জোড়াফুলের জোড়া ভুল: বামের ভোট রামে যাওয়ার অজুহাত দিয়ে পার পাবেন না মমতা

প্রশান্ত ভট্টাচার্য

 

শেষমেশ পাহাড়ও হাসল না, মাদল-ধামসা নিয়ে মেতে উঠল না জঙ্গলমহলও। উল্টে ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’ পড়ে ঘাসফুলের জায়গায় পদ্ম ফুটল রাজ্যে। বাংলায় বিজেপি সাবালক হল, পৌঁছল ১৮-য়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব প্রিয় স্লোগান ছিল, ‘পাহাড় ও জঙ্গলমহল হাসছে।’ এই দুই জায়গাতেই উন্নয়ন ও স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রতিষ্ঠা করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টাকে তাঁর অতিবড় নিন্দুকও অস্বীকার করতে পারবেন না। তবু এই দুটি জায়গার গুনে-গুনে ছ’টি আসন তুলে নিল বিজেপি।

এই ফলাফলের নিরিখে, আপাতদৃষ্টিতে দেখলে তৃণমূল এখন পাহাড়ে ও জঙ্গলমহলে কার্যত বাতিল মুদ্রা। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠছে, এত উন্নয়নের ঢাক পেটানো, পাহাড় ও জঙ্গলের হেসে ওঠা নিয়ে এত কথার পরেও এই ফল কেন? দেখা যাচ্ছে হাসতে-হাসতে জঙ্গলমহল ও পাহাড় একেবারে কাঁদিয়ে ছেড়েছে তৃণমূল সুপ্রিমোকে।

পাহাড়ে না হয় উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে, উন্নয়ন করেও পাহাড়িদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিকে পাশ কাটানো যায়নি। গত আড়াই দশক ধরেই দেখা যাচ্ছে পাহাড়িরা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে সামনে রেখে লোকসভা নির্বাচনে একটি চরম সুবিধাবাদী লাইন নিয়ে চলেছেন। এটাই পাহাড়ের ঘরানা হয়ে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু জঙ্গলমহল! ২০১১ সালে বাংলার রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরে রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল জঙ্গলমহলের উন্নয়নে কিছু করেনি বললে তা ডাহা মিথ্যা বলা হবে। উল্টে সাড়ে তিন দশকের বঞ্চনা-অভাব ভোলানোর মতো যথেষ্ট কাজ করেছে মমতা সরকার। বাড়ির দরজা পর্যন্ত ঝকঝকে রাস্তা, সামনেই আইটিআই কলেজ থেকে প্রত্যেক গ্রামে সাড়ে চার গণ্ডা পুকুর ও বাঁধ খনন থেকে প্রথম পাঁচবছরেই অনেক কিছু দেখা গেল। কেউ তা অস্বীকারও করতে পারেন না। কেউ বলতে পারেন, ন্যায্যই ছিল! তাহলে সমস্যাটা কোথায় হল? স্থানীয় কিছু নেতার ঔদ্ধত্য, দুর্নীতি আর কলকাত্তাইয়া নেতাদের এই জনজাতির মানুষগুলোকে না-মানুষ মনে করা। আর যেহেতু রাজা ‘কর্ণেন পশ্যতি’, তাই মাটিতে-বাতাসে ছড়িয়ে থাকা অনেক অরাজকতা তিনি দেখতে পান না। পার্ষদদের ভুরি ভুরি অনাচার তাই নীরবে নিভৃতে কাঁদে। তাহলে সমীকরণের আকারে সাজালে দাঁড়াচ্ছে– শাসকদলের ঔদ্ধত্য + পঞ্চায়েত + মেরুকরণ + সাম্প্রদায়িকতা + টাকার খেলা = আত্মঘাতী জঙ্গলমহল।

প্রাথমিকভাবে রক্ষণশীল অবস্থান নিয়ে থাকলেও দেখা গিয়েছে, জঙ্গলমহল রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনেরও দিশারী। এবারও বহু আশা নিয়ে জঙ্গলমহল ফের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। পদ্ম-শিবিরের কাছে তাদের প্রত্যাশা অনেক। সময়ই বলবে, তাদের সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ হবে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, গোটা দেশের পাশাপাশি বাংলাতেও চমৎকার ফল করেছে বিজেপি। পাহাড় ও জঙ্গলমহলের পাশাপাশি বাকি ১২টি আসনে বিজেপির এই জয় নিয়ে যদি কাটাছেঁড়া করা যায়, দেখা যাবে তৃণমূল নয়, বিজেপির জয়ের পথে অনুঘটকের কাজ করেছে বামরা। বরং মেরুকরণের রাজনীতির মাঝেও ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ভোটের শেয়ার বাড়িয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। আমাদের এক বন্ধুর ভাষায়, সিপিএমের ফিদায়েঁ আক্রমণ… নিজেকে ধ্বংস করে শত্রু নিকেশ… লাল ঝাণ্ডা করে পুকার… ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

না, বন্ধুটি একটুও বাড়িয়ে বলেননি। বামেরা মালদহ দক্ষিণ ও বহরমপুর (যদিও বহরমপুরে বামফ্রন্টের সমর্থন ছাড়াই আরএসপি প্রার্থী দিয়েছিল) ছাড়া বাকি ৪০টি আসনেই প্রার্থী দিয়েছিল। আর এই ৪০টির কোথাও বামেরা দ্বিতীয় স্থানে আসেননি। বামপ্রার্থীদের মধ্যে সেরা ছাত্র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তিন দলের মধ্যে লড়াই করে বিশিষ্ট আইনজীবী তৃতীয় হলেও জামানত বজায় রেখেছেন। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, মোট প্রদত্ত ভোটের ছয় ভাগের এক ভাগ পেলে জামানত রক্ষা হয়, যা শতাংশের হিসেবে হয় ১৬ শতাংশের কিছুটা বেশি ভোট। যাদবপুরে সিপিএম প্রার্থী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বামপ্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন, ২০.৯৯ শতাংশ। তাই রাখতে পেরেছেন জামানত। রায়গঞ্জের বিদায়ী সাংসদ মহম্মদ সেলিম এবারও যথারীতি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন একই কেন্দ্র থেকে। ভোট পেয়েছেন ১৪%। ২০১৪ সালে বামেরা জিতেছিল মুর্শিদাবাদ লোকসভা আসনটিও। এবারও সেখানে প্রার্থী হয়েছিলেন বদরুদ্দোজা খান। শতকরার হিসাবে তাঁর প্রাপ্ত ভোট ১২.৭৫ শতাংশ।  দমদম কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য পেয়েছেন ১৩.৭৭ শতাংশ ভোট। কলকাতা দক্ষিণ কেন্দ্রে সিপিএমের অন্যতম এলিট প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায় পেয়েছেন ১১.৩৮ শতাংশ ভোট। ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র থেকে সিপিএমের হয়ে লড়েছিলেন আর এক এলিট প্রার্থী ডা. ফুয়াদ হালিম। এঁর হয়ে প্রচার করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৬.৪৩ শতাংশ। কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী কণীনিকা ঘোষ পেয়েছেন ৭.৬ শতাংশ ভোট। বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে সিপিএমের তরুণ তুর্কি আভাস রায়চৌধুরী পেয়েছেন ১১.৩ শতাংশ ভোট। বর্ধমান পূর্ব কেন্দ্রে বামপ্রার্থী পেয়েছেন ১২.১২ শতাংশ আর শ্রীরামপুরে ১০.৮৭ শতাংশ ভোট। বারাকপুর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী গার্গী চট্টোপাধ্যায় পেয়েছেন ১১.৭৬ শতাংশ। একসময়ে বাম দুর্গ বলে পরিচিত জলপাইগুড়িতে সিপিএম প্রার্থী ভোট পেয়েছেন সাকুল্যে ৪.৭৬ শতাংশ। বাঁকুড়া কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্র এবং বোলপুরের রামচন্দ্র ডোমও ১০ শতাংশের কম ভোট পেয়েছেন। বামফ্রন্টের সমর্থন ছাড়াই বহরমপুরে আরএসপি প্রার্থী দিয়েছিল ইশ মহম্মদকে। তিনি পেয়েছেন মাত্র ০.৯৬ শতাংশ ভোট। চার বামদল, সিপিএম, সিপিআই, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক মিলে পেয়েছে ৭.৫৫ শতাংশ।

এটা কোন ন্যারেটিভকে তুলে ধরে? যে বামদলগুলো রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে, ৩ ফেব্রুয়ারি নজরকাড়া সমাবেশ করে ব্রিগেডে, অথচ সেই জমায়েত ট্রানস্লেটেড হয় না ইভিএমে! উল্টে ২০১৬’র থেকে ২২% ভোট কমে এবারে নেমে আসে ৭.৫৫%তে। আর বিজেপির ভোট বাড়ে ঠিক ২২%। ভোট যায় পদ্মে। তার মানে কি এই ‘রামরেড’রাই বিজেপিকে ২ থেকে ১৮তে পৌঁছে দিলেন? নাকি ওই ২২% ভোটের সবটা পদ্মে যায়নি?

অঙ্ক বলছে, ১৫-১৬ শতাংশ হিন্দু বামদের ভোট গেছে বিজেপিতে, আর বাকি ৬-৭% গেছে তৃণমূলে। আর এই সবটাই হয়েছে নিজের নিজের অ্যাজেন্ডায়। ২০১১ থেকে নীচের তলার বাম কর্মী-সংগঠক-সমর্থকরা যখন দিনের পর দিন মার খেয়েছেন তখন পার্টি পাশে দাঁড়াতে পারেনি, নড়বড়ে নেতৃত্ব ফিসফ্রাই সহযোগে চা পান করে সমাধানের উপায় খুঁজতে গেছেন নবান্নে। অথচ সামনে প্রতিদিন তৃণমূল। এই অবস্থায় তৃণমূলের একটা ঠিকঠাক (তায় আবার হিন্দু) প্রতিপক্ষকে পেয়ে সেদিকে ঝুঁকে পড়েছেন বেচারিরা! আর বাকি ৬-৭% দেখেছে ইসলাম খতরে মে হ্যায়, রক্ষা করার মতো তাগত নেই দলের, অতএব আপাতত হিন্দু আগ্রাসন থেকে বাঁচতে তৃণমূলের জোড়াফুলেই ছাপ মারি! যেমন বসিরহাটে বামদের ২০১৪ সালের তুলনায় ভোট কমেছে ২৫.২১ শতাংশ আর ২০১৪’র তুলনায় বিজেপির ভোট বেড়েছে ১১.৭৬ শতাংশ। কংগ্রেসের ভোট অতীতে যা ছিল তাই আছে। তাহলে তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নুসরত জাহান বাম ভোটের প্রায় সাড়ে ১৩% নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন।

এই স্থানিক পাটিগণিতের পিছনে রসায়ন এটাই, সংখ্যালঘু বামভোটের একটা অংশ বিপন্নতা থেকে তৃণমূলকে আশ্রয় করেছে। বাম ভোট যে রামে গিয়েছে তার একটি মোক্ষম উদাহরণ পোস্টাল ব্যালট। পোস্টাল ভোট গণনায় বিজেপি এগিয়ে থেকেছে। রাজ্যে মোট ১,০৯,৭০১টি পোস্টাল ব্যালটের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৬৮,৩৯৮, তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছে ২৫,৭৯১টি, আর বামেদের ঝুলিতে এসেছে ৭,৬৫৫টি। মনে রাখবেন, এই নির্বাচন কর্মীরা সবাই সরকারি কর্মচারী। এবং এঁদের ৯০ শতাংশই বাম আমলে চাকরি পেয়েছেন। সিপিএম পরিচালিত কোঅর্ডিনেশন কমিটি এঁদের সংগঠন। কোঅর্ডিনেশন কমিটির এক রাজ্য নেতা এই প্রতিবেদককে স্পষ্ট বলেছেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় এই সরকারের কর্মীরা ডিএ পাওয়ার ব্যাপারে দিনের পর দিন বঞ্চিত হয়ে চলেছে। তার রিফ্লেকশন হয়েছে এবারের ভোটে।’ পাঠক মনে রাখবেন, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের কর্মীদের পাশাপাশি  জেলা পরিষদ, পুরসভা ও সরকার অধিকৃত সংস্থার সব মিলিয়ে রয়েছেন প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ স্থায়ী কর্মী। নির্বাচনী প্রচারে বার বার এসে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ সরকারি কর্মীদের এই বঞ্চনার কথা উস্কে দিয়ে গেছেন। ফলে সেই সাড়ে ৭ লক্ষ কর্মীর ভোট ও তাঁদের বাড়ির ভোট কোন দিকে যেতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মনে রাখবেন, এই স্থায়ী কর্মীদের প্রায় ৯৯ শতাংশের চাকরি হয়েছে বাম আমলে।

এর সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের গোষ্ঠীকোন্দলও তৃণমূলকে ভুগিয়েছে। বহু এলাকায় এর ফায়দা তুলেছে বিজেপি। আর স্থানীয় নেতারা নিজেরা কোন্দল করতে করতে বিজেপির উত্থানের রিপোর্টও ঠিকমতো পাঠাতে পারেনি দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছে। এর সঙ্গে আছে অতিরিক্ত প্রশাসন-নির্ভরতা। প্রশাসনের চোখে দল দেখছেন নেতারা। বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের। আর তাতে সংগঠনে একাধিক ফাঁকফোকর তৈরি হয়েছে। অনেকটা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর আমলের বামফ্রন্টের মতো।

এর পাশাপাশি রয়েছে নেতাদের কাটমানি খাওয়ার দস্তুর। পুরুলিয়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় আবাস যোজনা বা অন্য সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের থেকে কাটমানি নিয়েছেন তৃণমূল নেতারা। এতে বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন মানুষ। এমনকী, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কাজ দিয়ে নেতাদের টাকা খাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে হারিয়েছে সাধারণ মানুষ থেকে তপশিলি জাতি-উপজাতি মানুষের ভোট। নেতাদের অতিরিক্ত মাতব্বরিতে মতুয়াদের ভোট খুইয়েছে তৃণমূল। এরসঙ্গে মোদি-শাহদের এনআরসি-র হুমকি ও হিন্দুত্বের জিগিরেও মতুয়াদের ভোট গিয়েছে বিজেপিতে।

এছাড়াও মোদি ও বিজেপিকে আক্রমণে জোর দিতে গিয়ে তৃণমূলের ইতিবাচক দিক ও রাজনৈতিক কথাগুলি সুস্থ রুচিশীল ভাষায় মানুষের সামনে রাখা হয়নি। উল্টো ভাষার গোলমাল ও ভঙ্গিতে বিপ্রতীপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

সর্বোপরি মানুষকে পাইয়ে দিয়ে, সরকার বা দলনির্ভর করে তুলে দিনের পর দিন ভোট পাওয়া যায় না। চাই সুষ্ঠু চাকরি বা কর্মসংস্থান। বাম রাম এক হয়ে গিয়েছে, এই প্রচার ছেড়ে নিজেদের দিকে নজর দিতে হবে তৃণমূলকে। নইলে আমও যাবে, ছালাও যাবে।

তবে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই সিপিএমের এরিয়া কমিটি স্তরে বা জেলা কমিটির স্তরে কিছু নেতা ছাড়া বাম নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘটাপটা করে বিজেপির ঘরে ভোট করিয়েছে, এমনটা হতে পারে না। বিজেপি হাত ধুয়ে টাকা নিয়ে নেমেছে ঠিক এবং তার একটা অংশ আঞ্চলিক ও জেলা স্তরে বাম নেতাদের পকেটে যায়নি, তা হলফ করে বলতে পারব না। যেমন পারব না তৃণমূল নেতাদের সম্পর্কেও। কেননা, ওদিকে তৃণমূলের ১০-১১ শতাংশ ভোট গিয়েছে বিজেপিতে, তারা নকল রামনবমী নয় আসল রামনবমী করতে গেছে। নরম হিন্দুত্বের লাইনে এটাই বিপদ। আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি, মুকুল রায় বাজে কথা বলেননি। বাইরে তৃণমূল সেজে ভিতরে গেরুয়া। বুথে এজেন্ট হয়ে বসেছেন রাজ্যের শাসকদলের হয়ে। আমি নিশ্চিত, রাজ্যের ৪২টি আসনের সবকটিতেই এমন কিছু গেরুয়া তৃণমূল অতিসক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। তবে বাম ভোটে রামে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বামদেরই। নেমে এসেছে শূন্যে। অথচ ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচনে ৩৪টি আসনের মধ্যে সিপিআই পেয়েছিল ৫টি, আরএসপি ১টি। ১৯৫৭ সালে তা বেড়ে হয়েছিল সিপিআই ৬টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ২টি, আরএসপি ১টি, পিএসপি ২টি। ১৯৬২-তে সিপিআই ৯টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ১টি, আরএসপি ১টি। ১৯৬৭ সাল, কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে সিপিএম-এর জন্ম হয়। সেই ভোটে রাজ্যে আসন সংখ্য বেড়ে হয় ৪০। সিপিএম পায় ৫টি, সিপিআই ৫টি, এসইউসি ১টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ২টি, আরএসপি ১টি। আর ১৯৭১-এ ৪০টি আসনের মধ্যে সিপিএম একাই পায় ২০টি আসন, সিপিআই ৩ ও আরএসপি ১টি। তারপর তো বাম ঋতু। সেই বাম এবার শূন্য। সারা দেশে সব মিলিয়ে ৫। বিপন্ন সময় কী বলছে তা শুনতে পারলেন না বাম নেতারা।

তবে এ তো গেল বাম-রামের কথা। এদিকে বিজেপির এই সাফল্যের পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ও সরকারের ভূমিকাও কম নেই। কী এমন সঙ্কট দেখা দিয়েছিল যে, পঞ্চায়েত ভোটে জনমত প্রতিফলনে বাধা দেওয়া হল? আর সেটি করে সাধারণ মানুষকে তো ক্ষেপানো হলই, এছাড়াও যাচাই হল না নিজেদের শক্তি! ভোটে লড়তে না পারা, ভোট দিতে না পারা মানুষের দীর্ঘশ্বাস কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে পদ্মে গিয়ে পড়েছে বলেই ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়।

যেমন, উত্তরে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, মালদহ উত্তর, দক্ষিণবঙ্গে রানাঘাট, বনগাঁ, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, বর্ধমান-দুর্গাপুর, হুগলি, মেদিনীপুরের ফল। মানুষ পঞ্চায়েত ভোট দিতে না পারার শোধ তুলেছে লোকসভা ভোটে। তবে এটাই সব নয়। এর সঙ্গে আছে, নব্য তৃণমূল বনাম আদি তৃণমূলের দ্বন্দ্ব। নব্যদের ‘দাদাগিরি’। তৃণমূল সুপ্রিমো বার বার দলের কোর কমিটির বৈঠকে তাঁর পুরনো সঙ্গীদের দলে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেছেন কিন্তু বাস্তবে তার জন্য যে নজরদারি দরকার, তা হয়নি। উল্টে বিভেদ বেড়েছে। এমনকী, পিসির ভাইপো-স্নেহও অনেককে কষ্ট দিয়েছে। অপমানিত করেছে।

অর্থাৎ এককথায়, বাইরের আক্রমণ সামলাতে না-পারার পাশাপাশি নিজের ঘর আগলাতে না-পারারও মাশুল মমতাকে দিতে হয়েছে এবারের ভোটে। পরেরবার ভোটে যাওয়ার আগে এই জোড়া ভুল সংশোধন করে নিতে পারবেন তো তিনি? সময়ই এর উত্তর দেবে।

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to Amalesh Dasgupta Cancel reply