মৃত্যু না হত্যা

অয়নেশ দাস

 




গদ্যকার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

I had a little bird
its name was Enza
I opened the window,
And in-flu-enza.”

{১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু-র পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের খেলার মাঠের ছড়া}

 

মড়ক ছুঁয়েছে আমারও শরীর

মাথার পেছন থেকে কানের ঠিক ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাক দেওয়া যন্ত্রণার মন্ডটা চোখের মধ্য দিয়ে সোজাসুজি খুলির ভিতরটায় যাবতীয় নরম অংশগুলি ছিঁড়তে ছিঁড়তে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। একটা পর্যায়ক্রমিক খেলার মতো। আস্তে আস্তে স্নায়ু যত বিবশ হয়ে আসে আমিও যন্ত্রণার বোধ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। বরং খেলাটার অংশীদার হয়ে পড়ি। একটু আগেই জ্বর দেখেছি। ১০৩ ডিগ্রি। রাত্রি ২-৩০ টা। গতকাল সন্ধেবেলা নাগাদ নাক আর গলার গভীর থেকে সোয়াব চলে গিয়েছিল ল্যাবরেটরির টেবিলে। রিপোর্ট এসএমএসে পৌঁছে গিয়েছে আজ সন্ধের আগেই। হঠাৎ। বিফোর টাইম।

যদিও সেই রিপোর্ট নিয়ে আমার আদৌ কোনও সংশয় ছিল না। আমি অনেক আগেই স্পষ্ট অনুভব করতে পেরেছিলাম, তারা ঢুকে পড়েছে আমার শরীরে। বি.১.১.৭। আমার নাক হয়ে, আমার গলা হয়ে, বুকের বিপজ্জনক গভীরতার দিকে নেমে গিয়েছে যে ভালোবাসাময় সুড়ঙ্গের ঢাল— যে ঢাল বেয়ে চুঁইয়ে নামে গন্ধ-স্বাদ-চুম্বনের অনির্বচনীয় শোভায়াত্রা— যে গোপন অন্ধকার থেকে আমার একান্ত শব্দরা ছড়িয়ে পড়ে বাইরের জ্যোতির্বলয়ে— সেখানে এখন শুরু হয়ে গিয়েছে ট্রাপিজের খেলা। এসিই২ রিসেপ্টরের সিঁড়ি বেয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে আতঙ্কের সেই বহু-প্রতীক্ষিত মারণ-সার্কাস। আরও গভীরে ঢুকে পড়ছে ওরা। আমার প্রতিটি কোষের অন্দরে— আমার প্রতিটি অস্তিত্বের প্রাকার চূর্ণ করে ক্রমশ থিকথিক করছে মারণ-বংশবিস্তার। ফুসফুসে ছড়ানো আমার নিকোটিন-রঙা অ্যালভিওলাইগুলোকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দেওয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে ওরা ক্রমশ ছেয়ে ফেলছে আমার কণ্ঠনালী-কণ্ঠস্বর। যত ছেয়ে ফেলছে আমার সামাজিক যাপন-বৃত্ত, আমার বোধ-চেতনায়— আমার অন্তর্গত অনাক্রম্যতায় ছড়িয়ে পড়ছে অসম্ভব এক একক অসহায়ত্ব। এক-দেড় বছরের দীর্ঘ চোর-পুলিশ খেলার শেষ। মড়ক ছুঁয়ে ফেলেছে আমাকে— আমার শরীর— আমার অন্দর-পরিসর। আমি আর বিচ্ছিন্ন নই। দাঁড়িয়ে পড়েছি মড়কের গন্ধ লাগা এক অবিচ্ছিন্ন, অন্তহীন লাইনে।

আমাদের গঙ্গা চলে আঁকেবাঁকে/বৈশাখ মাসে তায় মড়া ভেসে থাকে

মড়কের গন্ধ ছেয়ে ফেলছে আমার দেশ। গ্রাম-শহর-মফস্বল, প্রতিটি আশপাশ। অস্থি-মজ্জা-কোষ-শ্মশান-গঙ্গার ঘাট। মড়ক। মড়ক লেগেছে আমার দেশে। কয়েকদিন হয়ে গেল ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা চার লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। মৃতের সংখ্যা চার হাজার। সবই সরকারি হিসেব। বেসরকারি মতে আরও অন্তত তিনগুণ। অথবা চারগুণ। অথবা পাঁচ-ছয়গুণ। লাফিয়ে লাফিয়ে সংখ্যাগুলো ঘুরছে। কড়িকাঠ থেকে যেন একে একে ঝুলে ঝুলে আছে সব। শব— কোভিড-শব— অক্সিজেনের অভাবে মৃত সব— হাজারে-হাজারে— সব জমছে— রাস্তায়-বাড়িতে-নদীর ঘাটে। সৎকারের জায়গা থিকথিক করছে— পোড়ানোর কাঠ নেই— গোরস্থানে জায়গা নেই। মানুষ মরছে— পতঙ্গের মত— পালকের মত। হালকা। মাটিতে ভারী হয়ে পড়ার যে উপায় নেই। আমার দেশে আর সৎকারের জায়গা নেই। মানুষ মরে ভাসছে হাওয়ায়— মৃত ফড়িঙের মত; ভাসছে নদীর জলে— উলটানো কাগজের নৌকার মত— পূণ্যতোয়া গঙ্গায়।

স্বাভাবিক সময়ে শবকৃত্যের কাজ নিখুঁতভাবেই সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু যখন রোগ মহামারির আকারে পাহাড় ছারখার করে চলে যায়, যখন সদ্গতির ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের চেয়ে অনেক কম সময়ে তাড়াতাড়ি মানুষ মরতে থাকে, তখন গ্রামে একটি সহজ উপায়ে শবকৃত্য করা হয়। মৃতের মুখে একটি জ্বলন্ত কাঠকয়লা গুঁজে দিয়ে, পাহাড়ের কিনারা অবধি বয়ে নিয়ে গিয়ে শবটি নীচের উপত্যকায় ফেলে দেওয়া হয়।

১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু-এর প্রসঙ্গ এসেছিল জিম করবেটের লেখায়। ১৫ থেকে ১৮ মিলিয়ন মানুষ ভারতে শেষ হয়ে গিয়েছিল ১৯১৮-র মড়কে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। তখনও মানুষ মরেছিল— পতঙ্গের মত— পালকের মত। নিজের স্ত্রী ও পরিবারের আরও অনেককেই হারিয়েছিলেন হিন্দি কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী। কাউকেই দাহ করার কাঠ জোগাড় করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। তিনি লিখেছিলেন, গঙ্গার স্রোত কীভাবে ফুলে উঠেছিল ভেসে আসা মৃতদেহের ভিড়ে।

ঠিক একশো বছর আগে গঙ্গায় যখন শবদেহের ভিড়— ক্রমশ নরমাংসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিল নদীতীরবর্তী শকুন আর চিতাবাঘের দল— সদ্য রাজধানী দিল্লির বুকে মহান ব্রিটিশ রাজের তরফে তখন এডুইন লুটিয়েনের তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়ে চলছিল ঔপনিবেশিক গৌরবগাথার অনবদ্য এক একটি রেলিক। মাঝখানের শতাব্দী গঙ্গার জলে সিঁচিয়ে নিয়েছে আরেকটি মহাযুদ্ধ, একটি বিধ্বংসী মন্বন্তর, স্বাধীনতা, দেশভাগ। একশো বছর পর— গঙ্গা আবার, আবার যখন ফুলে উঠেছে মৃতদেহের ভিড়ে— কী আশ্চর্য সমাপতন— সেই লুটিয়েনের দিল্লির বুক খুঁড়েই তৈরি হয়ে চলেছে আধিপত্যের, দম্ভের এক নতুন গৌরবগাথা— বিশ হাজার কোটি টাকা দামী— সেন্ট্রাল ভিস্তা।

জানি না ঠিক কত সংখ্যায় শ্রমিকরা বাধ্যতামূলক কাজ করছেন সেখানে। এই সর্বব্যাপী মড়কে কী তাদের অবস্থা। শুধু এইটুকু জানি, ভাঙা ডানার মত তাদের মৃত্যুর নগণ্য ছাপ কোনওদিন লেগে থাকবে না সেইসব আত্মগর্বী নির্মাণের দেওয়ালে। আপাতত কয়েক হাজার কোভিড-শব— ফুলে কাঠ হয়ে ভাসছে কনৌজ-কানপুর-উন্নাও-এলাহাবাদ-বারাণসী-চন্দোলি-গাজিপুর-বালিয়া-বক্সারের ঘাটে-ঘাটে। কেউ কি খবর রেখেছে বিশ হাজার কোটি টাকায় তাদের জন্য কত মেট্রিক টন অক্সিজেনের ব্যবস্থা হতে পারত! একটু অক্সিজেনের জন্য ছটফট করতে করতে যে ফুসফুসগুলি চিরকালের মত নেতিয়ে পড়েছিল কয়েক ঘন্টা আগে, সেগুলো বাতাসের আনাগোনা ছাড়াই আবার ফুলে উঠেছে, ফেঁপে উঠেছে পবিত্র গঙ্গার জলে। কেউ কি জানতে পেরেছে তার কতগুলি মৃত্যু; আর কতগুলি হত্যা! একশো বছর আগেও— একশো বছর পরেও।

 

শুধু ধন্দ লেগে থাকবে

রোজই কেউ না কেউ চলে যাচ্ছেন। আমাদের ছেড়ে। বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয়-পরিজন। আর অহরহ ব্যক্তিগত পরিধির বাইরের প্রিয় মানুষেরা। রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চলে যাওয়ার সংখ্যা। শিরদাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের স্রোত যত দ্রুত নামে, তার চেয়েও দ্রুত বেড়ে চলেছে সংখ্যা আর সংখ্যা। তাঁরা কি সত্যিই যেতেন এই অসময়ে? সত্যি কি তাঁদের যাওয়ার ছিলই! মৃত্যু যদি হয় পাহাড়ের মত ভারী তাহলে সে হয়ত তার গৌরবগাথা অর্জন করে নেয়। কিন্তু পালকের চেয়ে হালকা মৃত্যুরা উড়তে থাকে। উড়তে থাকে দেশ ও সমাজের ঘরময়। একটি-একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির কড়িকাঠ থেকে ঝুলতে থাকে তারা। শুকনো; মড়কের গন্ধ লাগা।

যেমন করে একদিন মড়কের গন্ধ লেগে আচমকা শুকিয়ে পড়ে যায় ছেলেবেলার ঝাঁকড়া বাদামগাছটি। যখন তাজা ছিল সেই বাদাম গাছ— তার ওপার থেকে টিং-টিং বেল বাজিয়ে সাইকেল ছুটিয়ে আসত যে ছেলেটি; সে ছিল আশির দশকের শেষবেলার এক কিশোর রাজা। হলদে ছাদের লাজুক কিশোরী হাসিটি থেকে যার ফুসফুস শুষে নিত একবুক দমকা হাওয়া; গতকাল সকালেই— খবর পেলাম— সেই ফুসফুস থেমে গিয়েছে একবুক হাওয়ার অভাবে। আমার নিতান্ত বালক বয়সের রোল মডেল রাজা ঝরে গিয়েছে— পঞ্চাশ পেরোনোর আগেই। রাত এগারোটায় ফুরিয়ে গিয়েছিল অক্সিজেন সিলিন্ডার। কুড়িগুণ বেশি দামের বিনিময়ে প্রাণান্ত দৌড়ে আরেকটি সিলিন্ডার জোগাড় করা গিয়েছিল আবার ভোর ছটায়। ততক্ষণ আর লড়াই জারি রাখতে পারেনি অক্লান্ত সাইকেল চালানোয় আকৈশোর দক্ষ সেই এক জোড়া ফুসফুস।

এমনিতে বুকের সমস্ত প্রতিরোধ-ক্ষমতা এক করে লড়ছিল সে। কিন্তু পুরো লড়াইটা জেতার জন্য দরকার ছিল বাইরের একটু সামান্য সাহায্যের— যা তার একান্ত ন্যায্য প্রাপ্য ছিল— যা তার নাগরিক অধিকার— প্রয়োজনের মুহূর্তে এক সিলিন্ডার অক্সিজেন। যা পায়নি রাজা।

যেমন তালিব খান। জয়সলমিরের মাঙ্গানিয়ার গায়ক। মড়কের হাওয়া লেগেছিল তালিব খানের গলায়। যে গলার সুরে এক সপ্তাহ আগেও গাছেদের-মানুষের-পাখিদের ঘুম ভাঙত পুনম নগর গ্রামে— খানিকক্ষণ আগে সে গলা একটু বাতাস বুকে টেনে নেওয়ার ঘন্টাকয়েকের প্রাণান্তকর চেষ্টার পর চিরকালের জন্য থেমে গেল সরকারি হাসপাতালের করিডোরে, হুইলচেয়ারে বসে। তার পায়ের কাছেই বাবার ধীরে ধীরে স্থির হয়ে যাওয়া খোলা মুখের দিকে অবাক হয়ে অপলক তাকিয়ে ছিল ছোট্ট দুটি শিশু। তারা একদিন বড় হবে। বালিয়াড়ির হাওয়া মেখে তখন, যখন ভেসে আসবে পাগল করা কামাইচা ও খর্তালের ধুন, তাদের কি মনে পড়বে— ছটফট করতে থাকা তাদের বাবার গলাটা আবার সেই ধুনে সুর মেলাতে পারত, যদি সেই দু ঘন্টায় ভারতের গণ-স্বাস্থ্যব্যবস্থা তালিব খানকে দিতে পারত একটু বাতাস— প্রয়োজনের মুহূর্তে এক সিলিন্ডার অক্সিজেন? যা পায়নি তালিব খান।

যা পায়নি আমার পোড়া দেশের হাজার-হাজার রাজা। হাজার হাজার তালিব খান। উলটানো কাগজের নৌকার মত উন্নাও, গাজীপুর, বক্সারের ঘাটে ঘাটে রিগর মর্টিসে শক্ত হয়ে আটকে থাকা হাজার-হাজার রাজা। হাজার হাজার তালিব খান।

ছেলেবেলায় একটি বিদেশি ছবি ভুল করে দেখে ফেলেছিলাম। আজ আর নাম মনে নেই কিন্তু মনে আছে বেশ কয়েকদিন ঘুমোতে পারিনি। একটি বড় গামলার জলের মধ্যে পড়ে গিয়েছে ছোট্ট একটি পাখির ছানা। প্রাণপণে ভেসে থাকার চেষ্টা করছে সে। ওপরের কড়িকাঠ থেকে বাঁধা, সোজা গামলার জলে পড়েছিল একগাছি দড়ি। গোড়া থেকে গামলার পাশেই বসে পুরো ঘটনাটি লক্ষ্য করছিল একটি কিশোর। পাখির ছানাটি যখন তার সামান্য শক্তি নিয়ে তার শেষ অবলম্বন দড়িটি আঁকড়ে ঊঠে আসার চেষ্টা চালাচ্ছিল তখন ছেলেটির হাতে উঠে এল একটি ছুরি। না, সোজাসুজি ছানাটিকে আঘাত করেনি সেই ছুরি, শুধু দড়িটা কেটে দেওয়ার পর আর সামান্য সময় ভেসে থাকতে পেরেছিল পাখির ছোট্ট ছানাটি।

রাষ্ট্রের চোখে, সিস্টেমের চোখে, মুনাফা তৈরির জান্তবতার চোখে, সুযোগ-সন্ধানী কালোবাজারির চোখে, শয়তানের গগনচুম্বী ঔদাসীন্য ও দম্ভের চোখে যে নাগরিক জীবনের দাম ধুলোর কণার চাইতেও কম, সে জীবন ছোট্ট পাখির ছানাটির মত, পতঙ্গের মত ঝরে পড়বেই। শুধু ধন্দ লেগে থাকবে নিশ্চিত। সে সব ঝরে পড়া— মৃত্যু না হত্যা!

 

মৃত্যু নয়, মনে রেখো হত্যা

দরজার কোনা থেকে ঝুলতে থাকা অসংখ্য কাপড়-চোপড়ের মধ্য দিয়ে বেশ একটা পুরনো ব্যাগের নীচের দিকের অংশটা বেরিয়ে আছে। নিজেরই ঘরে ব্যাগটাকে চিনতে পারলাম না আমি। চেষ্টাও করলাম না, শুধু দেখলাম, বেশ বড় করে ছাপা একটা ফোন নাম্বার। নাম্বারের নীচে লেখা— রক্ত, মল, মুত্র ও কফ বাড়ি থেকে যত্নসহকারে সংগ্রহ করা হয়। আরেকটু নীচে ছোট করে লেখা— অক্সিজেনের সুবন্দোবস্ত আছে।

রাত তিনটের সময় কেউ আমার ফোন ধরবে আশা করি না। তবুও ভারী চোখের পাতা প্রাণপণ খুলে ডায়াল করলাম। দিস নাম্বার ডাজ নট এগজিস্ট। এবং আমি শান্তিতে চোখ বুজলাম। যেন আমি জানতাম ডায়াল করলে এটাই শুনব। তবে কেন ডায়াল করলাম! আমি কি বোকার মত নিজেই প্রমাণ করতে চাইছিলাম আমার নিজেরই ভয় ও অবিশ্বাস? আমি কি নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলাম এইটা আরও একবার জেনে যে আমার পাশে প্রয়োজনের মুহূর্তে অক্সিজেন জোগানোর জন্য কোনও সিস্টেম নেই— নেই কোনও রাষ্ট্র! যা আসলে কখনওই ছিল না। মুনাফার যন্ত্র এবং মানবকল্যাণ— একই সঙ্গে চালু থাকতে পারে না। এক শতাব্দী আগেও নয়, এক শতাব্দী পরেও নয়।

একটি অতিমারি একটা গোটা সামাজিক ল্যান্ডস্কেপকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। আবার হাজারে হাজারে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি মালার মত গেঁথে বসে সমাজের ওপরে, আর সেখান থেকেই তৈরি হয় সমষ্টিগত সহনশীলতার পর্ব। মানুষ মেনে নিতে থাকে। ক্রমাগত মেনে নিতে নিতে আবার বুনতে শুরু করে ভবিষ্যতের যাপণচিত্র। সেই যাপনচিত্রে আশার শুকতারা হয়ে ফুটে ওঠে কিছু ব্যক্তিমানুষের, কিছু সংগঠনের হৃদয়-ছোপানো প্রচেষ্টা। তবুও এবং তারপরেও… সেই যাপনচিত্রের আনাচে-কানাচে ছাইচাপা থাকে অনিবার্য ভবিষ্যৎ মড়কের গন্ধ। তবুও এবং তারপরেও… এত লাখে লাখে চিতা জ্বলছে গোটা দেশ জুড়ে— কোনও সমষ্টিগত আগুন কেন জ্বলে উঠতে পায় না গঙ্গার জলে ভিজে নেতিয়ে যাওয়ার আগেই— অসহায়তার রিগর মর্টিসে শক্ত হয়ে যাওয়ার আগেই!

এখনও আমার এসপিও২ দেখাচ্ছে সাতানব্বই। যদি নেমে যায় তা আশির ঘরে? আমার কাছে টাকা নেই— নেই ব্যবস্থা। অতি সাধারণ আম-নাগরিক আমি মড়কের দৌলতে জেনে গিয়েছি, আমার জন্য এক শতাব্দী পরেও তৈরি হয়নি কোনও গণ-স্বাস্থ্যব্যবস্থা— যা আমাকে নিশ্চিত করতে পারে প্রয়োজনের মুহূর্তটিতে এক সিলিন্ডার অক্সিজেন। তবুও আমি ও আমরা— যাদের শরীরে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে মড়কের গন্ধ— কর্পোরেশানের, মিউনিসিপ্যালিটির, পঞ্চায়েতের কোভিড-সংখ্যার অন্তহীন-অবিচ্ছিন্ন লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছি যারা— যে কোনও মুহূর্তে যাদের বুকে উঠতে পারে দুর্দমনীয় সাইটোকাইন ঝড়— তারা সবাই উপায়হীন চাতক পাখির মত তাকিয়ে আছি রাষ্ট্র, অর্থনীতি বা ব্যবস্থার দিকে— অতিপ্রয়োজনীয় কয়েকফোঁটা আক্সিজেনের জন্য। এবং . . . এরপর প্রয়োজনের মুহূর্তটিতে যদি তার অভাবে বুকের মধ্যে ওঠে সেই ঝড়— মৃত কোষেদের শবদেহে ক্রমশ ভরে আসে আমাদের বুক— জবাব দিয়ে দেয় একটির পর একটি অ্যালভিওলাই— একফোঁটা বাতাসের জন্য হাঁকপাক করতে করতে হাল ছেড়ে দেয় আমাদের কণ্ঠনালী— তখন, বাকিরা মনে রেখো— সেগুলো মৃত্যু নয়, হবে হত্যা।

 

শেষে কটি তথ্য:

  1. সরকারি হিসাবে ভারতের মোট অক্সিজেন উৎপাদন ৭১২৭ মেট্রিক টন, যার বেশির ভাগটাই ব্যবহৃত হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রয়োজনে। শেষ পর্যন্ত ২২ এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু পনেরটি বিশেষ বিশেষ কোম্পানিকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে রাখা হয় যারা অন্তত ২৫০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন ব্যাবহার করে। বাকী ৪৬২৭ মেট্রিক টন অক্সিজেন পড়ে থাকে মেডিক্যাল প্রয়োজনের খাতিরে। এদিকে মেডিক্যাল অক্সিজেনের প্রয়োজন, ১২ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল, এই মাত্র দশ দিনে ৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮৪২ মেট্রিক টন থেকে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৭৮৫ মেট্রিক টনে। এটা ২২ এপ্রিলের হিসেব। তারপরে ভারতবর্ষে অতিমারি ক্রমশ আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে চলেছে। তথ্য সৌজন্যে: নিউজলন্ড্রি।
  2. অক্টোবর ২০২০-তে মোদি সরকার সারা দেশে ১৫০টি পিএসএ (প্রেসার স্যুইং অ্যাবসর্পশন) অক্সিজেন প্লান্ট তৈরির টেন্ডার আহ্বান করে। ২০২১-এর জানুয়ারিতে জানা যায় কেন্দ্র পিএম কেয়ার ফান্ড থেকে ২০১.৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে ১৬২টি প্লান্টের জন্য। অথচ এই অতিমারির সময়ে দীর্ঘ ৬ মাস পরে এপ্রিল শেষে দেখা যায় মাত্র ৩৩টি প্লান্ট তৈরি হয়েছে, যদিও ফান্ডের কোনও অভাব ছিল না, কারণ ২০১৯-২০ বছরে পিএম কেয়ার ফান্ডে ৩০৭৬.৬২ কোটি টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। তথ্য সৌজন্যে: ন্যাশনাল হেরাল্ড ও দ্য হিন্দু।
  3. কেন্দ্রের অগ্রাধিকার স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন এই বীভৎস অতিমারির সময় অক্সিজেনের অভাবে অকাতরে মানুষ মরছে, শহর ও গ্রামের হাসপাতালগুলি অক্সিজেনের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে– তখন আমাদের দেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড অক্সিজেন তৈরি ও রপ্তানিতে ব্যস্ত। এই অতিমারির সময়েও, সময়টা লক্ষ করুন, ২০২০-র এপ্রিল থেকে ২০২১-র জানুয়ারির মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ ৯৮৮৪ মেট্রিক টন ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন রপ্তানি হয়েছে। যে পরিমাণটা তার আগের বছরে ছিল মাত্র ৪৫০০ মেট্রিক টন। তথ্য সৌজন্যে: ন্যাশনাল হেরাল্ড।
  4. এই লেখাটার সময় পর্যন্ত দিল্লি এয়ারপোর্টে বিদেশগুলি থেকে আসা সাহায্য বেশ কয়েকদিন পরেও এয়ারপোর্টেই পড়ে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাহায্য এসেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১০০০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার। ব্রিটেন পাঠিয়েছে ৪০০টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। ফ্রান্স পাঠিয়েছে ৮টি অক্সিজেন জেনারেটর, যার প্রত্যেকটি থেকে ২৫০ জন হাসপাতালস্থিত রোগী উপকৃত হতে পারতেন। এছাড়াও জার্মানি থেকে এসেছে অন্তত ১২০টি ভেন্টিলেটর। এই সব কিছু পড়ে আছে এয়ারপোর্টেই অথচ বাইরে অক্সিজেনের অভাবে দমবন্ধ হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছেন। তথ্য সৌজন্যে: ডিডব্লিউ.কম।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4821 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...