সবর্না চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

পাঁচটি কবিতা

 

আগুন

জ্যোৎস্না এসে পড়ে। সোনালি বালির গায়ে
ধূসর আঙুল বানিয়ে চলেছে অস্থায়ী খড়কুটো।
ঢেউ কি ভঙ্গুর তবে? বিশ্বাসঘাতক!
ট্রামের মৃদু ঘণ্টার সাথে আমার শীতের শহর যেন
দেওয়ালে টাঙানো এক ছবি।
থেকে থেকে ছুঁয়ে যাওয়া আর তার কারচুপি!

তারাদের দেখা হলে লাইট হাউজে প্রেম বাড়ে।
আলোর গোঙানি শুনি। যেন এক পূজারীর
কাছে সমর্পিত মন্ত্র। উন্মুক্ত পিঠের ওপর অবৈধ হাত… এতটাই কি অবুঝ তবে?

জলে ধুয়ে যাওয়া সীমারেখা যেন,
যেন শত জন্মের পর এই প্রথম তাকে দেখা,
নগ্ন উন্মুক্ত চোখে, ধারালো জিভের কিনারায়
বিষের ছোবল। কেঁপে ওঠা চাষজমি আর নাভিমূল,
অলক্ষ্যে চেপে রাখা দাগ,
জন্ম-জন্মান্তরে যাকে ভোলেনি শরীর,
ভোলেনি এ মন,
সে কোনও লিখিত বিবাহ নয়, সে ডুব অনন্ত আগুন। নজরে বাঁচানো লাল সুতো!

তবু বেড়ে রাখা ভাত। মাড় দেওয়া স্কুল ইউনিফর্ম।
কোথায় সে আমি?
মিথ্যে সাজানো ঘর। রোজকার অভ্যাস মাত্র। আসলে আগুন আগুন শুধু আগুন!

 

সমুদ্র

১.

যতবার ফিরে আসা যায়
মুঠো ভরা বালি… খামচে ধরি
জলের বিভ্রমে সঙ্কট বাড়ে
গোড়ালির চাপে বসে যায় চর…
শূন্য শঙ্খচিলের মতো আমাদের সঞ্চয়ে নেই আর
লাইট হাউজের নিভু নিভু আলো!
সঞ্চয়ে নেই বাস্তুসাপের খোলস
যা দেখে মনে পড়বে একদিন
এখানে আমরা ছিলাম!

২.

চামড়ার রং বদলে গেছে নোনা জলে
জিভে নুন নুন ভাব
ঝিনুকের খোলে কেটে গেছে পা
হাতে ভরা ভিজে বালি
তবু তো খোলা আকাশের নিচে দুটো নিঃস্ব হাত, চিৎকার করে বলে
‘বাঁচতে চাই’!

 

পাতা

বলেছিলে, ‘সুখী হতাম না দুজন একসাথে’
বলেছিলে, ‘আমি তো গৃহীজন নই’
সে স্বর রাতের শিশিরে ভেজা
দুর্বল ঘাসের শরীর
নেতিয়ে এসেছে কানে কানে।

চারাগাছে জল দিতে দিতে
বৃষ্টিতে কথা বলে গেছে।

যেন তার ধারাবিবরণী আমাকে করেছে অস্থির
চাঁদের আলোর মতো ধীর, একাকী স্টেশন কোনও
ছেড়ে গেছে দুরন্ত হাওয়া
কাঁপছে শরীর তখনও…

থরথর শীতল বাতাস, শিহরণে যেমন ঝরে পড়ে শুকনো হয়ে যাওয়া কোনও পাতা….

 

আমি আর মৃত্যু

এতক্ষণে রোদ এসেছে পায়ের কাছে
জানলায় যেন লক্ষ্মী পা…
উড়ন্ত পর্দার ফাঁকে দেখি একটা কাক
পাশের বাড়ির ছাতে, ঠিক একা একা,
পুরনো অ্যান্টেনার সাথে কত গভীর প্রেমে!

ড্রেসিং করতে এসেছে মেয়েটি।
আমি তাকে দেখিনি কখনও আগে। অথচ বিগত
একমাস এক অদৃশ্য নির্ভরশীলতায় আছি।
তার সাদা পোশাক, গায়ের গন্ধ
ক্রমশই ঈশ্বর করে তুলছে তাকে।

ব্যথা ওঠে ভীষণ। কুঁকড়ে যাই।
সমস্ত শরীর যেন এক প্ল্যাস্টিক ব্যাগ।
যেন এক সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে কেউ কুপিয়ে কুপিয়ে…

আর কতদিন, একমুঠো রোদ নিয়ে খেলতে খেলতে কাক আর অ্যান্টেনার গল্প লেখা?
আর হাসতে হাসতে বুঝে নেওয়া,

মৃত্যু,

ক্রমশ বন্ধুত্ব হচ্ছে আমাদের!

 

একলা থাকা কবিতারা

১.

অন্ধত্ব ভরছে বাষ্পে,
ফসফরাস জ্বলে ওঠে।
আচমকা ঢেউ

সব ভাসিয়ে নিয়ে গেলে?

২.

চার্জহীন জড়তায় কাটছে মুহূর্ত।
পারলে লিখে রাখা। হাতে পেন্সিল টর্চ।
ক্যালেন্ডার নেই।

তবুও স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমস্ত তারিখ।

৩.

আমাদের দেখা হয়নি দশ বছর হবে!
ফোনে কিছু আদানপ্রদান ছাড়া
আর ছোঁয়াছুঁয়ি নেই।
তবু অ্যাকোরিয়ামে রঙিন মাছ।
ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কেমন ভিজিয়ে দিয়ে যায়
দু’পশলা কুশল বিনিময়!

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4418 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...