ডাইনি

তিষ্য দাশগুপ্ত

 

ধু ধু প্রান্তরের এক কোণে বুড়ো গাছটায় আর একটাও পাতা অবশিষ্ট নেই। গ্রীষ্মের কাঠফাটা দুপুর, কোথাও কোনও জনমনিষ্যির দেখা নেই, কেবল একটা তৃষ্ণার্ত চাতক ডেকে চলেছে বিরামহীন। বড় একটা প্রয়োজন না থাকলে গ্রামের মানুষ খুব একটা আসে না এই ঊষর প্রান্তরে, দূর পথে হয়তো কোনও পথিক গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চলে যায়। উদাস দৃষ্টিতে ভাঙ্গা দাওয়ায় বসে থাকে সুদামা, মানুষটা মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অনুসরণ করে তার নিভে আসা চোখদুটো। কত বড় হয়েছে মেয়েটা এখন? চোখ বুজলে এখনও কানে ভাসে এই চালাঘরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট দুটো টলোমলো পায়ের নুপুরের রিনিকি ঝিনিকি শব্দ, “এমা, আমায় ধরতে পারে না।” দমকা হাওয়ার ঝোঁকে লাল সূর্যটা কখন যেন মিলিয়ে গেছে মাঠের কোণে, চোখ মুছে পিদিম জ্বালে বুড়ি, শীতালি পাখির মতো সন্ধ্যা নেমে আসে বিশ্বচরাচরে।

সতেরো বছর বয়সেই কেমিস্ট্রিতে ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ, এবার উচ্চশিক্ষার পালা। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি নানারকম শখ সৌমিতার, একটু সময় পেলেই ছুট লাগাত ফুটবল মাঠে। ঐ দৈত্যাকৃতি আমেরিকানদের সাথে অবলীলায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার মেয়ে, দেখে প্রথম প্রথম একটু বিচলিতই হতেন সুমিত, তারপর এ মেয়েকে শাসন করা বৃথা বুঝে হাল ছেড়ে দেন। মুক্তমনা সুমিত ও অনন্যা খোলামেলাভাবেই বড় করেছেন মেয়েকে, আর পাঁচটা আমেরিকানের মতো পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে, মেয়েও যথাযোগ্য মর্যাদা রেখেছে বাবা মায়ের। এবার উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেবে পেনসিলভানিয়া, প্রফেসর জনের দৃঢ় বিশ্বাস এ মেয়ে ঠিক নোবেল পেয়ে দেখাবে। আঠারো বছরের জন্মদিনে একরাশ উপহারের মাঝে মোটা চিঠির গোছাটা পায় সৌমিতা।

“আমার ছেলেটাকে তো খেয়েছিস, এবার কাকে গিলতে এসেছিস বেশ্যা মাগী? পুঁতেই ফেলবো এই বিষের পুঁটুলিটাকে”– দেড় বছরের একরত্তি মেয়েটাকে বুকে আগলে পালিয়ে আসা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না সুদামার, রাতের অন্ধকারে বহুদূরে চলে এসে এই জয়চণ্ডী পাহাড়ের নীচে রুখা প্রান্তরে আশ্রয় নিয়েছিল। তবু কিভাবে যেন গ্রামকে গ্রাম রটে যায় সে অপয়া, কিভাবে জ্যান্ত গিলেছে তার স্বামীকে, গ্রামের এক প্রান্তে এই বুড়ো গাছটার তলায় বেড়ে উঠতে থাকে মেয়েটা, শেষে মেয়েটাও যখন ভীষণ জ্বরে পড়ল তখন আর কোনও সংশয় রইল না নিজের মনেও। এখনও বুড়ির কানে ভেসে আসে সেই আধো আধো কণ্ঠস্বর “তুই কিছু ভাবিস নে মা, আমার সব অসুখ বুড়ো গাছ নিয়ে নেবে, দেখিস তুই।”

নিষ্ক্রিয় গ্যাসের সাথে সোডিয়ামের বিক্রিয়া ঘটিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন বাঙালি বৈজ্ঞানিক সৌমিতা সেনগুপ্ত। ডেট্রয়েটে সুমিত সেনগুপ্তর কাছে স্টকহোম থেকে যখন ফোনটা এল তখন আর না করেননি তিনি, নোবেলজয়ী কন্যা একবার দেশে ফিরতে চায় তার জন্মদাত্রীর কাছে, অনন্যার মনে কেবল ছবির মতো ভেসে ওঠে সেই অসহায় যুবতীর কথা, যে মেয়েকে নিজের কবল থেকে বাঁচাতে নামমাত্র দামে তুলে দিয়েছিল কোলকেতার বাবুদের হাতে।

যত দিন যাচ্ছে অসহনীয় হয়ে উঠছে সুদামা বুড়ি, বুড়ো গাছটার মতোই যেন তারও মরণ নেই। জটাবাধা ফোকলা কানী বুড়ি যেন এক মূর্তিমান বিভীষিকা, গত এক বছরে গিলে খেয়েছে চার চারটি মেয়েকে, গত পরশু শিবু বাগদীর বৌ যখন হঠাৎ গলায় রক্ত তুলে মারা গেল, সালিশি সভা বসাতে বাধ্য হল মাতব্বরেরা। রাতের অন্ধকারে গ্রামের যুবকেরা মশাল হাতে নিশ্চুপে এগিয়ে চলে বুড়ো গাছটার দিকে।

আজ অফিসে ঢুকেই মনটা খারাপ হয়ে গেল সঞ্জয়ের। আনন্দবাজারের পুরুলিয়া করেসপন্ডেন্ট সঞ্জয়ের এটাই প্রথম মেজর অ্যাসাইনমেন্ট, পুরুলিয়ার এক অজ পাড়াগাঁয়ে ডাইনি সন্দেহে এক বুড়িকে খুন করেছে গ্রামবাসীরা– গ্রামাঞ্চলে কুসংস্কার ইত্যাদির ওপর একটা জব্বর করে স্টোরি ফেঁদেছিল, আজ জায়গাই পেল না খবরটা।
বিষণ্ন মুখে পেন চিবোতে চিবোতে কালকের হেডলাইনটার ওপর চোখ বোলাতে থাকে সঞ্জয়… এডিটর নিজে করেছেন হেডলাইন, আজ যে সোনার মেয়ে ফিরছেন মায়ের কোলে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...