স্বপ্ন বেচে ক্ষমতায় এসে শুধু ভাঁওতাই দিয়েছেন মোদি

প্রশান্ত ভট্টাচার্য

 

চৌকিদার সজাগ আছেন জানান দিতে হাঁক পাড়ছেন মুহূর্মুহূ। আর মেহের আলি তখন অকম্পিত বুকে বলে চলেছে, সব ঝুট হ্যায়। যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পাঁচ বছরের শাসনকালে তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন নরেন্দ্র দামোদরদাসভাই মোদি। না-আনতে পেরেছেন অর্থনৈতিক সুরক্ষা, না-দিতে পেরেছেন নাগরিকজীবনে নিরাপত্তা।

এটা আমরা জানি, স্বপ্ন ফেরি করে নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়েছিলেন। প্রতিশ্রুতির বান ডাকিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতিতে ভুলে ৩১ শতাংশ ভারতবাসী কাজ কম কথা বেশিতে আস্থা রেখে শ্রীযুক্ত গোধরেশ্বরকে গদিতে বসালেন। ভুলে গেলেন সেই প্রবচন, শূন্য কলসির আওয়াজ বেশি। স্বপ্নবিলাসীরা ঠিকই করেছেন। যখন কোনও স্বপ্ন নেই, তখনই তো স্বপ্ন দেখতে হয়। পাঁচ বছর পর হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বেনিয়া বিলকুল ফেল হয়ে গিয়েছে। ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি যেমনই দিয়ে থাকুন, বাস্তবে মোদি সরকারের কাজের ফল নিয়ে আদৌ সন্তুষ্ট নন দেশের মানুষ। মোদি সরকারের রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে দেখা যাচ্ছে ডাহা ফেল। লোকসভা নির্বাচনের ঠিক মুখে, এমনই এক সমীক্ষার রিপোর্ট মোদি-শাহদের কপালে ভাঁজ ফেলার পক্ষে যথেষ্ট।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর) গত বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দেশের ৫৪৩টি লোকসভা কেন্দ্রের ২ লক্ষ ৭৩ হাজার ৪৮৭ জন ভোটারের মধ্যে, অর্থাৎ এক-একটি কেন্দ্রে গড়ে ৫০০-র বেশি ভোটারদের নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছে সাধারণের চেয়েও কম নম্বর পেয়েছে মোদির ‘অচ্ছে দিনের’ সরকার। এই মার্কস দেওয়ার মাপকাঠি বিবেচনায় রাখা হয়েছে এভাবে– খুব ভালোর মান ৫, সাধারণের ৩, আর খারাপ হল ১।

এডিআর এই সমীক্ষায় মূলত তিনটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছিল। প্রথমত, ভোটারদের অগ্রাধিকারের তালিকায় কোন কোন ইস্যু রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সেই সমস্ত ইস্যুতে সরকারকে কত নম্বর দিচ্ছেন ভোটাররা। আর তৃতীয়ত, কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে বদলে যেতে পারে ভোটদানের প্রবণতা। সমীক্ষায় পানীয় জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যের জোগান, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, গণপরিবহণের মতো মোট ৩১টি বিষয় রাখা হয়েছিল, যেগুলি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত। সমীক্ষার প্রথমেই ভোটারদের পাঁচটি অগ্রাধিকারের বিষয় তালিকায় নথিভুক্ত করা হয়। তারপর সেই বিষয়গুলির সঙ্গে সরকারের কাজের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট তৈরি করা হয়। শেষে খুব ভালো, সাধারণ এবং খারাপ, এই তিনটি পৃথক মাপকাঠিতে ফেলা হয় সাধারণ ভোটারের অগ্রাধিকার, এবং সেই সূত্রে সরকারের কাজকে।

এই সমীক্ষায় মোট ৩১টি বিষয়ের মধ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ১০টি ইস্যুকে বেছে নেওয়া হয়েছে। সমীক্ষার রিপোর্টে বলছে, কর্মসংস্থানকে দেশের সরকার নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ভাবছেন সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ভোটারদের (স্যাম্পলের) ৪৬.৮০ শতাংশ। দেশের অর্থনীতির হাল কী রকম, বিচারের এই জরুরি বিষয়টি অর্থাৎ কর্মসংস্থান ইস্যুতে মোদি সরকারের পারফরম্যান্স কেমন? সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ভোটাররা সরকারকে কর্মসংস্থান ইস্যুতে ২.১৫ নম্বর দিয়েছেন। অর্থাৎ সাধারণের চেয়ে খারাপ। সাধারণ ভোটারদের এই বিবেচনা যে রং-চড়ানো নয়, তার প্রমাণ বিভিন্ন সরকারি রিপোর্ট।

সরকারি প্রতিষ্ঠান লেবার বুরো-র হিসাবে, ২০১৫-১৬ সালে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৩.৭ শতাংশ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার (এনএসএসও) তথ্যে হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭-১৮ সালে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ৬.১ শতাংশ। এটি গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। যদিও সরকারের মন্ত্রীরা এনএসএসও-র ফাঁস হওয়া এই তথ্য মানতে চাননি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন এই রিপোর্ট অনুমোদন করা সত্ত্বেও মোদি সরকার তা প্রকাশ করেনি। এমন ঘটনার পরিণতি, সংস্থাটির দুই সদস্য পদত্যাগ করেছেন। তবে পাঠক এতেই বিস্মিত হবেন না,  এই রিপোর্টের আরও উদ্বেগজনক একটি তথ্য: আমাদের দেশে শহরের যুবকদের প্রায় এক পঞ্চমাংশ বেকার! সরকারি নথি থেকে পাওয়া এই পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয়, কর্মসংস্থানে মোদির রেকর্ড শোচনীয়। শহর ও আধাশহরে তরুণ কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা বছরে গড়ে দেড় কোটি করে বাড়ছে।

পাঠক মনে রাখবেন ২০১৪ সালে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মোদির প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি ক্ষমতা পেলে ১০ বছরে ২৫ কোটি চাকরি হবে। সেই হিসেব ভেঙে তিনি বলেছিলেন, বছরে গড়ে আড়াই কোটির কর্মসংস্থান হবে। গৃহস্থালির সমীক্ষার ভিত্তিতে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র রিপোর্ট দেখাচ্ছে, বেকারত্ব কমা তো দূরের কথা, বরং লাফিয়ে তা বেড়ে গিয়েছে বেশ খানিকটা। সিএমআইই-র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে বেকারত্ব ৭.২ শতাংশ। যা ভেঙে দিয়েছে আগের যাবতীয় রেকর্ড। গতবছর ফেব্রুয়ারিতে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৫.৯। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। শতাংশের হিসেব ছেড়ে কেবল সংখ্যার হিসেবে দেখলে, সিএমআইই ২০১৬ সাল থেকে কর্মসংস্থানের যে হিসেব কষেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে দেশে মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি ৬৭ লক্ষ। ২০১৮ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৬২ লক্ষ, ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে তা এসে ঠেকেছে ৪০ কোটিতে। ২০১৭ সালে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ১৮ লক্ষ, কিন্তু এটা সেই বছরের নতুন কর্মপ্রার্থীর সংখ্যার ১২ শতাংশ, আর মোদি বছরে যে আড়াই কোটি নতুন কাজ দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তার ৭ শতাংশ! সিএমআইই-র অন্য এক রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০১৮, এই চার বছরে দেশে কর্মসংস্থানের বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল ১.৯ শতাংশ। আগের দশকের চেয়ে এই হার কম। অর্থাৎ, ইউপিএ-র দশ বছরে যে হারে নতুন কাজ তৈরি হয়েছিল, গত চার বছরে কাজ তৈরি হয়েছে তার চেয়ে কম হারে।

সিএমআইই-র এই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে ১০ হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলার ভিত্তিতে। এই রিপোর্টকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন দেশের বহু অর্থনীতিবিদ। এমনকী, অনেক ক্ষেত্রেই বেকারত্বের সরকারি রিপোর্টের চেয়েও সিএমআইই-র রিপোর্টকে বেশি গুরুত্ব দেন অর্থনীতিবিদ ও বণিকসমাজের বৃহত্তর অংশ। বলা বাহুল্য, এই রিপোর্টের ঠেলায় কর্মসংস্থান নিয়ে মোদি সরকারের ফাঁপানো বেলুন ফেঁসে গিয়েছে।

শুধু কর্মসংস্থান নয়, এডিআরের সমীক্ষায় একই হাল স্বাস্থ্যেও। ভোট দেওয়ার সময় স্বাস্থ্যক্ষেত্র-সংক্রান্ত ইস্যুগুলিকে বিবেচনায় রাখাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন স্যাম্পলের ৩৪.৬০ শতাংশ ভোটার। এ-ক্ষেত্রেও ফেল করেছে মোদি সরকার। তাঁরা মনে করছেন, এ ক্ষেত্রে সরকার মাত্র ২.৩৫ নম্বর পাওয়ার যোগ্য। অর্থাৎ এ-ক্ষেত্রেও সরকারের প্রাপ্ত নম্বর সাধারণের চেয়ে খারাপ। এই সমীক্ষার ৩০.৫০ শতাংশ মানুষ পানীয় জলের সুষ্ঠু সরবরাহকে ভোট দেওয়ার সময় ক্ষেত্রে অন্যতম বিচার্য বিষয় বলে মনে করছেন। তাঁদের মতে, সরকারকে এ-ক্ষেত্রে দেওয়া যেতে পারে ২.৫২ নম্বর। অর্থাৎ, সাধারণের চেয়ে খারাপ। সমীক্ষায় ২৮.৩৪ শতাংশ মানুষ মনে করছেন রাস্তাঘাট ভোটের অন্যতম ইস্যু। সরকার তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছে ২.৪১ নম্বর, যা এককথায় ফেল। একই হাল উন্নত গণপরিবহণে। সমীক্ষায় ২৭.৩৫ শতাংশ মানুষই মনে করেন উন্নত গণপরিবহণ আসন্ন লোকসভা ভোটের অন্যতম প্রধান ইস্যু। সরকারকে তাঁরা দিচ্ছেন ২.৫৮ নম্বর, যা সাধারণের চেয়ে খারাপ।

এরপর সমীক্ষায় অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে চাষের কাজে জলের জোগান। শতকরা ২৬.৪০ জন ভোটদাতা মনে করেছেন এটাই এবারের ভোটের প্রধান ইস্যু। সরকারকে এ-ক্ষেত্রে মাত্র ২.১৮ নম্বর দিচ্ছেন তাঁরা। যা ফল হিসেবে সাধারণের চেয়ে খারাপ। দেশের মোট কৃষিজমির ২৩ শতাংশে জলসেচ ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি ৭৭ শতাংশ জমিতে জলের জন্য স্রেফ আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই কৃষকের। জয় জওয়ান জয় কিষাণ বলে মাঠ গরম হচ্ছে, অথচ স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও দেশে একটি বলিষ্ঠ কৃষিনীতি নেই!

সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ২৫.৬২ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, কৃষিকাজের জন্য ঋণের জোগান এই লোকসভা ভোটের অন্যতম প্রধান ইস্যু হতে চলেছে। এ-ক্ষেত্রেও সরকার সাধারণের চেয়ে খারাপ কাজ করেছে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ। সরকার পেয়েছে মোটে ২.১৫ নম্বর। উৎপাদিত ফসলের বিক্রয়মূল্য না-পাওয়াকে ২৫.৪১ শতাংশ মানুষ সবচেয়ে বড় বিষয় বলে মনে করছেন। তাঁরা সরকারকে এ-বিষয়ে ২.২৩ নম্বর দিয়েছেন, যা সমীক্ষার মাপকাঠিতে সাধারণের চেয়েও খারাপ ফল।

কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় বীজ এবং সার কিনতে সরকারি ভর্তুকিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে মনে করছেন ২৫.০৬ শতাংশ মানুষ। এই বিষয়ে সরকার পেয়েছে ২.০৬ নম্বর। এক্ষেত্রেও সরকারের ফল সাধারণের চেয়ে খারাপ।

দেশের সরকারগুলোর অদক্ষ ও দিশাহীন কৃষিনীতির জন্যই ২০০১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত দেশে চার লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করছেন! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন কৃষক আত্মহত্যা করছেন বলে দাবি করেছেন তেলেঙ্গানা রাজ্য কংগ্রেসের প্রধান উত্তমকুমার রেড্ডি। তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দেওয়া তথ্য তুলে ধরে জানিয়েছেন, মোদি-শাসনের প্রথম তিন বছরে তেলেঙ্গানায় মোট দু’হাজার ৯৬৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এই সময়ের মধ্যে ঋণে জর্জরিত হয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম দু’বছর খরা গিয়েছে। পরের দুই বছরে কেন্দ্র কৃষিতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেছে। তবে ২০১২ সালের পর থেকেই কৃষির বৃদ্ধি সন্তোষজনক নয়। এ-বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্টেও আবহাওয়ার পরিবর্তন ও নানা সমস্যায় কৃষি থেকে আয় আগামী দিনে এক-চতুর্থাংশ কমবে বলে দাবি করা হয়েছে। কৃষিঋণ মকুব, আত্মহত্যা-সহ একাধিক ইস্যু রয়েছে, যা সঠিকভাবে মোদি সরকার সামলাতে পারেনি।

সাদা চোখে যতটা দেখা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে কৃষির হাল যে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি খারাপ, তা-ও তথ্য তুলে ধরে দেখানো যেতে পারে। লক্ষ্যণীয়, ভারতের কর্মজীবী মানুষের অর্ধেকই এখনও কৃষিনির্ভর। মোদি কৃষকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁরা চাষের খরচের ওপর ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ পাবেন এবং ২০২২ সালের মধ্যে কৃষির আয় দ্বিগুণ হবে। সে সবের চিহ্নমাত্রও নেই, উল্টে ভারতীয় কৃষি ব্যাপক সঙ্কটে। ২০১৪ থেকে ২০১৭-র মধ্যে কৃষি আয়ের বার্ষিক গড় বৃদ্ধি-হার ২.৫১ শতাংশ। আগের দশকে (২০০৪-১৪) এই হার ছিল ৩.৭ শতাংশ, তার আগের দশকে (১৯৯৪-২০০৪) ২.৮৮ শতাংশ। গ্রামীণ মজুরি বৃদ্ধির হারও দশ বছরে এত কম কখনও হয়নি। ২০১৮ সালে গ্রামীণ মজুরি মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারেনি, অর্থাৎ প্রকৃত মজুরি কমেছে। পাশাপাশি, কৃষিপণ্যের দাম বেড়েছে অন্যান্য পণ্যের চেয়ে অনেকটা কম হারে, নোটবন্দির পর নানা ফসলের দাম কমার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে কৃষিনির্ভর মানুষের প্রকৃত আয়, যাকে বলা যায় আপেক্ষিক ক্রয়ক্ষমতা, তা-ও কমেছে। ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর রাতে নোট বাতিলের ধাক্কায় কাজের সুযোগও কমেছে, ফলে কমেছে গ্রাম থেকে বাইরে কাজ করতে যাওয়ার প্রবণতা। ফলে গ্রামীণ আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারের মতো শোনালেও, ঘটনা হচ্ছে, দেশের গ্রামজীবনে এত খারাপ সময় সাম্প্রতিক কালে আর আসেনি। ফলত, কর্মসংস্থান হোক কিংবা কৃষি, ভোটারদের চোখে সবকটি ইস্যুতেই বর্তমান সরকার সাধারণের চেয়ে খারাপ কাজ করেছে।

অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্য থেকেও অনেক দূরে সরে গিয়েছে মোদি সরকার। গত পাঁচ বছরে আন্তর্জাতিক পুঁজি এবং দেশীয় বৃহৎ শিল্পপতিদের মুনাফার মাত্রা আরও বাড়ানোর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে দেশের  অর্থনীতিকে। দেশে যে অতিরিক্ত সম্পদ তৈরি হচ্ছে তার ৭৩ শতাংশ জনসংখ্যার ১ শতাংশের হাতে কুক্ষিগত হচ্ছে। নোটবন্দি ও জিএসটি-র মতো যৌথ অর্থনৈতিক হঠকারিতা ব্যাপক অংশের অর্থনৈতিক কাজকর্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে, যার জেরে একদিকে কর্মহীন হয়েছেন বিরাট অংশের মানুষ, অন্যদিকে, শ্লথতা দেখা দিয়েছে অর্থনীতিতে। পরিসংখ্যানগত নানা কারচুপি সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে জিডিপি বৃদ্ধির হার এক দশকের মধ্যে নিম্নতম। আর তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতির আগ্রাসী পদক্ষেপ আর দেশীয় অর্থনীতির অবিরাম ধ্বংসের জেরে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বৃদ্ধি ঘটেই চলেছে।

বিবেচনা করে দেখবেন, রাজনীতি এই দেশের ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে আর ২০১৪ সাল থেকে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এখন ভারত আড়াই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি। বিশ্বে ষষ্ঠ। মোদি-জেটলিদের প্রতিশ্রুতি, আগামী পাঁচ বছরে ভারত হবে ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি। সারা বিশ্বে তৃতীয়। অসংখ্য স্টার্ট আপ কোম্পানি তাঁর এই স্বপ্নকে সফল করবে, দাবি প্রধানমন্ত্রীর। একইভাবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও বহু আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদি। মোদি সরকারের অন্যতম মুখ্য প্রকল্প ছিল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। তবে এই প্রকল্পে বড় কোনও সাফল্য আসেনি। একের পর এক স্টার্ট আপ তৈরি হলেও অধিকাংশই পরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিদেশের বড় সংস্থাগুলিও, যেভাবে প্রচার হয়েছিল সেই অনুপাতে দেশের বাজারে ব্যবসা করতে আসেনি।

বিরোধীদের অভিযোগ, পাঁচ বছর আগে দেওয়া কোনও প্রতিশ্রুতিই পালন করতে পারেনি মোদি সরকার। এটাও সবার জানা যে, মোদি সরকারের আমলে আর্থিক বৃদ্ধির হারের সাফল্য তুলে ধরতে হিসেবের পদ্ধতিটাই বদলে দেওয়া হয়েছে। ফলে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার নিয়ে সরকারের দাবিও এখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তবে এটা না বললে সত্যের বা তথ্যের অপলাপ হবে যে, ইউপিএ’র তুলনায় এনডিএ সরকার রাজকোষে ঘাটতির অনুপাত কিছুটা কমাতে পেরেছে। কিন্তু এর পিছনে যে কারণটি আছে সেটিও তুলে ধরা দরকার। মোদির আমলের বেশিরভাগ সময়টা জুড়েই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, অথচ সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে তার ওপরে আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে গিয়েছে। ফলে স্ফীত হয়েছে রাজকোষ। এর পাশাপাশি রাজ্যগুলোর প্রাপ্ত রাজস্বের অংশটির সবটা না-দিয়ে, হাতে রেখে দেখানো হচ্ছে রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধি। যা এক ধরনের ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয়।

যাঁরা এই ভেবে নিশ্চিন্ত রয়েছেন যে, অর্থনীতির এত প্যাঁচ-পয়জার সাধারণ মানুষের মাথায় ঢুকবে না, তাঁরা সম্ভবত মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। মনে রাখবেন, অর্থনীতির গূঢ় তত্ত্ব না-বুঝলেও পেটে লাথি যার পড়ে সে কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই সে লাথির মর্মোদ্ধার করে নিতে পারে। মার খেতে-খেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর, এবার সে কীভাবে তার জবাব দেয়, তার ওপরেই আসন্ন লোকসভা ভোটের ভাগ্য নির্ভর করছে।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...