকালীন সর্বাধিনায়ক কিম ইল-সুং-এর নেতৃত্বে এবং স্তালিন ও মাওয়ের সমর্থনে দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ ও কোরিয়া যুদ্ধের সূত্রপাত। খ্রুশ্চভের আমলে সোবিয়েত রাশিয়া-কর্তৃক উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক প্রযুক্তি প্রদান।

আক্রমণের প্রশ্নে অবশ্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ব্রুস কামিংস-এর মত কিঞ্চিৎ ভিন্ন। তাঁর কথায়, এই সবের মূলে ছিলেন দক্ষিণের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান-– সিংমান রী। রী ছিলেন তাঁর কমিউনিস্ট বিদ্বেষের জন্য, এবং বহু বামপন্থীকে নির্বিচারে হত্যা করবার জন্য খ্যাত। যাই হোক, বিষয় সেটা নয়।

এই কোরিয়ার যুদ্ধে, অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময়েই আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার বিদ্বেষের বীজ অঙ্কুরিত হল।

বীজের অঙ্কুরোদ্গম ও সে-অঙ্কুরের মহীরুহে পরিণত হবার সময়টুকু থেকে চারটে মূল কারণ তুলে আনা আবশ্যক।

আমেরিকার শিশুরা ইস্কুলে বিশ্বযুদ্ধ বা ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা পড়লেও কোরিয়ার যুদ্ধের কথা কিছুই জানে না। তারা জানে না কোরিয়ার মাটিতে আমেরিকার বর্বর বোমাবর্ষণের কথা। শুধু ইয়ালু নদীর ব্রিজ নয়, ইস্কুল, হাসপাতাল, কারখানা, সাধারণ মানুষের বসতির ওপর অক্লান্ত বোমাবর্ষণ। আমেরিকান এয়ারফোর্সের হিসেব-– ১৯৫০ থেকে ৫৩, এই তিন বছরের যুদ্ধে কোরিয়ার ওপর ফেলা হয়েছে ছয় লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার টন বোমা, যা কী না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমগ্র প্যাসিফিক অঞ্চলে ফেলা বোমার থেকে ওজনে বেশি। এই ছয় লক্ষ পঁয়ত্রিশের হিসেবে ধরে নিতে হবে বত্রিশ হাজার পাঁচশো সাতান্ন টন নাপামের হিসেবও। নাপাম রাসায়নিক অস্ত্র, জানেন তো স্থিতপ্রজ্ঞ পাঠক? এই বোমাবর্ষণে একেবারে পরিকল্পিতভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয় চোসান, হোয়েরিয়ং, হুইচন, কইন্দং, মানপোজিন, নামসি, সাকচুর মতন শহর। জেনারাল ডগলাস ম্যাকআর্থার অবশ্য বলেইছিলেন-– উত্তর কোরিয়ার প্রতিটা কাঠামো, প্রতিটা পরিষেবার জন্য তৈরী সুবিধা, প্রতিটা গ্রাম হবে আঘাতের লক্ষ্য। বোমাবর্ষণ শেষ হলে দেখা গেল-– উত্তর কোরিয়ার বাইশটা প্রধান শহরের আঠেরোটাই মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে ধুলোয়।

১৯৮৫ সালে উত্তর কোরিয়া নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন চুক্তিতে সই করেছিল। ১৯৯৪ সালে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনার জন্য একটা সনদও ঠিক হয়ে যায়। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে মোতায়েন আমেরিকান সৈন্যদলের ক্রমাগত চোখরাঙানির থেকেও মুক্তির উপায় দেখা দেয় ক্লিন্টনের সময়। কিন্তু বুশপুত্র বুশ ২০০২ সালে তাঁর ‘শয়তানের অক্ষে’ ইরাক ও ইরানের সঙ্গে উত্তর কোরিয়াকেও জুড়ে দিলেন। এরপর ২০০৩ সালে ইরাকের সঙ্গে ‘গদিমুক্তি’-র লড়াই, অর্থাৎ সাদ্দামবিরোধী যুদ্ধ শুরু হল। ২০০৪-এ পারমাণবিক বিপদের ছুতোয় ইরানের সঙ্গে শুরু হল তাকে একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টা। চোখের সামনে বাগদাদকে ধ্বংস হতে দেখে আর ইরানকে শাস্তি পেতে দেখে উত্তর কোরিয়া মনে করল তাদেরও ঘণ্টা বাজতে চলেছে।

২০০৩-এ কর্নেল মুয়াম্মর কদ্দাফির নেতৃত্বে লিবিয়া তার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির গোপন পরিকল্পনা ত্যাগ করল। ওই সময় আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সঙ্ঘের প্রধান মিশরীয় মোহাম্মদ অলবারাদেই ‘ভেবেছিলেন’-– পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে ফেলতে লিবিয়ার আর তিন থেকে সাত বছর সময় লাগবে। যাই হোক, লিবিয়া সে পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে। তার পরের বছর পরিত্যাগ করে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা। কিন্তু ২০১১-তে সেই গদিমুক্তির লড়াইয়ে প্রাণ দিতে হল কদ্দাফিকে। উত্তর কোরিয়া বার্তা পেল-– পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করলেই এই গতি হবে তোমারও।

সুবিবেচক পাঠককে বলি, এই লেখার অর্থ উত্তর কোরিয়াকে কোনও দেবশিশু প্রতিপন্ন করা নয়। বরং এইটা দেখানো-– কীভাবে আমেরিকার ক্রমাগত ভীতিপ্রদর্শন এক সময়ের ঘোষিত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক লড়াইয়ের বাইরে আসার পথটা বন্ধ করে দিল।

এরপর কী হবে তা জানা নেই। আপাতত মনে মনে হাচিয়ার মতন একটা কেতাব লেখার পরিকল্পনা নেওয়া যাক। নিস্তব্ধতার ডায়ারি।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4858 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...