“আজ থেকে পাঠশালা বন্ধ”

শুদ্ধ সত্য রায়

 



ছাত্র, ‘আনলক ক্যাম্পাস’ আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

হীরক রাজার দেশের সেই উক্তি বাঙালির মনে গেঁথে গেছে। করোনাকালে যেন উক্তিটির যথার্থ প্রয়োগ ঘটানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে মোদি এবং মমতা সরকার। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার চাইছে জনগণ শপিং মলে গিয়ে কেনাকাটি করুক, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখুক, পানশালায় গিয়ে একটু গলা ভেজাক, সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি উপনির্বাচনের প্রচারে জনসমাবেশ করুক, সবই ঠিক আছে। কিন্তু, স্কুল-কলেজ খুলে দিলেই করোনা রে রে করে তেড়ে আসবে, অগত্যা অনলাইনে ক্লাস করো। কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সবার মনে প্রশ্ন জাগবে যে সরকার বাহাদুরের স্কুল কলেজ খোলা নিয়েই এত আপত্তি কেন? কেন বারবার অনলাইন শিক্ষার দিকে ঠেলে দিতে চাইছে তারা আপামর ভারতের ছাত্রছাত্রীদের!

এই উত্তরটা পেতে গেলে আমাদের একটু পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিতে হবে। আমরা একটু কষ্ট করলেই দেখতে পাব যে পশ্চিমবঙ্গের মাত্র ৭.৯ শতাংশ গ্রামীণ এবং ৩৬ শতাংশ শহরের পরিবারের কাছে ইন্টারনেট আছে। আবার গ্রামের মাত্র ৩ শতাংশ পরিবারের কাছে এবং শহরের মাত্র ২৩ শতাংশ পরিবারের কাছে কম্পিউটার আছে এবং গোটা ভারতের ৯১ শতাংশ ছাত্রছাত্রীদের কাছেই স্মার্টফোন নেই। আসলে ভারতের সংবিধানে যেসব মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে তা সংবিধানের পাতা থেকে আর দেশের জনগণের কাছে পৌঁছয়নি। সেইরকমই শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। নাম রক্ষা করার জন্য যেটুকু শিক্ষা জনগণের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল সেটুকুও কেড়ে নিতে চাইছে রাষ্ট্র। তাই স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে শ্রমজীবী পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের সস্তা শ্রমিকে পরিণত করতে চাইছে সরকার। শহরের বস্তি থেকে গ্রামাঞ্চলের দিকে তাকালেই দেখা যাবে অনলাইন শিক্ষার ফলে বিপুল পরিমাণে স্কুলছুট বেড়েছে, কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া এবং শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো।

শিক্ষার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে সস্তার শ্রমিকে পরিণত করার বিরুদ্ধে আমরা Unlock_campus-এর পক্ষ থেকে বিগত বেশ কিছুদিন রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়, শহরে, গ্রামে প্রচার অভিযান শুরু করেছিলাম। গত ১৩ সেপ্টেম্বর কলেজ স্ট্রিটে আমরা মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতীকী রাস্তা অবরোধের ডাক দিয়েছিলাম। কিন্তু, পুলিশ তার অনুমতি দেয়নি, আগে থেকেই জানানো হয়েছিল যদি কোনও জমায়েত হয় তাহলে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেইহেতু বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আসার কথা ছিল, তাদের আমরা সেখানে নিয়ে আসতে পারিনি। কিন্তু, আমাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি পালন করার জন্য আমরা যখন ছোট জমায়েত করে কলেজ স্কোয়ারের সামনে পৌঁছোই এবং রাস্তা অবরোধ করি তখন পুলিশ আমাদের সাথীদের মারধর করতে করতে টেনেহিঁচড়ে ভ্যানে তোলে এবং পুরুষ পুলিশ ছাত্রীদের গায়ে হাত তোলে এবং এক সাধারণ ছাত্র যে কিনা আমাদের অবরোধে অংশও নেয়নি তাকেও পুলিশ তুলে নিয়ে যায় লালবাজারে। আমাদের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টের ৫১বি এবং ১৪৩, ১৪৯, ২৮৩, ১৮৮ IPC ধারায় মামলা দেওয়া হয়।

এই পুরো ঘটনা আমাদের কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে। বিগত বেশ কিছু মাস ধরে যাঁরা মমতা ব্যানার্জীকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মুখ বানানোর জন্য প্রচার করে এলেন তারা কি স্কুল-কলেজ খোলার দাবিতে আন্দোলনে পুলিশি সন্ত্রাসকে ফ্যাসিবাদের ভ্রূণ মনে করেন না! তারা কি উপলব্ধি করেন না যে সরকার স্কুল-কলেজ খোলার দাবিতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের ওপর ধারাবাহিকভাবে পুলিশি সন্ত্রাস নামিয়ে আনছে তারা ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মুখ হতে পারেন না! না কি সেখানে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে? এই প্রশ্ন আমাদের থাকবে। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই সাধারণ মানুষের অধিকারের আন্দোলনে ক্ষমতাশালী পুলিশি রাষ্ট্র আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তত প্রতিরোধ হয়েছে, ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় রক্তে লেখা আছে জনগণের প্রতিরোধের কাহিনি। আমাদের ওপর পুলিশি সন্ত্রাস নামিয়ে এনে খেটেখাওয়া মানুষের শত্রু রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার যদি ভাবে আমরা পিছিয়ে আসব তাহলে তারা মূর্খের জগতে বাস করছে। আমরা জানি অধিকার চাইলে পাওয়া যায় না, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়, পুলিশের লাঠির সামনে গোলাপ ফুল নয় পাল্টা আঘাত ফিরিয়ে দিতে হয়। এই শিক্ষা আমরা ইতিহাস থেকে পেয়েছি। তাই, আমরা ক্যাম্পাস বন্ধ করে রাখার বিরুদ্ধে জঙ্গি গণআন্দোলন গড়ে না তুলে “মগজে কারফিউ” ভাঙার নামে রাস্তায় অথবা বটগাছের নিচে বসে নামি দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের এনে পাল্টা ক্লাসরুম চালানোর নামে গিমিক দিয়ে খবরের কাগজের পাতায় আসতে চাই না। ইতিহাসের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েই আমরা আমাদের আন্দোলন “লাঠির মুখে গানের সুর” নয়, লাঠির মুখে প্রতিরোধের সুরেই এগিয়ে নিয়ে যাব এবং এই দাবির সাথে সহমত পোষণকারী সমস্ত সংগঠন, ব্যক্তি, মঞ্চকে আহ্বান জানাব যে তারা এই পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অত্যন্ত জরুরি লেখা। ধন্যবাদ, চারনম্বর প্ল্যাটফর্ম।

    হীরক সেনগুপ্ত

Leave a Reply to হীরক সেনগুপ্ত Cancel reply