মনুবাদী ভারত জন্ম নিচ্ছে একদল ধর্মান্ধের হাত ধরে

সৌমিত্র দস্তিদার

 

সংবাদমাধ্যমের দৌলতে আমরা সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছি যে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোপাল কেন্দ্র থেকে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন ২০০৮-এ মালেগাঁও বিস্ফোরণের মূল অভিযুক্ত ও চক্রী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর।

সন্ত্রাসবাদের মতো দেশবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত প্রজ্ঞা সিংকে ভোটে দাঁড় করানোর কারণ হিসেবে দুটো সম্ভাবনার কথা বলা যেতে পারে। এক, প্রথম দফায় নির্বাচনের ট্রেন্ড দেখে নরেন্দ্র মোদি ও তার রাজনৈতিক পরামর্শদাতারা নিশ্চিন্ত হয়ে গেছেন তারাই ফের ক্ষমতায় আসছেন। ফলে কোনওরকম চক্ষুলজ্জার ধার না ধরে খোলাখুলি হিন্দুত্ববাদের তাস খেলছেন। আগাম বার্তা দিয়ে রাখতেই ভবিষ্যতের সঙ্ঘ পরিবারের আজন্মলালিত স্বপ্ন হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের ব্রান্ড আম্বাসাডার প্রজ্ঞা ঠাকুরের মনোনয়ন। পাশাপাশি অন্য আর এক সম্ভবনাও প্রবল ও গুরুত্বপূর্ণ ।প্রথম দফায় নির্বাচনের ট্রেন্ড দেখে নরেন্দ্র মোদি বুঝতে পেরেছেন বা তার কাছে খবর পৌঁছেছে যে চৌকিদার চোর হ্যায় স্লোগান সত্যিই জনমনে চাড়িয়ে গেছে এমনভাবে যে তথাকথিত উন্নয়ন নিয়ে বাগাড়ম্বরেও আর চিঁড়ে ভিজছে না। অগত্যা এক ও অদ্বিতীয় ধর্মীয় মেরুকরণের পথই ভরসা। সেখানে প্রজ্ঞা ঠাকুরের মতো আইকন নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে মোদির কাছে অত্যন্ত জরুরি। এটা অন্তত বিজেপির অন্ধ ভক্তরাও প্রকাশ্যে না হোক আড়ালে আবডালে নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে উন্নয়ন দলের মুখ হলেও অন্তরে রয়ে গেছে মুসলিম বিদ্বেষ; আরএসএসের জন্মলগ্ন থেকে যে মুসলিম বিদ্বেষ রোপণ করা হয়েছিল, তাই পল্লবিত হয়ে এখন বৃহৎ বৃক্ষরূপে সারা দেশে শোভা পাচ্ছে।

স্বাধীনতার আগে থেকেই হিন্দুত্ববাদের অস্ত্র তীব্র মুসলমান ঘৃণা। ফলে ১৯৪৭ থেকে এদেশে আজ অবধি যত দাঙ্গা হয়েছে প্রত্যেকটির পিছনে কোনও না কোনও মিলিট্যান্ট হিন্দু সংগঠনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা আছে। সে একদা আর্যসমাজী-ই হোক বা মালেগাঁও কাণ্ডে জড়িত প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের অভিনব ভারতই হোক— কুকর্মে কেউই কম যায় না।

আসলে ফাসিস্ত প্রবণতার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে যে এক কল্পিত শত্রু খাড়া করে অনবরত তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা, নিদেনপক্ষে অবিরাম ছায়াযুদ্ধ করে যাওয়া। এর সুবিধে হচ্ছে দেশের সত্যিকারের সমস্যা থেকে জনসাধারণের মুখ ফিরিয়ে রাখা যায়। নির্বাচনের প্রচারে যতই উন্নয়নের ঢাক পেটানো হোক না কেন ভারতীয় অর্থনীতির হাল যে সঙ্কটজনক, তা একটু আধটু খোঁজখবর নিলেই জানা যায়। ফলে বিজেপির সামনে খোলাখুলি হিন্দু তাস খেলা ছাড়া আর অন্য কোনও রাস্তা নেই। মনে করতে পারছি না এ দেশে আজ অবধি অন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে জনসভায় নিজের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এভাবে আগে কখনও যুদ্ধঘোষণা করেছিলেন বলে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর কথা মনে রেখেই প্রশ্নটা তুললাম। মুখ্যমন্ত্রী মোদির গুজরাত আমি কাছ থেকে দেখেছি। গোধরা পরবর্তী জেনোসাইড-এর সাক্ষী হয়ে। যেখানে মোদি-বাহিনী আওয়াজ তুলেছিল— এ অন্দর কি বাত হায় পুলিশ হামারা সাথ হায়। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে উন্মত্ত গেরুয়া সন্ত্রাসীরা একের পর এক মুসলিম মহল্লায় আক্রমণ করে ধংসলীলা চালিয়েছিল। উভয় সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধার সুফি সন্ত বালি গুজরাতির মাজার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। গুলবর্গা সোসাইটির সামনে, আজও মনে আছে পুলিশ অফিসার নিজের বাইক থেকে পেট্রল ঢেলে দাঙ্গাবাজদের বস্তিতে আগুন লাগাতে কীভাবে ইন্ধন দিয়েছিল।

আজকের দিনে চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ব্রান্ড নিউ প্রডাক্ট হচ্ছে এইসব প্রজ্ঞা ঠাকুরেরা। সাধ্বী ঋতম্ভরা, উমা ভারতীরা এখন অতীত। উন্মাদনা জাগাতে চাই আরও নতুন, আরও হিংস্র মুখ। এই এক-একজন প্রজ্ঞা আসলে আমাদের তরুণ বয়সে দেখা রাম্বো সিরিজের হিন্দুত্ববাদী ভার্সান। ভিয়েতনাম যুদ্ধে হারের ক্ষত মুছে ফেলতে এক কাল্পনিক সুপার হিরো দরকার ছিল যার মধ্যে দিয়ে বদলার রাজনীতি চ্যাম্পিয়ন হয়। এখানে কোনও বদলার গল্প নেই। না, ভুল ভাবছি। আছে আছে আছে৷ আমাদের ১৯৪৬ আছে। গ্রেট কলকাতা কিলিং, নোয়াখালি ৪৭, ও দেশভাগ আছে। মুসলিম নির্যাতনের সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে অজস্র আখ্যান। হিন্দুত্ববাদের হাত ধরে যে একতরফা ইতিহাস জন্ম নেয়। যে ইতিহাসের পাঠে শুধু অতীতকে খুঁচিয়ে-তোলা ঘৃণা। সেখানে কোনও বর্ণহিন্দুর আধিপত্যের আখ্যান নেই। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কাহিনী নেই। নির্মম কৃষক শোষণ নেই। ঘটনাচক্রে যে কৃষক জনতার বড় অংশই মুসলিম অথবা দলিত। নোয়াখালি আছে। এমনকি ইতিহাসের অ্যাকাডেমিক পরিসরেও বিহারও নেই। মালেগাঁও বিস্ফোরণে, সমঝোতা এক্সপ্রেস সর্বত্রই এই হিন্দু তালিবানদের হাত ছিল তা যিনি সর্বসমক্ষে বলতে পেরেছিলেন তিনি মহারাষ্ট্র পুলিশের অন্যতম বিশিষ্ট নাম হেমন্ত কারকারে। রহস্যজনকভাবে তিনি মারা যান। কারকারের অধিকাংশ সহকর্মীর বিশ্বাস তাদের সাহেবকে কোনও এক অজানা ওপরওয়ালার অঙ্গুলিহেলনে খুন করা হয়েছিল। মহারাষ্ট্র পুলিশের প্রাক্তন আইজি এস এম মুশারফের লেখা এ সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই ‘হু কিলড কারকারে’ পড়লে বুঝতে পারবেন কী ভয়ঙ্কর এবং ঘৃণ্য কৌশলে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সংবিধান বদলে হিন্দু ভারত জন্ম নিচ্ছে। না, হিন্দু ভারত নয়। বলা ভালো মনুবাদী ভারত জন্ম নিচ্ছে একদল ধর্মান্ধের হাত ধরে। যে ভারতে যুক্তিবাদের কোনও জায়গা নেই। যে ভারতে বহুত্ববাদের স্থান নেই। আলো এখানে পিছু হটেছে। আছে শুধু একরাশ অন্ধকার। তাই প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের কথা ভেবে অবাক হচ্ছি না। তার বিরুদ্ধে এখনও মামলা চলছে। তিনি অসুস্থতার দোহাই দিয়ে জামিন পেয়েছেন মাত্র। ‘অসুস্থ’ অথচ ভোট লড়াইয়ে অবতীর্ণ। বৃদ্ধ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র হয়ে বসে আছেন নির্বাচন কমিশন। এইরকম এক সাধ্বী ছাড়া চৈতন্যের দেশ, লালনের দেশ, স্বামী বিবেকানন্দের ভারতবর্ষকে কেই বা বাঁচাবে!!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...