প্রেম-ভালোবাসার ঠাঁই নেই কোনও ধর্মেই— বিধর্মীরা ঘৃণ্য, প্রয়োজনে হত্যার যোগ্য

প্রেম-ভালোবাসার ঠাঁই নেই কোনও ধর্মেই— বিধর্মীরা ঘৃণ্য, প্রয়োজনে হত্যার যোগ্য -- শৈলেন সরকার

শৈলেন সরকার

 

উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে এক ধর্মসংসদের আয়োজন করেছিলেন গাজিয়াবাদের দশনা দেবী মন্দিরের পুরোহিত ও জুনা আখড়ার প্রধান ইয়াতি নরসিংহানন্দ। সেই ধর্মসংসদ থেকে প্রাক্তন এক আরএসএস-এর প্রচারক জনৈক প্রবোধানন্দ গিরি বললেন, ভারতের হিন্দুদের এখন পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারকে অনুসরণ করতে হবে। না, মায়ানমারের সমাজকল্যাণ বা অন্য কোনও নীতি নয়, বলা হচ্ছে মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতারণ নীতির কথা। ভারতকেও নাকি এভাবেই দেশ থেকে মুসলমানদের বিতারণ করতে হবে। এই প্রবোধানন্দ গিরি আবার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ঘনিষ্ঠ, তাঁর মতে এটি আসলে সাফাই অভিযান, ভারতকে জঞ্জাল অর্থাৎ মুসলিমমুক্ত করতে হবে। সাধ্বী অন্নপুর্ণা— যিনি নিরঞ্জনী আখড়ার অন্যতম প্রধান ও হিন্দু মহাসভার সাধারণ সম্পাদক, তার মতে আমাদের (মানে হিন্দুদের) প্রতি ১০০ জন যদি ২০ লক্ষ মুসলিমদের খতমের জন্য তৈরি থাকি তবে ভারত একদিন হিন্দু রাষ্ট্র হবে।

এবার দেখা যাক অমুসলিমদের নিয়ে মুসলিমরা কী ভাবে? আমরা তালিবানদের কথাতেই আসি, তালিবানদের কথায় অনেকেই হাঁ-হাঁ করে আসবেন, হ্যাঁ, তালিবানরা কিন্তু একেবারে কোরান-হাদিস অনুসারেই যথার্থ মুসলিম। এদের তত্ত্বগত উৎস আবার ভারতেই। ১৮৬৭ সালের ভারতের দেওবন্দি ইসলামে। ১৯৯৮ সালের আফগানিস্তানে ওদের ফর্মানে অমুসলিমদের সে দেশে নতুন করে কোনও মন্দির বা মঠ তৈরি করতে বারণ করা হয়েছিল। অমুসলিমরা মুসলিমদের কোনও সমালোচনা করতে পারবে না, তাদের ঘরবাড়ির দেওয়ালে বা ছাদে হলুদ রঙের কাপড় দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে, আর মুসলমানরা যে ধরনের বাড়িতে থাকে সেই ধরনের বাড়িতে অমুসলিমরা থাকতে পারবে না। মুসলিমরা যাতে অমুসলিম নারীদের সংস্পর্শে না আসতে পারে সে জন্য অমুসলিম নারীদের গায়ে হলুদ কাপড় জড়িয়ে রাখতে হবে। আবার বলছি, কোনও তথাকথিত উদারপন্থী যদি বলেন তালিবান বা আইসিসরা প্রকৃত মুসলিম নন তবে তার চেয়ে হাস্যকর আর কিছু হতে পারে না, কেন না এদের নেতারা সব অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ইসলামিক স্কলার। কোরান বা হাদিসের বাইরে এরা এক পা-ও চলে না। ভালো কথা এই সব হিন্দু-মুসলিমদের আচরণ বেশ চেনা মনে হচ্ছে না? মানে আপনি যদি এখনকার তৃণমূল-সিপিএম-বিজেপি বা কংগ্রেসের কথা ভাবেন? সিপিএমের আমলে বিধর্মী কংগ্রেসি বা তৃণমূলীদের প্রতি সিপিএমের আচরণের কথা মনে পড়ে? হত্যা-অগ্নিসংযোগের কথা? হ্যাঁ এদের আবার মন্দির-মসজিদের জায়গায় পার্টি অফিস। বা এখনকার তৃণমূলিদের কতটুকু প্রেম আছে সিপিএম-কংগ্রেস বা বিজেপিওয়ালাদের জন্য? দু হাজার এগারোর নির্বাচনে সিপিএমের হার ও তৃণমূলের জয়ের পরপরই সিপিএমের পার্টি অফিস ভাঙা বা পার্টি অফিসে অগ্নিসংযোগের কথা মনে পড়ে? বা বেদখল হওয়া? মনে করুন অতীতের মুসলমানদের জয়ের পর হিন্দু মন্দির ভাঙা বা বর্তমানের বিজেপি উত্থানে মুসলিম মসজিদ ভাঙা। ব্যাপারটা আলাদা কোথাও? আরও আছে, মুঘলসরাই বা বিভিন্ন স্থানের নাম পরিবর্তনের কথাও আসবে। আসবে এমনকি তাজমহলের নাম পরিবর্তন নিয়ে ভাবনার কথাও।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে কী আছে? কী আবার, শুধুই অবিশ্বাস আর ঘৃণা। না, ভুল হল, বলা উচিত প্রয়োজনে ছদ্মপ্রেম। কিন্তু তার আড়ালে ওই অবিশ্বাস আর ঘৃণাই। ছদ্মপ্রেম মানে, ছোট কোনও সাময়িক স্বার্থ চরিতার্থ— এই যেমন ভোটে সুবিধা পাওয়া বা অমনি কোনও কারণে মুখে হাসি নিয়ে হাত ধরাধরি করা এমনটিই। সিপিএম-কংগ্রেস বা বিজেপিওয়ালাদেরও তৃণমূলিদের প্রতি সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ভ্রাতৃত্ববোধও আসলে তেমনিই। ওইসব হিন্দু-মুসলিম ধর্ম-টর্ম আসলে প্রাচীন রাজনীতির অবশেষ ছাড়া তো আর কিছুই নয়, অন্যরকম আর হবে কীভাবে?

কদিন আগে দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার কোম্পানির ঠেকে কথা হচ্ছিল এক তৃণমূল কর্মীর সঙ্গে। ক্লাবে ক্যারাম খেলছিল সব বন্ধুরা মিলে। আর ওই খেলতে খেলতেই ওদের পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবসের কথা উঠল। সামনের ১ জানুয়ারি। ‘ফিস্টি’ হবে।

–ফিস্টি মানে?

–ফিস্টি মানে ওই প্রতিষ্ঠা দিবসের জন্য জমায়েত হবে। স্লোগান-টোগান হবে আর আসল হল খাওয়া-দাওয়া।

–পয়সা দিতে হবে কোনও?

–না না, ওটা পার্টির ব্যাপার।

–কী খাওয়া হবে?

–মুরগি।

–রান্না করবে কি তোমরাই?

–হ্যাঁ, আমরাই তো, ওই হিন্দুদের জন্য রাঁধবে হিন্দুরা আর আমাদের মানে মুসলমানদের জন্য মুসলমানেরা।

–কেন, এরকম কেন হবে? গরু হচ্ছে না তো বা ভঁইস, তাহলে না হয় বোঝা যেত, খাবে না অনেক হিন্দুই, কিন্তু গরু বা ভঁইস হচ্ছে না তবু হিন্দু-মুসলিম আলাদা?

লোকটির নাম না হয় করলাম না, কিন্তু মুসলিম মানুষটি বললেন, এইরকমই হয় বুঝলেন, সেই আগে থেকেই এটা নিয়ে কেউ মনে করে না কিছু। হিন্দুদের রান্না হিন্দুরা আর মুসলমানদের রান্না মুসলমান। বললাম, আগে থেকে মানে? আগে থেকে মানে সেই সিপিএম-এর আমল থেকেই। ওরা আগে সব ছিল সিপিএম-এ। কান্তি গাঙ্গুলির পেছনে। এখন তৃণমূল।

শহরে বসে আমাদের পুরো দেশের ঠিকঠাক অবস্থা বোঝার উপায়ই নেই কোনও। এখানে না হয় দেশ বলতে বাংলার কথাই ধরছি। বেশ অসাম্প্রদায়িক বা উদার বলে যে দেশের নামডাক খুব। এ দেশের মানে বাংলার কথাই ধরি, হিন্দু-মুসলিম মিশ্র এলাকায় যদি কোনও মুসলিম মালিকের খাওয়ার জিনিসের দোকান দেখেন তবে নিশ্চিত জানবেন হিন্দু খরিদ্দাররা ওখানে ভুলেও পা দেবে না। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, কিন্তু ব্যতিক্রম দিয়ে নিয়ম হয় না। মৈপীঠের রেজাউল আমাকে ধরাল ব্যাপারটা। কদিন হল ওদের পাড়ায় এক ‘ঠাকুর’ তেলেভাজার দোকান দিয়েছে একটা, ভালো বিক্রি। রেজাকে বললাম, তোমরাও তো দিতে পারতে দোকান। রেজা বলল, ওর কাকা দিয়েছিল এই তেলেভাজার দোকানই, কিন্তু ‘বাঙালি’রা ঢুকতই না দোকানে, আর ‘বাঙালি’দের হাতেই তো পয়সা, ওরা দোকানে না এলে দোকান চলে কীভাবে? অর্থাৎ কেনাবেচার অভাবে বন্ধই করে দিতে হল দোকানটা। কিন্তু এই ‘বাঙালি’রা কারা? হ্যাঁ ‘বাঙালিরা’, গোটা বাংলা জুড়েই শেখানো হয়েছে হিন্দু বাঙালিরা ‘বাঙালি’ আর ধর্মে মুসলমানেরা শুধুই ‘মুসলমান’। অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার, কাশীনগরে বসে এক ইউনিভার্সিটিতে পড়া বাঙালি হিন্দু সামনে বসে থাকা প্লাস্টিক ব্যবসায়ী আলমগীরকে বেমালুম বলে গেল “কেউ মরে গেলে আমাদের বাঙালিদের কাজ আর তোমাদের মুসলমানদের—।” লোকটার ভুল ধরাতে আর ইচ্ছে করে না।

আমরা অনেকেই গোলা-গোলাভাবে অতি গদগদ হয়ে বলে ফেলি ‘সব ধর্মই শান্তির কথা বলে, কোনও ধর্মই মানুষে মানুষে হিংসার কথা বলে না।’ যদি বলি কোন ধর্মে বলা হয়েছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার কথা? কোনও ধর্মেই না। সব ধর্মেই মানুষের এক একটি আলাদা সংজ্ঞা। যার যার ধর্মের অনুসারীদের বাইরে কেউ তো মানুষই নয়। কোনও ধর্মেই বিধর্মীদের নিজেদের সমমানের মর্যাদা দেওয়া হয় না। মুসলিমরা বিধর্মীদের বলবে কাফের এবং তারা বশ্যতা স্বীকার না করলে অবশ্যই হত্যার যোগ্য। হিন্দুরা বৌদ্ধদের ‘পাষণ্ডি’ অভিধায় অভিহিত করে সেই শঙ্করাচার্যের নেতৃত্বে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন। প্রেমের ঠাকুর চৈতন্যের যুগে এই বাংলাতেই ‘পাষণ্ডি’দের সাজানো তর্কযুদ্ধে হারিয়ে গলায় গলন্ত সীসা ঢেলে হত্যা করা হয়েছে। হিন্দুরা মুসলমানদের আগে যাও-বা একটু সুন্দর করে ‘যবন’ বলত, কিন্তু যুগের পরিবর্তনে এখন একেবারে ‘মোল্লার পো’ বা ‘শেখের বাচ্চা’ বা স্রেফ ‘নেড়ের জাত’। হিন্দুসমাজের কর্তাব্যক্তিরা আবার নিজেদের স্বার্থ বরাবরের মতো কায়েম করতে কোনকালে ‘গীতা’ নামক এক ধর্মশাস্ত্রের মাধ্যমে অশিক্ষিত ও অজ্ঞ মানুষদের বুঝিয়েছেন ভগবান অবতার হয়ে নীচে নেমে তাদের বাঁচার উপায় বাতলেছেন। কী উপায়? না ভগবানের মুখ, কাঁধ, হাঁটু বা পা থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন জাতের মানুষকে ভগবানের কথা বা ভগবানের পাঠানো অবতারের কথা শুনে চলতে হবে। তিনি ঈশ্বরের অবতার শ্রীকৃষ্ণ। তিনি ধরাধামে নামেন ‘ধর্মসংস্থাপনা’র জন্য। শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণীই হল ‘শ্রী মদ্ভাগবত’ বা ‘গীতা’। যাবতীয় শ্রমজীবী বা কর্মী মানুষদের ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যদের সেবা করতে হবে। এইসব ওপরতলার মানুষকে সেবার সময় কোনও ফলের আশা করা যাবে না। তোমাকে যদি যথাযথ শ্রমের মূল্য না দেওয়া হয়, তুমি তা দাবী করতে পারবে না। না খেয়ে থাকলেও খাবার চাইতে পারবে না। স্পষ্টত কর্মফলের আশা করা যাবে না— ফলের আশা না করে ব্রাহ্মণদের সেবায় জীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই পরের জীবনে তুমি ব্রাহ্মণ। কী ধুরন্ধর নষ্টামি! নিজেদের সুবিধামতো বর্ণবিভাজন করে বিশাল সংখ্যক শ্রমজীবী বা কৃষিকর্মে নিযুক্ত মানুষকে অমর্যাদাকর শূদ্র শ্রেণিতে পাঠিয়ে তাদের জন্য জারি করা হল পৃথক নিয়ম। স্রেফ শোষণ আর বঞ্চনার একেবারে পাকাপাকি ব্যবস্থা। আর গীতাকে নিয়ে কতই না শোরগোল, একেবারে ঋষি বঙ্কিম থেকে মহাত্মা। এক ব্রাহ্মণ দরকারে শূদ্রকে হত্যা করতেই পারে— তার মৃত্যুদণ্ড নেই, কিন্তু এক শূদ্র? তার মৃত্যভয় একেবারে পদে পদে, গোহত্যা থেকে শুরু করে। মুসলিম বা শূদ্র বা দলিত শ্রেণি যে বর্ণহিন্দুদের কাছে কতটা ঘৃণার তা বাংলার মুসলিমরা এবং অবশ্যই হিন্দুরা ভালোই জানে। বর্ণহিন্দুদের গায়ে ছোঁয়া লাগা নয়, ওদের ছায়া যদি পবিত্র বর্ণ হিন্দুদের গায়ে লেগেছে তার ফল যে কত ভয়ানক হতে পারে তা পূর্ব বাংলা থেকে পালিয়ে আসা আমার মায়ের কাছে শুনেছি। মায়ের কথায় ‘আমরা ওদের ওপর যা অবিচার করেছি ওরা তা একেবারে কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দিয়েছে।’ ঘর তো দূরের কথা, মুসলমানেরা হিন্দুদের বারান্দায় উঠতে পারত না। কোনও অনুষ্ঠানে হিন্দু বাড়িতে মুসলমানদের জন্য হত আলাদা অমর্যাদাকর ব্যবস্থা। মুসলমানরা ছিল হিন্দুদের কাছে ঘৃণ্য। মনে রাখার যে জমির মালিকানার শতকরা নব্বই ভাগই ছিল হিন্দুদের, আর মুসলমানরা নিজেদের দেশেই ছিল খাতক প্রজা। আর সেই দেশ থেকে হাজার বছরের করে চলা অন্যায়ের শাস্তি পেয়ে বিতাড়িত হওয়ার পর কত কান্না, কত সাহিত্য, কত সিনেমা। অথচ হাজার বছর ধরে নিম্নবর্ণ বা মুসলিম বা দলিত বা আদিবাসীদের ওপর বর্ণ হিন্দুদের করা অত্যাচার বা নিষ্ঠুরতার কথা কারও মনে পড়ল না।

যে কারণে এত কথা বলা, অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে কোনও? না, হওয়া সম্ভবও নয়। যতদিন ধর্মের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন এক ধর্মের মানুষের অপর ধর্মের প্রতি ঘৃণাও থাকবে। মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষাপটে এক নির্দিষ্ট ভৌগলিক অবস্থানের শাসক শ্রেণির রাজনীতির ফসল এই সব ধর্ম নিজেদের স্বার্থেই এমন নিয়ম তৈরি করে রেখেছে যে ভিন্নধর্মের প্রতি যেন কোনওভাবেই সেই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষের কোনও অনুরাগ তৈরি না হয়। খাদ্যাভ্যাস থেকে পোষাক-পরিচ্ছদ থেকে সকাল থেকে সন্ধ্যা প্রত্যেকের জীবন এমন ধর্মীয় অনুশাসনে বেঁধে ফেলা হল যাতে এক ধর্মের মানুষ যেন অন্য ধর্মের সংস্পর্শেই না যেতে পারে। ভিন্ন ধর্ম মানেই ভিন্ন রাজনীতি। প্রত্যেক ধর্মশাস্ত্রেই একেবারে সুস্পষ্ট ভাষায় ভিন্ন ধর্মের মানুষকে ঘৃণার কথাই বলা হয়েছে। না, কোনও ধর্মের বিচারেই ভিন্ন ধর্মের আল্লা বা ঈশ্বর বা গড এক নয়। এই সব আল্লা-ঈশ্বর বা গডের প্রেম-প্রীতি বা ভালবাসা শুধু নিজ নিজ ধর্মের অনুসারীদের জন্যই। আল্লা কি যত ভাল কাজই করে থাকুক, কোনও হিন্দুকে জন্নতে পাঠাবে? বা চিত্রগুপ্ত কি কোনও মুসলমানের খাতা লিখছেন? তিনি কি কোনও মুসলমান— যিনি সারা জীবন অনেক ভাল কাজ করেছেন, তার হিসাব-নিকাশ বুঝে তাঁকে দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে স্বর্গে রেফার করবেন? অবশ্যই করবেন না।

কোনও দিন মুসলমানদের জলসা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান শুনেছেন? সে এক বিরাট ব্যাপার, দূর-দূরান্তের আত্মীয়রা সব আসবে বাড়িতে আর রাত জেগে ধর্মের কথা, আসবেন সব বিখ্যাত আলেম বা হাফেজরা। আর এই সব বক্তৃতায় শুনবেন মেয়েদের প্রতি আর বিধর্মীদের বকলমে হিন্দুদের প্রতি হাস্যকর সব কুরুচিকর কথা। শুনবেন প্রেমের অবতার শ্রীচৈতন্যের অনুসারী বৈষ্ণবদের অনুষ্ঠানও। নাম সংকীর্তন, মাইক বাজিয়ে অহোরাত্র প্রেমের নিবেদনের নামে সেখানেও মেয়েদের বিরুদ্ধে বাজে কথা আর শুধুই ছোঁয়াছুয়ি আর শুধুই ঘৃণা। শহরে বসে যারা বই লেখেন তাঁরা নিজেদের মনগড়া কথাই লেখেন শুধু।

ভাল কথা, আমাদের সেই রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকার নিয়ে আমরা যারা গর্ব করি সেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শহর বা শহরতলির হিন্দু বাঙালিদের পাড়ায় বাড়িভাড়া করতে চাইলে কোনও মুসলিম ব্যক্তি বাড়ি বা ঘর পান? বা মুসলিম কোনও পরিবার?  শুনেছেন কোনও দিন?

কোনও বয়স্ক মুসলমানকে কোনও হিন্দু সন্তান পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে দেখেছেন? বা হিন্দু হয়ে থাকলে, আপনি নিজে প্রণাম করেছেন কোনও বয়স্ক বা শ্রদ্ধেয় মুসলমান মানুষকে? খেয়াল করে দেখুন, দেখেননি বা নিজেও করেননি। আবার কোনও মুসলমান ছেলেমেয়ে কোনও হিন্দুকে সালাম করেছে দেখেছেন? না, দেখেননি। জেনে রাখুন, আপনি কাফের বা বিধর্মী হয়ে থাকলে কোনও মুসলমান আপনাকে ‘আসসালাম ওয়ালেকুম’ বলে সম্ভাষণ করবেন না। ধরা যাক, এক হিন্দু পিতা বা মাতা— তা রক্তসম্পর্কিত বা পালকপিতা-মাতা যাই হোক, কন্যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এক মুসলমান ছেলের। সেই মুসলমান ছেলে কি সালাম জানাবে তার কার্যত শ্বশুর বা শাশুড়িকে? না, সালাম তো দূরের কথা শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেলে তার জন্য ‘দোয়া’ মাঙতে পারবে? এক কথায় না। এই উদাহরণ কিন্তু একেবারেই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত। একই ব্যাপার কিন্তু মুসলমান পিতামাতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোনও হিন্দু জামাই তার মুসলমান শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করবে না। ঠিক আছে ভিন্ন ধর্মে বিয়ের কথাই চলে আসল বলতে গেলে। কোনও হিন্দু ছেলে মুসলিম মেয়ের প্রেমে পড়লে কী হয় দেখেছেন? প্রায় খুনোখুনি। এক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ে কারও পরিবারই মানতে চাইবে না, আর ঘটনাটা খুনোখুনির পর্যায়েই যেতে পারে শেষ পর্যন্ত। পারস্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাস না থাকলে কেন হবে এমন? মজার ব্যাপারটা হল উল্টোটা হলে অর্থাৎ মুসলিম ছেলে ও হিন্দু মেয়ে হলে মুসলিম ছেলের বাড়ি থেকে তেমন কোনও বাধা আসবে না, আসবে শুধু হিন্দু পরিবার অর্থাৎ মেয়ের পরিবারের দিক থেকে।  মুসলিম ছেলের পরিবার এক্ষেত্রে মেয়েটির ধর্মান্তর ঘটিয়ে মুসলমানে পরিণত করে ওদের ধার্মিক ধারণায় প্রকৃত ‘মানুষ’ করে নেবে। মেয়েটি আর টিপ পরতে পারবে না কপালে, দরকারে বোরখা। আর মুসলিম মেয়ে হিন্দু ঘরে যদি আসে কোনওমতে। তাহলে প্রথমেই গঙ্গাজলে তাকে পবিত্র করে নেওয়া হবে, তারপর হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর। বলতে পারেন বিয়ে নিয়ে এমন ঝামেলা আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও তো হয়। ঠিক, কিন্তু আদিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা আসে জাতিত্ব নিয়ে। এটাও সমর্থনযোগ্য নয়, তবু ওরা রক্তের বিশুদ্ধতার দোহাই দেবে। কিন্তু বাংলার হিন্দু বা মুসলমান তো কোনও পৃথক জাতির নাম নয়। বাংলার হিন্দু বা মুসলমান সবাই জাতি হিসাবে তো একই— বাঙালি। নীহাররঞ্জন রায়ের কথায় বাংলার ব্রাহ্মণের সঙ্গে এখানকার মুসলমান বা হিন্দু কায়স্থদের রক্তের তেমন তফাত নেই। অর্থাৎ জাতি হিসাবে কোনও বাঙালি ব্রাহ্মণ নিজেকে এক কায়স্থ বা বাঙালি নমশুদ্র বা মুসলমানের থেকে আলাদা নয়। সবাই বাঙালি। এবং আমরা উত্তর বা পশ্চিম বা দক্ষিন ভারতের মানুষের থেকে নৃতত্ত্বের দৃষ্টিতে স্পষ্টতই আলাদা। তাহলে? হ্যাঁ, অর্থাৎ মানুষ হিসাবে নয় ‘ধার্মিক’ মানুষ অন্য মানুষকে দেখে ধর্মবিশ্বাসের নিরিখে। স্পষ্টত কোনও ধর্মই মানুষকে মানুষ হিসাবে ভালবাসতে শেখায় না। প্রত্যেকের কাছেই ‘মানুষ’ শব্দটি শুধু নিজেদের ধর্মের মানুষের জন্যই। বাকিরা অমানুষ বা পশুর সমমর্যাদার। প্রয়োজনে হত্যার যোগ্য।

কিন্তু তবু যে কিছু মুসলমান বা হিন্দু বা খ্রিশ্চান অন্য ধর্মের মানুষকে ভালবাসে, অন্তত দেখি তো ভালবাসতে— তার বেলা? ঠিকই দেখি আমরা। কিন্তু তা ওই দু’-এক মুহূর্তের জন্যই, কয়েকটা মুহূর্তের জন্য আমাদের ভেতরের প্রকৃত মানুষ বাইরের ধার্মিক মানুষটাকে হারিয়ে জেগে ওঠে। আর ভিন্ন একজনকে মানুষ হিসেবে চায় ভালবাসতে। কিন্তু প্রকৃত মানুষটাকে জেগে উঠতে দেখলে ধার্মিক মানুষের শুধুই আতঙ্ক। রব ওঠে গেল গেল। বাঁচার জন্য বেদ-কোরান বা গীতার কথা মনে পরে। সেই সব জান্নাত-স্বর্গ। সেই সব বাহাত্তর হুরের সম্ভোগ আনন্দ বা সেই সব রম্ভা-উর্বশীর নাচ-গান-সুরার সুযোগ বুঝি গেল! ওই দু’-এক বে-খেয়ালের মুহূর্ত পার করেই ধার্মিক মানুষরা বিধর্মী মানুষকে ভালবাসার খেসারত স্বরূপ আওড়াতে শুরু করে গীতার শ্লোক বা কোরানের আয়াত। ভিন্ন ধর্মের ধার্মিক মানুষদের মধ্যে সম্পর্ক ওই তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপির সম্পর্কের মতোই। তাদের ওই দীর্ঘদিন পাশাপাশি থাকার ভালবাসা একেবারেই লোকদেখানো। যেখানে হিন্দুরা সংখ্যায় অনেক বেশি সেখানে হিন্দুদের ‘মোল্লার পো’ বা ‘নেড়ের জাত’-এর গালি বা অবজ্ঞা ভরা কথা মুসলমানরা গায়ে মাখে না, আর যেখানে মুসলিমরা সংখ্যায় বেশি সেখানে হিন্দুরা নিজেদের তথাকথিত অধিকার বা সম্মান রক্ষায় জোর দেখাতে যায় না। গ্রাম বা শহর-শহরতলির বাংলায় আমরা ভিন্ন ধর্মের মানুষের যে সহাবস্থান দেখি, তার স্বরূপ এমনিই। সেখানে অতএব পারস্পরিক অবিশ্বাস আর ঘৃণা। ঘৃণা শুধুই ঘৃণা, হাজার হাজার বছর ধরে বেদ-গীতা-কোরানের কুশিক্ষার আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষদের ধর্মের মোড়কে এই অনন্ত ঘৃণার আরাধনা থামাবে কে?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4645 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. কংশালরা আলাদা বুঝি সেইজন্য লেস এভিল তত্ত্ব।
    আর বানান ঠিক করুন।কথাটা বিতাড়ন-‘বিতারন’ নয়।

Leave a Reply to Kushal Chatterjee Cancel reply