সূর্যমুখীর এরোপ্লেন

সূর্যমুখীর এরোপ্লেন

ইন্দ্রাণী দত্ত

 

সূর্যমুখীকে অনেকদিন পরে এয়ারহস্টেসের মতো দেখাচ্ছে আবার। লম্বা গর্বিত গ্রীবা, কনুই অবধি ব্লাউজের হাতা, চোয়ালের কাছে মৃদু টেনশন— যেন একটু পরেই টেক্‌ অফ্‌, এই স্বল্প সময়ে ওভারহেড লকার বন্ধ করা, সেফটি ব্রিফিং এইসব কত কী হাসিমুখে সেরে ফেলতে হবে। সূর্যমুখীর পায়ের কাছে হ্যান্ডব্যাগ, হাতে একটা নীলচে রুমাল— আলতো ক’রে কপাল মুছে নিতে দেখলাম একটু আগে। আসলে, কলকাতার হাসপাতালে অঙ্কোলজিস্টের চেম্বারে বসে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার পাশেই সূর্যমুখী, আমার শাশুড়ি। সামনে ডাক্তার  কথা বলছেন অনর্গল— মাঝে মাঝে লিখছেন, হিজিবিজি কাটছেন নোটপ্যাডে। সম্ভবত একই কথা নানাভাবে বলে চলেছেন— প্যালিয়েটিভ, মির‌্যাকল, আর ভগবান কানে এল শুধু। আমার মন অন্যখানে— পুরনো সব কথা ভাবছিলাম।  সূর্যমুখীও আদৌ শুনছিলেন না; চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, অন্য কিছু ভাবছেন, একদম অন্য কোনও কথা কারণ সূর্যমুখীর  চোখে এখন বিয়েবাড়ির রোশনাই–

সূর্যমুখীর শ্বশুরবাড়ি কলকাতা থেকে দূরে, মফস্‌সলে। পঁচিশ বছর আগে সে’ বাড়িরই দোরগোড়ায় জীয়ল মাছ হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি— আমার মাথায় শোলার মুকুট, সিঁথি জুড়ে লাল, আর দুধে আলতায় ভরা কষ্টিপাথরের থালা পায়ের সামনে; চারদিকে কৌতূহলী মানুষজন— সবাই অচেনা। মাথার ওপর মশারা ঝাঁক বাঁধতে শুরু করেছে, বাড়ির লাগোয়া মাঠে বাঁশ, দড়ি, প্যান্ডেলের কাপড় আর সূর্যমুখী বরণডালা সহ মিসিং। যেহেতু সূর্যমুখী আমার শাশুড়ি, ছেলে আর বৌকে বরণ ক’রে তিনিই ঘরে তুলবেন, এইরকম স্থির হয়ে আছে সম্ভবত। আমার নতুন পরিজনরা ঘড়ি দেখছেন ঘন ঘন, শ্বশুরমশাইয়ের হাঁক ডাক— প্রায় সবাইকেই অপ্রস্তুত আর অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে। শয্যাশায়ী জেঠিশাশুড়িকে কোনওমতে তুলে এনে বরণ করানো যায় কী না এই সব আলোচনা শুরু হয়ে গেছে, আমার স্বামী টোপর আর দর্পণ নামিয়ে মাকে খুঁজতে যেতে প্রবৃত্ত— হইচই তুঙ্গে— আর ঠিক সেই সময় সূর্যমুখীকে মাঠ পেরিয়ে আসতে দেখি। অগোছালো গরদের শাড়ি, এলোমেলো চুল, দু হাতে বরণডালা উঁচু করে ধরা, পায়ে হাওয়াই চটি। হাঁটার ভঙ্গিটাই এমন, যেন স্লো মোশনে হাঁটছেন এক এয়ারহস্টেস, তাঁর চটির তলা দেখা যাচ্ছে; ভিজে ঘাস মাটি লেগে রয়েছে তাতে, কিছু ঘাস শুকনো হয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে প্লেনের কার্পেটে— এ’ নিয়ে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁর— যেন তিনি জানেন ঘাস মাটি শুকিয়ে গেলেই ঝরে যাবে— দুঃখ কষ্ট বইতে বইতে একসময় তারা যেমন নিজেরাই সরে যায় জীবন থেকে। মাঠ পেরিয়ে, দুধে আলতা ভরা পাথর ডিঙিয়ে, আমার সামনে বরণডালা নিয়ে দাঁড়ালেন সূর্যমুখী— ‘ভালো দুব্বো খুঁজতে খুঁজতে সেই নদীর পাড়ে, তারপর এমন হাওয়া উঠল’— কথা বলতে বলতে সামান্য হাঁফাচ্ছেন, সেই অবসরে পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে নিলাম আমরা। সূর্যমুখীর কাঁচা পাকা চুলে খড়কুটো, ঝরা পাতা, কাঁধের ওপর একটা শুঁয়োপোকা নড়ে চড়ে লম্বা গলার দিকে যাচ্ছে আর চোখের মণিতে বিয়েবাড়ির আলো; কেমন যেন দেখতে পেলাম, নদীর ধারে প্রকাণ্ড এক ঊড়োজাহাজ আর সেখান থেকে সূর্যমুখী, দূর্বাঘাস হাতে, স্লো মোশানে নেমে আসছেন; প্রপেলারের তুমুল হাওয়ায় আশপাশের গাছ থেকে পাতা, পিঁপড়ে, প্রজাপতি সব খসে খসে পড়ছে সূর্যমুখীর মাথায়, কাঁধে; বদলে যাচ্ছেন সূর্যমুখী, বিলকুল বদলে যাচ্ছেন— এই ছিলেন এয়ারহস্টেস, গরদ টরদ পরে হয়ে গেলেন টিপিকাল শাশুড়ি। সূর্যমুখীর চোখের আলো দেখতে দেখতে মনে মনে শাশুড়িকে ডাকলাম— ভানুমতী, ও ভানুমতী।

ম্যাজিক ট্যাজিক আমিও জানি। বিয়ের আগে আমার প্রেমিক ছিল— অনিন্দ্য, তাকে বদলে দিয়েছিলাম ম্যাজিক ক’রে; কোন্‌ ছোটবেলায় বদরাগী কাকিমাকে এক মন্তরে চুপ করিয়ে দিয়েছিলাম, অনেক অনেক গল্প আছে আমার… দুধে আলতায় পা রেখে সে’ সব আর মনে করতে চাইছিলাম না তখন।  শাঁখ, উলু, বরণপর্ব শেষ হ’লে আমার হাত ধরলেন শাশুড়ি— ‘ভিতরে এসো, সরি আই কেপ্ট ইউ ওয়েটিং।’ প্লেন ছাড়তে দেরি হলে এয়ারহস্টেস ঠিক যেমন বলেন। আমি অবাক হইনি একেবারেই। অথচ, আশেপাশের লোকজনকে অস্বস্তি বোধ করতে দেখলাম— কেউ সূর্যমুখীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন, পরক্ষণেই আমার মুখে— যেন পড়তে চাইছিলেন আমার মন— নতুন বৌ প্রথম দিনে শাশুড়িকে নিয়ে কী ভাবছে। এক পাড়াতুতো ননদ তৎক্ষণাৎ আমাকে সূর্যমুখীর ইংরিজি বুলির গল্প শোনানোর প্রয়োজন বোধ করল; সেও এক বিয়েবাড়ির গল্প : সূর্যমুখীর নিজের বৌভাত  সেদিন, লোকজন গমগম করছে, আলো টালো— আমার শ্বশুরের এক সাহেব বন্ধু এসেছেন— নববধূর হাতে উপহার ধরিয়ে বলেছেন, ‘ও মাই গড, ইউ আর সো বিউটিফুল, সো গরজাস, ইউ লুক লাইক আ কুইন’;  সূর্যমুখী কোনও কথা না ব’লে নতমুখে মৃদু হাসছেন যখন, সাহেব বললেন, ‘ক্যান ইউ স্পিক ইংলিশ? হার্ড, ইউ আর আ গ্র্যাজুয়েট।’ সূর্যমুখী বার তিনেক ‘আই আই’ ক’রে থেমে গেলেন; সে’ রাতে ফুল সাজানো ঘরে দোর দিয়ে আমার শ্বশুর নতুন বৌকে এমন ধমকালেন, আড়িপাতার দল পর্যন্ত লজ্জা পেয়ে পালাল। শোনা যায়, সূর্যমুখীর পিতৃদেবকে ঠগবাজ অবধি বলেছিলেন আমার শ্বশুর। পরদিন থেকেই সূর্যমুখীর মুখে অনর্গল ইংরিজির খই।  ‘কতটা অপমান করলে, মানুষ এমন বদলে যায় ভাবো— যে মেয়ের মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছিল না, রাত পোহাতেই মেমের মতো ইংলিশ।’ ননদ বলছিল— অপমান। আমার মনে হয়েছিল ভানুমতীর খেল। সিম্পলি।

আমার শ্বশুরবাড়ির শহরের নিজস্ব চরিত্র ছিল না— ধার করা গ্রীষ্ম, ধার করা শীত। আশ্চর্য সব হাওয়া বইত নদীর দিক থেকে অকস্মাৎ আর বাড়ি থেকে সূর্যমুখী উধাও হয়ে যেতেন। এই সব হাওয়ার দিনে আমার মনে হ’ত— যেন প্লেন নেমেছে নদীর পাড়ে, আর সূর্যমুখী এয়ারহস্টেস হয়ে গেছেন— কস্টিউম, মেক আপ, চকচকে জুতো— নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, ঠিক সে’খান থেকে যেন প্লেন টেক অফ করল, সূর্যমুখী পৌঁছে যাচ্ছেন অন্য দেশে, এ’দেশ থেকে ও’দেশ, তারপর ফিরে এল প্লেন— আবার আমার সেই এলোমেলো শাশুড়ি, পায়ে হাওয়াই চটি, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন দেশবিদেশের হাওয়াবাতাস। ভেবেছি, পিছু নেব, লুকিয়ে দেখে আসব ঊড়োজাহাজ— হয়নি। আসলে, হাওয়া যে কখন বইতে শুরু করত— কেবল সূর্যমুখীই টের পেতেন। আমি হয়ত দুপুরে ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে খেয়াল করলাম হাওয়া উঠেছে, ততক্ষণে সূর্যমুখীর প্লেন মাঝ আকাশে— তখন আর কোথায় যাব, কী বা দেখব! সূর্যমুখীর ফেরার অপেক্ষা করতাম। রাতের দিকে বাড়ি ফিরতেন— উড়োখুড়ো চুলে ঘাস পাতা, আঁচলে হয়ত প্রজাপতি ম’রে আটকে রয়েছে, হাতে কখনও দুব্বোঘাস, আমের পাতা আর দু চোখে সেই রোশনাই। আমার মাথায় দুব্বো দিয়ে বিড়বিড় করতেন ইংরিজিতে— ‘প্লিজ প্লিজ’ শুনতে পেয়েছি কখনও। মনে হ’ত, যেন চাইছেন, সুখশান্তির হাওয়া বয়ে যাক সংসারে— আমি যেন তাতে বাধা না হই।

আসলে, সংসারের যাবতীয় শান্তি আমি হাইজ্যাক করে নিচ্ছিলাম তো—

বিয়ের দু’মাসের মধ্যে শ্বশুরবাড়ির একতলায় ‘নটরাজ’— নাচের স্কুল। আমিই শেখাতাম।  প্রথমদিকে ছাত্রী মোটে চার পাঁচজন, তারপর দশ, পনেরো, কুড়ি। রিহার্সাল, প্রোগ্রাম, দল নিয়ে এদিক ওদিক যাওয়া। বাজারে একটা ছোট দোকানঘরও নিয়ে নিলাম— নাচের কস্টিউম, গয়না সব পাওয়া যায়— কাজ অনেক বেড়ে গেল— এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি, কলকাতা থেকে জিনিস আনানো, অর্ডার নেওয়া। নিজের কিছু আয়পত্র হচ্ছিল— সংসারেও দিতে থুতে পারি; ভালো লাগছিল। ঘুঙুরের শব্দ সহ্য হয়নি শুধু আমার শ্বশুরের— রোজ চেঁচামেচি— ‘বন্ধ করো, এসব বন্ধ করো, এক্ষুণি বন্ধ করো।’

‘কেন বন্ধ করব? কেন বন্ধ করতে যাব আমার নাচ, আমার স্কুল?’ বোঝাতাম। তর্ক করেছি। পরের দিকে তুমুল ঝগড়া— শ্বশুর হুমকি দিলেন, কী সব খারাপ খারাপ কথা!  আমার পক্ষ নিয়ে কেউ একটা কথাও বলেনি— না স্বামী, না শাশুড়ি। সবার মুখে যেন কুলুপ। নিজেই নিজেকে শান্ত করলাম, মন্ত্র পড়লাম মনে মনে। তারপর, হ’ল কী, শ্বশুর একদিন খেতে বসেছেন, শাশুড়ি মাছের বাটি আনতে রান্নাঘরে— শ্বশুরের সামনে বাটিচাপা ভাত, লালশাক, ঘন মুগের ডাল, লেবু নুন; কাঁসার থালার পাশে জলের ছড়া দিয়েছেন সবে, বুকে হাত চেপে ঢলে পড়লেন। সে’ এক দুপুর বটে! আমার স্বামী ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে গেল সাইকেল নিয়ে, এদিকে হাসপাতালে ফোন করা হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়বে, শ্বশুরের মুখ নীল হয়ে বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে, ফর্সা গেঞ্জির কাঁধের ওপর তখনও একফালি রোদ, জলের ছড়ার পাশে পিঁপড়েরা ঘুরঘুর করছে। সূর্যমুখী একবার শ্বশুরের কাছে গিয়ে বসছেন— বুকে মাথায় হাত বোলাচ্ছেন পরক্ষণেই দৌড়ে ছাদে যাচ্ছেন আর বারে বারে আমার হাত চেপে ধরে বলছেন— ‘হেল্প মি, ও, হেল্প মি প্লিজ।’ শ্বশুরের নিঃশ্বাস যখন আর পড়ছে না, অ্যাম্বুলেন্সের হুটার শোনা যাচ্ছে গলির মোড়ে, দৌড়ে ছাদে উঠলাম— দেখি গনগনে রোদে দু’হাত ছড়িয়ে সূর্যমুখী দাঁড়িয়ে— আকাশের দিকে মুখ। আকাশে প্লেন টেন কিছু দেখিনি; কাক, চিল পাক খাচ্ছিল— পা টিপে নিচে নেমে এলাম।

মফস্‌সলের আবহাওয়া দ্রুত পালটে যাচ্ছিল, এল নিনো না কী যেন, কাগজে দেখলাম। নদী খটখটে শুকনো, সেই সব হাওয়া আর বয় না কতদিন! সূর্যমুখী সর্বক্ষণ বাড়িতেই— হয় ছাদে নয় বাগানে। দুম ক’রে বদলে গেল আমার স্বামীও। বাবলু, টাবলু হওয়ার পরে ‘নটরাজ’ বন্ধ করার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। আমি তখন আরও বড় করে কিছু চাইছি— তার জন্য ট্রেনিং নেওয়া জরুরি, লোকবল চাই, টাকাপয়সাও দরকার। একটা কোর্স করতে চাইছিলাম কলকাতা গিয়ে— রাজী হল না। না, কি বাবলু, টাবলুকে কে দেখবে? যত বলি, কেন তুমি তো আছ, শাশুড়ি রয়েছেন, কথাই কানে নেয় না— সব নাকি আমার বদমায়েশি— বাইরের হাওয়া লেগেছে গায়ে, সার্টিকিকেট কোর্স টোর্সের বাহানা দিয়ে আমি অন্য পুরুষের সঙ্গে আশনাই করতে যাচ্ছি।

ম্যাজিক করতেই হ’ল— অনিন্দ্যকে একমুঠো ছাই করে দেওয়ার জাদুমন্ত্র আমি সঙ্গে করেই এনেছিলাম— কাজে লেগে গেল। একদিন অশান্তির মুখে পড়েই দিলাম মন্ত্রটা— জাস্ট তিনটে শব্দ। আমার স্বামী ভ্যানিশ হয়ে গেল পরের দিন। থানা পুলিশ— কোনও হদিশই পেল না কেউ। সূর্যমুখী আবার আমার হাত ধরে বললেন, ‘হেল্প মি, প্লিজ হেল্প মি।’ একটা নতুন হুলো এল পরের দিন— রান্নাঘরে সর্বক্ষণ ম্যাও ম্যাও। বাটি ক’রে দুধ দিলাম হুলোকে। সূর্যমুখী আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন, ‘থ্যাঙ্কিউ; আমিই ওকে খেতে দেব রোজ। প্লিজ তুমি ওকে তাড়িয়ে দিও না।’

হুলো রয়ে গেল, নটরাজের নাম আরও ছড়াল, আমার কাজের কত সুখ্যাতি চারদিকে— টিভিতে, কাগজে ইন্টারভিউ— সেল্ফ এমপ্লয়েড ওম্যান এইসব— মেঝেয় মার্বেল, বাথরুমে গিজার, বাবলু, টাবলু কলেজে গেল।

এল নিনোর প্রভাব বাড়ছিল। হাওয়াবাতাসের ম্যাজিক বিলকুল উধাও হয়ে গিয়েছিল মফস্‌সল থেকে। ফাঁকা মাঠে হাইরাইজ, শপিং সেন্টার। শহরের দিক থেকে উড়ে আসছিল ব্লু হোয়েল, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ। ‘নটরাজে’ ফিউসন ড্যান্সের ক্লাস শুরু হয়েছিল। এই সময় একদিন সূর্যমুখীর ক্যান্সার ধরা পড়ল— ডাক্তার হাসপাতাল ছোটাছুটি— আমি ছাড়া সূর্যমুখীর তো কেউ ছিলও না। প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ শিখছিলাম সূর্যমুখী আর আমি— প্রগনসিস, মেটাস্ট্যাসিস, ইমিউনোথেরাপি। একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আজ একমাস আমরা কলকাতায়— অঙ্কোলজিস্ট, টেস্ট ফেস্ট, কেমো, নিদান। খুব দ্রুত সব কিছু ঘটে যাচ্ছিল। ঢাউস বেডকভার, লেপের ওয়াড়, শাড়ি টাড়ি যতক্ষণ বাইরে, হাওয়ায়, রোদে কেমন ফুলে ফেঁপে থাকে, অথচ ভাঁজ করে ইস্ত্রি করতেই এক হাতে এঁটে যায়, এতদিনের সুখ দুঃখ হাসি কান্নাও তেমন গুটিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেল— পাঁচ মিনিটে প্রায় গোটা জীবনটাই দেখে নিলাম ডাক্তারের অফিসে বসে।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সূর্যমুখীকে উচাটন দেখাল— বারবার আকাশের দিকে চোখ। ভ্যাপসা গরম এখন কলকাতায়, গাছের পাতা নড়ে না; সূর্যমুখীর কপাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছিল। বললেন, ‘কাছেই একটা মন্দির আছে, যাবে? সেদিন ফেরার পথে দেখছিলাম, আরতি হচ্ছিল।’

বড় রাস্তায় বাস, গাড়ি, ব্যস্ত লোকজন; ফুটপাথ ধরে দুজনে হাঁটলাম— পুরনো মিষ্টির দোকান, ফার্মাসি পরপর— কাঠের ফার্নিচারের দোকান থেকে রঙের গন্ধ আসছিল, সামনেটায় কাঠের গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে, একটা কাফে দেখলাম— সুন্দর সাজানো— সূর্যমুখীকে বললাম— ‘চা খাবেন?’ সূর্যমুখী আকাশ দেখতে দেখতে হাঁটছিলেন, মাথা নেড়ে ‘না’ বললেন সম্ভবত। সামনের ক্রসিং পেরোলেই মন্দির; মালাটালা বিক্রি হচ্ছে— ফুটপাথ থেকে দেখা যাচ্ছিল। ট্রাফিক সিগনাল সবুজ— হলুদ হয়ে লাল হ’লেই সূর্যমুখীর হাত ধরে পার হব— তখনই কাঁধের ওপর একটা ধাক্কা— দু’ পার থেকে রব উঠল, সামাল সামাল! রাস্তায় ছিটকে পড়ে গিয়ে প্রথমে কাচ ভাঙার শব্দ পেলাম, তারপর বোমা ফাটার মতো কিছু একটা— পাঁজর ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছিলাম— বাসের চাকা আমাকে চ্যাপ্টা করে রাস্তায় মিশিয়ে দিচ্ছিল— লাল, ঘন লাল হয়ে যাচ্ছিল অ্যাসফল্ট। কোথায় যেন একটা কুকুর ককিয়ে উঠল, তারপর আর যেন কোনও শব্দ নেই, সব অন্ধকার— যেন রাত নেমে এল ভর বিকেলেই। পরক্ষণেই আলো ফিরে এল আবার, গাড়ির হর্ন, মানুষজনের চিৎকার— অনেক ওপর থেকে সব কিছু দেখছি, এ’রকম মনে হচ্ছিল। হয়ত পালক হয়ে গেছি, কিম্বা তুলোর আঁশ, অথবা বেলুন। তারপর খেয়াল হ’ল, পাখা গজিয়েছে— লাল কালো ছিট ছিট একটা পোকা হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি আসলে। নিচে ভিড় দেখতে পাচ্ছিলাম— পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্সের মাথার ওপর ভাসতে ভাসতে  দেখলাম, সূর্যমুখী নেমে এসেছেন রাস্তায়, এখনও আকাশের দিকে চোখ— দু’হাত ছড়ানো। এবারে, মাথার ওপর আকাশ কালো করে এল— প্রথমে মেঘলা, তারপর কালো, একদম নিকষ। মুহুর্মুহু বেগুনি বিদ্যুৎ। শুকনো পাতা দৌড়োতে শুরু করল রাস্তার এপার থেকে ওপার। জলের আঁচড়ে সূর্যমুখীর গাল কেটে রক্ত, চোখ মুখ বন্ধ ধুলোয়, চাবুকের মতো গায়ে মুখে আছড়ে পড়ছে জল, ধুলো, পাতা, ভাঙা ডাল— চুল, কাঁধ, ঘাড় বাইছে পিঁপড়ে, শুঁয়োপোকা; অজস্র উই পাখা মেলে ঘিরে ধরেছে সূর্যমুখীকে।

ঝড় উঠল। প্রথমে এলোমেলো তারপর ঘূর্ণি— ধুলো, জল, পাতা, শিলা, শুঁয়োপোকা, পিঁপড়ে, লাল ছিট ছিট পোকার এক শঙ্কু তৈরি হচ্ছিল, পাক খেতে খেতে ঢুকে যাচ্ছিল শাশুড়ির ব্যাদান মুখে— বিশাল হাঁ করে ঝড় খাচ্ছেন সূর্যমুখী। ঠোঁট, দাঁত, জিভ, আলজিভ পেরিয়ে গলায় ঢুকে যেতে যেতে শুনলাম সূর্যমুখীর ফ্যাসফ্যাসে স্বর— ‘লেটস টিম আপ। লেটস ডু ইট টুগেদার, ভাসিলিসা। উই নিড আ মির‌্যাকল।’

আকাশ ফাটিয়ে উড়োজাহাজ নামছিল বড় রাস্তায়…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

4 Comments

  1. এক মুঠো ছাই করে দেওয়ার মন্ত্র তো তাহলে সূর্যমুখীই জানতেন ভালো…সেটাই প্রমাণিত হলো শেষ ধাপে ,হয়ত এ মন্ত্র সবারই কম বেশি জানা,ম্যাজিশিয়ান তো লুকিয়ে আছে সবার মাঝেই।

Leave a Reply to কেয়া গাঙ্গুলী Cancel reply