নদী হয়ে ওঠার কথা

সোমজিৎ হালদার

 

ছবি : অমিত গাঙ্গুলি

আমাদের দেশে যাওয়া একটা হইহই ব্যাপার ছিল। দেশ মানে আমাদের গ্রাম। জন্ম শহরে। তাই দু’একদিনের দেখার অপূর্ণতা ভরাট হত বাবা-কাকাদের কাছে গল্প শুনে। গ্রামকে ঘিরে থাকা সেসব গল্পে অদ্ভুত শূন্যতা ছিল। যেন ভরা মরশুমে জমিতে জল না থাকার হাহাকার। চব্বিশ বছরে বিধবা ঠাকুমা। কোলে এক মেয়ে তিন ছেলে। সে জীবনে বোধহয় নদীর বিলাসিতা ছিল না। তাই আমার শোনা গল্পে নদী বাদ। তবে আর পাঁচজনের মতো ছোটবেলায় আঁকা ছবিতে গাঢ় নীল রঙের নদী থাকত। সব নদীতে যে জল থাকে না— নৌকা ভাসে না— সেকথা কে বোঝাবে। নদী নিয়ে আমাদের কিছু নষ্ট রোমান্টিকতা থাকে। শুকনো নদীখাতে ওঠা বহুতলের দেয়ালে দেয়ালে নদীর মোটিফ। আমার শহরেও নদী আছে একটা। বাঁকা নদী। কী আশ্চর্য! বর্ধমানের অধিকাংশ মানুষ বাঁকা নদীকে নালা বলেই চেনেন। তাই পরিষ্কার রাখার দায় নেই। তবে সেই কথা আজ থাক। নিজের মতো করে একটা নদী আবিষ্কার করার কথা বলি আজ। ফিরে যাই গ্রামে।

আবিষ্কার শব্দটা ভারী হয়ে গেল কি? ‘কোথা হইতে আসিয়াছ?’— এটুকুও সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিনি। অকুলীন একটা জলধারা। কৈথন গ্রামের শেষ প্রান্তের নির্জনতা শুষে নিয়ে বসে থাকে। বয়ে যেতে বলেনি যেন কেউ। নামেও আভিজাত্য নেই। ‘ফড়ে’ একটা নদীর নাম? আসলে নদী বলে তাকে চিনতামই না। গ্রামের সকলের কাছে শুনে আমিও তাকে কাঁদর বলেই জেনেছি। এই তো সেদিন ফেসবুকে ছবি দেওয়াতে জোর তর্ক হল নদীকে কাঁদর বলা যায় কিনা। কাঁদর হল প্রকৃতিসৃষ্ট খাল। মানলাম নদী। কিন্তু তোমরা তো তাকে ভালো নামে ডাকোনি কোনওদিন। একটা বয়ে যাওয়ার পাশে চুপটি করে বসে দেখোনি। আমিও দেখিনি বহুকাল। গ্রামের বাড়ি গেলে বামুনদীঘিতে ছুটতাম টলটলে জলে মেঘের ছায়া দেখব বলে।

আরেকটু বড় হয়ে কাঁদরের খোঁজ পেয়েছি। দুপাশের ধানক্ষেতের মাঝে আইবুড়ো মেয়ের সিঁথির মতো বয়ে গেছে। প্রথমবার গিয়ে নৌকো চড়েছিলাম। নাক সিঁটকে ভেবেছিলাম এইটুকুন জল তার আবার ফেরি পারাপার। দাদা বুঝিয়েছিল প্রয়োজনের কথা। এপারে যার বাড়ি তার জমি হয়তো ওপারে। কাটা ধান নৌকোতে বোঝাই করে আনা নেওয়া হয়। বিনিময়ে মরশুম শেষে মাঝি ধান নিয়ে ঘরে ফেরেন। অর্থমূল্যে মেপে দেওয়ার অভ্যেসে খানিক বেমানান ঠেকে। প্রাগৈতিহাসিক কিছু অভ্যেস এভাবেও তো টিকে থাকে। ঘড়ির সময় ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে এক অন্য সময়। কাঁদর যাওয়ার পথে পাশাপাশি ভাগাড় আর চাষজমি। জীবনমৃত্যু পাশাপাশি শুয়ে থাকে।

এবার কালীপুজোয় গ্রামের বাড়ি এমনিতেই ফাঁকা ফাঁকা ছিল। ভাই পুনেতে। আমার কাঁদর যাওয়ার সঙ্গী। দাদার বন্ধু চন্দনদা এসে বলল, ‘কী দেখবি বল, পুকুর না নদী?’ চল, নদীই দেখে আসি। গ্রামের কাছাকাছি নদী আছে বলে তো জানতাম না। কৈথন কাটোয়া রোডে খানিক এগোলেই ব্রিজের নিচে নদী। আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে বিস্ময়। কারণ কিছু পরেই চন্দনদা বলবে কৈথন গ্রামের পাশ দিয়ে এই নদীই পঞ্চাননতলার কাছে ব্রাহ্মণী নদীতে পড়েছে। অনাদরের কাঁদর আসলে একটা নদী! নাম জেনেছি অবশ্য আরও পরে। ক্ষেত্রসমীক্ষক ও গবেষক স্বপনকুমার ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলে। ‘ফড়ে’ শব্দটা ভালো অর্থে এখন ব্যবহার করি না। অভিধান বলছে অকালপক্ক। শীর্ণ এই নদীখাতের পাকামি দেখানোর সুযোগ আছে বটে বর্ষাকালে। সারা বছরের শীর্ণতার তবে কী হবে? ফসল পাকিয়ে যে ঘরে তুলছ সেও তো তারই কল্যাণে। নামকরণে হয়তো বা লুকিয়ে আছে প্রশ্রয়। ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। তারগাছের সারি, পাখির ডাক— তবে কী যেন নেই। আসলে কাঁদর ততক্ষণে নদী হয়ে গেছে। বন্ধু বিখ্যাত হয়ে অন্য বৃত্তেও বেড়েছে যাতায়াত। আমি সবটা মেনে নিয়েও ফিরে যাব কাঁদরে। যেখানটিতে বসে নৌকো দেখা যায়।

ফিরে গেলাম। নৌকো ডুবে ছিল। তবে কি বাতিল হয়ে গেছে? পড়ে আছে প্রত্নচিহ্নের মতো? কুলুকুলু শব্দ শুনছি। স্রোতহীন নদীতে কিসের শব্দ? দেখলাম সেই ঘড়ি ছেঁড়া সময় আর নেই। নদীর বুকের ওপর মাটির রাস্তা। মাঝে জল যাওয়ার জন্য গোটাতিনেক পাইপ বসানো। সেই অল্প জায়গা দিয়ে জল বেরিয়ে আসছে বলেই এমন শব্দ। দিব্যি হেঁটে সাইকেলে পারাপার করছে মানুষ। নৌকোর তবে কী প্রয়োজন? সব ফিরে আসা সুখের হয় না। এই যে কষ্ট হচ্ছে, চিনচিন করছে বুক— তা কি ওর নদী পরিচয়ের জন্য? কাঁদরের বুক আটকে দিলে এতটা ভাবতাম? বসলাম ডুবে যাওয়া নৌকোর পাশটাতেই। গলা অবধি শোক নিয়ে ডুবে আছে তখন। কিছুদিন পরে চন্দন দা আবার ছবি তুলে পাঠাল। দেখলাম ভেসে উঠেছে আবার। ভেসে থাক বর্তমানেই। এই বর্ষার তোড়ে ভেঙে যাক মাটির রাস্তা। তুমি শক্ত করে নোঙর ধরে থেকো।

কিছু উত্তর এখনও পেলাম না। বাবা-কাকাদের দামালপনায় কোথাও নদী নেই কেন? নাকি দীর্ঘদিনের শহরবাসে ভিতরের নদীগুলো শুকিয়ে যায়? পড়ে থাকে শুকনো ঝুরঝুরে মাটি। যার ওপরে স্মৃতির ছবি আঁকি অকপট। অপত্যেরও কিছু দায় থাকে খোঁজার। নদী বেয়েই একদিন সেই স্মৃতিশূন্যতায় পৌঁছে যাব। ভুলে যাওয়া নদী ফিরিয়ে দেব পূর্বপুরুষের মানচিত্রে। বালতি বালতি জল তুলব নৌকোর বুক থেকে। অল্প জলে হাসবে আমার কাঁদর, আমার খুঁজে পাওয়া নদী।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...