অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিষয়টা ইদানীং এ-দেশে এক চূড়ান্ত নিকৃষ্ট স্তরে নেমে গিয়েছে। অবস্থার অবনতি এতটাই, যে সাম্প্রদায়িক হানাহানির ছোট থেকে বড় কোনও ঘটনাকেই আজকাল আর আলাদা করে নজিরবিহীন বলে মনে হয় না। হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও সংখ্যালঘু ধর্ম সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগুরুর ক্রমাগত জোর ফলানোর চেষ্টা, আগ্রাসন, সন্ত্রাস ও হিংসা, আজকাল একেবারেই বেআব্রু, বেলাগাম রকমে সামনে এসে পড়েছে। এদেশের সংবিধান অনুযায়ী ‘ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক’ সরকারের (এখনও অবধি) কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এই তালিকাতেই শেষতম উদাহরণ, জম্মু-কাশ্মিরের বৈষ্ণোদেবী মেডিকেল কলেজের ঘটনা
ঘটনা-প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ও জম্মু-কাশ্মিরের বিধায়ক তনভির সাদিক এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, বিজেপি দল জম্মু ও কাশ্মিরকে আবারও, তাদের বিভাজনের রাজনীতির সপক্ষে ব্যবহারের প্রয়োজনে, এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চাইছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে এমন গতানুগতিক হুঁশিয়ারি আমরা এ-দেশে বহুকাল যাবৎ কানে শুনে এসেছি। জ্ঞানপাপী রাজনীতির অবশ্য তাতে এতটুকুও পরিবর্তন ঘটেনি।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিষয়টা ইদানীং এ-দেশে এক চূড়ান্ত নিকৃষ্ট স্তরে নেমে গিয়েছে। অবস্থার অবনতি এতটাই, যে সাম্প্রদায়িক হানাহানির ছোট থেকে বড় কোনও ঘটনাকেই আজকাল আর আলাদা করে নজিরবিহীন বলে মনে হয় না। ধর্মের পাশাপাশি ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, এই বিষয়গুলি নিয়েও পারস্পরিক হানাহানি অব্যাহত। তবে বিশেষ করে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও সংখ্যালঘু ধর্ম সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগুরুর ক্রমাগত জোর ফলানোর চেষ্টা, আগ্রাসন, সন্ত্রাস ও হিংসা, আজকাল একেবারেই বেআব্রু, বেলাগাম রকমে সামনে এসে পড়েছে। এদেশের সংবিধান অনুযায়ী ‘ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক’ সরকারের (এখনও অবধি) কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এই তালিকাতেই শেষতম উদাহরণ, জম্মু-কাশ্মিরের বৈষ্ণোদেবী মেডিকেল কলেজের ঘটনা।
এর পাশাপাশি মুর্শিদাবাদে বাবরি মসজিদ উদ্বোধন, ময়দানে গীতাপাঠ ও তৎ-সম্পর্কিত মুসলিম-প্যাটিসবিক্রেতাকে মারধরের ঘটনা, এগুলি আজকাল এত বেশি স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে— লজ্জায় মাথা হেঁট করা ভিন্ন আমাদের আর কোনও কিছুরই অবকাশ থাকছে না। ধর্মকে আমরা বাড়তে দিয়েছি, রাজনীতির প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতে দিয়েছি— সেই দায় আমাদের প্রত্যেকের। বিজেপি অথবা আরএসএসের প্রত্যক্ষ শাসন, অথবা নরমপন্থী হিন্দুত্বের আড়ালে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ-আশ্রয়ে টিকে থাকতে চাওয়া একেকটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল (যথাক্রমে আপ অথবা তৃণমূল কংগ্রেস), এহেন দলগুলির রাজনীতির কল্যাণে এদেশে, এমন সময়ে, এহেন পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটাই সবদিক থেকে স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মিরের রিয়াসি জেলায় অবস্থিত, সদ্য-স্থাপিত ‘শ্রী মাতা বৈষ্ণোদেবী ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়ান্স’-এর ছাত্রভর্তি-প্রক্রিয়া নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত। চলতি বছরে ‘জম্মু-কাশ্মির বোর্ড অব প্রফেশনাল এন্ট্রান্স এক্সামস’-এর তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রভর্তি-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এরপর দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ৫০টি আসনের মধ্যে ৪২টি আসনেই মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছাত্রেরা জায়গা পেয়েছে। জম্মু-কাশ্মিরের মতো মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের জনবিন্যাস বিচার করলে যা কোনওভাবেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ন্যাশনাল মেডিকেল কাউন্সিলের নির্দেশিকা অনুসারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ৮৫ শতাংশ আসন জম্মু-কাশ্মিরের বাসিন্দাদের জন্য ও বাকি ১৫ শতাংশ আসন দেশের বাকি অংশে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত।
বিতর্কের সূত্রপাত এই তালিকা প্রকাশের পর থেকেই। এই তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরেপরেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির প্রত্যক্ষ মদতে একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দাবি করতে শুরু করে মাতা বৈষ্ণোদেবীর নামে যে প্রতিষ্ঠান, এমনকি ‘পবিত্র’ বৈষ্ণোদেবী ট্রাস্টের অর্থসাহায্যে যে প্রতিষ্ঠানের ব্যয়-সঙ্কুলান ঘটে, তেমন এক প্রতিষ্ঠানে কোনওভাবেই বিধর্মী মুসলিমদের জায়গা হতে পারে না। এই বিষয়টি নিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি জম্মু-কাশ্মিরের লেফটেনান্ট গভর্নর (ভূতপূর্ব বিজেপি-নেতা) মনোজ সিনহার সঙ্গেও দেখা করেন। বিজেপির তরফে বিরোধী দলনেতা সুনীল শর্মা নিজে এই ডেপুটেশনে সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিজেপির তরফে জানানো হয়, শ্রী মাতা বৈষ্ণোদেবী ট্রাস্টে কেবলমাত্র ধর্মপ্রাণ হিন্দুরাই অর্থসাহায্য করে থাকেন। এমতাবস্থায় ‘মাতা বৈষ্ণোদেবী’র নামাঙ্কিত কোনও প্রতিষ্ঠানের প্রথম উদ্দেশ্যই হল ‘সনাতন ধর্ম ও নিখাদ ভারতীয় সংস্কৃতি’র প্রচার ও প্রসারে নিযুক্ত থাকা।
মাফ করবেন, আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে ‘সনাতন ধর্ম’ অথবা ‘নিখাদ ভারতীয় সংস্কৃতি’র যোগাযোগের বিষয়টা পুরোপুরি বোধগম্য হল না। অবশ্য নয়া ভারতে এমনটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় বজরং দলের সদস্য-সমর্থকেরা সংশ্লিষ্ট কলেজ-ক্যাম্পাসে মিছিল করে ঢুকে পড়ে, ও তৎপরবর্তীতে স্লোগানিং ও ভাঙচুর চালায়। এর পাশাপাশি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তরফে মাতা বৈষ্ণোদেবী ট্রাস্টের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসারেরও কুশপুত্তলিকা-দাহ করা হয়। কোনওভাবেই যাতে মাতা বৈষ্ণোদেবীর নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানে ‘বিধর্মী’রা জায়গা না পায়, সেই নিয়ে ‘শ্রী মাতা বৈষ্ণোদেবী সংঘর্ষ কমিটি’ নামে একটি বৃহত্তর সংগঠন গড়ে তুলে, ক্রমশ আরও বড় আকারের আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এই মুহূর্তে সে রাজ্যে জারি রয়েছে।
শাসক ন্যাশনাল কনফারেন্স, অথবা মেহবুবা মুফতির পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রমুখ, অন্যান্য প্রায় সব দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের তরফেই সাম্প্রদায়িক বিজেপির এই হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা আলি মুহম্মদ সাগর এই ঘটনাকে মাতা বৈষ্ণোদেবীর পবিত্রতা-র প্রতি অসম্মান ও সংবিধানের উপর আঘাত হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ওয়াকিবহাল অনেকে অবশ্য এই সময়ে দাঁড়িয়ে, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আরও একটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক কারণের দিকেও অঙ্গুলিনির্দেশ করছেন।
সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা কাশ্মিরের ঐতিহ্যবাহী ‘দরবার স্থানান্তর’ প্রক্রিয়াটি পুনরায় চালু করার বিষয়ে উৎসাহ প্রকাশ করেন। জম্মু-কাশ্মিরের প্রাচীন ডোগরা-রীতি অনুসারে বহুকাল যাবৎ, তৎকালীন রাজতন্ত্রের অধীনেই, শীত ও গ্রীষ্মে যথাক্রমে শ্রীনগর ও জম্মুতে রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তর করা হত। পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতেও, কাশ্মিরিয়ৎ তথা কাশ্মিরি ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে এই প্রক্রিয়াই এতকাল জারি থেকেছে। এই প্রক্রিয়াই কাশ্মিরে ‘দরবার স্থানান্তর’ নামে পরিচিত। ২০১৯-পরবর্তীতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একাধিক বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পাশাপাশি এই ‘দরবার স্থানান্তর’ প্রক্রিয়াটিও বন্ধ করে দেয়। এর ফলে জম্মু তথা সমতল অঞ্চলের অর্থনীতি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। দীর্ঘকাল যাবৎ জম্মুর ব্যবসায়ীরা এই প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করার বিষয়ে বিভিন্ন মহলে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। গ্রীষ্মকালীন রাজধানী স্থানান্তরের কারণে, সংশ্লিষ্ট এলাকার অর্থনীতি যে বিশেষরূপে প্রভাবিত হয়, এই বিষয়টি কারও বুঝতেই কোনওরকম অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কাজেই, ওমর আবদুল্লার সাম্প্রতিক ঘোষণা জম্মুর ব্যবসায়ী-মহলে বিশেষ উৎসাহের বার্তা নিয়ে আসে, এবং জম্মুতে এক বিরাট জনসভায় গেরুয়া-প্রধান সমতল অঞ্চলেও বিজেপি-বিরোধী ন্যাশনাল কনফারেন্সের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা যায়। একই সময়ে এই বৈষ্ণোদেবী মেডিকেল কলেজের ঘটনা।
যে-কোনও ধরনের রাজনৈতিক সংকটের মোকাবিলায় বিজেপি তথা আরএসএসের সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরির কৌশল আজ আর কোনও নতুন বা অজানা ঘটনা নয়। ১৯৯২-এ বাবরি ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে যে দলের উত্থান, ২০০২-এর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে আজকের হিন্দু-হৃদয়সম্রাট নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির যে উত্থান, এই উত্থানের প্রতিটি ধাপ সেই কৌশলের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বিপরীতে আমাদের দেশ, নির্বাচনের পরে নির্বাচনে, অন্তত কিয়দংশে প্রমাণ করে চলেছে, এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের মনে, এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনতার এক বিরাট অংশের মনে, সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষই ক্রমশ চিরস্থায়ী আসন লাভ করতে পেরেছে।
সে-কারণেই বোধহয় ময়দানের প্যাটিস-বিক্রেতার সমর্থনে ভদ্রকুল-বুদ্ধিজীবীদের তেমনভাবে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। সে-কারণেই বোধহয় বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের একেকজনকে, বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষদের বিষয়ে খোলাখুলি সংবাদমাধ্যমে ও সামাজিক মাধ্যমে, বিদ্বেষ পোষণ করতে দেখা যায়। সে-কারণেই বোধহয় মুসলিম সহনাগরিকদের প্রতি ‘ওরা, ওদের, ওই ওরা’ এমনতরো শব্দবন্ধের ব্যবহার ক্রমশই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে— বৃহত্তর সমাজে ‘ওদের’ সার্থক অপরায়নে সহায়ক হয়। বৈষ্ণোদেবী মেডিকেল কলেজের ঘটনা গোটা দেশের বিবেককে জাগ্রত করে না। ‘ধর্মনিরপেক্ষ আমার স্বদেশ’ বহুকাল যাবৎ শেষযাত্রায় রওয়ানা হয়ে গিয়েছে।

