বিশ্বভরা প্রাণ: উন্মত্ত পৃথিবীতে মেয়ের জন্য মায়ের চিঠি

অপরাজিতা সেনগুপ্ত

 

প্রিয় ছোট্ট বুড়ি আমার,

কাল তোর দু বছর বয়েস হবে। এখনও তুই পড়তে পারিস না জেনেও তোকে চিঠি লিখছি। পড়তে শেখার এত তাড়াই বা কিসের আমাদের? তুই বরং পড়তে শেখার আগে ছুঁতে শেখ, আর শুনতে, শ্বাস নিতে, আর হাজাররকমভাবে দুনিয়াটাকে মেখে নিতে দু চোখের পাতায়? আমি কেন আজ তোকে চিঠি লিখছি জানিস? কারণ আজ, আজকেই, তোকে অনেক কথা বলার আছে আমার, তোর আজ আর কাল নিয়ে, তোর বড় হওয়া নিয়ে। তোর জীবনটা হয়ত একটা অর্থহীন হুড়োহুড়িই হবে, আমাদের অনেকের মতো। তাও ভাবছি যদি কখনও সেই ব্যস্ত জীবনে এটা পড়ার সময় তুই খুঁজে পাস। তুই জানিস না এখনও যে তুই আমার বুকের মধ্যে মোচড় দেওয়া ভালবাসা। কিন্তু মাঝে মাঝে আজকাল ভাবি কেনই বা আনলাম তোকে আমাদের এই উন্মাদ দুনিয়ায়, যেখানে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামা কাঁচের বোতলের মতো আমরা এগিয়ে চলেছি ধ্বংসের পথে, ঘৃণা আর লোভের অমোঘ তাড়নায়! আর সবচেয়ে বেশি দুঃখ কিসে জানিস? আমার মেয়ে বলেই তোর জন্য একটা বিশেষ জায়গা ঠিক হয়ে আছে সমাজে– আমার শিক্ষা, আমার শ্রেণি তোর পথ আগলে আছে। তুই তো পারবি না মাটির কাছে যেতে, কিম্বা রোদ্দুরের কাছে, পৃথিবীর আসল সম্পদের সন্ধান পেতে! বরং তুই সেই দলের হবি, যারা না চেয়েও প্রতি পলে পৃথিবীর ধ্বংস ডেকে আনছে, আর মানুষের ওপর চালিয়ে চলেছে অনর্গল আঘাত, জেনেও জানছে না! আমরা হলাম “সাধারণ মানুষ”, জন্মেই যারা ছকে পড়ে যাই, যা কিছু করি, তা “সবাই করছে” বলে করি, কখনও বা কী করে ব্যূহগুলো থেকে বেরোব জানি না বলে করি। কখনও কখনও, হয়ত অসাধারণ “বুদ্ধিমত্তার” বলে, বা কপালজোরে আমরা সেই তাদের দলে গিয়ে ভিড়তে পারি, যারা কিনা জেনেশুনে, ইচ্ছে করে দুনিয়াটা ধ্বংস করে চলছে, নিংড়ে চলেছে রক্ত অন্য মানুষের শরীর থেকে, সেই তারা, যারা বাকি দুনিয়াকেও বুঝিয়ে ফেলেছে যে পৃথিবীতে টাকার কারবার, পণ্যের কারবার সবচাইতে ওপরে, সবার থেকে সত্যি। কিন্তু তোর মতো একজনের ওই দলটাতে নাম লেখানো সোজা হবে না। কেন জানিস? কারণ প্রাচ্যের উন্নতির এই দিনেও তো তুই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাতে পারিসনি! তোর মা-দিদিমারা তো বাঙাল বাড়ির মেয়ে, বড় জোর মাস্টারনি, কেরানি। তোর চোদ্দ পুরুষেও কেউ কোম্পানির মালিক ছিল না, কেউ তোর জন্য লাইনের সামনে টাকার বান্ডিলের থান ইট রেখে যায়নি, যে তুই আজ বিজনেস স্কুলের একটা ডিগ্রি নিয়েই কোম্পানির মাথা হয়ে বসবি, শুধুই বাবার নামের জোরে! “ওপরে ওঠার” যে গাজরটা তোদের সামনে ঝুলিয়েছি আমরা, তার দৌড়ও যে বেশি দূর নয়!

তাহলে কী হবি তুই? যে বিশ্বে প্রাণ পেলি, তাকে কী দিবি? যদি বা বোতলের জলের কোম্পানির মালিক হতি— দক্ষিণ ভারতের কোনও এক গ্রামের মাটির তলার জলে গ্রামবাসীদের কোনও অধিকার নেই বলে মনে করে, ঘুষ দিয়ে পুলিশ আনিয়ে লাঠি বা গুলি চালাতে বলতি ধুলো ওড়া মাটিতে বসে পড়া মানুষের ধর্নায়! এমনকি তুই যদি ঘুষ নেওয়া অফিসারটাও হতি, তবেও তোকে কী বলতে হবে আমি জানতাম। তোর মা না আমি? কিন্তু তুই যখন তোর এসি অফিস থেকে বেরিয়ে, এসি গাড়ির কাচ নামিয়ে এক বোতল ওই কোম্পানির জল কিনবি, তখন তোকে কী বলব, কে বলে দেবে আমায়? তুই বলবি, “মা, এসব কী বলছ আমি জানি না! আমি তো আর কিছু করিনি, কাউকে মারিনি! আর দেখো, বোতলের গায়ে লেখা আছে, ওরা ডলফিন বাঁচানোর জন্য জলের দামের ১% দেয়, ওরা তো ভালোই লোক, মা?” তখন কী বলব আমি তোকে?

তুইও তাই একটা সাধারণ মেয়ে হবি। রাজনীতিতে মাথা দিবি না, রাজনীতিকরা বড় অসৎ বলে, দূষণ নিয়ে ভেবে লাভ নেই বলে ভাববি না, টিভি যেমনটি বলবে তেমনটি সাজবি, তেমনটি খাবি! বিষ ছাড়া খাবার খাবি না, পেট্রোল ছাড়া চলবি না, আর ব্রান্ডের ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের তৈরি জামা ছাড়া পরবি না তুই! সিগালের পেটে প্লাস্টিকের টুকরোর ছবি দেখে, তোর জন্মদিনের দিন শ্রাবণের বৃষ্টিভেজা ভিখিরি বাচ্চাটাকে দেখে, ধোঁয়ায় কালো শহরের আকাশ দেখে তোর চোখে জল আসবে, তখন তুই (তোকে তো আমি ভালোটাই শিখিয়েছি রে মা) চেক বই বের করে খসখস করে চেক লিখবি দান খয়রাতের, চাই কি দূর থেকে একটি শিশুকে ভালোবেসে তার পড়াশুনোর খরচার ভারও নিয়ে ফেলবি, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারবি না, যে তুই সব কিছু ঠিক করা সত্ত্বেও  দুনিয়াটা এত নোংরা, এত অন্ধকার, এত উন্মাদ কেন হয়ে উঠছে?

কী শেখাব আমি তোকে তবে? পাশ্চাত্যের স্বাধীন চেতনা দেব তোকে? যাতে তুই ভাবতে পারিস যে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে তোর স্বাধীনতাই সব, যা ইচ্ছে তাই করবি, যা ইচ্ছে তাই কিনবি, যা ইচ্ছে তাই ফেলবি? শিখিয়ে যাব তোকে সভ্যতার সেই মিথ, বলে যাব যে কারও সঙ্গে তোর কোনও যোগ নেই, মাটির সঙ্গে তো একেবারেই না? তোর মতামত, তোর কাজকর্ম সব তোর একার; যা কিনলি, তা তোর জন্যেই তৈরি হয়েছিল, সে জিনিসটার তৈরি হবার ইতিহাস বা মাটিতে ফিরে যাবার ভবিষ্যৎ নেই? সেটা যেন উঠে আসেনি পৃথিবীর মাটি, জল, খনিজ, শ্রম থেকে, যেন ব্যবহার শেষে মাটিতে মিশতে না পারলে ভেসে বেড়াবে না সমুদ্রে? বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলতে শেখাব তোকে, “আমি শুধু আমার জন্য!” নাকি প্রাচ্যের উন্নতির দিনে, ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সিইও হবার স্বর্ণযুগে তোকে আমি শিখিয়ে যাব সফল হবার মন্ত্র, বোতলের কাঁকড়াগুলোকে যেমন শেখানো হয় কার কার মাথায় পা দিলে উঠে যাওয়া যাবে বোতলের কিনারায়? পাশ্চাত্য কেড়ে নিয়েছিল যে প্রাচুর্য, আমরা চাইলেই, ইঁদুর দৌড়ে একটা সুযোগ পেলেই, আবার কেড়ে আনতে পারি জগত সভার শ্রেষ্ঠ আসন? শেখাব না তোকে, দম বন্ধ করে দৌড়ে যেতে জীবনভর? বস্তি দেখলে অন্য দিকে তাকাতে? খুব মন খারাপ লাগলে শান্তি পেতে এনজিওদের টাকা দিতে? কাল তোর জন্য দুর্দান্ত একটা স্কুল বেছে নিতে নিতে তোকে জানাব কি, যে কলকাতার ৫০% বাচ্চা স্কুলেই যেতে পারে না?

আমি তো সাধারণ হয়েই জীবন কাটিয়েছি, আমার কিইবা বলার থাকতে পারে তোকে? পৃথিবীটাকে ধ্বংস করেছি, মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি প্রতিনিয়ত না দেখার ভান করে, করতে না চেয়েও। এখনও করছি তাই। আবর্জনার ঢিবি তৈরি করছি রোজ, জল বিষিয়ে যাচ্ছে আমারই জামা রঙিন করতে গিয়ে, হাওয়া গরম হয়ে উঠছে আমারই গাড়ি চালাতে গিয়ে, বিষের ঢল নামছে সমুদ্রে আমারই খাবার ফলাতে গিয়ে! অপ্রয়োজনীয় সাধের জিনিসগুলো দিয়ে ঘর সাজাচ্ছি, অথচ সেগুলি তৈরি করতে গিয়ে আমার গ্রহ, আমার আর তোর একমাত্র বাসস্থান ছারখার হয়ে যাচ্ছে! কৃষক আত্মহত্যা করছে আমিই সস্তায় চাল কিনছি বলে। আমার জীবন সহজ আর সস্তা হবে বলে তোর কালকের কথা ভাবছি না আমি, শুধু আমি আরামে, সুবিধায়, ঠান্ডা ঘরে বাঁচলেই যে ঢের হবে!

আজ তোর জন্য একটা গাছ লাগাব মাটিতে। একটা ছোট চারা কিনলাম। যে ঠ্যালাওয়ালা ওটা বিক্রি করতে এনেছিলেন আরও অনেক গাছের সঙ্গে, তার সঙ্গে অনেক কথা বলেও জানতে পারলাম না যে গাছটা কে তৈরি করল টবে, কে যত্ন করেছিল ওকে ওর শিশুকালে। পাচার হওয়া অনাথা ছোট্ট একটা মেয়ে যেন ও। কিন্তু আমরা আসলে আজ তোর জন্য, তোর প্রজন্মের জন্য, একটা বীজ পুঁতে যেতে চাই শুধু। আমাদের এই ধ্বংসের চিৎকার যেন তোরা থামাতে পারিস, মাগো আমার! যেন মাটি ছুঁতে পারিস হাত বাড়িয়ে, যেন তোদের মুঠোয় থাকে নিরাময়ের মন্ত্র। আমার কিছুই শেখানোর নেই তোকে, শুধু অনেক আশা আছে। যেন তুই বুঝতে পারিস যে তুই মাটির আর রোদের, যেন বিশ্বভরা প্রাণের কেন্দ্রে আমাদের এই সুন্দর গ্রহটায়, জীবনের অবিরাম অবিনশ্বর চক্রে, তুই খুঁজে পাস তোর প্রকৃত, শাশ্বত স্থান।

ইতি
তোর মা।

 

(এই লেখাটি 07 November, 2011, Countercurrents.org ওয়েব সাইটে Hope Without Wisdom: A Letter to My Daughter On Her Future in a Mad Planet নামে ইংরিজিতে প্রকাশিত হয়। http://www.countercurrents.org/sengupta071111.htm) 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4853 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...