জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

চারটি কবিতা

 

Elegy মাত্রই ব্যর্থ শ্রম

পথচারীদের দু-একজন ওপর দিকে তাকালে,
আরও কিছু জন, তারপর আরও কিছু…
একইভাবে অনুসরণ করে, মাথা তুলে চেয়ে দেখে—
বহুতলের কোনও জানালায় প্রস্ফুটিত এক অলৌকিক আলিঙ্গন।

মুখ, চোখ, অভিব্যক্তি, শারীরিক জ্যামিতি অতিক্রম করে
আরও স্পষ্ট, আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে আলিঙ্গনের অস্তিত্ব।

আঁধার আর আধার
কসুর আর সুর
কাম আর নিষ্কাম
হেতু আর সেতু

জোড়ায় জোড়ায়, আতসবাজির মতো ফেটে ছড়িয়ে পড়ে নিজস্ব বিস্ফারে
মানুষ হাঁ করে পর্যবেক্ষণ করে, ভক্ষণ করে সেই অভূতপূর্ব অতিপ্রাকৃত।

ওবেলার সংবাদপত্র, যথেষ্ট হাতবদল সহ্য করে থমকে যায়,
ওপর দিকে তাকিয়ে থাকা কোনও সুধী নাগরিকের হাতে।
তারই উত্তরসূরি আগামীকালে প্রথম পাতায় তাকে পাবে খবরের প্রচ্ছদে,
এক নীরব অবিচুয়ারি, ফ্ল্যাশের পর ফ্ল্যাশের মতো বিদ্যুৎ চমকে বৃষ্টি পড়ে গেল।

বজ্রপাতের শব্দে শিউরে ওঠে মূর্ত আলিঙ্গন,
কারও কারও হঠাৎই মনে হয় অস্পষ্টভাবে, দুজন নয়… ‘একা’-ই।
সামান্য আন্দোলনে হঠাৎ স্মরণে আসে তাদের—
বিপজ্জনক উচ্চতায় আছে সেই আলিঙ্গন ভাস্কর্য, জানালায় গরাদ নেই কোনও।

 

স্পর্শকের ওপর বিন্দু অবস্থানে

পর্বত, আকাশ, সাগর ডেকে বিশালতার উপমা পাঠ হল।
এদিকে আমার দুহাত ছড়ালে বোধহয় ছ-ফিটও হবে না,
আর একটু বেশি চেষ্টা করলে একসময়ে খাঁচায় টান পড়ে।
অ্যালবাট্রস আর ফিলিপাইন ঈগলের বিস্তৃত উড়ান কল্পনা করি,
ওদেরও ব্যথা হয়, কোথাও টান পড়লে?
মানুষের পিঠে পালক, আর পাখির ঠোঁটে পাপড়ি কেন থাকবে?—
এমন প্রশ্নযুগলের মিথুন
আঁকশির গোড়ালি তুলে উঁচু ডালে টানাটানি করে।
নাগাল প্রসঙ্গে সচেতন হওয়ার ইঙ্গিত আমি বুঝি।
প্রশ্নচিহ্নের বিন্দুরা ভুরুর মাঝে উজ্জ্বল টিপ
টিপের রং পরিবর্তনশীল,
ব্যাসার্ধ বাড়ে-কমে স্পন্দনের মতো।
ব্যাসার্ধের বিস্ফার, কপাল থেকে গড়িয়ে চলে যায়,
কয়েন থেকে ম্যানহোল
চন্দ্র-সূর্য থেকে কৃষ্ণগহ্বর।
বিন্দুকে একক ভর ধরে বন্দি হয়ে আছি এরই মাঝে কোথাও,
আমার নন-একজিস্টেন্সকে কিছুই ধরতে পারছে না এক বিস্ময়জাতক।
আঙুলের কর গুণে যাচ্ছে একাগ্র চিত্তে।

 

প্রগাঢ়

দুটো কথার পর ফুরিয়ে যায়
এমনই আশঙ্কায় সরিয়ে রাখা
এক মুঠো বীজধান
যৎকিঞ্চিৎ, অথচ অগোচরে।
প্রিয় পরাঙ্মুখ, ভবিতব্য জেনেও
বসে আছি ক্ষেতের আলে
রাত্রি বাড়ে, ধোঁয়ায় মেশে হৈমন্তিক রাগ
হঠাৎই নৈঃশব্দ্য পায় একাকী পেচক।
অপেক্ষা কেউ চিনবে না বলেই
দুবেলা দুমুঠো খেয়ে ঘুমোতে যাই
বাকসংযত থাকি,
আর প্রবণতামুক্ত থাকার অভিনয় ।

প্রিয় উন্মুখ, উদ্যত অন্য কোনও স্থলে
আমার প্রণতি জ্বলে মৃৎপ্রদীপশিখা
লুটায়ে আঁচল চলে ভিক্ষুণী একা
শ্রাবস্তীর উদাসীন নগর কোলাহলে।

 

তাহাদের দর্পজন্ম অতিক্রম করে…   

এভাবেই তো ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে কবিদের স্মৃতি
পদাঙ্ক হারায় যায় নগরীর সদাব্যস্ত জনপথের ধুলায় ধূসরে
অসংখ্য ভোর, জ্যোৎস্না এবং বায়সপক্ষীদের উড়ে যাওয়া দেখে ফেলার পর
কখনও তো অবসাদ আসে, অবসরের পরবর্তী চিন্তায়
ধীর লয়ে দোলে হাতপাখা, পড়ে একটাই… ওসবও অকাজের খাতায়!
আনন্দঘন, ঘনদুঃখ— এমনই নাম নিয়ে দুটি তুরগ ঠগ ঠগ শব্দ তুলে তুলে
দূর থেকে এসে দূরে চলে যায়, নিতান্তই প্রেতের মতো গহন নিশীথে
কৃষ্ণ আর রাধাচূড়ার ঝিরিঝিরি আলোছায়া মেখে।
অস্তিত্ব অস্বীকার করেই তো চলে যায় কত কেউ, চলে গেছে কত কিছু
এপার ওপার করে দিয়ে, অভ্রভেদী বাণের মতোই, যদিও
অস্ত্রশাসনে সে অর্থে পটু নয় তারা, প্রতিহিংসার থেকেও যে বেশি কিছু লাগে,
এ-সকল কথা পৌঁছতে পৌঁছতেই এবারও কেটে যাবে তাহাদের দর্পজন্ম, এভাবেই।

কয়েক দশক আগে, বিপন্ন এক মাঠের যে অংশে শুয়ে
উল্কার পতনচিত্র পর্যবেক্ষণ করেছিল কোনও ছেলে
তার পাশেই তির্যক রোদ্দুর এসে পড়েছিল মেঘ ভাঙার পর,
তার কাছেই এসে কোনও মেয়ে, কুড়িয়ে নিয়ে গেছে দূর্বাঘাস—
এইসব কিছুর সমান্তরালেই তো নিহারীকার সম্মুখে
‘সুদূর’ হয়ে ওঠে এক প্রবল অস্তিত্বমান বিশেষণ,
আর কিছু নক্ষত্র আত্মাহুতি দেয় কৃষ্ণগহ্বরে
কিছু মানুষ আর চিনতে পারে না পরিচিত মুখচ্ছবি, অথবা চায় না আর।
হয়তো কখনও, প্রবল ঔজ্জ্বল্য অথবা আলোকশূন্যতায়
শুদ্ধ ও কোমল হয়ে ওঠে কোনও সর্বনাম,
মনে হয় রূঢ়-কর্কশ সড়কও মিশেছে সেই স্নিগ্ধ সৈকতে,
সকল জাগতিকতা অতিক্রম করে,
অগ্রাহ্য করে একদা গুরুত্বপূর্ণ সেই সব পরিণামদর্শিতা।

এসবের মাঝেই তো ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে, শূন্যসঞ্চয় কবিদের স্মৃতি,
হঠাৎই মনে হয় প্রয়োজনহীন, উদ্যানের এক প্রান্তে দীর্ঘকাল পত্রশূন্য বৃক্ষের মতো।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...