দোহা স্পেশ্যাল অলিম্পিক — ২০১৯

সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

চারিদিকে পাপ্পু বনাম চৌকিদার, দেশপ্রেমী বনাম আম-আদমি এসব ঢক্কানিনাদের থেকে অনেকটা দূরে নিঃশব্দেই দোহাতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পঞ্চদশতম বিশেষ অলিম্পিক। আমাদের গর্বের সংবাদমাধ্যম খুব স্বাভাবিকভাবেই এ ব্যাপারে প্রায় নীরব, কারণ প্রিমিয়ার লিগ না হলে ক্রীড়াপ্রেমী ভারতে কলকে পাওয়া এমনিতেও কঠিন। তার মধ্যে এ তো আবার বিশেষ অলিম্পিক। চিরকাল যাঁদের আমরা পাগল, অ্যাবনর্মাল ইত্যাদি বলে থাকি, নিজেদের কমপ্ল্যান কাচ্চাবাচ্চাদের যাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছি, তাঁদের এহেন কার্যকলাপ আমাদের এন্টারটেনমেন্ট-পাতে যে পাত্তা পাবে না, তা বলাই বাহুল্য। তবুও একটু ঘুরে দেখি, কী হল এই প্রতিযোগিতায়।

প্রতি দু-বছরে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় ২২টি ইভেন্টে এবারে অংশগ্রহণ করেছিলেন ১৯০টি দেশের প্রায় ৭৫০০ জন প্রতিনিধি। ভারতের প্রতিনিধিরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন নবমবার। এবারে ভারতের পদক সংখ্যা ৩৬৮; সোনা ৮৫, রুপো ১৫৪, আর ব্রোঞ্জ ১২৯। পাওয়ারলিফটিং, ব্যাডমিন্টন, সাইক্লিং, গল্ফ, অ্যাথলেটিক্স, জুডো, ভলিবল, সাঁতার, টেবিল টেনিস, রোলার স্কেটিং, বাস্কেটবল, হ্যান্ডবল, থেকে ফুটবল— পদকের ছড়াছড়ি সবেতেই। প্রতিটা জয়পদকের মধ্যে আঁকা হার না মানার রূপকথা। আসুন ছুঁয়ে দেখি এর মধ্যে তিনটি অবিশ্বাস্য কাহিনী।

মহারাষ্ট্রের উনিশ বছরের মেয়ে মানালি মনোজ শেলকে, প্রতিযোগিতায় তিনবার ওজন তুলতে গিয়েও পারেননি। চারিদিকে নীরবতা৷ ব্যর্থতার সম্ভাবনা ভারী করে তুলেছে মরু বাতাস। তখনই তাঁর কোচ এগিয়ে এলেন। দর্শকদের উদ্দেশে তাঁর উচ্চকিত আবেদন কাজে এল। সমস্ত স্টেডিয়ামের উত্তাল অনুপ্রেরণায় ওজনও যেন মাথা নোয়াল। মানালির হাতে উঠে এল গোটা বিশ্ব। স্বর্ণপদক ছিল নেহাতই সময়ের অপেক্ষা। আর তারপর, মানালির ছুটে গিয়ে কোচকে জড়িয়ে ধরা, দর্শকদের মনে আর ইন্টারনেটে শাশ্বত হয়ে থাকবে।

২৩ বছরের শালু। শৈশবেই মা-বাবা-পরিত্যক্তা মেয়েটিকে নিজের মেয়ে হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন পদ্মিনী শ্রীবাস্তবা। তাঁর আর অল ইন্ডিয়া পিংলাওয়ারা চ্যারিটেবল সোসাইটির (যেখানে শালুকে পাওয়া যায়) সক্রিয় সহযোগিতায় নিজের স্পিচ অ্যান্ড লার্নিং ডিসঅর্ডারকে পিছনে ফেলে রেখে রৌপ্যপদক পেয়েছেন শালু। একদিন নিজের রাগ আর অসহায়তা ভুলতে গিয়ে ওজন তুলতে শুরু করেছিলেন শালু, আজ তা-ই তাঁকে নিয়ে গিয়েছে এক অবিস্মরণীয় উচ্চতায়, কোনও কিছুতেই হার না মানার এক সবুজ দ্বীপে।

অভিষেক গগৈ, শৈশবেই মৃগী রোগে আক্রান্ত, কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন তিনি। যখন থেকে তিনি বুঝতে পারেন, শরীরের নিম্নাংশের ওপর তাঁর স্নায়ুর সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি, ফিজিওথেরাপি আর ক্রিকেটে মন দেন তিনি। কিন্তু, অদৃষ্ট আবার তির্যক হাসি হাসে, তাঁর বাবা মারা যান হঠাৎ। এগারো বছরের অভিষেক মায়ের সাথে গুয়াহাটি ফিরে আসেন, নতুন যাত্রা শুরু করার জন্য। সেখানেই প্রতিবেশী বন্ধুদের উৎসাহে তিনি সাইকেল চালানো শুরু করেন। তাঁর ক্রিকেট কোচও তাঁর সহজাত প্রতিভা দেখে সাইক্লিংয়ের পরামর্শ দেন। একটা নতুন রেসিং সাইকেল ছিল না তাঁর। সেই অবস্থায়ও রাঁচিতে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় রেকর্ড করেন তিনি। দশ কিলোমিটার সাইক্লিংয়ে তিনি বিশ্বের দ্বাদশ স্থানে। আঠারো বছরের অভিষেকের এই কৃতিত্বই তাঁকে দোহা অলিম্পিকের যোগ্যতা-মান পেরোতে সাহায্য করে। সেখানে পড়ে গিয়ে চোট লাগা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত রৌপ্যপদক পান অভিষেক।

আমরা আশা করতেই পারি এঁদের প্রতি আর একটু সচেতনতা আর সহমর্মিতা। তা দেশের গর্বের ভাঁড়ার আরও ভরিয়ে তুলবে। আর শুধু খেলাধুলোর অঙ্গনে নয়, জীবনের সমস্ত অমোঘ অন্ধকার মুহূর্তে দীপশিখার মতো এঁরা আমাদের মনের ভিতর চেঁচিয়ে উঠে বলবেন, ফাইট কোনি… ফাইট।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...