লেবার কোডের রাজনীতি

অঞ্জন চক্রবর্তী

 


গত তিন দশকে যাঁরা প্রকৃত আয় ও সম্পদের সৃষ্টিকারী— সেই শ্রমজীবী শ্রেণি কীভাবে এই উৎপাদনের সুফল পাবেন, সে বিষয়ে শ্রম কোড নীরব। যদিও এতে মজুরি ও আয়ের সুরক্ষার উল্লেখ আছে, তথাপি এই শ্রম সংস্কার আয় ও সম্পদ বণ্টনকে শ্রমজীবী শ্রেণির পক্ষে সামান্যতমও ঘোরাতে পারবে কি না এবং সমাজকে আরও সমতাভিত্তিক করতে পারবে কি না, তা এক গভীর প্রশ্ন। বিশেষ করে যখন এই কোড ‘শ্রমিক’ ও ‘শ্রমজীবী শ্রেণি’— এই চেতনা ও ঐক্যের ধারণার ওপরই আঘাত হানে এবং ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠিত শক্তিকে দুর্বল করার পদক্ষেপ নেয়। তাই বলাই যায়, এই লেবার কোড ধনী ও দরিদ্রের মাঝে বিদ্যমান শ্রেণিবিভাজনকে অক্ষুণ্ণ রাখে, উপরন্তু সেই ফারাক আরও গভীর করার পথ সুগম করেছে

 

বিশ্বের বৃহত্তম পরিবার হল শ্রমজীবী শ্রেণি। অন্যান্য পরিবারের মতো, এই পরিবারও  আয়, জাত, লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকে খণ্ডিত। তা সত্ত্বেও, একটি বিষয়ে স্বতন্ত্র শ্রেণি হিসেবে তাঁরা একসূত্রে গাঁথা— তাঁরা সকলেই শ্রমিক, শ্রম-এর মধ্যে দিয়েই তাঁরা নিজেদের শ্রমক্ষমতার পুনরুৎপাদন করেন। মার্কসের মতে শ্রমিকের মধ্যে সুপ্ত আছে যে মূর্ত শ্রমক্ষমতা বা শ্রমসম্ভাবনা— শারীরিক এবং মানসিক, উভয় অর্থে, তা-ই হল শ্রমশক্তি। ‘শ্রমশক্তির ব্যবহারই শ্রম’ এবং ‘ব্যবহারের এই অ-স্থিরতাই শ্রমকে একটা প্রক্রিয়া করে তোলে’— যার নাম, ‘শ্রম-প্রক্রিয়া’। শ্রম-প্রক্রিয়ায় শ্রম সতত পরিবর্তনশীল। অ-স্থির এবং পরিবর্তনশীল ‘এই প্রক্রিয়া তখনই শেষ হয়, যখন শ্রম শ্রমের লক্ষ্যে পৌঁছয়।’[1] সেই লক্ষ্য হল: উৎপাদিত বস্তু, সামগ্রী, বা পরিষেবা। আমরা আলোচনা শুরু করব, উদারীকরণ-পরবর্তী ৩৫ বছরে ভারতীয় অর্থনীতিতে যে কাঠামোগত সংস্কার হয়েছে, তার পটভূমিতে। এই সংস্কার শুধুমাত্র ভারতীয় অর্থনীতির‌ই রূপান্তর ঘটায়নি, আমূল বদলে দিয়েছে দেশের পুঁজিবাদ এবং তার সঙ্গে পুঁজিপতি ও শ্রমজীবী শ্রেণির গঠনকেও। শ্রম সংস্কার এবং ‘শ্রম বিধি’ (লেবার কোড) নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত‌ও এই প্রেক্ষাপটেই স্থান করে নেবে।

 

ভারতের অর্থনৈতিক রূপান্তর এবং লেবার কোড

১৯৯০-এর দশকের উদারীকরণ ও সংস্কারের পর তিন দশক পেরিয়ে ভারতের বিশ্ব-অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্তি যত বাজারভিত্তিক অর্থনীতির উত্থান এবং সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমশক্তির বাজারকেও ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করেছে। এর ফলে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকের সম্পর্কের পরিসর বহুগুণে বেড়েছে। তবে তার মানে এই নয় যে, সমস্ত উৎপাদন কাঠামো এখন পুঁজিবাদী হয়ে গেছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফার সর্বাধিকরণ, উপাদান এবং উৎপাদিত দ্রব্যের পণ্যায়ন এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজার সুনিশ্চিতকরণ। কিন্তু এটাও ঠিক, যে পুঁজিবাদী উৎপাদন এখন ভারতের সবচেয়ে বড় মূল্য-সংযোজনকারী ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, অর্থনীতিতে আয় এবং সম্পদ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে ভারতকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে। ভারতীয় অর্থনীতির বিকাশের উচ্চ হার এবং বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে তার গুরুত্ব নিচের দুটি চিত্র থেকে বোঝা যায়।

চিত্র ১[2]

চিত্র [3]

 

বেসরকারি উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা যতই ভারতীয় অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, নতুন একপ্রকার পুঁজি-বর্তনী বা ক্যাপিটাল-কেন্দ্রিক সার্কিটের উন্মেষ ঘটে। তার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় কর্পোরেট পুঁজিপতিশ্রেণি ‘জাতীয়’ থেকে ‘বিশ্বায়িত’ হিসেবে অভিযোজিত হয়। দেশের পুঁজিপতিশ্রেণি হয়ে ওঠে বিশ্বায়িত পুঁজির অংশীদার। নতুন অবতারে আবির্ভূত এই পুঁজিপতিরা আর শুধুমাত্র উৎপাদনক্ষেত্রেই নিজেদের বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ রাখে না, আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রিয়েল এস্টেটে পুঁজি ঢালতে শুরু করে। মনে রাখা দরকার, শিল্প, আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, রিয়েল এস্টেটের মতো লগ্নিক্ষেত্র পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। সংশ্লিষ্ট পুঁজি-বর্তনীগুলিও (উৎপাদনশিল্প-সম্পর্কীয়, বাণিজ্য-সম্পর্কীয়, অর্থ-সম্পর্কীয়, জমি-সম্পর্কীয়) পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়ে। এই যোগসূত্র আজ আর শুধু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে‌ই সীমাবদ্ধ নেই; বস্তুত, দেশীয় গণ্ডির সীমা ভেঙে আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজির অবাধ চলাচল স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে এবং এক ধরনের স্থানীয়-আন্তর্জাতিক বাজার কাঠামো তৈরি করেছে। সমকালীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরবরাহ শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেন), পরিবহণ ও লজিস্টিক্স (স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে), আউটসোর্সিং, সাব-কন্ট্র্যাক্টিং, অফশোরিং এবং ‘বডি শপিং’-এর গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। বিভিন্ন পুঁজি-বর্তনীগুলির নিবিড় আন্তঃসম্পর্ক স্থানীয়-আন্তর্জাতিক বাজারকাঠামোর মধ্যে দিয়ে পুঁজির চরিত্রকে নতুন আকার দিয়েছে এবং পুঁজি ও ভারতীয় রাষ্ট্রের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতিতেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, বদলে দিয়েছে নীতি ও রাজনীতির অভিমুখ।

পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র-সহ সামাজিক ক্ষেত্রের বৃহত্তর পরিসর ক্রমশ কার্যত নয়া ব্যবস্থায় পুঁজি বিনিয়োগের ছত্রছায়ায় চলে আসছে। একসময় পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত উৎপাদনের আ‌ওতার বাইরে থাকলেও আজ এই সমস্ত ক্ষেত্র বাজারনির্ভর উৎপাদনের অন্তর্ভুক্ত, যার প্রধান লক্ষ্য সর্বাধিক মুনাফা অর্জন। একদিকে পুঁজির পরিসর যেমন বড় হয়েছে, অন্যদিকে তেমনই পুঁজিবাদী শ্রেণিও পরিণত হয়েছে একটি বৃহত্তর বর্গে। পুঁজিবাদী শ্রেণি শুধু যে আড়েবহরে বেড়েছে তা-ই নয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর প্রভাব অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গেছে— এমনকি মানুষের স্বভাব, চেতনা, চিন্তা, আবেগ, এগুলিও পুঁজির তথা পুঁজিবাদী নীতির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের আবেগ-চেতনা-চিন্তার ওপর পুঁজিবাদী নীতির প্রভাব বিস্তার লেবার কোড-এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্র-পুঁজির কাছে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তাই লেবার কোড শুধুই আইন বা কাঠামোর প্রশ্ন নয়, তা একই সঙ্গে নৈতিকতা এবং চেতনার প্রশ্নে মতাদর্শগত সংগ্রামেরও প্রশ্ন।

ভারতে পুঁজি-চালিত অর্থনীতির রূপান্তর শ্রমজীবী শ্রেণিরও একটি কাঠামোগত এবং ধারণাগত রূপান্তর ঘটিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই, শ্রম আইনের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা কয়েক দশক ধরে পুঁজিপতিদের এবং তাদের সহযোগী বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে উঠে এসেছে এবং এখন নতুন লেবার কোডের মাধ্যমে তা ভারতীয় রাষ্ট্রের‌ও উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সংগঠনগুলি সময়ে সময়ে শ্রম আইন সংশোধনের দাবি জানিয়ে এসেছে, আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে রাষ্ট্র-পুঁজি জোটের দৃষ্টিকোণ থেকে কেন এই আইন সংশোধনের দরকার পড়ছে এবং দাবি উঠছে এটা বোঝা। এই বোঝাটা জরুরি, কারণ রাষ্ট্র-পুঁজি জোটের দৃষ্টিকোণ থেকেই ঐতিহাসিকভাবে শ্রম কোড চালু হয়েছে এবং ট্রেড ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সংগঠনগুলি কী চায় বা কেন চায়, শ্রম আইনের সংশোধনগুলি সেই সব প্রশ্নকে কার্যত পাশ কাটিয়ে গেছে।

তবে শুধু আইনের de jure (আইনগত) দিক নয়— যদিও সেটাও গুরুত্বপূর্ণ— রাষ্ট্র-পুঁজি জোটের দৃষ্টিকোণ থেকে এই আইন সংশোধনের সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে শ্রমজীবী শ্রেণির ঐতিহাসিকভাবে অর্জিত চেতনা। এই ঐতিহাসিক চেতনা অর্থাৎ শ্রমিক হিসেবে নিজের পরিচয়ের প্রাপ্ত জ্ঞান হল, তাঁরা একটি শ্রেণি হিসেবে সংগঠিত হয়ে পুঁজিপতি-নিয়োগকর্তা গোষ্ঠীর মুখোমুখি হতে পারেন এবং তাদের প্রশ্ন করতে পারেন। প্রায় দুই শতকের প্রায়োগিক সংগ্রাম-জীবনের ইতিহাস শ্রমজীবী মানুষকে শ্রেণিসংগ্রামের অভিজ্ঞতা, চেতনা, এবং ব্যবহারিক জ্ঞান উপহার দিয়েছে। সহজ কথায়, এই ঐতিহাসিক চেতনার অর্থ এই রাজনৈতিক অধিকারটির সম্ভাবনা ও অস্তিত্বকে স্বীকার করা। কেউ এই অধিকার ব্যবহার করছে কি না, সেটি পরের কথা, আগের কথা হল— এই অধিকারটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সাধারণভাবে সচেতনতা আছে এবং বাস্তবে কিছুটা স্বাধীনভাবে তা প্রয়োগ করাও সম্ভব। কিন্তু বর্তমান লেবার কোড এই জায়গাটিই রাখতে চাইছে না। সংগঠিত হওয়ার আইনি স্বাধীনতার জন্য লেবার কোড শ্রমিকদের বা তাঁদের প্রতিনিধিত্বকারী ট্রেড ইউনিয়নের ওপর এমন সব শর্ত আরোপ করতে চাইছে, যা বাস্তবে সংগঠিত হ‌ওয়ার সম্ভাবনাকেই অসম্ভব করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ ধর্মঘট ডাকলে তাঁদের গ্রেপ্তার এবং জেলবাসের আইনি বিধান আছে লেবার কোডে। লেবার কোড, কার্যত, শ্রমজীবী শ্রেণির সংগঠিত হওয়ার বনিয়াদি রাজনৈতিক অধিকারটির অস্তিত্ব, সম্ভাবনা এবং শ্রমজীবী মানুষের পরিচয় চেতনার উপর‌ই সরাসরি আঘাত হানে। নতুন কিছু অধিকার— যেমন, সকল শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দিতে হবে— দেওয়ার বদলে শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারগুলির একটিকে সে খর্ব করতে চায়।

পরিস্থিতি এতটাই বদলে গেছে যে, এরকম একটি ঐতিহাসিক অধিকারকেও এখন বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোয় প্রতিযোগিতা ও মুনাফা অর্জনের যে অন্তর্নিহিত চাপ, তা মাথায় রেখে পুঁজিপতি শ্রেণির লক্ষ্য— শ্রমজীবী শ্রেণির সম্মিলিত শক্তিকে দুর্বল করে দেওয়া। সেই উদ্দেশ্যে শ্রমজীবী শ্রেণিকে একটি সম্মিলিত সত্তা ও চেতনা হিসেবে ধ্বংস করা, তার ধারণা ও কাঠামো ভেঙে ফেলা দরকার বলে মনে করা হচ্ছে। নয়া ব্যবস্থার লক্ষ্য হল শ্রমজীবী সত্তা বা পরিচয় প্রতিস্থাপন করে এক-একজন ‘ব্যক্তিগত কর্মচারী’ পরিচয় তৈরি করা— যেমন, ‘এক্সিকিউটিভ’, ‘সুপারভাইজর’, ‘পার্টনার’ ইত্যাদি; অথবা চুক্তিভিত্তিক/অস্থায়ী কাজের প্রসার এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক CTC (Cost to Company) প্যাকেজের বিকাশ— যার মাধ্যমে কর্মীদের সহজেই পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সম্ভব, তাঁদের সম্মিলিত ‘শ্রমিক’ পরিচয় থেকে। বলা বাহুল্য, ১৯৯০-এর দশকে উদারীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে, স্থানীয়-আন্তর্জাতিক বাজারভিত্তিক অর্থনীতির মধ্যে বিশ্ব পুঁজির চক্রকে কেন্দ্র করে ভারতের যে অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটেছে, তা ইতিমধ্যেই এদেশের শ্রমিকদের একটি অংশকে তাদের ইতিহাসলব্ধ-অভিজ্ঞতালব্ধ শ্রেণিচেতনার সম্পর্ক থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিচ্ছিন্ন করতে সফল হয়েছে।

এই প্রেক্ষিতেই মনে রাখতে হবে, বিশ্ব-ইতিহাসের মতোই এবং আধুনিক ভারতের ইতিহাসেও, এটা রূঢ় বাস্তব যে— যত সমস্যাই থাকুক না কেন, ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠনই হচ্ছে সেই অতুলনীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যা শ্রমজীবী শ্রেণির সম্মিলিত শক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা রাখে। পুঁজিপতি শ্রেণি যে ধরনের মতাদর্শগত আধিপত্যমূলক চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন হিসেবে ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠনগুলি তার পথে রাজনৈতিক অন্তরায় হিসেবে এখনও টিকে আছে, যেগুলি শ্রমিকের স্বার্থে বিকল্প চেতনা ও মতাদর্শ বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে। অতএব, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে— পুঁজির মদতে পুষ্ট ভারতীয় রাষ্ট্র (আঞ্চলিক রাজ্যগুলির প্রচ্ছন্ন সমর্থনে) যে শ্রম আইনের খসড়া তৈরি করেছে, তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য‌ই থাকবে ট্রেড ইউনিয়নকে কার্যত আঘাত করে অবশিষ্ট সম্মিলিত শ্রমিক চেতনা ও কার্যক্ষমতাকে ধ্বংস করা— সোজাসুজি আইনগতভাবে (de jure) না হলেও, বাস্তবিক বা কার্যকরীভাবে (de facto) অবশ্যই।

 

পুঁজিবাদী অর্থনীতি, নয়া শ্রমিকশ্রেণি ও লেবার কোড

এ-কথা সকলেরই জানা যে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন না, এবং সাধারণত পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানে তাঁরা নিয়োজিত নন। নিচের সারণি থেকে দেখা যায় যে ভারতের অধিকাংশ শ্রমিক স্বনিযুক্ত (self-employed)।

চিত্র ৩[4]

 

তবে, শ্রমজীবী শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই পরিসংখ্যানও অর্ধসত্য বা বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, পুঁজিবাদী উদ্যোগ ও বিশ্বপুঁজির বৃহত্তর বর্তনী বা সার্কিট— এই দুটি ধারণার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পুঁজিবাদী উদ্যোগ বলতে বোঝানো হয় একটি স্বতন্ত্র একককে, যার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হল ফ্যাক্টরি/অফিস/স্টোর ব্যবস্থা। কিন্তু সংস্কার-উত্তর ভারতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংজ্ঞা হিসেবে আমরা বিশ্বায়িত পুঁজির সার্কিটকেই বুঝব। আজ ভারতের শ্রমজীবী মানুষের একটা বড় অংশ সরাসরি কোনও পুঁজিবাদী উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত না হয়েও বিশ্বপুঁজির বৃহত্তর সার্কিটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদক হিসেবে তাঁরা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের বৃহত্তর সমন্বয়-শৃঙ্খলের মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে কার্যত মিলেমিশে গেছেন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

‘ডেলিভারি পার্টনার’, যাঁদের ‘স্বাধীন চুক্তিকারী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, আনুষ্ঠানিকভাবে এঁরা স্বনিযুক্ত শ্রেণিতে পড়েন। তবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে এঁরা এখন পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানে— যেমন রেস্টুরেন্ট, যা সাধারণত পুঁজিবাদী উদ্যোগ— সর্বশেষ পর্যায়ের পরিষেবা প্রদানকারী কর্মী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পুঁজিবাদী রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্য শুধুই দ্রব্য উৎপাদন করা নয় (যেটা সাধারণত গৃহস্থালিতে হয়ে থাকে), বরং দ্রব্য উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে মুনাফা অর্জন করা। পুঁজির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই ডেলিভারি পার্টনাররা আজ কেবল পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানে পুনরুৎপাদনের জন্য অপরিহার্যই নন, বরং প্রতিটি পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগের একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা ও বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে ও ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই ‘স্বাধীন চুক্তিকারী’ স্বনিযুক্ত শ্রমজীবী মানুষগুলি। পুঁজির দৃষ্টিকোণ থেকে এই মানুষগুলিকে ‘ডেলিভারি পার্টনার’ হিসেবে (অর্থাৎ এঁরা রেস্টুরেন্টের সরাসরি নিযুক্ত কর্মী/শ্রমিক নন) সংজ্ঞায়িত করা হলেও, শ্রমজীবী শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে এই মানুষগুলি শ্রমিক, যাঁদের শ্রমের ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাদী রেস্টুরেন্টের উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে পরিণত হতে পারছে; তার থেকে মুনাফা তৈরি এবং আহরণ সম্ভব হচ্ছে। বলা বাহুল্য, যা রেস্টুরেন্টের ‘ডেলিভারি পার্টনার’-দের ক্ষেত্রে সত্য, তা নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, বাণিজ্য, পরিবহণ, স্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের কোটি কোটি কর্মীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আবার স্থানীয় এলাকায় রেস্টুরেন্টের ক্ষেত্রে যে মডেলটি লক্ষ করা যায়, তা বিশ্বব্যাপী রেস্টুরেন্ট ডেলিভারিকর্মীদের সংখ্যার বিস্ফোরণের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। এটাই বর্তমানে শ্রমবিভাজনের বিশ্বব্যাপী একটি মডেল হয়ে উঠেছে।

ভারতীয় রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রম আইনের সংস্কার এমনভাবে পরিকল্পিত হয়েছে যাতে (গ্লোবাল) পুঁজির পরিক্রমণের বিস্তার— অর্থাৎ পুঁজিবাদী অর্থনীতির সম্প্রসারণ— সুনিশ্চিত হয়। এই সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে, লেবার কোড একটি আইনি ও আদর্শগত কাঠামোর মাধ্যমে এমন কিছু বিষয় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চেষ্টা করছে, যেগুলি ইতিমধ্যেই প্রচলিত ছিল, কিন্তু এখন তা আইনের মাধ্যমে বৈধতা পেয়ে পুঁজিপতির পক্ষে এবং শ্রমজীবী শ্রেণির বিপক্ষে ক্ষমতার ভারসাম্যকে স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। মোটের উপর, লেবার কোড নিচের বিষয়গুলিতে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ পুঁজিপতির হাতে তুলে দিতে চায়—

কাজের মেয়াদ: শ্রমিকরা কতক্ষণ কাজ করবেন।

প্রযুক্তি: কোন মাত্রার যান্ত্রিকীকরণ হবে, কী ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হবে, তার ভিত্তিতে কত শ্রমিকের দরকার হবে, এবং তাঁরা কোথায় কী কী পদ্ধতিতে কাজ করবেন।

শ্রমের তীব্রতা: প্রতি ঘণ্টায় কতটা শ্রম আদায় করা হবে।

দাবিদাওয়া/আন্দোলন: শ্রমিকরা নিজেদের ইচ্ছায় সংগঠিত হতে পারবেন কি না, হলে কেমনভাবে হবেন।

শ্রমিকদের উপর পুঁজির শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আইনি, আদর্শগত ও প্রাতিষ্ঠানিক— এই তিন ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করা জরুরি। এক‌ই সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকেও এমনভাবে রূপান্তরিত করতে হবে যাতে তারা পুঁজিপতি শ্রেণির পক্ষে কার্যকর হয়। এর ভিত্তিতে বলা ভুল হবে না যে, লেবার কোড মূলত দুই শ্রেণির— শ্রমিকশ্রেণি ও পুঁজিপতি শ্রেণি— মধ্যে একটি ‘অবস্থানগত বিরোধ’-এর অংশ, যেখানে ভারতীয় রাষ্ট্র কাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

 

অ-পুঁজিবাদী ক্ষেত্র ও শ্রমিকশ্রেণি

যদিও শ্রমজীবী শ্রেণির একটা বড় অংশ‌ই বিশ্ব পুঁজির ক্রিয়াকলাপের অংশ হয়ে উঠেছে, তথাপি আরও বৃহৎ সংখ্যক শ্রমিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির (অর্থাৎ পুঁজি-সার্কিটের) বাইরে অবস্থান করছে। যেমন গৃহস্থালি, কৃষি ও কুটিরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষেরা। কেউ কেউ পণ্যের বা পরিষেবার (বেতনবিহীন) উৎপাদক, সাধারণত পরিবারভিত্তিক কাঠামোর মধ্যেই এঁরা কাজ করেন। আবার কেউ কেউ, যেমন গৃহপরিচারিকার ক্ষেত্রে দেখা যায়, গৃহস্থালির কাঠামোর মধ্যে নিয়োগকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কের অধীনে বেতনের বিনিময়ে শ্রম দেন। গৃহপরিচারিকার ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা-কর্মচারী সম্পর্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুঁজিবাদী নয়, কারণ এক্ষেত্রে উৎপাদনের উদ্দেশ্য মুনাফা নয় এবং উৎপাদিত বস্তু বা সেবা প্রায়শই বাজারে বিক্রি হয় না। বাস্তবিকভাবে এই গৃহস্থালির শ্রমের বড় অংশ সাধিত হয় নারী-শ্রমিকের দ্বারা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা নিম্নবর্ণের নারী। না-পুঁজিবাদী ক্ষেত্রের বেতনভোগী শ্রমজীবী মানুষ, বেতনভোগী নয় এমন শ্রমজীবী মানুষ, এবং তাঁদের লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম দ্বারা খণ্ডিত পরিচয়, এই বাস্তবতা ট্রেড ইউনিয়নের কাজকে জটিল করে তোলে, কারণ ট্রেড ইউনিয়ন ঐতিহাসিকভাবে পুঁজিবাদী কারখানা/অফিস ব্যবস্থার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেখানে পুরুষ সদস্যদের আধিপত্য ছিল। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গৃহভিত্তিক শ্রমিকদের ব্যাপক সম্প্রসারণ ট্রেড ইউনিয়নের জন্য‌ও একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কেবল একটি সংখ্যাকেন্দ্রিক প্রশ্ন নয়, বরং একটি মৌলিক তাত্ত্বিক প্রশ্নের‌ও জন্ম দিয়েছে— ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে কে ‘শ্রমিক’ এবং কীভাবে তাঁদের সংগঠিত করা যায়? বলা বাহুল্য, আমাদের আলোচনায় এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু, কারণ লেবার কোড এই সব শ্রমিকদের মূলত উপেক্ষা করেছে এবং তাঁদের সুপারিশের আওতার বাইরে রেখেছে। অথচ এই ধরনের শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে এবং এঁদের সংগঠিত হওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই ট্রেড ইউনিয়নগুলোর দায়িত্ব সমষ্টিগতভাবে একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করা এবং লেবার কোড সংক্রান্ত তাদের দাবিতে এই ‘বাদ পড়া শ্রমিকদের’ দাবিদাওয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা।

এই প্রসঙ্গে, উপেক্ষিত শ্রমজীবী মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়: শ্রম কোড কি আদৌ তাঁদের জন্য প্রাসঙ্গিক? এই প্রশ্নটি তোলা জরুরি, কারণ লেবার কোড এই ধরনের শ্রমিকদের শ্রমজীবী শ্রেণির সদস্য হিসেবে যে পরিচয়, তাকে অস্বীকার করছে। শুধু তা-ই নয়, যে কোনও সংগঠন বা সমিতি গঠনের জন্য অপরিহার্য সমষ্টিগত চেতনা ও সংহতির সম্ভাবনা যেটুকু অবশিষ্ট আছে, এই লেবার কোডের উদ্দেশ্য তাকেও অপসারণ করা। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে আমরা যখন বলছি ‘সংগঠন’ বা ‘সমিতি’, তখন তা কেবলমাত্র ট্রেড ইউনিয়নের কথা নয়— যে কোনও ধরনের শ্রমজীবী সংগঠনের কথাই বলছি। তাই লেবার কোড কেবল সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কিংবা বিশ্বায়িত পুঁজির ক্রিয়াকলাপের আওতাধীন শ্রমিকদের বিষয় নয়— এটি এমন একটি ইস্যু, যা যে কোনও রকমের সমষ্টিগত সংগঠন বা ঐক্য গঠনের চেষ্টার ধারণাকেই সন্দেহের চোখে দেখে। সুতরাং, লেবার কোড সেই সব শ্রমিকদের জন্যও গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক, যাঁরা সরাসরি এই আইনের আওতায় না পড়লেও সম্মিলিত সংগঠন ও প্রতিরোধের ধারণা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

 

বৈষম্য ও শ্রমিকশ্রেণি

যদি ভারতের অর্থনীতির রূপান্তর— যা গ্লোবাল পুঁজির পরিক্রমার দ্বারা চালিত— অভূতপর্ব আয় ও সম্পদ সৃষ্টির পথ করে দিয়ে থাকে (চিত্র ১ এবং ২-এ উল্লিখিত), তবে প্রশ্ন থেকে যায়: এই সাফল্যের আসল ভাগীদার কারা? পুঁজিবাদী শ্রেণি এবং তাদের কাছের সহযোগীরা? সেই শ্রমিকরা কি লাভবান হয়েছেন, যাঁরা পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি নিযুক্ত কিংবা যে কোনওভাবে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত (পূর্বে আলোচিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী)? দেশের বাকি জনসাধারণ কি এই তথাকথিত অর্থনৈতিক সাফল্যের সুফল পেয়েছেন? এই প্রেক্ষিতে এক চমকপ্রদ তথ্য উপস্থাপন করেছে World Inequality Database (WID)। এই আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বের অর্থনৈতিক বৈষম্য পরিমাপের কাজে নিয়োজিত। তারা দেখিয়েছে, ভারতের আয় ও সম্পদের বৈষম্য ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এমনকি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের চেয়েও বেশি। তাদের ভাষায়:

আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় ভারতে বৈষম্যের মাত্রা অত্যন্ত চড়া। ২০২২-২৩ সালে জাতীয় আয়ের ২২.৬ শতাংশ গিয়েছে শীর্ষস্থানীয় ১ শতাংশ মানুষের হাতে— যা আমাদের সিরিজের (১৯২২ সাল থেকে) মধ্যে সর্বোচ্চ, এমনকি ঔপনিবেশিক পর্বে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালেও এতটা বৈষম্য ছিল না… অন্যভাবে বললে, আজকের ভারতের ধনকুবের শ্রেণির নেতৃত্বাধীন ‘বিলিয়নেয়ার রাজ’ ঔপনিবেশিক শক্তির নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ রাজের চেয়েও বেশি অসম।[5]

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আয় বৈষম্যের এই গভীরতা বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়ের তুলনায় কতটা বেড়েছে, তা নিচের চিত্রে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।

বিশেষত, ২০২২ সালে ভারতের আয় ও সম্পদ বণ্টনের চিত্র ছিল অত্যন্ত বৈষম্যমূলক:

শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল ২২.৬ শতাংশ জাতীয় আয়।
শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষ নিয়ন্ত্রণ করছিল ৫৭ শতাংশ মোট আয়।
অথচ নিম্নতম ৫০ শতাংশ মানুষের ভাগে ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ আয়।

সম্পদের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আরও প্রবল:

শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষ নিয়ন্ত্রণ করছিল ৪০.১ শতাংশ সম্পদ (আয় ও সম্পদ— আর্থিক ও অনার্থিক উভয়) এবং নিম্নতম ৫০ শতাংশ মানুষ অধিকার করছিল মাত্র ৬.৪ শতাংশ।

এছাড়াও, ২০২২-২৩ সালে পুরুষেরা মোট শ্রম-আয়ের ৮২ শতাংশ অর্জন করেছে, যেখানে নারীরা পেয়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যেও একটি স্পষ্ট লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ছবি তুলে ধরেছে।

চিত্র ৪[6]

 

লক্ষণীয় বিষয় হল, লেবার কোড সামাজিক সুরক্ষা ও উপভোক্তার (beneficiary) প্রশ্নে একটি অবস্থান নেয়— যেখানে শ্রমিকদের উপকারভোক্তা হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়েছে, যাঁরা রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু গত তিন দশকে যাঁরা প্রকৃত আয় ও সম্পদের সৃষ্টিকারী— সেই শ্রমজীবী শ্রেণি কীভাবে এই উৎপাদনের সুফল পাবেন, সে বিষয়ে শ্রম কোড নীরব। যদিও এতে মজুরি ও আয়ের সুরক্ষার উল্লেখ আছে, তথাপি এই শ্রম সংস্কার আয় ও সম্পদ বণ্টনকে শ্রমজীবী শ্রেণির পক্ষে সামান্যতমও ঘোরাতে পারবে কি না এবং সমাজকে আরও সমতাভিত্তিক করতে পারবে কি না, তা এক গভীর প্রশ্ন। বিশেষ করে যখন এই কোড ‘শ্রমিক’ ও ‘শ্রমজীবী শ্রেণি’— এই চেতনা ও ঐক্যের ধারণার ওপরই আঘাত হানে এবং ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠিত শক্তিকে দুর্বল করার পদক্ষেপ নেয়। তাই বলাই যায়, এই লেবার কোড ধনী ও দরিদ্রের মাঝে বিদ্যমান শ্রেণিবিভাজনকে অক্ষুণ্ণ রাখে, উপরন্তু সেই ফারাক আরও গভীর করার পথ সুগম করেছে। একদিকে পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের সহযোগীরা, আর অন্যদিকে বিশাল সংখ্যক শ্রমজীবী শ্রেণি— দুইয়ের মাঝে থাকা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধান আরও চওড়া হওয়ার আশঙ্কাকেই উস্কে দিয়েছে এই লেবার কোড।

 

উল্লিখিত গ্রন্থসূচি:

  1. অনুপ ধর ও অঞ্জন চক্রবর্তী (২০২৩)। “রাজনীতির ভূত, ভবিষ্যৎ: প্রতিরোধ, পুনর্নিমাণ, রূপান্তর”। আনন্দ: কলকাতা।
  2. Nitin Kumar Bharti & Lucas Chancel & Thomas Piketty & Anmol Somanchi, 2024. “Income and Wealth Inequality in India, 1922-2023: The Rise of the Billionaire Raj,” Working Papers halshs-04563836, HAL.

তথ্য সহায়তা:

  • বর্তমান নিবন্ধ রচনায় সাহায্য করেছেন সায়ণী মজুমদার।

স্বীকৃতি:

  • এই রচনাটির একটি সংস্করণ ‘লেবার কোড’ পুস্তিকাতে (নাগরিক মঞ্চ প্রকাশন, জুলাই ২০২৫) প্রকাশিত হয়েছে এবং এটি ‘কারার ঐ লৌহকপাট: মার্ক্সের ক্যাপিটাল ও বিকল্প পথ’ (সারস প্রকাশন, ২০২৬) বইটিতেও স্থান পাবে।

[1] এই সম্পর্কে বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন: ধর, অনুপ ও চক্রবর্তী, অঞ্জন। রাজনীতির ভূত-ভবিষ্যৎ: প্রতিরোধ, পুনর্নিমাণ, রূপান্তর। কলকাতা: আনন্দ। ২০২৩। পৃ. ৮৫-৮৭।
[2] সূত্র: MoSPI, GoI. জিডিপি-র বৃদ্ধি পরিমাপের পদ্ধতি ২০১৮ সালে পরিবর্তিত হয়, যে পরিবর্তনের ছাপ আছে ২০১২-২৪ সালের রেখচিত্রাংশে।
[3] সূত্র: GDP based on PPP, share of world. Percent of World. IMF.
[4] সূত্র: NSSO ও PLFS, MoSPI, GoI.
[5] Bharti, Chancel & Piketty & Somanchi, 2024, 2.
[6] সূত্র: World Inequality Database.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5228 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...